চিত্রলেখার_কাব্য চল্লিশতম_পর্ব ~মিহি

0
548

#চিত্রলেখার_কাব্য
চল্লিশতম_পর্ব
~মিহি

“মনে পড়লে অকারণ, কাউকে বলা বারণ
রিমঝিমঝিম বরষায় তুই আজ ভেজার কারণ
মেঘেদের ডাকবাক্সে তোর চিঠি পৌঁছে দিলাম…” চিত্রলেখা বিভ্রান্ত চোখে চারিদিক তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে শব্দটা কোথা থেকে আসছে। রেকর্ডেড ভয়েস তবে তার মন জানান দিচ্ছে রঙ্গনের উপস্থিতি। উদভ্রান্তের মতো এলোমেলোভাবে সব ঘর খুঁজলো সে। এখনো গানটা বাজছে কোথাও একটা। রঙ্গনের স্বর যেন চিত্রলেখার মনকে আরো এলোমেলো করে তুলছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। ঘর ছেড়ে বারান্দায় দাঁড়ালো চিত্রলেখা। ঠিক তখনি চোখে পড়লো নিচে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার দিকে। এখন রাতের দশটা। অন্যান্য দিনের তুলনায় কুয়াশাও বেশি পড়েছে। সবে শীত আসি আসি ভাব হলেও ঠাণ্ডার প্রকোপ মারাত্মক এবার অথচ ছেলেটা কিনা শুধু একটা হুডি গায়ে জড়িয়ে সংসারত্যাগী সন্ন্যাসীর মতো তার ঘরের বারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। চিত্রলেখার প্রচণ্ড রাগ উঠলো। আশেপাশেও কোনোকিছু আর ভাবলো না সে। তৎক্ষণাৎ দৌড়ে নিচে নামলো।

চিত্রলেখার উদ্বেগ লুকিয়ে রাখতে পারলো না সে। রঙ্গনকে দেখামাত্র তার সমস্ত রাগ যেন জল হয়ে গেল। ইচ্ছে করলো রঙ্গনকে কষে একটা চড় দিতে। বেয়াদব ছেলেটা ফাজলামি শুরু করেছে। শরীর খারাপ হলে কে দেখবে?

-এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার কারণ কী?

-তোমার উপরের ফ্ল্যাটের মেয়েটার জন্য এসেছি। মেয়েটা খুব কিউট তো!

-ওহ আচ্ছা।

চিত্রলেখার শান্তস্বরে বলা ‘ওহ আচ্ছা’র ভয়াবহতা বুঝতে সময় লাগলো না রঙ্গনের। চিত্রলেখা ফিরে যাওয়ার জন্য পিছু ফিরেছিল, রঙ্গন পেছন থেকে তার হাতটা ধরলো বেশ শক্ত করেই।

-এ জীবন ফুরিয়ে যাবে তুমি চলে গেলে, ভবলীলা সাঙ্গ হবে তোমায় না পেলে।

-আজ বড্ড গান শোনাচ্ছেন যে গায়ক সাহেব। কাহিনী কী?

-কাহিনী হচ্ছে আমার রঙ্গনা আজ বড্ড উদাসী বিকেলের মতো নিষ্প্রভ হয়ে আছে। তার একটু রঙ্গনের প্রয়োজন।

-আচ্ছা?

-হুম অনেকগুলো আচ্ছা। আমি জানি তোমার পড়াশোনার অনেক চাপ এখন, আমি বেশি সময় নিব না। আমাকে শুধু পাঁচ মিনিট সময় দিতে আপত্তি আছে?

-আপত্তি করলে কি আপনি শুনবেন?

-না।

-তবে?

-আমি চাই তুমি আমাকে অনুমতি দাও তোমার মন ভালো করার।

-অনুমতি দেওয়া হলো।

রঙ্গন পকেট থেকে বেলিফুলের গাজরা বের করলো। চিত্রলেখার বেলিফুল পছন্দ কথাটা সে সাথীর থেকে জেনেছে। রঙ্গনের অবশ্য এ ফুল খুঁজতে অনেকটা সময় লেগেছে। সব জায়গায় লাল গোলাপ সহজলভ্য হলেও শুধু বেলির গাজরাটা খুঁজে পাওয়া ভারি দুঃসাধ্য হয়েছে তার জন্য। রঙ্গন ফুলটা নিয়ে নিজের ডানহাতের সাথে চিত্রলেখার বামহাতটা আলতো করে বাঁধলো।

-কী হলো এটা?

-ফুলেল বন্ধনে আবদ্ধ হলাম।

-তুমি আসলেই পাগল!

-উফ! কতদিন পর তুমি করে ডেকেছো। শেষ আমি, বুকে ব্যথা করছে।

-নাটকবাজ কোথাকার!

-তুমি নাটক হও প্রিয়, আমি নাটকবাজ হতে দ্বিধা করবো না।

-আপনাকে কে বললো আমার মন খারাপ?

-ভালো কথা মনে করিয়েছো। তোমার কেন মন খারাপ সেটাই শুনিনি এখনো। কী হয়েছে বলো তো।

-ওহ, ঐটা তেমন কিছু না।

-কেমন কিছু সেটাই জিজ্ঞাসা করছি।

-কোচিংয়ের একটা স্যারের পড়ানো ভালো লাগছে না আর কী! ঐটা নিয়েই একটু মন খারাপ।

-হে আল্লাহ, আমার মতো ব্যাকবেঞ্চারের কপালে তুমি এ কেমন আঁতেল রাখলা!

-এই আমি আঁতেল?

চিত্রলেখার ডানহাত দিয়ে সমানে রঙ্গনের ডানহাতে আঘাত করতে লাগলো। রঙ্গন হাসতে হাসতে চিত্রলেখার ডানহাতটাও বাহুবন্দি করে ফেললো।

ফাঁকা রাস্তায় হেডলাইটের অল্প আলোতে রঙ্গনের চোখে দুরন্তপনা দেখলো চিত্রলেখা। এ দুরন্তপনা যে কতদিন তাকে পড়তে বসতে দিবে না তাও উপলব্ধি করতে চাইছে না চিত্রলেখা। এ চাঞ্চল্য উপভোগের করতে ইচ্ছে করছে তার। রাস্তার অপর পাশে পেরিয়ে অল্প দূরত্বে একটা পার্কের লেকের ধারে বসলো দুজন। চিত্রলেখার এক হাত এখনো রঙ্গনের হাতে বন্দি।

-আমার যাওয়া উচিত। ভাবী চিন্তা করবে।

-আপা জানে তুমি এখানে এসেছো।

-ভাইয়া তো জানে না। ভাইয়া রাগারাগি করবে।

-অপেক্ষা জিনিসটা এতটা কষ্ট দেয় কেন বলো তো। আমি চাইলেও কেন তোমায় হুটহাট দেখতে পারবো না? খুব কাছে থেকেও কেন কাছে আসতে পারবো না? অন্তত এক প্রহর কেন কথা বলে কাটিয়ে দিতে পারবো না? আমি তোমার বিরহে পুড়ছি রঙ্গনা। তুমি জল হয়ে এসে শীতল করো এ দহন যন্ত্রণা।

-বিরহ কাব্য শিখিয়ে দিয়েছে?

-হুম। আচ্ছা পাঁচ মিনিট তো শেষ। চলো তোমাকে রেখে আসি।

রঙ্গন চটজলদি উঠে পড়লেও চিত্রলেখা আলতো করে রঙ্গনের টি-শার্টের কোণা আঁকড়ে ধরলো। চিত্রলেখার চোখজুড়ানো যেন বলছে,”না গেলে হয় না?” রঙ্গনের বুকে তৎক্ষণাৎ ঝড় বয়ে গেল। মেয়েটা আর কতভাবে ঘায়েল করবে তাকে?

-রঙ্গনা, তোমার চাহনি আমায় যেভাবে মাতাল করছে তাতে যদি আমি কোনো ভুল করে বসি তবে তুমি আগামী কতদিন যে পড়াশোনায় মন দিতে পারবে না তা আমিও জানি না।

-আপনি এতটা নির্লজ্জ কবে হলেন?

-তোমার প্রেমে পড়ার পর থেকেই।

রঙ্গন হাসতে লাগলো যেন সে বড়সড় কোনো ডিবেট জিতে গেছে। চিত্রলেখা মুগ্ধ হয়ে সে হাসির দিকে চেয়ে রইলো। এ হাসির স্নিগ্ধতা পরিমাপযোগ্য? মোটেও না! এ হাসি চিত্রলেখার কত রাতের ঘুম কাড়তে চলেছে তা সে নিজেও অনুধাবন করতে পারছে না।

________________________________

-ভাইয়া এখনো আসেনি ভাবী?

-নাহ। রঙ্গন ভেতরে এলো না?

-তুমি ডেকেছিলে ওকে?

-না, ঐ আসতে চেয়েছিল।

-কেন?

-তার রঙ্গনার মন খারাপ ছিল তাই।

চিত্রলেখা আর কিছু বলার উপায় পেল না। রঙ্গনের বাচ্চামির কারণে এখন ভাবীও তার দিকে অদ্ভুত রকমের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। চিত্রলেখা মাঝেমধ্যে ভুলে যায় আসলে ছোট কে। সে নাকি রঙ্গন!

ঘরে ঢুকতেই চিত্রলেখার ফোনটা বেজে উঠলো। তৌহিদের কল দেখে খানিকটা ব্যতিব্যস্ত হয়েই রিসিভ করলো চিত্রলেখা।

-তৌহিদ ভাইয়া, কোনো প্রমাণ পেয়েছেন?

-প্রমাণ আছে লেখা তবে জোরদার নয়। আমাদের আরো সময় নিতে হবে। অপর্ণা ভাবীর উপর হামলা লোক্যালদের দিয়ে করানো, ওদের ধরলেও নওশাদের কিছু করা যাবে না।

-ভাবীর উপর হামলা হয়েছে?

-হ্যাঁ, অনেক লম্বা কাহিনী। তবে আমার মনে হয় রঙ্গনকে জানানো উচিত। সে বোধহয় আমাদের সহায়তা করতে পারবে।

-না ভাইয়া। রঙ্গন কোনো ঝুঁকির মধ্যে থাকুক আমি চাইনা। তাছাড়া রঙ্গন এসব থেকে যতটা আড়ালে থাকবে ততটাই ভালো। সময় বেশি লাগুক, সমস্যা নেই।

-আচ্ছা আমি আমার কাজ চালিয়ে যাচ্ছি পুরোদমে। আশা করি কোনো না কোনো প্রমাণ তো হাতে আসবেই। এখন রাখছি আমি।

-আচ্ছা ভাইয়া।

চিত্রলেখা কল কেটে দিয়ে চুপচাপ বিছানায় বসে রইলো। রঙ্গনকে এসব জানানোর ভুলও করা যাবে না। চিত্রলেখার সব ভয় এখন রঙ্গনকে ঘিরে। রঙ্গন যদি এসবে জড়িয়ে ভুলেও কখনো জানে সে আশফিনা আহমেদের আসল সন্তান নয় তখন চিত্রলেখা নিজেকে কিম ক্ষমা করবে? আশফিনা আহমেদ এত বছর ধরে যে সত্য রঙ্গনের থেকে আড়াল করেছেন, সে সত্য আড়ালে থাকাই ভালো। চিত্রলেখা নওশাদকে যতদূর চেনে, তাতে নওশাদ নিজের বেলায় রঙ্গনকেও পরোয়া করবে না এটাই স্বাভাবিক। চরম মাত্রার নিকৃষ্ট একটা লোক সে।

হোয়াটসঅ্যাপের মেসেজ টোনে ঘোর কাটলো চিত্রলেখার। আহাদের ক্রমাগত টেক্সট এবার তাকে বিরক্ত করছে। সমস্যা কি এই লোকটার? চিত্রলেখা যে বিরক্ত এটা বুঝতে তার এতক্ষণ সময় লাগছে? মানুষটার সাধারণ জ্ঞান নাই নাকি কাজে লাগাতে পারছে না? চিত্রলেখা এবার আর কিছু ভাবলো না। তৎক্ষণাৎ নম্বরটা ব্লক করে দিল। মানুষকে কোনোকিছুর সুযোগ দেওয়াই উচিত না বরং সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার আগেই প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি করে ফেলা উচিত তাকে। একটু ষুযোগ পেলে মানুষ যে মাথায় চড়ে বসে এর প্রমাণ তো চিত্রলেখা আগেও পেয়েছে। এখন আগের সেই চিত্রলেখাটা তার মাঝে আর নেই। আগ্নেয়গিরির সুপ্ত সময় এখন শেষ, এখন কেবল প্রচণ্ড লাভা প্রতিমুহূর্তে প্রস্তুত হচ্ছে তার মাঝে। কখন কোন সময় এ লাভা কোন ব্যক্তির উপর বিস্ফোরিত হবে তার ধারণা চিত্রলেখার নিজেরও নেই।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here