#চিত্রলেখার_কাব্য
সপ্তবিংশ_পর্ব
~মিহি
-মা আসবো?
-এসো।
-ডেকেছিলে আমাকে?
-হুম। তোমার কী হয়েছে রঙ্গন? এতটা অবাধ্য কবে হলে তুমি? আমি নিষেধ করেছিলাম ঐ মেয়েটার সাথে দেখা করতে অথচ তুমি তাকে আশ্রমে নিয়ে গেলে!
-তুমি আমার উপর নজর রাখছো মা?
-তোমার মা আমি, তোমার ভালো মন্দ বোঝার দায়িত্ব নিশ্চয়ই অন্য কারো নয়।
-আমার ভালো সময়টুকু চিত্রলেখার সাথে কাটে মা। দয়া করে এটা আমার থেকে কেড়ে নিও না।
-তুমি ঐ মেয়েটাকে ভালোবাসো?
রঙ্গন নিশ্চুপ হয়ে যায়। সে এখনো চিত্রলেখাকে বলেনি কথাটা। মাকে কী করে বলবে সে? চিত্রলেখা যদি তাকে ভালো না বাসে?
-চুপ করে আছো কেন রঙ্গন? কারণ তুমিও জানো মেয়েটা তোমার মোহ ছাড়া কিছুই নয়। দুয়েকদিন ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগা আর সারাজীবন একসাথে থাকার বিষয়টা ভিন্ন। তোমাকে ভুল পথ থেকে সরিয়ে আনা আমার দায়িত্ব।
-মা আমি চিত্রলেখাকে ভালোবাসি।
-ঐ মেয়ের নম্বর এখনি ব্লক করো, আমার চোখের সামনে।
-না মা, আমি ওকে ভালোবেসে ফেলেছি।
রঙ্গন আশফিনা আহমেদকে কিছু বলার সুযোগ দিল না। অনেকটা ছুটেই সে বাড়ি থেকে বেরোলো। এখন চিত্রলেখার হোস্টেলে যেতে হবে তার। চিত্রলেখাকে এই গুরুত্বপূর্ণ কথাটা জানাতে হবে অন্যথায় সে দম বন্ধ হয়েই মারা যাবে। রঙ্গনের মনে হলো সমস্ত শহরটা আজ রঙিন তবে সময়টা যেন ধীর গতিতে চলছে। সে যতই এগোচ্ছে, ততই যেন দুরত্ব বেড়ে চলেছে। এটাই কি আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সূত্র? রঙ্গনের মাথা কাজ করছে না। অদ্ভুত এক দৈব শক্তি যেন ভর করেছে তার মাথায়।
_________________
-তুমি কী চাইছো আশফিনা? রঙ্গনকে সত্যি জানালে ও কতটা ভেঙে পড়বে ভেবেছো একবার?
-আমি রঙ্গনকে সত্যি জানাবো না, চিত্রলেখাকে জানাবো। সে যখন জানবে তার স্বপ্নের রাজপুত্রটা মেকি তখন সে নিশ্চিত পিছু হটবে। রঙ্গনকে আমি কখনোই ওর কাছে যেতে দিতে পারি না মাশরুর। সব দোষ তোমার, তোমার কারণেই ঐ মেয়েটার ছায়া এ বাড়িতে পড়েছে!
-রঙ্গন চিত্রলেখাকে ভালোবেসে ফেলেছে আশফিনা! রঙ্গনকে আমরা জোর করতে পারি না।
-তুমি কী চাচ্ছো মাশরুর? আমার ছেলেকে আমি ঐ মেয়ের সাথে বিয়ে দিব? কখনোই না। রঙ্গনের বিয়ে আমার পছন্দের মেয়ে ছাড়া কখনোই হবে না।
মাশরুর আহমেদ আশফিনার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আশফিনা ভয় পাচ্ছে, সন্তান হারানোর ভয়। তার ধারণা চিত্রলেখা এলে সে রঙ্গনকে কেড়ে নেবে। আশফিনা আহমেদকে কি আদৌ বোঝাতে পারবেন তিনি? বোধহয় না।
-রঙ্গন ভুল করছে, আমি ওকে এখানে রাখবো না। ওকে বাইরে পাঠিয়ে দিব।
-আশফিনা! রঙ্গন বাইরে গেলেই ভালো থাকবে? ওর ভালো থাকার জায়গাটা চিত্রলেখা!
-নাহ! এটা শুধুই ওর মোহ, চিত্রলেখা রঙ্গনকে ভালোবেসে মরে গেলেও ওদের বিয়ে আমি কখনো মানবো না। তুমি কেন ভুলে যাচ্ছো ও কেমন ফ্যামিলিতে বিলং করে? ওর মায়ের চরিত্র নিয়ে অবধি আমার বাপের বাড়িতে প্রশ্ন ওঠে। সেই মেয়েকে আমার ছেলে কী করে পছন্দ করতে পারে?
মাশরুর আহমেদ তর্ক করার চেষ্টা করলেন না। আশফিনা আহমেদের মাথা গরম, উল্টোপাল্টা বলবেন এখন। তার সাথে তর্ক বাড়িয়ে লাভ নেই তবে রঙ্গন যদি সত্যিই চিত্রলেখাকে ভালোবেসে থেকে, এটা একটা চিন্তার বিষয়। চিত্রলেখার পরিবারের সাথে ইতোমধ্যেই একটা মনোমালিন্য তার শ্বশুরবাড়ির লোকদের রয়েছে। আশফিনা তো চিত্রলেখাকে দু’চোখে সহ্য করতে পারে না। রঙ্গন জেনে বুঝে চিত্রলেখাকে অগ্নিপরীক্ষার মাঝে এনে ফেলছে। মেয়েটা অনেক কষ্ট পেয়েছে জীবনে। ও একটা স্বাভাবিক জীবন ডিসার্ভ করে। এই শ্বশুরবাড়ির ঝামেলা কিংবা পারিবারিক মনোমালিন্য তার ভাগ্যে আর থাকা উচিত নয়। রঙ্গন আজীবন তাকে রক্ষা করে চলতে পারবে? এ ভালোবাসা স্থায়ী নাকি রঙ বদলাবে? মাশরুর আহমেদের মনে রঙ্গনকে নিয়ে প্রশ্নের ভাণ্ডার সৃষ্টি হয়। ছেলেটা তার মায়ের হাতে গড়া, এখন সৃষ্টিকর্তা ভালো জানে সে কী করতে চলেছে।
___________________
চিত্রলেখার হোস্টেলের ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে আছে রঙ্গন। শীতে হাত পা মনে হচ্ছে জমে আছে। হুডিতে মোটেও উষ্ণ অনুভব হচ্ছে না। চিত্রলেখার নম্বর ডায়াল করলো সে। চারবার রিং হলো তারপর সে রিসিভ করলো।
-চিত্রলেখা, একটু বারান্দায় আসবে?
-কেন? তাও এত রাতে?
-আসবে একটু?
রঙ্গনের আকুতিতে মন গললো চিত্রলেখার। চাদরে আবৃত করলো নিজেকে। অতঃপর বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। রঙ্গন নিচে দাঁড়িয়ে।
-আপনি এত রাতে এখানে এসেছেন কেন?
-খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলার জন্য যেটা ঝিলে পা ডুবিয়ে বসে বলতে চেয়েছিলাম।
-কী কথা? বলুন।
-আচ্ছা তুমি কি সবসময় আমাকে আপনি আপনি করে বলবে? আমায় তুমি করে কবে বলবে? আমার ‘ফরেভার বন্ধু’ হবে চিত্রলেখা যার কোলে মাথা রেখে আমি রাতের আঁধারে আলো খুঁজে বেড়াবো?
-এত রাতে এসব বলার জন্য ….
-এখনি উত্তর দিও না। সময় আছে তোমার কাছে, আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো চিত্রলেখা। এখন ভেতরে যাও, ঠাণ্ডা লাগবে তোমার।
চিত্রলেখা গেল না। রঙ্গন চোখের আড়াল হওয়া অবধি সে গভীর নয়নে কেবল দেখে গেল এ পাগল প্রেমিকের পাগলামি। মানুষ নাকি প্রেমে পড়লে সব ভুলে যায়। রঙ্গনকে দেখে কথাটা সত্যিই মনে হচ্ছে চিত্রলেখার। ছেলেটা আদৌ এত ভালোবেসে ফেলেছে তাকে? চিত্রলেখা কি বিশ্বাস করতে পারে রঙ্গনকে? সেও যদি একসময় চিত্রলেখার বাবার মতো হয়ে যায়! কেন যেন ভয় হয় চিত্রলেখার। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে নিজের ঘরে ঢোকে সে।
চিত্রলেখা ঘরে ঢুকতেই সঞ্চারী সন্দিহান চোখে তাকালো। চিত্রলেখা এড়িয়ে যেতে চাইলো। সঞ্চারী তা হতে দিল না। চিত্রলেখার পাশে বসে মুচকি হাসতে লাগলো।
-তা কবে দেখা করাচ্ছিস জামাইবাবুর সাথে?
-কিসের জামাইবাবু? সঞ্চারী তুই বেশি ভাবিস কেন এতো?
-এত রাতে বারান্দায় তবে কার জন্য গেলি? তাও আবার ফোন আসার সাথে সাথে? কিছু বুঝি না তাইনা? তলে তলে টেম্পু চালাও আর আমরা বললেই হরতাল? এই অহনা উঠ! কী মরার মতো পড়ে আছিস? দেখ লেখার ….
চিত্রলেখা সঞ্চারীর মুখ চেপে ধরলো। এই মেয়ে পারলে এখনি পুরো হোস্টেলবাসীকে মাইকিং করে জানিয়ে দিবে।
-বোন আমার, চুপ কর। সেরকম কিছুই না।
-তো কেমন কিছু?
-এখন না, কাল বলবোনি। ঠাণ্ডা মাথায় বলবো কাল, এখন তুই যা পড়তেছিলি, পড়।
-আমি এখনি শুনবো। বল তুই।
-তুই যেমন ভাবছিস তেমন না!
-তার মানে তোরা প্রেম করতেছিস না….এই তোরা বিয়েও করে ফেলছিস? তোর বিয়ে খাওয়ার কত শখ ছিল আমার! তুই আমার সাথে এমন করতে পারলি লেখু?
-বইন চুপ! ড্রামাকুইন রে। আমার বিয়ে তো দূর প্রেমও হয়নি। উনি আজ শুধু আমাকে তার মনের কথাটুকু বলেছে।
-তুই কী উত্তর দিলি?
-উত্তর দিইনি। উনি সময় দিয়েছেন, এখনি উত্তর দিতে হবে না।
-ছেলে তো ভালোই বোঝে আপনাকে ম্যাডাম। এখন তাড়াতাড়ি তার সাথে সাক্ষাৎ করান। আমি কিন্তু ট্রিট নিবোই, জামাইয়ের টাকা বাঁচাতে আসবি না একদম।
-তুই একটু থাম, যা তো ঘুমা।
-হ্যাঁ হ্যাঁ নাও, কথা বলো তার সাথে। আমি আর কাবাবে হাড্ডি হচ্ছি না।
সঞ্চারী উঠে গেল। চিত্রলেখা হালকা হাসলো। অদ্ভুত একটা অনুভূতি তার সমগ্র মনকে ক্রমান্বয়ে গ্রাস করে চলেছে। এ অনুভূতির নাম কি তবে ভালোবাসা? ফোন ভাইব্রেট করে উঠাতে ঘোর কাটলো চিত্রলেখার। রঙ্গন টেক্সট করেছে,
“তুমি আমায় ভালো না বাসলেও আমরা বন্ধু থাকবো। আমি তোমায় নিজের সবচেয়ে ভালো বন্ধু হিসেবেই দেখি এখনো। ভালোবাসতে গেলে আগে বন্ধুই হতে হয়। তাই বন্ধুত্বটা যত্নে রেখে দিও। ভালোবাসা যদি নাই দিতে পারো, বন্ধুত্বটা কেড়ে নিও না যেন।”
রঙ্গনের আবেগী মেসেজে চিত্রলেখা আরেক দফা হাসলো। এ ছেলেটা আসলেই পাগল প্রেমিক। তবে মারাত্মক সত্য এটা যে চিত্রলেখার মনের আঙিনাতে একটা ছেলে ধীর পায়ে এক্কা দোক্কা খেলছে।
চলবে…
[আজকের পর্বে একটু সুখ-শান্তি থাকুক। পরেরটাতে অশান্তি আসতেছে😶]