চিত্রলেখার_কাব্য আটাশতম_পর্ব ~মিহি

0
588

#চিত্রলেখার_কাব্য
আটাশতম_পর্ব
~মিহি

অপর্ণা খানিকটা বিরক্তবোধ করছে। নওশাদের অফিসে সে এসেছে তাও ঘণ্টা দুয়েক হবে অথচ তাকে এখনো হলে বসিয়ে রাখা হয়েছে। কিছু বলতেও পারছে না। এবার অপর্ণা খানিকটা বিরক্ত হয়েই নওশাদের নম্বরে কল দিল।

-এসব কী নওশাদ সাহেব? আমাকে অফিসে ডেকে এভাবে বসিয়ে রাখার মানে কী? আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন।

-আপনি ভেতরে আসুন। কেউ আটকাবে না।

অপর্ণা খট করে কল কেটে বেশ রাগী ভঙ্গিতে নওশাদের কেবিনে ঢুকলো। নওশাদ অপর্ণার আসার অপেক্ষায় ছিল তবুও অপর্ণাকে বাইরে বসিয়ে রেখেছিল ইচ্ছে করেই। অপর্ণা নওশাদের মুখোমুখি বসলো।

-ভালো আছেন অপর্ণা ভাবী?

-ভালো আর কই থাকলাম ভাই। যার দেবর কয়দিন আগে জেল থেকে বেরোলো তার কী আর ভালো থাকা যায়? মানুষ থাকতে দেয় ভালো?

-অযথা চিন্তা করতেছো অপর্ণা! অনিককে দুয়েকদিন এসব ঝামেলা সহ্য করতে হতে পারে। তোমাকে যে কারণে ডাকছি সেটা শোনো।

-জ্বী বলেন!

-লেখাকে আমার পছন্দ। বলতে গেলে বিয়েতে আমার আপত্তি নেই। বুঝতেই পারতেছো। এখন চিত্রলেখার আপত্তি থাকতে পারে। সেসব দেখার বিষয় তোমার। বিয়েটা যদি ঠিকমতো হয়, তাহলে লেখা সুখেই থাকবে। পাশাপাশি তোমাদেরও সুখের অভাব হবে না। বোঝোই তো।

-সব ঠিকই আছে কিন্তু আপনার বয়সটা..বুঝতেই পারছেন। এসব ম্যানেজ করতে হবে তো। আপাতত ভাবী হিসেবে কিছু উপহার তো পেতেই পারি।

নওশাদ হাসলো। এই মহিলা যে লোভী তা সে আগেই বুঝেছে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থাও করেছে। ড্রয়ারে থাকা নেকলেসটা বের করে অপর্ণার হাতে তুলে দিল।

-ভাবীসাহেবা, আরো উপহার কিন্তু অপেক্ষা করছে। আপনি শুধু বিয়ের বাজনাটা বাজানোর ব্যবস্থা করুন।

অপর্ণা হাসিমুখে নেকলেসটা নিয়ে আরো কিছুক্ষণ হাসিঠাট্টা করলো। অতঃপর নওশাদের অফিস থেকে বেরিয়ে এসে ভাবলো কী করা যায়। অর্ণবকে কিছু একটা বুঝিয়ে রাজি করাতে হবে। অপর্ণা নানান চিন্তাভাবনা করতে করতে বাড়ি ফিরলো। নেকলেসটা ব্যাগে বেশ যত্নে রেখেছে সে। আজ মায়ের বাড়িতে যাবে সে। নিজের মায়ের থেকে এ বিষয়ে পরামর্শ নিবে। চিত্রলেখা নামক আপদটা যখন ভালোই ভালোই ঘাড় থেকে নামছে তখন অযথা তাকে পোষার কোনো দরকারই নেই।

________________

ক্লাসটা বড্ড বিরক্ত লাগছে চিত্রলেখার। ম্যাথ ক্লাসে এসে স্যার ইতিহাস বোঝাচ্ছেন। কী আজব! চিত্রলেখার বারবার হাই উঠছে। শেষমেশ বিরক্ত হয়ে ফোন বের করলো সে। রঙ্গনকে কি একবার টেক্সট করবে? দ্বিধাদ্বন্দ্বে শেষমেশ করেই ফেললো টেক্সট।

-ব্যস্ত?

রঙ্গনের রিপ্লাই আসলো না। চিত্রলেখা আবারো মন খারাপ করে ক্লাসে মনোযোগ দিল। কোনমতে ক্লাসে মন বসাতে পারছে না সে। অদ্ভুতভাবে রঙ্গনের উপরেই তার মন পড়ে আছে। রঙ্গনের বলা কথাগুলো তার কানে বাজছে। যতবার সে রঙ্গনের কথা মনে করছে, ততবার ঠোঁটের কোণে এক প্রসারিত হাসি ঝুলছে।

রঙ্গন বাড়িতে আসার পর থেকে আশফিনা আহমেদ তার সাথে একটাও কথা বলেননি। রঙ্গনও কিছু বলতে যায়নি। বাড়িতে ঢুকেই মাথাব্যথার ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়েছে সে। আপাতত কোনোরকম হৈহৈ-রৈরৈ এর মধ্যে সে থাকতে চায় না। কিন্তু অহমের ডাকাডাকিতে ঘুম বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না তার।

-এই ভাইয়া, ভাবী টেক্সট করছে উঠ!

রঙ্গন লাফ দিয়ে উঠলো। অহম কী বলছে এসব! চটজলদি উঠে নিজের ফোনটা অহমের হাতে দেখে খানিকটা ঘাবড়ালো সে। তড়িৎ গতিতে ফোনটা কেড়ে নিল।

-তো শেষমেশ আমার কথাই সত্যি হলো ভাইয়া!

-অহম, বিরক্ত করিস না তো যা।

-ভাবীর সাথে দেখা করাও তো। অনেকদিন হলো দেখিই না, এখন তো পরীক্ষাও ভালো দিয়েছি। এখন দেখা করাই যায়।

-তোর ভাই-ই দেখা করতে পারতেছে না আর তো তুই! তার চেয়ে বড় কথা তোর ভাবী এখনো আমাকে এক্সেপ্ট করেনি।

-আহারে বেচারা, করে নিবে নাও। মুখে না বললেও বুঝে নিও। এখন গেলাম আমি। তোমাদের কাবাবে হাড্ডি হয়ে আমার লাভ নাই।

অহম চলে যেতেই চিত্রলেখার নম্বর মেসেজ করলো রঙ্গন।

-না আসলে ঘুমিয়েছিলাম, মাথাব্যথা করছিল।

চিত্রলেখার হাতেই ফোন ছিল। সে চটজলদি রিপ্লাই করলো,

-ওহ, শরীর কি বেশি খারাপ?

-না। কিছু বলবে?

-আপনার অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রহর থেকে কিছু তুচ্ছ মুহূর্ত ধার নিতে পারি?

-যা বলবেন আপনি!

-আর এক ঘণ্টার মধ্যে আমার ক্লাস শেষ। কলেজের বাইরে অপেক্ষা করতে পারবেন?

-হ্যাঁ। তুমি ক্লাস শেষ করে কল দিও। আমি ফাইরে অপেক্ষা করবো।

-আচ্ছা।

চিত্রলেখার একেকটা টেক্সট রঙ্গনের বুকে আঘাত করছে যেন। চিত্রলেখা তার দুঃসময়ের বন্ধু থেকে কি তবে প্রেয়সী হতে চললো?

_____________

অর্ণব দুপুরের খাবার বাড়িতে বসেই খাচ্ছে। ব্যবসার অবস্থা যথেষ্ট খারাপ। বিক্রি নেই বললেই চলে, অদ্ভুতভাবে তাদের দোকানের ডিমান্ড যেন একেবারে তলানিতে মিশে গেছে। এ অবস্থায় কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না অর্ণব। তার উপর এখন অনিকেরও চাকরি নেই। সব মিলিয়ে দায়িত্বটা অর্ণবের কাঁধেই পড়েছে। এ বিষয় নিয়ে সে কারো সাথে কথাও বলতে পারছে না। অপর্ণাকে বললে সে বাড়াবাড়ি করবে নিশ্চিত আর অনিককে বললে সে দুশ্চিন্তা করবে। একাকী খেতে খেতে নানান প্রশ্ন অর্ণবের মাথায় এসে জট পাকাচ্ছে।

-অর্ণব শোনো।

-হ্যাঁ বলো কী হয়েছে।

-আমি একটু মায়ের ওখানে যাবো আজ, বাচ্চাদের নিয়ে আসতে।

-আমি রেখে আসবো?

-না আমি যেতে পারবো।

-আচ্ছা যাও।

-কিছু টাকা দাও তো। বাড়িতে যাচ্ছি, কিছু নিয়ে যাবো।

-গত পরশুই তো তিন হাজার টাকা নিলে, ওখান থেকে কিছু কেনো।

-ওটা খরচ হয়ে গেছে।

-কোথায়?

-ধূর! এত জেরা করার কী আছে আজব, লাগবে না তোমার টাকা। টাকার উপর শুয়ে থাকো ভাইকে নিয়ে।

অপর্ণা খানিকটা রূক্ষভাবেই বললো। অর্ণবের ইচ্ছে করছে না অপর্ণার সাথে তর্কে জড়াতে, অযথা যাওয়ার আগে ঝামেলা করতে চাইছে! অর্ণব চুপচাপ খেতে লাগলো। অপর্ণাও আর কথা বাড়ালো না তবে সাথী দূর থেকে এই দৃশ্যটা দেখলো। রান্নাঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল সে। তরকারির বাটিটা এনে টেবিলে রাখলো সে।

-ভাইয়া কিছু হয়েছে? আপনাকে চিন্তিত মনে হচ্ছে খুব।

-না সাথী, কিছু হয়নি। অনিকের শরীরের কী অবস্থা? সকালে তো দেখলাম ঘুমোচ্ছিল।

-ওর কী হয়েছে বুঝতে পারছি না ভাইয়া। চাকরিটা চলে যাওয়ার পর থেকে খুব ভেঙে পড়েছে, কোনোভাবেই বোঝাতে পারছি না কিছু।

-চিন্তা করো না। যাও ওর কাছে থাকো।

সাথী মাথা নেড়ে চলে গেল। বাড়িতে সুখ শান্তির ছিটেফোঁটাও যেন নেই। চিত্রলেখা বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পর বাড়িতে একটা কিছুও ভালো হচ্ছে না। এর দায়টা অপর্ণার! তবুও মুখ ফুটে সেসব বলতে পারেনা সাথী।

______________

ঝিলের পানিতে পা ডুবিয়ে চুপচাপ বসে আছে চিত্রলেখা। রঙ্গন পাশে বসে চিত্রলেখাকে দেখছে। মেয়েটার চোখেমুখে আজ অন্যরকম দ্যুতি। সদ্য প্রেমে পড়া একটা আভা জ্বলজ্বলে করছে তার চাহনিতে তবুও মেয়েটা স্বীকার করছে না ভেবে খানিকটা মনোঃক্ষুণ্ন হয় রঙ্গন।

-আপনি জিজ্ঞাসা করলেন না তো কেন আপনাকে এখানে ডেকেছি।

-কেন ডেকেছো?

-আপনাকে একটা সত্যি কথা বলবো। তারপর যদি আপনার মনে হয় আমি আপনার যোগ্য তবেই আমাদের আগানো উচিত হবে।

-বলো।

-আপনার মামার যেসব ছবি ভাইরাল হয়েছিল সেসব আমি করেছিলাম।

-কিন্তু কেন?

-আপনার মামা আমায় বাজেভাবে স্পর্শ করার চেষ্টা করেছিলেন।

-এসব তুমি আমাকে আগে বলোনি কেন?

-আগে বললে কী হতো? প্রেমের শখ জাগতো না আপনার? প্রপোজ করতেন না? নাকি নিজের মামার এ রূপটা মেনে নিতে পারতেন? আপনি পারতেন বিশ্বাস করতে এটা এত সহজে? আপনার মা না থাকলে হয়তো আমি সেদিন বাঁচতাম না। উনার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। উনি যদি না চান তাহলে আমি কখনোই আপনার সাথে জড়াবো না রঙ্গন।

-তুমি আমাকে ভালোবাসো চিত্রলেখা?

চিত্রলেখা নিশ্চুপ হয়ে গেল। রঙ্গনকে সে কেন বোঝাতে পারছে না এসব কিছুর পরিণতি কতটা অনিশ্চিত! তার বলা সামান্য একটা বাক্য দুটো পরিবারকে ধ্বংস করে দিতে পারে। সে চায় না তার জন্য তার ভাবীর জীবনে নতুন করে কোনো ঝামেলার সৃষ্টি হোক।

-আমি তোমাকেই বিয়ে করবো চিত্রলেখা। তুমি শুধু রাজি থেকো। আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুটাকে আমি ভালোবাসার মানুষ হিসেবেই পাশে রাখতে চাই সবার অনুমতি নিয়েই। তখন নিষেধ করো না যেন।

চিত্রলেখা জানে এটা কখনো সম্ভব না। আশফিনা আহমেদ মরে যাবেন তবুও তাকে নিজের পুত্রবধূ হিসেবে মানবেন না।

চলবে …

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here