চিত্রলেখার_কাব্য সাতচল্লিশতম_পর্ব ~মিহি

0
489

#চিত্রলেখার_কাব্য
সাতচল্লিশতম_পর্ব
~মিহি

তৌহিদ নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। আশফিনা আহমেদের এই অকস্মাৎ পরিবর্তন তার সমস্ত বিশ্বাসকে কাঁচের ন্যায় ভেঙে ফেলেছে। নওশাদের ঠোঁটের কোণে ভেসে থাকা কুৎসিত হাসিটা তার চোখে লাগছে। নিজেকে প্রচণ্ড অসহায় মনে হচ্ছে তার। আশফিনা আহমেদ প্রমাণগুলো নওশাদকে দিবেন এটা সে ভুলেও ভাবেনি।

-তোমায় বারবার আমি বাঁচাতে আসবো না নওশাদ! ভাই হয়েছো বলেই সবসময় পার পেয়ে যাবে তা ভেবো না। নির্ঘাত চিত্রলেখাকে আমিও পছন্দ করিনা বলে এবার বাঁচালাম। তুমি এসব কেন করেছো ওর সাথে?

-আপা, দোষ ঐ মেয়েটার। চুপচাপ বিয়ের জন্য রাজি হলেই পারতো! তাহলে পরীক্ষাও শান্তিতে দিতে দিতাম আর ওর ভাবীকে আমি শুধু ভয় দেখানোর জন্য লোক পাঠিয়েছি। ওরা ঐ মহিলাকে রেপ করবে তা কি আমি জানতাম? তাছাড়াও ঐটার টাকার লোভ বেশি, এটুকু শাস্তি পাওয়া দরকার ছিল।

-নওশাদ, জীবনে যত পাপ করেছো! এখন একটু ভালো হও।

-কিসের ভালো? এখন ক্ষমতাই নাই দেখে কি প্রভাবও কমছে? আরো দশটা মেয়েকে তুলে আনবো কেউ কিছু করতে পারবে না। তোমার সামনে ভালো সাজছি অনেক, এখন তো জানোই সব। এখন তুমি আমাকে আটকাতে চাইলেও পারবেনা।

-তুমি একটা এলাকার দায়িত্বরত চেয়ারম্যান ছিলে নওশাদ!

-তখনো এসব করছি, এখনো করবো। বাদ দাও আপা, চিত্রলেখার ক্ষতি হলে তো তোমারই লাভ। নিজের লাভ দেখো আর এই তৌহিদরে মেরে রেখেই যাই, শালা কাউকে বলে দিলে বিপদ!

-ওর ব্যবস্থা আমি করছি, যাও এখান থেকে। আর এসব প্রমাণ পুড়িয়ে ফেলো আগে।

নওশাদ মাথা নেড়ে চলে যায়। আশফিনা আহমেদ আসলেই তার আদর্শ বোন। ভাইকে তো এভাবেই আগলে রাখতে হয়! নওশাদ ক্রুর হাসি হাসে। পরের আঘাতটা সে এই আদরের বোনের আদরের সন্তানকেই করবে ভেবে তার পিশাচ মন প্রফুল্ল হয়ে উঠে।

তৌহিদের চোখের কোণে জল চিকচিক করছে। তার সমস্ত চেষ্টা আশফিনা আহমেদ এক নিমেষে ধ্বংস করে ফেলল। মনে মনে যত জানা গালি ছিল সব মহিলাটার উপর প্রয়োগ করলো সে। তৌহিদের হাত বাঁধা থাকায় কিছু করতেও পারছে না সে। নওশাদকে ডাকার আগেই তিনি সুকৌশলে তৌহিদের হাত বেঁধে ফেলেন। হাতে খানিকটা ব্যথাও করছে এখন তবুও কিছু করার নেই তৌহিদের।

-পানি খাবে তৌহিদ?

-বিষ অফার করতেন এর চেয়ে! আপনার ছেলে যে মেয়েটাকে ভালোবাসে তার লাইফ নিয়ে এভাবে খেলছেন? মেয়েটার অবস্থা জানেন? ঐ মেয়েটা জন্মের পর থেকে বাবার ভালোবাসা পায়নি, মাকে অত্যাচারিত হতে দেখেছে। যখন বড় ভাই পাশে ছিল তখন ছোট ভাইয়ের অবহেলা সহ্য করেছে। দিনশেষে তার চরিত্রে অবধি দাগ লাগানো হয়েছে। এত যুদ্ধের পর মেয়েটা যখন স্বপ্ন পূরণে মন দিল, আপনার ঐ পিশাচ ভাই তার পরীক্ষার হলে তাকে বেরং বিরক্ত করলো, হ্যারাস করলো! আপনার মনে নূন্যতম বিবেক কাজ করেনা? আরে আপনিও তো মেয়ে!

-আগে মাথা ঠাণ্ডা করো। আমার বিবেক কাজ করে বলেই আমি সঠিক কাজটা করেছি। তোমার মতো আবেগ দিয়ে কোর্ট চলেনা। তুমি যা প্রমাণ এনেছো তা ভুল বানাতে নওশাদের দশ সেকেন্ড লাগতো না!

-সেজন্য প্রমাণ ওর হাতেই তুলে দিলেন! সাবাশ!

আশফিনা আহমেদ বিরক্ত হলেন। এত বেশি কথা বলার স্বভাব ছেলেটার! এমন করলে জীবনেও ভালো কিছু করতে পারবে না। আশফিনা আহমেদ কথা বাড়ালেন না। ঘর থেকে নিজের ল্যাপটপটা নিয়ে এসে তৌহিদের দিকে ঘোরালেন। তৌহিদ খেয়াল করলো একটু আগে নওশাদের বলা প্রতিটি কথা এখানে রেকর্ড হয়েছে। ভ্রু কুঁচকালো সে। আসলে ঘটনাটা কোন দিকে মোড় নিচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না সে। আশফিনা আহমেদ আসলে কী করতে চাচ্ছেন তা ভেবেই মাথা ঘুরাচ্ছে তার।

_________________________

-রঙ্গন, ভাইয়ার সাথে যোগাযোগ হয়নি। আমার প্রচণ্ড অস্বস্তি হচ্ছে। এখানে মন টিকছে না আমার। আমি আপাতত বাড়িতে ফিরতে চাই।

-আমি টিকিট কেটে রাখবোনি সকালের। আমি নিয়ে যাবো, এখন একটু শান্ত হও তুমি।

চিত্রলেখা মলিন হেসে রঙ্গনের দিকে তাকায়। সামনে ব্যস্ত রাস্তা। সবকিছু যেন মুহূর্তে থমকে গেল। চিত্রলেখার সমস্ত ধ্যানজ্ঞান রঙ্গনকে ঘিরে আবদ্ধ হলো।

-টিএসসি এলাকাটা সুন্দর বুঝছো? ঠিক তোমার মুখের হাসির মতো আর এই ঢাকা শহরের খাবার দাবার তোমার মলিন মুখের মতো।

চিত্রলেখা এবার হেসে ফেলল। কথাটা ভুল বলেনি রঙ্গন। দিন কয়েকেই ঢাকার খাবার দাবারের উপর থেকে মন উঠে গেছে তার। হয়তো অভ্যেস নেই বলে ভালো লাগছে না।

-কথা ঠিক বলেছেন। ঢাকার খাবার দাবার আমার মলিন মুখের মতোই!

-অনিক ভাইয়া তোমায় বাইরে আসতে দিল কিভাবে আজ? ভাবতে পারিনি তুমি আসতে পারবে।

-ভাবী জানে। ভাবীই ভাইয়াকে ম্যানেজ করেছে।

-আপা আর ভাইয়ার প্রেমটা ভালোই। আমাদের সংসার হলে আমিও এমন তোমার সব কথা শুনবো।

-তো বিয়ে কবে করতেছেন?

-অতীব শীঘ্রই ডাক্তার সাহেবা। আচ্ছা বাস তো সম্ভবত সকাল নয়টার আছে। তোমায় রাতের বাসে তো নিয়ে যাওয়া রিস্কি, কোনো হেলথ ইস্যু আছে তোমার?

-ট্রেনে যাওয়া যায় না?

-তোমার যদি পক্ষীরাজ ঘোড়াতেও যেতে মন চায় আমি ম্যানেজ করবো তবুও হাসিখুশি থাকো। তোমার মন খারাপ দেখলে আমার মনে অমাবস্যার আঁধার ছেয়ে যায়।

-থাক হইছে! এত সাহিত্যমাখা কথা বলতে হবে না। আপনার সাথে ভাইয়া আমাকে যেতে দিবে বলে তো মনে হয়না। আমি ভাবীর সাথে যেতে পারবো।

-আজব তো! আমি কী দোষ করছি? এই চলো তো বিয়ে করবো। বিয়ে করে বউ নিয়ে নিজের বাড়ি যাবো। শালাদের এত অত্যাচার এত ভালো লাগে না!

-এই কী বললেন আপনি?

-না মানে তোমার ভাই! তারা তো আমার শালা, তাই না?

-আপনি অফিস বাদ দিয়ে আমার সাথে বসে আছেন। কাজ নাই অফিসে?

-একদিন আমার রঙ্গনাকে সময় দিতে ছুটি নেওয়াই যায়! এসো হেঁটে কথা বলি।

চিত্রলেখা মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে উঠে দাঁড়ালো। ঢাকার রাস্তায় হাঁটার একটা বিশেষত্ব আছে। এস্থেটিক একটা ভাব কাজ করে মনে। ফুলপট্টির কাছে আসতেই চিত্রলেখার চোখ ধাঁধিয়ে আসলো। ফুলপট্টি জায়গাটা বরাবরই এত সুন্দর কেন? রঙ্গন বোধহয় উপলব্ধি করলো বিষয়টা।

চিত্রলেখা বিস্মিত নয়নে কেবল পর্যবেক্ষণ করছিল চারপাশ। রঙ্গন কখন তার হাত ছেড়ে দিয়েছে খেয়াল করেনি সে। আচমকাই তিন রঙের তিনটি জবা তার মুখের সামনে বাড়িয়ে দিল রঙ্গন। ঠোঁটের কোণে মনোমুগ্ধকর হাসি। গানের সুরে বলে বসলো,

“গোলাপ ফুলের জায়গায় আমি দিলাম তোমায় জবা,
বলো তুমি এইবারে কি আমার প্রেমিকা হবা?”

চিত্রলেখা হাত বাড়িয়ে ফুল তিনটা নিয়ে মাথা নিচু করলো। লজ্জার লাল আভা তার গালে শোভা পাচ্ছে। রঙ্গনের বেশ লাগছে এই লজ্জাটুকু উপভোগ করতে। চিত্রলেখার মুখের হাসি তাকে প্রশান্তি দিচ্ছে। এই মেয়েটাকে সে জীবনের এমন একটা পরিস্থিতিতে পেয়েছিল যখন সে নিতান্তই মানসিক ভেঙে পড়েছিল। বন্ধুত্বে বিচ্ছেদ এবং জীবনের অন্যতম একটা লুকানো সত্য জেনে সেই সত্য আড়াল করার প্রচেষ্টা প্রচণ্ডভাবে কুঁড়ে খাচ্ছিল তাকে। কারো সামনে স্বীকারও করতে পারেনি মনের অবস্থা। চিত্রলেখার আগমনটাই যেন তার জীবনে বিশেষ কিছু ছিল। মেয়েটা কখনো তাকে মোটিভেশনাল বাক্য শোনায়নি অথচ তার উপস্থিতিই যেন একেকটা মোটিভেশন। চিত্রলেখা আশেপাশে থাকলে সে সবসময় নিজেকে ভালো অনুভব করতো। এ ভালো থাকার অনুভূতিটাই তাকে চিত্রলেখাকে ভালোবাসতে বাধ্য করেছিল।

-কী ভাবছেন এত?

-শুনেছি প্রেমের মরা জলে ডোবে না। আমি তো সাঁতার জানি না। আমি তো তোমার প্রেমে মরেছি। আমার জলে ডোবার চান্স আছে?

-হে ধরণী দ্বিধা হও! এই লোকটা ফিজিক্সে পড়ে এত ফ্লার্টিং লাইন কোথায় শিখছে?

-পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়েছি বলে প্রেমিক হওয়া যাবে না কি? তোমার মতো আঁতেল ছিলাম না বলেই প্রেমটা করতে পারতেছি!

চিত্রলেখা চোখ গরম করে তাকালো রঙ্গনের দিকে। রঙ্গনের ঠোঁটের হাসি প্রসারিত হলো। চিত্রলেখার রাগী চোখখানার মায়ায় সে একেবারে ধ্বংস হতে প্রস্তুত!

চলবে…

[ঢাকায় আমার যাওয়া মাত্র দুইবার, বিশ্বাস করেন আমি ঢাকার খাবার একদম খেতে পারি নাই। সম্ভবত অভ্যাস নাই দেখেই সমস্যা হয়েছে, ঢাকাইয়া মানুষজন অফেন্ড হইয়েন না🙂]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here