চিত্রলেখার_কাব্য দ্বাদশ_পর্ব ~মিহি

0
443

#চিত্রলেখার_কাব্য
দ্বাদশ_পর্ব
~মিহি
[প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদেরদের জন্য উন্মুক্ত]

“নির্বাচন পূর্ব সময়ে *** এলাকার চেয়ারম্যানের অশ্লীল কৃতকর্মে সোশ্যাল মিডিয়া সয়লাব।” ফেসবুকের পোস্টগুলো দেখে ঠোঁটে হাসি খেলা করছে মেয়েটার। অবশ্য সে ধারণা করতে পেরেছিল লোকটা সহজেই তার জালে ধরা দিবে। বাকি কাজ গার্লস গ্রুপ করে দিয়েছে। গার্লস গ্রুপের একটা মারাত্মক ফায়দা হলো একটু ইমোশনাল কথাবার্তা দিয়েই কাজ হাসিল করানো যায়।

‘কায়া’ আইডি থেকে গার্লস গ্রুপে নওশাদের অশ্লীল ছবিসহ কিছু অশ্লীল কথাবার্তার স্ক্রিনশট পোস্ট করা হয়েছে। উপরে বেশ আবেগী বাক্যে লেখা,”এই লোকটা আমার এলাকার চেয়ারম্যান। নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি আমাকে শারীরিক নির্যাতনের চেষ্টা করেছেন।” কমেন্টবক্সের ক্ষুদ্র একাংশ সহমত পোষণ করলো। নওশাদকে তারাও চেনে, লোকটা তাদের সাথেও খারাপ আচরণ করেছে। ব্যস! পোস্ট ভাইরাল হতেই কায়া আইডিটার আর সন্ধান পাওয়া গেল না। এতে যুক্তি আরো প্রখর হলো যেন নওশাদই ধমকে আইডি বন্ধ করাতে বাধ্য করেছে। ফেসবুক জুড়ে এ বিষয় নিয়েই চর্চা চলছে। নওশাদ এখনো এসব নিয়ে মুখ খোলেনি। দ্রুত তাকে সব খোলাসা করার আহ্বান জানানো হয়েছে।

_______________

হলের বাথরুমের ছোট আয়নাটা বড্ড নোংরা। হলদেটে একটা দাগ আছে আয়নাটাতে। চিত্রলেখার বমি বমি ভাব হচ্ছে। নিজের উপর আবারো একটা বিতৃষ্ণা চলে এসেছে তার। চোখেমুখে পানি দিতেই আয়নায় নিজের উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি লক্ষ করে সে। হলদেটে আয়নাতেও প্রতিচ্ছবিটি শুভ্র স্বচ্ছ মনে হচ্ছে। প্রতিচ্ছবিটি যেন ডেকে উঠলো চিত্রলেখাকে।

-নিজের উপর ঘৃণা হচ্ছে চিত্রলেখা?

-হুম। কুকুরকে কামড়েছি মনে হচ্ছে।

-কুকুর তোমার সভ্রমে হাত দিয়েছিল আর তুমি তার সভ্রম এবং ক্ষমতা ভরাবাজারে নিলামে তুলেছো। নিজের সাথে এর চেয়ে বড় ইনসাফ কী হতে পারতো? নিজের ‘কায়া’ পরিচয় ভুলে যাও।

-আমি কি ঠিক করেছি? লোকটার অশ্লীল মেসেজগুলো আমার চোখে ভাসছে দুঃস্বপ্ন হয়ে।

-কায়ার অস্তিত্ব মিটিয়ে লেখা হয়ে বাঁচো।

চিত্রলেখা কিছু বলার আগেই দরজায় শব্দ শুনতে পায়। সামনে তাকিয়ে প্রতিচ্ছবিটিকে আর দেখতে পায় না সে তবে কথাগুলো তার মনে ভাসে। সে অবশ্যই সঠিক কাজটাই করেছে। এরকম একজন পুরুষের সাথে এটাই হওয়া উচিত!

“মরে গেছিস নাকি ওয়াশরুমে? বের হ!” চেঁচামেচির শব্দে দ্রুত ওয়াশরুম থেকে বের হয় চিত্রলেখা। তাকে রুম শেয়ার করতে হচ্ছে আর্টসের একজনের সাথে। মেয়েটা বেশ উগ্র। চিত্রলেখা ফেসবুকে ঢুকলো না আর। ফেসবুক ডিলিট করে হোয়াটসঅ্যাপ ইনস্টল করলো। হোয়াটসঅ্যাপ আনইনস্টল করেছিল দিন কয়েক আগে। হোয়াটসঅ্যাপ ওপেন করতেই সিয়ামের গতকালের মেসেজ ভেসে উঠলো,”নোটখাতাটা যত্নে রাখিস।” চিত্রলেখা মৃদু হাসলো। সিয়ামকে অনলাইনে দেখে রিপ্লাই দিল।

-এতই যখন নোটখাতার চিন্তা, তো দিলে কেন আমায়?

-সাহায্য তো করতে নাই মানুষকে!

-সাহায্য করে বারবার খোঁটা দেওয়া উচিত?

-আচ্ছা স্যরি। পরীক্ষা তো কয়েকদিনের মধ্যে। পড় মনোযোগ দিয়ে।

-আচ্ছা।

ফোন রেখে বসতেই ওয়াশরুম থেকে তার রুমমেট বেরোলো। মেয়েটির নাম সঞ্চারী, হিন্দু সম্প্রদায়ের। আরেকজন রুমমেট আছে, অহনা নাম। অহনা সায়েন্স ফ্যাকাল্টিতে। সঞ্চারীর চোখজোড়া সবসময় অদ্ভুত এক রাগে রাগান্বিত থাকে। সে এসে বসলো চিত্রলেখার ঠিক মুখোমুখি।

-তুই সায়েন্সের?

-হ্যাঁ। আমার বাংলা নোটটা করে দে তো।

-আমার পড়া আছে।

-তো? তোর পড়া আছে পরে পড়বি। আমার কাজটা কর আগে, বেশি কথা বলিস না।

চিত্রলেখার ঝগড়া করতে ইচ্ছে করলো না তার উপর এই মেয়ে এসেছে গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে। কী লাভ তাকে খেপিয়ে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে সঞ্চারীর জন্য নোট করতে বসলো সে।

_______________

-ভোটের আগে এসব ফাজলামি করার কোনো মানে হয় নওশাদ? যেভাবে পারো এসব বন্ধ করো।

-আমি দেখছি বিষয়টা।

নওশাদ ফোনটা দূরে আছাড় মারলো। আসলেই সে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। চিত্রলেখাকে দেখার পর থেকে তার মধ্যে যে আগুনের শিখা জ্বলতে শুরু করেছে তা কেবল চিত্রলেখার নরম শীতল স্পর্শেই দূর হওয়া সম্ভব। নিজের লোকদের কাজে লাগিয়ে ভাইরাল পোস্টগুলো সরানোর ব্যবস্থা করেছে নওশাদ আর পাবলিককে ভুজুংভাজুং বোঝানোর ফন্দি আঁটাও শেষ। ‘এডিট’ বলে পুরো ব্যাপারটাই ধামাচাপা দেওয়া যাবে তবে চিত্রলেখার ঝড় তার মনে তখনো বহমান। এ ঝড় থামানো আবশ্যক। নওশাদ মির্জাকে এখনো চেনেনি চিত্রলেখা। নওশাদ জীবনে প্রথম কাউকে বউ বানানোর স্বপ্ন দেখেছে, এ স্বপ্ন এত সহজে ভাঙতে তো সে দেবেনা তবে আপাতত পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হওয়া অবধি নীরব থাকবে সে। নীরবেই চিত্রলেখার দুর্বল জায়গা খুঁজে বের করতে হবে।

আশফিনা আহমেদ নওশাদের অবস্থা বুঝতে পারছেন। তবে তিনি কিছু বলছেন না। ঘটনাটা আকস্মিক মনে হচ্ছে না তার। যদিও চিত্রলেখা বেশ সরল তবুও তার সন্দেহের তীরটা কেন যেন চিত্রলেখার দিকেই ঠেকছে। এ কথা তিনি নওশাদকে জানাবেন না। তার ভাই ভুল করেছিল এবং শাস্তি পাওয়াটা উচিত। যতটুকু অসম্মান তার হয়েছে তা একজন মেয়ের অসম্মানের নিকট তুচ্ছ মাত্র।

অহমের ইদানিং মন ভালো থাকেনা তবুও পড়ায় মন বসিয়েছে সে। চিত্রলেখার কথা মনে পড়ে তার আবার পরক্ষণেই মনে পড়ে ম্যামের কলেজে চান্স পেতে হলে পড়তে হবে। রসায়ন স্যারের মেয়েটা তাকে আর বিরক্ত করে না। অবশ্য তার ব্রেক আপ হয়েই গেছে, এখন আর বিরক্ত না করলেই কী? বড় ভাইকেও বড্ড মিস করছে সে। সব মিলিয়ে জীবনটা বেশ বিষণ্ণ কাটছে তার।

-অহম, কী ভাবছো এতো?

-মা, ভাইয়া আর কিছুদিন থাকতে পারতো না?

-পরীক্ষা শেষ হলেই আসবে।

-আমি একদিন চিত্রলেখা ম্যামের সাথে দেখা করতে যাবো ভাইয়ার সাথে।

-ড্রাইভার আঙ্কেলের সাথে যাও।

-না আমি ভাইয়ার সাথেই যাবো।

আশফিনা আহমেদ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কিছু বিষয় না চাইতেও সামনে উপস্থিত হয়। এসব বিষয় যেমন ছুঁড়ে ফেলা যায় না তেমন প্রতিবাদও করা যায় না। রঙ্গনের ব্যাপারে তিনি কখনো চিত্রলেখাকে নিয়ে আপোস করতে পারবেন না। রঙ্গনের মনে যে ক্ষণিকের অনুভূতি জন্মেছে তা অচিরেই বিনাশ হওয়াটা আবশ্যক ছিল। তার জন্য নিজের ছেলের সাথে রুক্ষ্ম ব্যবহার তার কাছে অযৌক্তিক নয়। রঙ্গনের জন্য তিনি সেরা ছাড়া কিছু নির্বাচন করবেন না কখনোই।

_______________

চিত্রলেখার লেখা শেষ করতে অনেকটা সময় লাগলো। অতঃপর সঞ্চারীকে নোটটা দিল। সঞ্চারী অনেকটা রুক্ষভাবে সেটা নিল। চিত্রলেখার বিরক্ত লাগলেও কিছু বললো না। অযথা অশান্তি করার ইচ্ছে তার নেই। যে অশান্তি থেকে বাঁচতে সে এখানে এসেছিল, সে অশান্তি বোধহয় এত সহজে তাকে ছাড়বে না।

-তুই নোটে কাটাকাটি করেছিস কেন? দেখে লিখতে পারিস না?

-এত সমস্যা হলে নিজে লেখতে পারো। কেউ সাহায্য করলে ধন্যবাদ দিতে শেখো।

-তোকে কেন ধন্যবাদ দিতে হবে?

-তোমার নোটটা আমি করে দিয়েছি। ধন্যবাদ না দিতে পারলে ভুল ধরিও না অযথা।

-ভুল করলে ভুল ধরবো না?

-নিজে লেখো তাহলে।

চিত্রলেখার কণ্ঠস্বর উচু হলো। সবসময় নীরব থাকা যায় না। চিত্রলেখার উচ্চ কণ্ঠস্বরে বোধহয় দমে গেল সঞ্চারী। মুচকি হাসলো সে। নোটখাতাটা বিছানায় ফেলে বেশ ফুরফুরে মেজাজে চিত্রলেখার বাহু ধরে তাকে বিছানায় বসালো।

-আসার পর থেকে দেখতেছি চুপচাপ, যে যা বলে তাই শুনতেছিস। এই যে তোর মধ্যে বাকশক্তি আছে এটাই পরখ করলাম।

-মানে?

-মানে প্রতিবাদ করতে শিখ। সবার কথা মাথায় রেখে কাজ করলে নিজের ভালো থাকার সবটুকু অংশ বিসর্জন দিতে হবে আর অন্যের জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে কেউ ভালো থাকে না।

-অযথা ঝগড়া বাড়ে প্রতিবাদ করলে।

-তার জন্য সব মেনে নিবি? শোন, জীবনে লড়াই না শিখলেও কৌশলী হতে হয়। মুখে ঝগড়া না করলেও সুচতুরভাবে পরাজিত করতে হয় শত্রুকে। যুক্তিবাদী হ, তোকে আমি প্রতিবাদ করতে বলেছি তোর কাজের মাধ্যমে। সবার হা’তে হা মিলাস না। পরে যেন পস্তাতে না হয়। জীবন বড্ড কঠিন।

সঞ্চারী আবারো হাসলো। চিত্রলেখা লক্ষ করলো মেয়েটার হাসি অদ্ভুত সুন্দর। এতক্ষণ যাকে উগ্র মনে হচ্ছিল তাকে একমুহূর্তেই যেন খুব ভালো মনে হচ্ছে তার। চিত্রলেখার চোখে আবারো সেই জ্যোতি অনুভব করলো সে। ভুল কিছু সে করেনি, সে লড়েছে নিজের জন্য তবে নীরবে।

“ইন্ট্রোভার্টরা সচরাচর লোকসমাগম ভয় পায় তবে ভার্চুয়াল জগতটা তাদের জন্য কমফোর্ট জোন। এখানে তারা নিজেদের রাজত্ব চালায়। ইন্ট্রোভার্টদের জন্য এই ভার্চুয়াল জগতে যুদ্ধ জয় করাও বড্ড সহজ। এরা বাস্তবতা ভয় পায়, কল্পনার আশ্রয়ে আশ্রিত এরা কল্পলোকে বাস করতে ভালোবাসে।” চিত্রলেখা আনমনে আওড়ালো কথাগুলো। ঠিক সে সময় রঙ্গনের টেক্সট আসলো। টেক্সট ওপেন করতেই ভীতি গ্রাস করলো চিত্রলেখাকে। রঙ্গনের থেকে এই টেক্সট মোটেও প্রত্যাশা করেনি সে।

চলবে…

[রিচেক দিতে পারিনি, বানান ভুলগুলো ধরে দিয়েন আর বেশি বেশি কমেন্ট করুন💛]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here