চিত্রলেখার_কাব্য ছেচল্লিশ_পর্ব ~মিহি

0
493

#চিত্রলেখার_কাব্য
ছেচল্লিশ_পর্ব
~মিহি

“স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ! লেখা তুই খুশি না?” সাথীর প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনা চিত্রলেখা। সে অনেক বেশি খুশি কিন্তু কোথাও একটা সংকোচ-দ্বিধা তাকে আটকে ফেলেছে ভেতরে ভেতরে। ঢাকা মেডিকেলের জন্য চিত্রলেখার গভীরতম স্বপ্ন হয়তো ছিল না কিন্তু রঙ্গনের ইচ্ছে ছিল। রঙ্গন কি মন খারাপ করবে? চিত্রলেখা চাইলেও খুশি হতে পারে না। সাথী ইতোমধ্যে অনিককে মিষ্টি আনতে পাঠিয়ে দিয়েছে। এদিকে চিত্রলেখার মুখে হাসির রেশমাত্র নেই। রঙ্গনকে কল করার সাহসটুকুও যেন পাচ্ছে না সে। চিত্রলেখার উদাসীনতা অনুভব করতে পারলো সাথী।

-লেখা? কী হয়েছে তোর? এত ভালো রেজাল্টের পরও তোর মন খারাপ কেন?

-জানিনা ভাবী। মনে হচ্ছে কিছু একটা কমতি রয়ে গেছে।

-রঙ্গনের সাথে কথা বলেছিস?

-না ভাবী। ও চেয়েছিল আমি যেন ঢাকা মেডিকেলে চান্স পাই। ওর ইচ্ছেটা অপূর্ণ থেকে গেল ভাবী।

-পাগল মেয়ে, আগে কথা বলে তো দেখো।

সাথী মুচকি হেসে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। এই দুইজনের প্রেম তাকে নিজের অতীতের কথা মনে করিয়ে দেয়। অনিকের সাথে প্রেমের স্মৃতিগুলি এখনো অম্লান তবুও সংসারের চাপে কোথাও একটা হারিয়ে গেছে সেই পুরনো টান। প্রেমিকের ভালোবাসার সংজ্ঞা আর স্বামীর ভালোবাসার সংজ্ঞা বরাবরই আলাদা। প্রেমিকের বেলায় শুধু প্রেমটাই থাকে, স্বামীর বেলায় থাকে দায়িত্ব। সমুদ্রের নীরব ঢেউ যেমন আচমকা তীরে আছড়ে পরে, তেমন করে সাথীর মনের রদবদলটা ক্ষণিকের মাঝেই ঘটে। অনিকের সেই প্রেমিক রূপটা আজ বড্ড অনুভব করছে সে।

রঙ্গন দাঁত দিয়ে নখ কামড়াচ্ছে। চিত্রলেখা এখনো কল করলো না কেন এই ভেবে সে অস্থির। রেজাল্ট কী এমন এসেছে! রঙ্গনের চিন্তা কোনভাবেই কমছে না। সামনে থেকে কল করারও সাহস পাচ্ছে না। ইদানিং চিত্রলেখাকে নিয়ে বড্ড ভয় পায় রঙ্গন। মেয়েটার মনের অবস্থা শতভাগ বোঝার চেষ্টা করে সে। রঙ্গনের বেশিক্ষণ চিন্তা করতে হলো না। চিত্রলেখার কল আসলো। রঙ্গন যেন এই মুহুর্তের অপেক্ষাতেই ছিল। তৎক্ষণাৎ কল রিসিভ করলো সে।

-হ্যালো!

-কী হয়েছে? তোমার কণ্ঠ এরকম কেন? ঠিক আছো তুমি?

-ঢাকা মেডিকেলে আসেনি, স্যার সলিমুল্লাহ’তে এসেছে।

-আলহামদুলিল্লাহ। এত খুশির খবর কেউ এভাবে বলে? এই মেয়ে তুমি পাগল? আমি..আমি কী করবো বুঝতেছি না। এই তুমি বাইরে অনেক করো, আমি দশ মিনিটের মধ্যে আসছি।

-কিন্তু আমার তো ঢাকা মেডিকেলে হয়নি রঙ্গন!

-ঢাকা মেডিকেলের এপ্রোনের রঙ আলাদা? তুমি চেষ্টা করেছো রঙ্গনা, শত চেষ্টার পরও অনেকেই হেরে যায়। তুমি তো তবুও নিজের স্বপ্ন পূরণের সুযোগ পেয়েছো। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করো। আমি তোমার বাসার সামনে গিয়ে কল করছি।

-আচ্ছা।

চিত্রলেখার মন খারাপ ভাব খানিকটা কমে আসলো। সে ভেবেছিল রঙ্গন বোধহয় মন খারাপ করবে কিন্তু ছেলেটা যেভাবে বোঝালো তাতে চিত্রলেখার মন খারাপ টেকার কথাই ছিল না। চিত্রলেখা চটজলদি অর্ণবের নম্বরে কল করলো। রঙ্গনকে কল করার আগেও দুইবাদ সে অর্ণবের নম্বর ডায়াল করেছে। নম্বর বন্ধ বলছে। বাড়িতে ফোন বলতে ঐ এক অর্ণবেরটাই। চিত্রলেখা নিজের ভাইকে খুশির খবর জানাতে উৎসুক অথচ সে কলই রিসিভ করছে না! খানিকটা রাগ হয় তার। তার বড় ভাই তার রেজাল্টের কথা যেন ভুলেই গেছে! চিত্রলেখা ঠিক করলো সেও আর কল করবে না, ভাইয়ের উপর সেও রাগ করবে এবার! কথাটা ভেবে ফোন সাইলেন্ট করে বিছানার পাশে রেখে দিল সে। এখনো সবকিছু স্বপ্নের মতো লাগছে তার। সত্যিই কি সাদা এপ্রোনের যোগ্য হয়ে উঠতে পেরেছে সে? পরীক্ষার একটা ঘণ্টা চিত্রলেখার চোখের সামনে ভেসে উঠে। সর্বপ্রথম ইংরেজী আর জিকে অংশটুকু শেষ করেছিল সে। এদিকে বাঁচানো সময়টুকু ফিজিক্সে কাজে লাগিয়েছে বলেই কোনরকম তাড়াহুড়ো হয়নি। শিওর না হয়ে কোনো প্রশ্নের উত্তর সে করেনি তবুও পরীক্ষার হল ছেড়ে বেরোতেই কতরকম আজগুবি চিন্তা যে দানা বাঁধে মাথায়! একবার মনে হয় খাতায় রোল ঠিকমতো পূরণ করিনি, আবার কখনো মনে হয় প্রশ্নের সিরিয়াল অনুযায়ীই উত্তর করেছি তো? এ ভয়টা চিত্রলেখা রেজাল্টের আগ অবধি আটষট্টি ঘণ্টা দিব্যি উপলব্ধি করেছে। খেতে, বসতে, উঠতে সব জায়গায় সে কেবল আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে গেছে যেন সবকিছু ঠিকঠাক থাকে। আল্লাহও তার দোয়া কবুল করেছেন। মেয়েটার অসংখ্য স্বপ্নভঙ্গের পর অবশেষে স্বপ্ন পূরণের দরজাগুলো খুলতে শুরু করেছে।

___________________________________

অপর্ণার অবস্থা প্রচণ্ড খারাপ। একে তো শারীরিক অসুস্থতা, পাশপাশি মানসিকভাবে একেবারে ভেঙে পড়েছে সে। ডাক্তারদের মতে মেয়েটার বাঁচার কোনো ইচ্ছে অবশিষ্ট নেই যার কারণে সে কোনভাবেই নিজেকে সুস্থ হতে দিতে চাচ্ছে না। অর্ণব কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। একদিকে তার দুই বাচ্চা, তাদের তো কোনো দোষ নেই! অপর্ণার দিকে তাকিয়ে আজ কেবলই করুণা হচ্ছে অর্ণবের। পাপের শাস্তি কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা স্বীয় চোখে প্রত্যক্ষ করলো সে। অপর্ণা যদি সময় থাকতে একবার বুঝতো! রূপসা কান্না করতে করতে অর্ণবের কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে। অর্ণব উঠতেও পারছে না। ফোনটা পকেটে আছে, সেটা বের করারও সুযোগ হচ্ছে না। কিছু সময় বাদে অপর্ণার মা এসে বাচ্চা দুটোকে খাওয়াতে নিয়ে গেলেন। রূপসা রাদিফকে কোনভাবেই বাড়িমুখো করা যাচ্ছে না। তাই অর্ণবও হাসপাতালেই রয়ে গেছে। তার বাচ্চাদের এখন তাকে প্রয়োজন। প্রয়োজন অপর্ণারও ছিল তাকে তবে এখন অনুভূতিগুলো কেবল রূপসা রাদিফের মা হিসেবে আসবে, স্ত্রী হিসেবে যে মায়া তা আর কখনো জন্মাবে না অর্ণবের মনে।

________

তৌহিদ খানিকটা ভীত সন্ত্রস্ত অনুভব করছে। প্রথমত আশফিনা আহমেদের বাড়ির আয়তনটাই তাকে অবাক করেছে। দ্বিতীয়ত নওশাদের সাথে আশফিনা আহমেদের সম্পর্কে তাকে একদম সাত তলা থেকে যেন নিচে ফেলেছে। তৌহিদের এখন নিজেরই জানের মায়া হচ্ছে। আশফিনা আহমেদ আবার ভাইকে বাঁচাতে তাকে মেরে টেরে ফেলবে না তো? সোফায় বসে জিকির করতে লাগলো তৌহিদ।

আশফিনা আহমেদ সময়ের পাকা হলেও গুণে গুণে সাড়ে চার মিনিট লেইট করলেন তিনি। তৌহিদের মুখোমুখি বসতেই অনুভব করলেন ছেলেটা ভীত হয়ে আছে। স্বাভাবিকভাবেই কথা বলার চেষ্টা করলেন আশফিনা আহমেদ।

-তুমি তৌহিদ?

-জ্বী ম্যাম।

-তো উকিলগিরি ছেড়ে গোয়েন্দাগিরিতে কেন?

-প্যাশন ম্যাম!

-আচ্ছা ভালো। নওশাদের বিরুদ্ধে কী কী প্রমাণ তোমার কাছে আছে?

-প্রমাণ বেশ অনেকগুলোই আছে। কিছু প্রমাণ শুরুর সময়ের যেগুলো শক্তপোক্ত না তবে এখন যেগুলো প্রমাণ পেয়েছি তাতে কাজ হয়ে যাবে মনে হচ্ছে। কমসে কম বছর দশেকের শাস্তি তো কনফার্ম।

-প্রমাণটা কী? কথা না ঘুরিয়ে সরাসরি প্রমাণগুলোর কথা বলো।

তৌহিদ এবার সিরিয়াস হলো। স্পাইডারম্যান কালারের ব্যাগটা থেকে বেশ কিছু পেন ড্রাইভ এবং ফাইল বের করলো সে। চোখেমুখে আত্মবিশ্বাসের উজ্জ্বল রেখা। আশফিনা আহমেদ স্পষ্ট লক্ষ করলেন এ ছেলের সবকিছু নিয়েই আত্মবিশ্বাস অধিক। চোখের চাহনিই বলে দিচ্ছে বিষয়টা।

তৌহিদ একে একে বোঝালো কোন ফাইল, কোন পেন ড্রাইভে কী আছৈ। কয়েকটাতে নওশাদের রাজনৈতিক কারচুপির প্রমাণ আছে তো কিছু পেন ড্রাইভে তার নোংরা চরিত্রের। নিষিদ্ধ পল্লী থেকে শুরু করে গ্রামের সহজ সরল মেয়েরাও তার অত্যাচার থেকে রেহাই পায়নি। এসব প্রমাণ তৌহিদের জোগাড় করতে কী পরিমাণ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তা কেবল সে-ই জানে। বিশেষ করে কোনো মেয়ের সাথে ঘটে যাওয়া অত্যাচার সম্পর্কে জানতে চাইতেও তৌহিদের লজ্জায় মাথা নিচু হয়েছে। তবে নওশাদ সম্পর্কে যত জেনেছে তত আগ্রহ বেড়েছে তৌহিদের। একটা লোক এত কুকর্ম করেও কী ক্লিন ইমেজ নিয়ে চলে! ভাবতেও অবাক লাগে তার।

“এখন বাড়িতে কাজের লোকরা ঘুমিয়ে, কোনো জাগ্রত মানব নেই ভেতরে। তোমায় যদি খুন করে বস্তায় ভরে বাইরে ফেলে দিয়ে আসি এ প্রমাণগুলোর কী হবে ভেবে দেখেছো?” তৌহিদ যেন অনুভব করলো আশফিনা আহমেদের কণ্ঠস্বরের এক আকস্মিক পরিবর্তন!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here