চিত্রলেখার_কাব্য ছত্রিশতম_পর্ব ~মিহি

0
513

#চিত্রলেখার_কাব্য
ছত্রিশতম_পর্ব
~মিহি

আশফিনা আহমেদ বিরক্ত বোধ করছেন তা তার মুখভঙ্গি বলে দিচ্ছে। চিত্রলেখার কথায় তিনি এখানে আসার পাত্রী মোটেও নন তবে রঙ্গনের খাতিরে তাকে আসতে হয়েছে।

-চিত্রলেখা, যা বলার বলো। এভাবে ঘটা করে সবাইকে এক জায়গায় এনে বসিয়ে রেখেছো কেন?

-হিসাব মিলাচ্ছিলাম আন্টি। যাই হোক, কিছু কথা বলার ছিল আপনাদের উদ্দেশ্যে। আপনার সাথেই প্রথমে আলাপ সেরে নেই তবে।

চিত্রলেখার কণ্ঠস্বরে খানিকটা বিব্রতবোধ করলেন আশফিনা আহমেদ। অদ্ভুত এক তেজী স্বর! এটা কি চিত্রলেখার কণ্ঠস্বর? নাকি অন্য কেউ ভর করেছে তার মাঝে?

অপর্ণা এবার বেশ খানিকটা রেগে গেল। অর্ণব না থাকলে সে নির্ঘাত কষে একটা থাপ্পড় লাগাতো চিত্রলেখার গালে। আশফিনা আহমেদ আশেপাশের পরিস্থিতি বিবেচনায় বিচক্ষণতা ধরে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

-কী বলতে চাও সাফ সাফ বলো।

-আপনার ছেলেকে আমি ভালোবাসি এ কথা আপনি জানেন আন্টি। আমায় আপনি পছন্দ করেন না সেটাও আমি জানি। আপনার ইচ্ছেটা আংশিক পূরণ হবে কারণ আগামী তিন বছরের জন্য আমি আপনার ছেলের থেকে একেবারে দূরে সরে যাচ্ছি। তিন বছর পর আমার সাথে সাক্ষাৎ করে যদি আপনার আপত্তি থাকে তবে আমি রঙ্গনকে বিয়ে করবো না।

-এটা কি তুমি ভেবে বলছো?

-জ্বী। আপনি রাজি?

-হ্যাঁ!

-বেশ তাহলে আপনার সাথে আমার কথা শেষ। আপনি এখন এই জঞ্জাল থেকে মুক্ত হয়ে ফিরতে পারেন।

আশফিনা আহমেদ চিত্রলেখার স্ট্রেটফরোয়ার্ড কথায় অনেকটাই ঘাবড়ে গেছেন। মেয়েটা যে এতটা কাট কাট কথা বলবে তা তিনি ভেবে আসেননি।

“এসো রঙ্গন” আশফিনা আহমেদ রঙ্গনকে তার সাথে যেতে বললেন। রঙ্গন তখনো চিত্রলেখার দিকে তাকিয়ে আছে। তার নিজেকে পুতুল মনে হচ্ছে এখন।

-রঙ্গনের সাথে আমার কথা হয়নি আন্টি, ও একটু পরে আসুক? শেষদিন তো!

-বেশ।

আশফিনা আহমেদ কথা বাড়াতে চাইলেন না। এ বাড়ির পরিস্থিতি তার দম বন্ধ লাগছে। রঙ্গনকেও নিয়ে আসতেন তবে চিত্রলেখার কথায় অদ্ভুত একটা মায়া অনুভব করে আর বাড়তি কথা বললেন না। রঙ্গন মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলো। সাথী সবকিছু দেখছে কেবল। সে বোঝার চেষ্টা করছে রঙ্গনকে সব জানিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তটা কতটুকু সঠিক ছিল। চিত্রলেখা এবার অপর্ণার মুখোমুখি দাঁড়ালো।

-ভাবী, যে লোকটার বিয়ের প্রস্তাব আপনি এনেছেন তাকে আপনি কিভাবে চেনেন?

-না চেনার কী আছে? উনি তো সাথীর চাচা হন। সেই সূত্রে…

-তাহলে ভাবীর চাচা মানে আমারও চাচা? তার সম্বন্ধ আপনি কেন আনলেন?

-আজব তো, উনি তোকে পছন্দ করে তাই..

-উনি আমাকে পছন্দ করে এ কথা আপনি জানলেন কী করে?

-কোর্টে যখন দেখা হয়েছিল তখন বলেছিলেন।

-কোর্টে যখন সবাই ছোট ভাইয়াকে নিয়ে চিন্তিত ছিল তখন আপনি ওনার সাথে কথা বলেছেন? তাও আবার এ বিষয়ে? এতক্ষণ সময় ধরে তো কথা বলতে দেখিনি আপনাকে।

-তুই বলতে কী চাইছিস? আমি পরে ওনার সাথে কথা বলেছি। তখন উনি প্রস্তাব দিয়েছেন।

-এটা আপনি ভাইয়াকে জানিয়েছিলেন?

-ওকে জানাতে হবে কেন?

-সেটাই তো। ভালো কথা বলেছেন। আমিই কথা বলছি ভাইয়ার সাথে।

চিত্রলেখা অপর্ণার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অর্ণবের দিকে তাকালো। অর্ণব প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে অপর্ণার দিকে তাকিয়ে আছে। অপর্ণা আসলে চাইছে টা কী?

-ভাইয়া, আমি ভাবতাম তুমি আমাকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করো। পরিস্থিতি যেমনই হোক তুমি আমার পাশে থাকবে। হোস্টেলের ঘটনার সত্যতা একবারো আমার কাছে তুমি জানতে চাওনি। সে রাতে আদৌ আমার কাছে কেউ এসেছিল নাকি ঘটনা অন্যকিছু একবারো জানতে চেয়েছো? তোমার দোষ আমি দিচ্ছি না। সে রাতে আমার রুমমেটের বন্ধু এসেছিল এবং খুব সুনিপুণভাবে আমাকে ফাঁসানো হয়েছে যার প্রমাণ আমার কাছে নেই। এখন সবটা তোমাদের বিশ্বাসের উপর। রঙ্গন, আপনারও মনে হয় আমি কোনো ছেলেকে এনেছিলাম রুমে?

-আমি তোমাকে বিশ্বাস করি চিত্রলেখা তবে ভাইয়া শুধুমাত্র পরিস্থিতির কারণে…

-ব্যাখ্যা চাইনি রঙ্গন। আমার ব্যাখ্যা কেউ জানতে চায়নি একবারও, আমিও চাইনা। ভাইয়া, আমি কেন হোস্টেলে গিয়েছি জানো? তোমার বউয়ের মা আমাকে কল করে যা নয় তা বলেছে। আমি লজ্জায় এ বাড়িতে আর থাকতে পারিনি। এ কথা আমি বলতাম না কিন্তু আমার ধৈর্য শেষ। আমার সহ্যক্ষমতাও অবশিষ্ট নাই আর।

-মানে? এসব আগে বলিসনি কেন তুই?

-আগে বললে কী করতে? বিশ্বাস তো হারিয়েই ফেলেছি! ঐ নোংরা লোকটা আমায় রেপ করার চেষ্টা করেছিল এটা বিশ্বাস করেছো? করোনি! রঙ্গন বিশ্বাস করেছে ভাইয়া। আমার এক কথায় সে বিশ্বাস করে নিজের মামাকে আঘাত করেছে। ওর মাঝে আমি তোমার প্রতিচ্ছবি দেখি যে আমাকে আগলে রাখতে জানে। আমার ভালোবাসা কী ভুল ভাইয়া?

-লেখা, তুই ভুল বুঝিস না আমাকে। আমি পরিস্থিতি অনুযায়ী যা সঠিক মনে হয়েছে তাই ভেবেছি। আমি এখনো তোকে বিশ্বাস করি বলেই তোর সাথে হোস্টেলের ঘটনা নিয়ে কোনো কথা বলিনি।

-তোমার বউ বাকি কাজ করে দিয়েছে, তাইনা ভাবী? এলকায় খবর ছড়াতে বেশি সময় লাগেনি তো? কষ্ট হয়েছে ভাবী? তুমিও তো একটা মেয়ে! আমার ভাবী হও তুমি? একটুও খারাপ লাগলো না?

অপর্ণা এতক্ষণ চুপ থাকলেও এবার সাপের ন্যায় ফোঁস করে উঠলো। নিজের উপর আনীত অভিযোগ কাঁটার ন্যায় চুবছে তার শরীরে।

-একদম উল্টোপাল্টা কথা বলবি না! নিজে কুকর্ম করে আমার ঘাড়ে দোষ চাপানো? লজ্জা করেনা?

-ভাইয়া, ভাবী যে একটা নতুন নেকলেস কিনেছে তা কি তোমায় দেখিয়েছে? দাঁড়াও আমি দেখাই।

চিত্রলেখা রূপসাকে ডাকলো। রূপসা ভেতরের ঘরে খেলছিল। চিত্রলেখার ডাকে দৌড়ে বাইরে আসলো।

-রূপ, আমাকে যে সুন্দর মালাটা দেখিয়েছিলে না ঐটা আনো তো পাখি।

-ঐ তো সুন্দরটা?

-হ্যাঁ।

-দাঁড়াও।

রূপসা দৌড়ে অপর্ণার ব্যাগ থেকে নেকলেসটা বের করে এনে চিত্রলেখার হাতে দিয়ে দৌড় দিল। অপর্ণার মুখ চুপসে যেতে সময় লাগলো না। অর্ণবের চোখ লাল হয়ে এসেছে। এসব যদি সত্যি হয় তবে আজ অপর্ণার সাথে সে কী করবে নিজেও আন্দাজ করতে পারছে না।

-অপর্ণা, এটা তুমি কিনেছো?

-না, মা…মা দিয়েছে আমাকে। বাড়িতে গিয়েছিলাম না তখন মা…

-মিথ্যে বললে তোমাকে এই মুহুর্তে তালাক দিব আমি। কল দিব তোমার বাড়িতে? তোমার মাকে না, তোমার বাবাকে কল করবো। তিনিই বলবেন সত্যিটা!

-না…এ…এটা ন…নওশাদ চাচা দি..দিয়ে…

অপর্ণার কথা শেষ হওয়ার আগেই তার গালে থাপ্পড় পড়লো অর্ণবের। একটা থাপ্পড়ে অর্ণবের রাগ ক্ষান্ত না হলেও সে নিজেকে স্থির করলো। আরো অনেক প্রশ্নের উত্তর জানা বাকি এখনো।

চিত্রলেখার এই প্রথম কাউকে কষ্ট পেতে দেখে আনন্দ হচ্ছে। অপর্ণা নামক মানুষটার প্রতি সে এতদিন ছোটখাটো ক্রোধগুলো জমিয়ে রাখতো যা আজ আগ্নেয়গিরিতে রূপ নিয়েছে। অপর্ণা আসলে ভুলে গিয়েছিল আগ্নেয়গিরি সুপ্ত থাকে ঠিকই তবে চিরকাল নয়। অর্ণব অপর্ণার দিকে পুনরায় হাত তোলার আগেই থামালো চিত্রলেখা।

-দাঁড়াও ভাইয়া, কথা তো শেষ হতে দাও। তারপর তোমার বউকে যা ইচ্ছে কোরো। আমার বলার তেমন কিছু নেই। আগামী তিন বছর সময় দরকার আমার। তোমার কাছে দুইটা রাস্তা খোলা। প্রথমত আমার মায়ের সমস্ত গয়না এবং আমার নামে লিখে দেওয়া মায়ের জমি আমাকে দেওয়া অথবা তিন বছরে আমার পড়াশোনার যাবতীয় খরচ দেওয়া। আমি জানি তুমি এমনিতেও আমার পড়াশোনার খরচ দিতে অস্বীকার করতে না কিন্তু তোমার বউয়ের সমস্যা থাকতেই পারে আর কী!

-লেখা, তুই শান্ত হ। তারপর আমরা এসব বিষয় নিয়ে কথা বলবো।

-আমার শান্ত থাকার সময় আমি পার করে এসেছি ভাইয়া। তুমি কোনটা চাও বলো। আমার জমিজমা ফেরত দিতে নাকি পড়াশোনার খরচ?

-খরচ আমি দিব এবং জমিও তোর থাকবে। তুই নিজেকে শান্ত…

অর্ণবের কথা শেষ হওয়ার অপেক্ষা করলো না চিত্রলেখা। রঙ্গন এতক্ষণ নোনা চোখে সবটা দেখছিল। চিত্রলেখা তার মুখোমুখি দাঁড়াতেই সে খানিকটা ভীত হলো। অন্য সকলের মতো তার জন্যও কি অভিযোগ বাক্স ভরেছে চিত্রলেখা?

“আমার জন্য অপেক্ষা করবেন রঙ্গন? আগামী তিনটা বছর? আমার স্বপ্ন পূরণের জন্য আমি আপনাকে অপেক্ষা করাচ্ছি। আমার উপর ভরসা থাকবে তো আপনার? তিন বছর পর আপনার সামনে দাঁড়ালেও আপনার রঙ্গনা হয়েই থাকবো তো?” চিত্রলেখার আকুতি যেন রঙ্গনের বুকে এসে ধাক্কা দিল। রঙ্গনের ইচ্ছে করলো চিত্রলেখাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলতে,”আমি জনমভর অপেক্ষা করবো, তুমি শুধু আমারই থেকো।”

চলবে…

[গল্প আসতে লেট হবে জানানোর কথা একদম মনে নাই। স্যরিইইইই!]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here