#চিত্রলেখার_কাব্য
নবম_পর্ব
~মিহি
“হাত ছাড়ুন আমার নাহলে আমি চেঁচাতে বাধ্য হবো।” চিত্রলেখার কথায় নওশাদের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না বরং সে আরো চড়াও হতে চাইলো চিত্রলেখার উপর। বুদ্ধিটা অবশ্য মন্দ করেনি সে। অহমকে খেলার ছলে ঘরে আটকেছে আর নিজের বোনকে কফির মধ্যে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে, চাকর-বাকরদেরও বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে বেশ মতলব করেই। এখন চিত্রলেখার তীক্ষ্ম চোখ কোন কাজেই আসবে না। নওশাদের চোখজুড়ে লালসা। হিংস্র দানব ভর করেছে তার সর্বাঙ্গে। চিত্রলেখার চোখ বেয়ে অশ্রুকণা গড়িয়ে চলেছে। শেষবারের মতো এ বাড়িতে আসা তার জন্য এমন ভয়ানক বিপদ বয়ে আনতে পারে তা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি সে। নওশাদ প্রচণ্ড জোরে হাত চেপে ধরায় চিত্রলেখার হাতে ব্যথা অনুভূত হলো কিন্তু চিৎকার করা বৃথা।
-অযথা চেঁচিয়ে কী লাভ বলো তো? যা চাচ্ছি দিয়ে দাও, দরকার পড়লে টাকা নাও।
-আপনি আমার বাবার বয়সী। দয়া করে আমার হাত ছাড়ুন।
-বাবা? তোমার বাবাও তো সাধু পুরুষ নন। তোমার মা কি তার স্ত্রী ছিলেন নাকি রক্ষীতা? এমন বাবার মেয়ে হয়ে সতী হয়ে কী করবে বলো? তার চেয়ে আমার আবদার মানো। আর যদি আমার ভালো লাগে তবে তোমাকে স্ত্রী করতেও তো আমার আপত্তি নেই। তারপর থেকো রাজরানী হয়ে।
চিত্রলেখার ঘৃণায় সারা শরীর কেঁপে উঠে। একজন মানুষ এতটা নোংরা কী করে হতে পারে? চিত্রলেখা সরানোর চেষ্টা করে নওশাদকে। বিশেষ কোনো লাভ হয়না। সুঠামদেহী নওশাদের সামনে বড্ড অসহায় চিত্রলেখা। শেষমেশ নওশাদের ধস্তাধস্তিতে আরো দুর্বল হয়ে পড়ে সে। নওশাদের বিভৎস দৃষ্টি গভীর হচ্ছে। চিত্রলেখার ঠোঁটের দিকে হাত বাড়ানোর চেষ্টা করতেই লাঠির আঘাত পড়লো নওশাদের হাতে। ছিটকে খানিকটা দূরে সরে গেল সে। লাঠির উৎস খুঁজতে গিয়ে চোখ পড়লো তার বোন আশফিনা আহমেদের দিকে। আশফিনার হাতে হকিস্টিক। তার মানে আশফিনা আঘাত করেছে তাকে! নওশাদ বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। আশফিনার চোখ থেকে যেন অগ্নিবর্ষণ হচ্ছে।
-বনু, তুই আমাকে মারতে পারলি?
-আমি একটা পশুকে আঘাত করেছি যার মাথায় হিংস্রতা ভর করেছিল।
-চিত্রলেখা তোরও অপছন্দের। ওর সাথে আমি কিছু করলে তোর খারাপ লাগবে কেন? তাছাড়া আমি ওকে বিয়ে করবো।
-অপছন্দের বলে আমি তার সভ্রমহানির দৃশ্য দেখে তৃপ্ত হবো? তুই চুপচাপ বের হ এখনি। আমাকে পুলিশ ডাকতে বাধ্য করিস না।
-একটা বাইরের মেয়ের জন্য তুই নিজের ভাইয়ের সাথে এরকম করতে পারিসনা।
-তুই যাবি নাকি ঘাড় ধাক্কা…?
নওশাদের আত্মসম্মানে বড়সড় আঘাত লাগলো। গটগট করে বেরিয়ে গেল সে। চিত্রলেখা এতক্ষণের দৃশ্যে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। নওশাদ চলে যেতেই সে মেঝেতে বসে কাঁদতে শুরু করলো। এতটা ভয়ানক পরিস্থিতির মুখোমুখি সে কখনো হয়নি। বাবার ভালোবাসা না পেলেও তাকে আগলে রাখার কেউ না কেউ ছিল কিন্তু আজকের এ পরিস্থিতি চিত্রলেখাকে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে। তার চোখে আঙুল দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছে সে কতটা দুর্বল। আশফিনা আহমেদ হকিস্টিক ফেলে চিত্রলেখাকে ধরে সোফায় বসালেন। ফার্স্ট এইড বক্স থেকে ওষুধ বের করে চিত্রলেখার হাতে লাগাতে থাকলেন। চিত্রলেখার কান্না তখন থেমেছে তবে কণ্ঠে কান্নার রেশ বিদ্যমান।
-আমার বড় ভাই পছন্দ করেন না আমার এখানে আসা। তাই আজ শেষবারের …
-তোমার এ মাসের টাকা আমি পাঠিয়ে দিব আর ড্রাইভার তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে।
-টাকার প্রয়োজন নেই, আমি তো একমাস সম্পূর্ণ পড়াইনি।
-সেটা আমার হিসেব, তোমার ভেবে কাজ নেই। আর শোনো, এতটা দুর্বল হয়ো না যে রাস্তার কুকুরও তোমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। নিজেকে রক্ষা করতে যদি কোন নরপশুকে হত্যাও করতে হয় তবুও সে সাহস থাকা দরকার।
চিত্রলেখা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। এ এক নতুন আশফিনা আহমেদ যার চোখে তার প্রতি রাগ নেই।
-আপনাকে ধন্যবাদ।
-কৃতজ্ঞতা স্বীকার করার অনেক সময় পাবে। যাও বাসায় ফিরতে হবে তোমার।
চিত্রলেখা আর কিছু বলার মতো পরিস্থিতিতে নেই। তার কেবল চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। লোকটা যখন তার হাত স্পর্শ করে নোংরা ইঙ্গিত করছিল, কেন সে নিজের ক্রোধ দেখাতে পারলো না? কেন সে প্রতিবাদী হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারলো না? মায়ের মতো সেও কি দুর্বল সত্তা? নিজের মায়ের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে কি সে? হয়তোবা।
চিত্রলেখার এখনো মনে পড়ে মায়ের করুণ দিনগুলি। চিত্রলেখার মা চারুলতা। বেশ শৌখিন জমিদার পরিবারের বংশধর তবে কালগর্ভে এখন সম্পদের ছিটেফোঁটাও নেই। অনেকটা অসচ্ছলই ছিল তারা। চিত্রলেখার বাবা আমিন শেখ তখন উঠতি ব্যবসায়ী। চারুলতার মোহে পাগল হয়ে পরিবারের বিরুদ্ধে বিয়ে করেন। বিয়ের তিন বছরেও তাদের কোনো সন্তান হয়না। আমিন শেখের ব্যবহারে পরিবর্তন আসে। প্রতিনিয়ত চারুলতার উপর অত্যাচার করতে থাকেন তিনি। বিয়ের সাড়ে তিন বছরের মাথায় দ্বিতীয় বিবাহ করেন সাহেরা বানুকে। সাহেরা বানুর থেকেই বিয়ের বছর না ঘুরতেই বড় সন্তান লাভ করেন। চারুলতার গল্প তখন থমকে দাঁড়ায়। বাবার ঘরে আশ্রয় নেওয়ার মতো সাহস সে করতে পারেনি। অর্ণবের জন্মের পরের বছরেই তার ছোট ভাই অনিকের জন্ম হয়। তারপর থেকেই সাহেরা বানু অসুস্থ হয়ে পড়েন। আবারো শারীরিক চাহিদার দংশনে চারুলতার মোহে ডোবেন আমিন শেখ। গর্ভে আসে চিত্রলেখা। প্রথম সন্তান মেয়ে, এটা মানতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয় আমিন শেখের। চারুলতাকে তিনি স্ত্রীর মর্যাদা থেকে বিচ্যুত করেন। জন্মের পর থেকেই নিজের মাকে কতরকম ভাবে অত্যাচারিত হতে দেখেছে হিসেব নেই চিত্রলেখার। মাও কেমন বেহায়ার মতো সব সহ্য করতে করতে মরে গেল। চারুলতার সেই বেহায়া রক্তই চিত্রলেখার শরীরে তাই সে এতটা দুর্বল। কান্না আটকানোর চেষ্টা করতে থাকে সে। চিত্রলেখার বয়স অল্প, আমিন শেখ তখন কঠিন অসুখে পড়েন। বাড়ির লোকজন মুখ ফিরিয়ে নেয়। চারুলতা বেহায়ার মতো সেবা করে তবুও লোকটা অপরাধবোধে অথবা অনুতাপেই মারা যায়। তার মৃত্যুর পর চারুলতা এক মাসও বাঁচেনি। ভালোবাসার কাঙাল যাকে বলে। তবুও ভুল মানুষের ভালোবাসায় কাঙাল। চিত্রলেখার কান্না বাঁধ মানতে চাইছে না। সবকিছু ধ্বংস করে দেওয়া প্রলয় তার মাঝে বয়ে চলেছে। এ প্রলয়ের রেশমাত্র সে ঐ নওশাদকে দেখাতে পারেনি এ দহনে পুড়ছে সে।
________________
-তোমার বোন এসেই বাথরুমে ঢুকলো কেন? কী করে এসেছে?
-তোমার লজ্জা হয়না অপর্ণা? তুমি কতটা নিচ যে আমার বোনকে নিজের পড়াশোনার কথা ভেবে টিউশনি করতে হয় এখন আবার সেটা নিয়েই প্রশ্ন তোলো?আমার দেওয়া টাকা কী করো তুমি?
-হ্যাঁ সব দোষ আমার। তোমার বোন যে নতুন ফোন কিনেছে তা দেখেছো? রঙঢঙ বদলে গেছে ওর। দেখো কার সাথে শুয়ে এসেছে। বিয়ে দিয়ে দাও কোনো দুই বাচ্চার….
অপর্ণা কথা শেষ করতে পারলো না। অর্ণবের হাতের চড়ে সে স্তব্ধ। তাদের মাঝে ঝগড়া-কথা কাটাকাটি হলেও অর্ণব কখনো তার গায়ে হাত তোলেনি। আজ প্রথম এ কাণ্ড ঘটেছে। রাগে আগুন ধরে যাচ্ছে অপর্ণার মাথায়। হাতে থাকা টিভির রিমোটটা দূরে ছুঁড়ে মারলো সে। তৎক্ষণাৎ রূপসা এবং রাদিফকে নিয়ে এক কাপড়ে বেরিয়ে গেল। অর্ণবের রাগও তখন সপ্তম আসমানে। সেও প্রতিক্রিয়া দেখালো না।
ঝর্ণার পানি যতবার চিত্রলেখার শরীর স্পর্শ করছে ততবার কেঁপে উঠছে সে। অজানা আতঙ্কে তার মনে দাগ পড়ে গেছে। বিশ্রি একজোড়া হাত সে চোখ বন্ধ করলেই প্রত্যক্ষ করছে। পানির শব্দের আড়ালে কান্নার শব্দগুলো কারো কানে পড়ছে না, ঠিক তেমনি বাইরের ঝড় সম্পর্কেও অবগত নয় সে। তাকে কেন্দ্র করে বাইরে তার ভাই এবং ভাবীর মধ্যে যে ঘূর্ণিঝড়ের আগমন ঘটেছে তা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি সে।
চলবে…
[জানি ছোট হয়েছে। অত্যন্ত দুঃখিত, কালকে বড় করে একটা পর্ব দিব ইনশাআল্লাহ।]