চিত্রলেখার_কাব্য চতুর্দশ_পর্ব ~মিহি

0
680

#চিত্রলেখার_কাব্য
চতুর্দশ_পর্ব
~মিহি

চিত্রলেখা শুক্রবারের দুপুরে ঘুম থেকে উঠেই জানলো তাকে একটু পর দেখতে আসবে। ধড়ফড় করে উঠে বসলো সে। অপর্ণার কথা বিশ্বাস করতে একটু কষ্ট হলো তার। উপস্থিত কেউই যেন বিশ্বাস করতে চাইলো না অপর্ণার কথা। সবচেয়ে বেশি ক্রোধ ফুটে উঠলো অর্ণবের মুখে।

-অপর্ণা, তোমাকে আমি অনুমতি দিয়েছিলাম কি আমার বোনের জন্য সম্বন্ধ দেখতে? কেন তাদের ডেকেছো তুমি?

-তো বোনকে কতদিন বসে খাওয়াবা? কয়দিন পর পালায়ে গেলে? ছেলে ভালো, এসে দেখে যাক আগে।

-তোমার সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি।

অর্ণবের উচ্চস্বরে দমলো না অপর্ণা। ঝগড়া সেও পাল্টা করেই গেল। অনিক বিরক্তির চোখে দৃশ্যগুলো অবলোকন করছিল। শেষমেশ দুজনকে থামালো সে।

-দেখো ভাইয়া, ভাবী যেহেতু তাদের ডেকে ফেলেছে তারা আসুক। লেখাকে দেখে যাক, পছন্দ না হলে আমরা রিজেক্ট করে দিব। কাউকে বাড়িতে ডেকে নিষেধ করে দেওয়াটা ভালো দেখাবে না।

-আচ্ছা ঠিক আছে। অপর্ণা যাও নাস্তার আয়োজন করো।

চিত্রলেখা কিছুই বললো না। সে যেন জীবিতই নেই। তার মতামত কেউ নেওয়ার প্রয়োজনই বোধ করলো না। সাথী বোধহয় ব্যাপারটা বুঝতে পারলো। সকলে রুম ত্যাগ করতেই সে চিত্রলেখার পাশে বসলো।

-মন খারাপ করছিস যে কেউ তোর কথা জানতে চাইল না?

-মন খারাপ করে কী হবে ভাবী? যা হওয়ার তা হবেই।

-তুই বারবার হতে দিস বলেই হয়। অপর্ণা আপা সম্পর্কে আমার বড় হলেও তার প্রতি আমার মনে আর সম্মান অবশিষ্ট নাই শুধু তোর কারণে কিছু বলা যায় না। তুই এত নরম হলি কেন? তোকে দেখলে আমার ভয় হয়। অন্যের কথায় যে সব ছেড়ে দিতে পারে তার অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়ে।

-আমার অস্তিত্ব কোথায়? আমিও তো অনুভব করতে পারছি না। তুমি যাও, আমি রেডি হই।

-শাড়ি পড়তে হবে না, জামা পড়। তোর সাধের বড় ভাবীর পছন্দে আমার তিল পরিমাণ বিশ্বাস নেই। তার জন্য সঙ সাজতে হবে না তোকে।

-আচ্ছা যাও।

সাথী বের হতেই দরজা লাগিয়ে দিল চিত্রলেখা। আলমারি থেকে একটা নতুন জামা বের করে পড়লো। এসব বড় ভাবী কিনে দিয়েছিল তাকে, এখানেই রেখে গেছে সে। আলমারির এক কোণে পড়ে আছে চিত্রলেখার মায়ের চাদর। মায়ের কিছুই সে পায়নি। শাড়ি, গয়না সব বড় ভাবীর দখলে। সামান্য এ চাদরটা সে নিজের কাছে যত্নে রেখেছিল। মায়ের কথা তেমন মনে পড়ে না তার। দুর্বিষহ সে দিনগুলো ভোলাই ভালো। চিত্রলেখার ফোন বেজে উঠে। সিয়াম কল করেছে। রিসিভ করবে কিনা ভাবতে ভাবতেই কল কেটে যায়। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চিত্রলেখা। কারো সাথেই কথা বলতে ইচ্ছে করছে না তার। জীবনের এই পরিস্থিতিটাকে কী বলা যায় যেখানে সে থমকে আছে অথচ চোখের পলকে চারপাশ পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে? দীর্ঘশ্বাস ব্যতীত কিছুই যেন আপন মনে হচ্ছে না তার। সিয়াম আবারো কল করলো। চিত্রলেখা এবারো রিসিভ করলো না। সিয়ামের তার প্রতি অতিরিক্ত চিন্তা চিত্রলেখার জন্য অমঙ্গলের। দরজায় শব্দ করলো সাথী।

-লেখা হয়েছে তোর?

-হ্যাঁ ভাবী, খুলছি দরজা।

চিত্রলেখা দরজা খুললো। মুখে ম্লান হাসি, অবশ্য এখন চিত্রলেখার ঠোঁটের কোণে হাসি আশা করাটাই বেমানান। সাথীর বড্ড মায়া লাগে মেয়েটার প্রতি। মনে হয় একটু যদি মেয়েটাকে হাসিখুশি রাখা যেত।

-কী ভাবছো ভাবী?

-ওনারা চলে আসবে একটু পর। তুই আমি না আসা অবধি বের হবি না।তোর বড় ভাবীর পছন্দ আগে পরখ করি তার আগে তোকে ওদের সামনে আনবো না।

-এত সন্দেহ করো না তো ভাবী। যা হবে দেখা যাবে।

সাথী চুপ করলো। চিত্রলেখা মেয়েটা বেশি চিন্তামুক্ত হয়ে পড়েছে নাকি জীবনের প্রতি আর কোনো মায়াই অবশিষ্ট নেই তার? কত সহজে সবকিছু মেনে নিচ্ছে!

_______________

অন্তর বেশ অস্বস্তি বোধ করছে। তার মা বেশ রসিয়ে আলাপ করলেও সে এসবে সায় দিতে পারছে না। সে এসেছে মেয়ে দেখতে, এসব দুনিয়ার প্যাঁচাল শুনতে কী আর ভালো লাগে?

-অনেক সময় তো হলো, মেয়েকে ডাকলে ভালো হতো।

-আরে একটু বসুন। মেয়ে আসছে।

অন্তরের উতলা ভাব বেশ বুঝতে পারে সাথী। লোকটাকে তার মোটেও সুবিধের মনে হচ্ছে না। বয়স পঁয়ত্রিশের কাছাকাছি। থাকেও প্রবাসে, বিয়ে করে সেখানেই চলে যাবে আবার। এই ছেলেকে দেখামাত্র না বলা যায়। তার সামনে চিত্রলেখাকে আনার ভুল সাথী করবে না। অর্ণবকে বিষয়টা আড়ালে বলার জন্য উদ্যত হলো সে। এরই মধ্যে অপর্ণা সঙ্কট হয়ে দণ্ডায়মান হলো।

-আরে সে কী? এতক্ষণ ধরে সাজছে নাকি লেখা? আমাদের মেয়ে এমনিই সুন্দর। অন্তর, তুমি এক কাজ করো। ওর ঘরে গিয়ে কথা বলে ওকে নিয়ে এসো। এইতো সোজা গিয়ে ডানপাশের ঘরটাই ওর।

-ধন্যবাদ।

অন্তর অনেকটা লাফ দিয়ে নিজের জায়গা ছেড়ে উঠলো। অন্তরের মায়ের এত উতলা ভাব পছন্দ হলো না তবুও চুপ রইলেন তিনি।

অন্তর চিত্রলেখার ঘরের দরজায় টোকা দিল। সাথী ভেবে দরজা খুললো চিত্রলেখা। চোখের সামনে অপরিচিত মানুষকে দেখেই খানিকটা বিব্রতবোধ করলো সে। অদ্ভুত তো! লোকটা সোজা তার ঘরে এসেছে কেন?

-এত অবাক হচ্ছো যেন আমাকে আশাই করোনি।

-না আসলে..

-তুমি কিন্তু মারাত্মক সুন্দর।

চিত্রলেখা বিরক্ত হলো। প্রথমত লোকটা তার অনুমতি ছাড়াই তার ঘরে প্রবেশ করেছে। দ্বিতীয়ত লোকটার তাকানোর ভঙ্গি বেশ অস্বস্তিকর।

-তো তুমি এখনো পড়াশোনা করছো?

-জ্বী।

-বেশ ভালো। বিয়ের পরও কন্টিনিউ করতে পারবা, আমার সমস্যা নাই।

চিত্রলেখা লোকটার দিকে তাকালো। তার চোখ অন্য কথা বলছে। চিত্রলেখা স্পষ্ট বুঝতে পারলো লোকটার চাহনি বলছে, একবার পায় তোমায়, বেঁধে রাখবো সংসারে। চিত্রলেখার উত্তর না পেয়ে আবারো কথা বাড়ানোর চেষ্টা করলো অন্তর।

-তো তোমার শখ কী?

-তেমন শখ নেই।

-ওহ।

অন্তর আর কিছু বলার আগেই বাইরে থেকে ডাক পড়লো দুজনের। চিত্রলেখা স্বস্তি পেল। অন্তরকে রেখে সে আগে আগেই বেরিয়ে এলো। চিত্রলেখার তড়িৎ গতিতে আসাটা পছন্দ হলো অন্তরের মায়ের। মেয়েমানুষ এত দ্রুত হাঁটবে কেন? ভ্রু কুঁচকালেন তিনি।

-তো মেয়ে, এত জোরে হেঁটে তো আসছো, দেখি এখন কাজেকর্মে জোর কতো। রান্না পারো?

চিত্রলেখাকে বলার সুযোগই দিল অপর্ণা। সেই উত্তর করতে লাগলো।

-পারে? আরে আমাদের রান্না তো বেশিরভাগ ওই করে। এত সুন্দর রান্নার হাত খালাম্মা, আপনি একবার খেলে আর কারো হাতের রান্না খেতেই পারবেন না।

-ভালো তো। চাকরি বাকরির ইচ্ছে আছে নাকি?

চিত্রলেখা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সে নীরব থেকে বোঝার চেষ্টা করছে বিষয়টা কতদূর গড়ায়।

-ও মা মেয়ে বোবা নাকি?

-বোবা হলেই বোধহয় ভালো হতো তাইনা? এই যে হাঁটার খোঁটা, চাকরি সংক্রান্ত প্রশ্ন এসবের উত্তর দিতে হতো না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিয়ের পর আপনার কথার উপরে কথা বলার ক্ষমতাই থাকতো না! আপনার ছেলেকে একটা সুন্দরী বোবা দেখে বিয়ে দেন খালাম্মা।

চিত্রলেখার শান্ত স্বরে বলা বাক্যটা অন্তরের মায়ের মগজ চিরতে সময় নিল না। অগ্নিচোখে তিনি প্রত্যক্ষ করলেন চিত্রলেখাকে।

-বেয়াদব কোথাকার! বড়দের প্রতি সম্মান নাই। ছিঃ ছিঃ!

এতক্ষণে অর্ণবেরও ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে। এতক্ষণ ধরে অন্তরের মা নিজের ছেলের নামে যে সমুদ্রসম প্রশংসার ফোয়ারা ছোটাচ্ছিল তাতেই এদের পারিবারিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা হয়েছে তার। এবার সেও প্রত্যুত্তর করলো।

-জ্বী, আমার বোনকে আদবের শিক্ষা দেইনি। আপনি এবং আপনার শিক্ষিত ছেলে সসম্মানে বেরিয়ে যান।

-এতবড় অপমান! এ মেয়েকে কেউ যদি বিয়ে করে!

অর্ণব কিছু বলার আগেই কলিং বেলের শব্দ হলো। সাথী দরজা খুলতে গেল। দরজা খুলতেই অপর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ অফিসারদের দেখে ভ্রু কুঁচকালো সে।

“আমরা অনিক মাহমুদের সাথে দেখা করতে চাই। তার উপর এটেম্পট টু রেপের চার্জ আছে। তিনি একজন মেয়েকে মলেস্ট করার ট্রাই করে পালিয়ে এসেছেন।” অফিসারের কথাটা সাথীর কানে ভ্রমরের ভোঁ ভোঁ শব্দের ন্যায় ধাক্কা দিল। এক মুহূর্তে বাড়ির পরিস্থিতি বদলে পরিণত হলো সঙ্কটারণ্যে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here