চিত্রলেখার_কাব্য ত্রিশতম_পর্ব ~মিহি

0
534

#চিত্রলেখার_কাব্য
ত্রিশতম_পর্ব
~মিহি

অপর্ণা তার মায়ের মুখোমুখি বসেছে। বাচ্চাদের খাইয়ে জোর করে ঘুমিয়ে দিয়ে মায়ের কাছে এসেছে সে। দুপরের রোদ খুব একটা কড়া না হলেও আজ অন্যদিনের তুলনায় শীত কম। অপর্ণার মা আনজুমান কিছুক্ষণ পর পর ঠাণ্ডা পানি খাচ্ছেন। মায়ের এ আচরণে বিরক্ত অপর্ণা। সে এসেছে শলা-পরামর্শের জন্য সেখানে তার মা কিছু বলছেই না!

-মা, তুমি কিছু তো বলো। কিভাবে কী করবো একটু তো বুদ্ধি দাও আমাকে। চিত্রলেখার বিয়ে ঐ লোকের সাথে না দিলে শেষে আমার নেকলেসটাও হাতছাড়া হবে।

-আহা চুপ কর তো অপু, বেশি অধৈর্য তুই। আমাকে ভাবতে দে আগে। ঐ বুড়োটার সাথে তোর বর জীবনেও বিয়ে দিতে রাজি হবে? কোনো চাল চালতে হবে যেন ও নিজে রাজি হয় বিয়ে দিতে।

-সেইটাই বলো। কি চাল চালবো বলো।

আনজুমান আবার ঠাণ্ডা পানির গ্লাসে ঠোঁট ঠেকালেন। মতলব তো তার মাথায় আছে তবে বিষয়টা জটিল হয় কিনা এ ভয়ে তিনি বলতে পারছেন না।

-শোন, বুদ্ধি একটা আছে তবে এটার দায়ভার তোর উপর। তুই কাজটা করবি কিনা তুই ভেবে দেখ!

-আগে বলো তো কী বুদ্ধি।

-লোকটা তো প্রভাবশালী বললি, তো ঐ বুড়োকে বর লেখাকে একরাতের জন্য তুলে নিয়ে যেতে আর পরেরদিন ভোরবেলায় যেন বাড়ির সামনে ফেলে যায়। মহল্লার মানুষ একবার এ ঘটনা দেখলে ঐ বুড়ো ছাড়া কেউই লেখাকে বিয়ে করতে আসবে না।

-বুদ্ধি তো খারাপ দাওনি মা কিন্তু ঐ বুড়ো রাজি হবে?

-সেটা তোর বোঝার ব্যাপার। বুদ্ধি চেয়েছিস দিয়েছি। এখন যা, তোর বাবা আসলো বলে।

অপর্ণা মাথা নাড়তে নাড়তে চলে গেল। নওশাদকে কোনভাবে রাজি করাতে হবে এই প্ল্যানটাতে। ফুরফুরে মেজাজে নিজের ঘরের দিকে চললো সে।

______________________

চিত্রলেখার অদ্ভুত রকমের সংকোচ বোধ হচ্ছে। আশফিনা আহমেদ মানুষটা বড্ড আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন। তার সামনে চিত্রলেখার নিজেকে বড্ড দুর্বল মনে হয়। এমনিতে সে ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্সে ভোগে আর আশফিনা আহমেদের সামনে এ সমস্যাটা বোধহয় আরো বাড়লো। ভয়ে তার হাত পা কাঁপতে লাগলো। আশফিনা আহমেদ না চাইলে সে কখনো রঙ্গনকে পাওয়ার স্বপ্ন দেখবে না। মায়ের অসম্মতিতে ছেলের হাত ধরার মতো কাজ সে করতে চায় না।

-কেমন আছো চিত্রলেখা?

-জ..জ্বী, আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।

-ভয় পেয়ো না। তোমায় আমি কিছু বলতে চাই এবং তোমার জন্য কিছু প্রশ্ন আছে আমার কাছে।

-জ্বী।

-তুমি রঙ্গনকে ভালোবাসো?

চিত্রলেখা উত্তর দিতে পারছে না। এখন অবধি রঙ্গনকেই সে নিজের মনের কথা বলতে পারেনি। সে ভয় পায়, মারাত্মক ভয়। রঙ্গন আর তার কোনো মিল আছে? আকাশ-পাতাল তফাত! সেখানে জমিনে থেকে রঙ্গনকে ছুঁতে চাওয়ার সাধ্য কি তার আছে? সে কখনো পারবে না এ প্রশ্নের উত্তর দিতে।

-পারিপার্শ্বিক চিন্তা বাদ দিয়ে বলো চিত্রলেখা। তুমি শুধু তোমাকে মনের কথাটুকু আমাকে বলো।

-আমি রঙ্গনের উপস্থিতিতে ভালো থাকি। এ অনুভূতির নাম আমার জানা নেই। আমার পক্ষে রঙ্গনকে চাওয়া বামন হয়ে চাঁদ ছোঁয়ার মতো। সে আমার ভাগ্যে নেই আমি বুঝি।

-আমি বুঝতে পেরেছি তুমি রঙ্গনকে ভালোবাসো। এখন তোমার সাথে আমি এমন কিছু কথা শেয়ার করবো যা রঙ্গনও জানে না। আমি চাইবো এ কথা যেন আমাদের মধ্যেই থাকে। রঙ্গন যদি ভুলেও এ কথা কোনদিন জানতে পারে, সে দিনটা হবে তোমার জীবনের শেষ দিন।

আশফিনা আহমেদ বেশ শান্তস্বরে কথাটুকু বললেও চিত্রলেখার অন্তরাত্মায় কম্পন সৃষ্টি হলো। নিউক্লিয়ার বোমার মতো এ মহিলার মুখনিঃসৃত কথা। ঠিক কিভাবে আহত করবে আর কতটা আহত করবে তার নিশ্চয়তা নেই।

-চিত্রলেখা তুমি একটু স্বাভাবিক হও যেন আমি নির্দ্বিধায় কথাগুলো বলতে পারি।

-জ্বী জ্বী বলুন।

-রঙ্গনের বয়স এখন চব্বিশ, একেবারে বেশিও না। ম্যাচিওরিটি ওর মধ্যে আছে তবে সময় আর মানুষভেদে ওর আচরণগুলো বদলে যায়। আমার বিয়ের পর প্রায় ছয় বছর আমি নিঃসন্তান ছিলাম। তখন রঙ্গন আমার জীবনে আসে খুব অদ্ভুতভাবে। আমরা ডাক্তারের কাছ থেকে ফিরছিলাম। তিনি বলেছিলেন আমার মা হওয়ার সম্ভাবনা পাঁচ শতাংশেরও নিচে। মারাত্মক ভেঙে পড়েছিলাম। ডাক্তারের কাছ থেকে ফেরার সময় একটা রাস্তার ধারে হঠাৎ আমাদের গাড়ি নষ্ট হয়ে যায়। সে মুহূর্তেই একটা বাচ্চার কান্নার স্বর আমার কানে আসে। মাতৃত্বের তৃষ্ণায় তৃষ্ণার্ত অভাগী আমি গাড়ি থেকে নেমে এদিক সেদিক তাকালাম। তখনো ডিসেম্বরে মাস ছিল। একটা নবজাতক শিশুকে কাপড়ে মুড়ে রাস্তার এককোণে ফেলে রেখে যাওয়া হয়েছিল। আমি সেদিন বাচ্চাটাকে কোলে জড়িয়ে কতক্ষণ কেঁদেছিলাম তার ইয়ত্তা নেই। মাশরুর সাহেব আমাকে পরবর্তীতে দেখানোর জন্য মুহূর্তটার ছবি তুলেছিলেন। ছবিটা আমি অ্যালবামে রাখলেও কখনো রঙ্গনকে দেখাতে পারিনি। আমার ছয় বছর কান্নার পর আল্লাহ তাআলা আমার বুকে রঙ্গনকে পাঠিয়েছিলেন।

চিত্রলেখা স্তব্ধ হয়ে গেল। রঙ্গন তাদের আসল সন্তান নয়? তবে রঙ্গন কে? কি তার পরিচয়? প্রশ্নগুলো মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকলেও চিত্রলেখা যেন একটু স্বাভাবিক হলো। রঙ্গনের জন্য তার অনুভূতিতে বিন্দুমাত্র ভাটা পড়লো না বরং প্রখর হলো তার অনুভূতির ভাণ্ডার।

-আমি কী বললাম বুঝতে পেরেছো?

-জ্বী আন্টি বুঝেছি।

-এখন বলো, এ সত্যি জানার পরেও তুমি রঙ্গনকে ভালোবাসো? বিয়ে করতে পারবে তাকে? তোমার পরিবার মানবে?

-আমি রঙ্গনকে অনেক বেশি ভালোবাসি। উনি যেমনই হোক, ওনার প্রতি আমার ভালোবাসা বিন্দুমাত্র কমবে না।

আশফিনা আহমেদ খেয়াল করলেন চিত্রলেখা প্রতিটা শব্দ জোর দিয়ে বলছে। রঙ্গনের প্রতি তার ভালোবাসা যেন অকস্মাৎ বেড়ে গেছে। যে উদ্দেশ্যে তিনি এসেছিলেন, তা সফল হলো না বুঝতে পেরে আশফিনা আহমেদের চোখের চাহনি বদলাতে থাকলো। চিত্রলেখার উপর তার ক্রোধের আগুন মিশ্রিত দৃষ্টি পড়লো। তাতে অবশ্য চিত্রলেখার যায় আসলো না। সে এখন নিশ্চিত রঙ্গন নামক মানুষটার পাশে সে থাকবেই তবে তাকে তার সত্যিটা না জানিয়ে।

-এ কথাগুলো রঙ্গন যেন না জানে।

-আমি রঙ্গনকে কখনো এসব জানতে দিব না আন্টি, বিশ্বাস রাখুন আমার উপর।

আশফিনা আহমেদের মন গললো না। রুক্ষ মেজাজেই তিনি চিত্রলেখার সামনে থেকে চলে গেলেন। চিত্রলেখা তখন একাকী ক্যাফের টেবিলটাতে বসে। আচমকা সে ফোন বের করে রঙ্গনের নম্বরে ডায়াল করলো।

মানসিক অবসাদে জর্জরিত রঙ্গন চিত্রলেখার কলে খানিকটা প্রাণ ফিরে পেল। নওশাদের কথা এখনো চিত্রলেখাকে জানায়নি সে। চিত্রলেখার প্রতিক্রিয়াটা সামনাসামনি দেখতে চায় বিধায় জানানোতে বিলম্ব করছে সে।

-হ্যালো চিত্রলেখা, কিছু বলবে?

-হুম। আপনি একটু ‘ক্যাফেকাপ’ এ আসতে পারবেন কিছু সময়ের জন্য?

-আসছি। অপেক্ষা করো একটু।

-একটু শুনুন।

-বলো।

-সাদা রঙের শার্টটা পড়ে আসতে পারবেন?

-হুম। তুমি একটু অপেক্ষা করো, আমি আসছি। রাখো।

-আচ্ছা রাখলাম।

রাখলাম বলার পরে চিত্রলেখা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো। রঙ্গন কল কাটলো না। শেষমেশ চিত্রলেখা নিজেই কল কেটে দিল। রঙ্গনের এই ছোট ছোট বিষয়গুলোও এখন তার মনে অনুভূতির ফোয়ারার সৃষ্টি করছে। রঙ্গন কি বুঝতে পেরেছে চিত্রলেখা তাকে কেন ডাকলো এভাবে? বুঝতে পারার তো কথা না!

ক্যাফেতে আসতে রঙ্গনের কাঁটায় কাঁটায় ত্রিশ মিনিট লাগলো। একে তো জ্যাম তবুও রঙ্গন সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে তাড়াতাড়ি আসার। চিত্রলেখার মুখোমুখি বসলো সে। চিত্রলেখা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। শুভ্র রঙটা বড্ড মানায় রঙ্গনকে। ছেলেটা কি জানে সৃষ্টিকর্তা তাকে কতটা মুগ্ধতা সৃষ্টিকারী করেছেন! রঙ্গনের কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে। নিঃশ্বাসের ক্রমশ উঠা-নামার মাঝখানে চিত্রলেখা তার এক হাত রঙ্গনের হাতের উপর রাখলো। রঙ্গনের মনে হলো সে বোধহয় ছোটখাট একটা বৈদ্যুতিক শক খেল। চিত্রলেখার দিকে তাকানোর মতো অবস্থাতেও নেই সে। নিজেকে প্রচণ্ড অস্থির লাগছে তার। পরবর্তী ধাক্কাটা বেশ জোরেসোরেই লাগলো চিত্রলেখার বলা বাক্যটাতে।

“আমি সারাজীবন তোমাকে তুমি বলে ডাকতে চাই, রঙ্গন!” বাক্যটুকু রঙ্গনের কর্ণকুহরে প্রবেশ করতে দেরি হলো তবে রঙ্গনের হৃদস্পন্দন থেমে যেতে সময় লাগলো না। মাথা ঘুরাচ্ছে তার। এই বোধহয় সে পড়ে যাবে। রঙ্গন অনুভব করলো চিত্রলেখা ব্যতীত সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here