#চিত্রলেখার_কাব্য
ত্রয়োবিংশ_পর্ব
~মিহি
অপর্ণা বেশ অনেকক্ষণ ভেবেচিন্তে নওশাদকে কল করলো। নওশাদ তৎক্ষণাৎ কল রিসিভ করলো না। একটু বাদে নওশাদ নিজেই কল ব্যাক করলো অপর্ণাকে।
-অপর্ণা?
-জ্বী। তোমার সাথে আমার দরকারি কথা আছে। তুমি আমার অফিসে এসে দেখা করতে পারবে?
-আজকেই?
-তোমার সুবিধামতো সময়ে আসলেই হবে। আজকে তো তোমার দেবর জেল থেকে ফিরেছে, আজ থাক। তুমি দিন দুয়েকের মাঝে দেখা করো।
-আচ্ছা কিন্তু কী বিষয়ে কথা বলতে চান?
-অবশ্যই তোমার লাভের বিষয়ে। এখন রাখো, আমি একটু ব্যস্ত আছি।
-আচ্ছা।
অপর্ণা ফোন রেখে গম্ভীর ভঙ্গিতে কিছু একটা ভাবার চেষ্টা করলো। এর মধ্যেই অর্ণব এসে বসলো পাশে।
-রূপসা আর রাদিফকে নিয়ে আসবো কবে? এখন তো বাড়িতে সব ঠিক আছে।
-কী ঠিক আছে? আশেপাশের মানুষ এখনো কেমন করে তাকাবে! আমার বাচ্চারা ভয় পাবে।
-আমার কথার বিপরীতে যাওয়ার চেষ্টা সবসময় করবে না অপর্ণা। যেটা বলেছি ঐটা করবে।
-তুমি আমাকে ধমকানোর সাহস কী করে পেলে? আমি আজকেই চলে যাবো বাড়ি ছেড়ে।
-দ্বিতীয়বার এই কথা বললে আমি নিজেই সসম্মানে তালাক দিয়ে রেখে আসবো। তোমার রাগটা লেখার উপর ঝেরেছি বলে ভেবো না তোমাকে কিছু বলবো না। তোমাকে যখন আনতে পেরেছি ঠিক সেভাবেই ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আসবো।
অপর্ণা চুপ হয়ে গেল। অর্ণবের অগ্নিচক্ষু তাকে এক মুহূর্তে নীরব করে দিল। বলার মতো কিছু খুঁজে পেল না সে। অর্ণব তৎক্ষণাৎ রুম থেকে বেরিয়ে গেল। অপর্ণার বাঁকা কথাগুলো অর্ণব আর কোনোভাবেই নিতে পারছে না। সহ্যসীমা তার অবশিষ্ট নেই আর। অপর্ণাও বুঝতে পেরেছে অর্ণব মারাত্মক রেগে আছে তবুও তার জেদ কমলো না। সে ভাবলো এ রাগের কারণ চিত্রলেখা! রাগটা আবারো চিত্রলেখার উপর গিয়েই পড়লো।
____________
চিত্রলেখাকে রান্নাঘরে দেখে ভ্রু কুঁচকালো সাথী। মেয়েটার উপর কাজ চাপিয়ে অপর্ণা আবারো পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে নির্ঘাত!
-তুই কেন কাজ করছিস এখন? উনি কাজ চাপিয়ে পালিয়েছে?
-বাদ দাও তো ভাবী।
-আর কত বাদ দিবি তুই? তোর মধ্যে একটুও রাগ জেদ জাগে না?
-আল্লাহর উপর ছেড়ে দিছি ভাবী, বিচারের মালিক তো তিনিই। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।
-ধৈর্য রাখা ভালো তবে অন্যায় মুখ বুঁজে মেনে নেওয়া নয়। দিনরাত ও তোকে অপমান করে, তোর কি একটুও প্রতিবাদ করতে ইচ্ছে করেনা?
-করেছিলাম তো ভাবী, দেখলে তো ভাইয়া কেমন ব্যবহার করলো। এখন প্রতিবাদ কথায় করবো না, কাজেই প্রতিবাদ করবো।
-মানে?
-বুঝতে পারবে ভাবী, ধৈর্য রাখো।
চিত্রলেখার ঠোঁটের কোণে হাসি লক্ষ করলো সাথী কিন্তু বুঝে উঠতে পারলো না সে কী করতে চাইছে। চিত্রলেখা রান্না শেষ করলো। পেঁয়াজু ভেজেছে সে। অপর্ণার ঘরে পেঁয়াজুর বাটি রাখতে গেল সে। অপর্ণা তখনো রেগে ছিল। চিত্রলেখাকে দেখে সে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো তবে অকস্মাৎ প্রতিক্রিয়া দেখালো না। চিত্রলেখা বাটি রেখে চলে গেল। অপর্ণা কেবল রক্তচক্ষু মেলে সেদিকে তাকিয়ে থাকলো। চিত্রলেখাকে এত সহজে সে ছাড়বে না তা স্পষ্ট বয়ান হলো তার চাহনি দ্বারা।
_______________
চিত্রলেখা ঘরে এসে বইখাতা গোছাতে শুরু করলো। হোস্টেলে যাওয়ার সময় সন্নিকটে তার। এতদিন অনিকের আসার অপেক্ষায় ছিল। এখন সব যখন ঠিকই হয়েছে, তখন আবার হোস্টেলে ফিরতে পারে সে। ওখানে চাইলেও অপর্ণা তাকে বিরক্ত করতে পারবে না। চিত্রলেখাকে ব্যাগ গোছাতে দেখে অনিক ঢুকলো তার রুমে। অনিককে দেখে খানিকটা বিস্মিত হলো সে। অনিক সচরাচর যেচে তার সাথে কথা বলতে আসে না অথচ আজ এসেছে! কৃতজ্ঞতাবোধ নাকি দায়িত্ববোধের জন্ম?
-কোথায় যাচ্ছিস তুই?
-হোস্টেলে ভাইয়া। অনেক গ্যাপ পড়ে গেছে, এখন হোস্টেলে থেকে দিনরাত পড়েই কভার করতে হবে।
-বাসায় কী অসুবিধা?
-সবসময় বাচ্চারা থাকে, ওদের রেখে আমার পড়তে বসতে মন চায় না।
-হোস্টেলের রুমমেট কী রকম? সমস্যা করে? তোর সাথে ভালো ব্যবহার করে?
-কোনো সমস্যা হয়না ভাইয়া।
-আচ্ছা আমিই রেখে আসবো কাল তোকে।
চিত্রলেখা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। অনিক আশ্বস্ত হয়ে চলে গেল। চিত্রলেখা মুচকি হাসলো। সময়ের পরিক্রমায় চরিত্রগুলোর বিপরীত রূপ তার সামনে আসছে, কেবল সবসময় সাথী ভাবীকেই পাশে পেয়েছে সে। মানুষটাকে চিত্রলেখা নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসে শুধুমাত্র তার ব্যবহার এবং ভালোবাসার জন্য। অপর্ণার অত্যাচারের মাঝে খানিকক্ষণের প্রশান্তি হয়ে আছে সাথীর আদর-স্নেহ। এসব না থাকলে হয়তো সে অনেক আগেই মরে যেত অনাদরে।
_________________
রাতের জার্নি সচরাচর সহ্য না হলেও সিয়ামের কিছু করার নেই। চাচার শরীর খারাপ, এমতাবস্থায় নিজের কমফোর্ট নিয়ে ভাবার অবকাশ তার নেই। আর বোধহয় দেড় ঘণ্টার মতো লাগবে পৌঁছাতে। সিয়াম আগামীকাল যাবে ভেবেছিল কিন্তু আজ আচমকা চাচার শরীর বেশি খারাপ হওয়াতে লাস্ট বাসটার টিকিট সৌভাগ্যক্রমে পেয়ে সেটাতেই চড়ে বসেছে সে।
ঘণ্টা দেড়েক পর বাস থেকে নেমে সোজা হাসপাতালের উদ্দেশ্যেই রওনা দিল সে। তার চাচাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সন্ধ্যা নাগাদ। হার্ট এটাকের আশঙ্কা সন্দেহে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সিয়ামের সেখানে পৌঁছাতে বেশি সময় লাগলো না। হাসপাতালের কেবিনের একপাশের চেয়ারে সুবহা বসে কাঁদছে, অন্যপাশে তার চাচী বিলাপ করছে। সিয়াম কার কাছে কী সান্তনা দিবে নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না। সিয়ামকে দেখামাত্র সুবহার কান্নার বেগ বেড়ে গেল। সিয়ামের বুকের কাছাকাছি আশ্রয় নিয়ে সে আর্তনাদ করতে লাগলো।
-ভাইয়া, আমার বাবা ঠিক হয়ে যাবে তো? আমার বাবা কেন এমন করছে? ভাইয়া বাবার কিছু হবে না তো?
-তুই একদম চিন্তা করিস না। বোস এখানে চুপচাপ, কিচ্ছু হবেনা চাচ্চুর।
সুবহাকে বসিয়ে সিয়াম তার চাচীর পাশে বসলো। তিনিও চিৎকার করে আর্তনাদ করে উঠলেন। সিয়াম তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলো।
-চাচী, আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন। চাচ্চুর কিছু হবে না ইনশাআল্লাহ।
-বাবা, ভালো মানুষ খাইতে বসছিল। কিসের না কিসের কল আসলো, কথা বলার পর থেকেই মানুষটা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লো! আল্লাহ আমার ধৈর্যের পরীক্ষা কেন নিতেছে রে বাবা! লোকটারে কেন এত কষ্ট দিচ্ছে?
-শান্ত হোন চাচী, সব ঠিক হয়ে যাবে।
সিয়ামের মনেও ভয় খেলা করছে। এই চাচ্চুই তাকে দীর্ঘতম ধরে লালন পালন করেছেন। বলতে গেলে বাবার মতো ছায়া হয়ে ছিলেন সবসময়। সিয়ামের আদর্শ, নৈতিকতা সবই তার এ চাচ্চুর গড়ে দেওয়া। আজ সেই মানুষটাকে এভাবে কষ্ট পেতে দেখে সিয়ামের ভেতরটাও দুমড়ে মুচড়ে উঠছে। ডাক্তাররা তাদের সাধ্যমত চেষ্টা করছেন তবুও সিয়ামের মনের ভয় একটুও কমছে না।
ঘণ্টাখানেক পর তার চাচা শাহজাহান আলীর জ্ঞান ফিরলো। ডাক্তাররা যেকোনো একজনকে দেখা করার অনুমতি দিলেন। সিয়ামের চাচী ভেতরে যেতে চাইলো কিন্তু ডাক্তার বললেন তিনি বেশ কয়েকবার ‘সিয়াম’ নাম ধরে ডাকছিলেন। শেষমেশ সিয়ামই গেল তার চাচ্চুর সাথে দেখা করতে।
শাহজাহান আলীর শক্ত সামর্থ শরীরটা মুহুর্তেই রোগা হয়ে গেছে যেন। যমে মানুষে টানাটানির পর যে কঙ্কালসার অবশিষ্ট রয়েছে তা চোখে দেখেও সিয়ামের বুক চিরে আর্তনাদ বেরিয়ে আসছে। বেডের পাশে থাকা ছোট টুল সিস্টেম জায়গাটাতে বসলো সে। চোখ পিটপিট করে শাহজাহান আলী সিয়ামের উপস্থিতি দেখলেন।
-সিয়াম এসেছো তুমি?
-জ্বী চাচ্চু, আপনি একদম চিন্তা করবেন না। ডাক্তার বলেছেন আপনি দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবেন।
-আ..আমার তো..তোমার সাথে গুরুত্বপূর্ণ ক..কিছু কথা আছে সিয়াম। আমি যদি তোমার লালন পালনে কোনো অবহেলা না করে থাকি, আমি আশা করি তুমি আমার কথা রাখবে।
-কী কথা চাচ্চু?
-তোমার আগামী সপ্তাহের আগেই সুবহাকে বিয়ে করতে হবে।
সিয়ামের মনে হলো তার পায়ের নিচের জমিন যেন কেঁপে উঠলো। এ কেমন অদ্ভুত শর্তের মুখোমুখি তাকে করা হলো? সুবহাকে সে সর্বদা বোনের নজরে দেখে এসেছে। চিত্রলেখার জন্য তার অনুভূতিও মিথ্যে নয়। তবে কী করে অন্য একজনকে সে বিয়ে করে ফেলতে পারে?
চলবে…
[প্রচণ্ড তাড়াহুড়োয় লিখেছি। ভুল ত্রুটিগুলো জানায়েন।]