চিত্রলেখার_কাব্য চুয়াল্লিশতম_পর্ব ~মিহি

0
571

#চিত্রলেখার_কাব্য
চুয়াল্লিশতম_পর্ব
~মিহি

আজ রঙ্গনের জন্মদিন। সপ্তাহ তিনেক হলো রঙ্গনের চিত্রলেখার সাথে কথা হয় না। রঙ্গন প্রতিমুহূর্তেই মনে করে চিত্রলেখার কথা কিন্তু আজকের দিনে মনটা যেন একটু বেশিই খারাপ হয়ে আছে। চিত্রলেখার জন্মদিনের জন্য অনেক কিছু ভেবে রেখেছিল কিন্তু চিত্রলেখা আচমকা সাথীকে নিষেধ করলো তার জন্মদিনে কোনোরকম অনুষ্ঠান না করতে। এতে অবশ্য সাথী বিশেষ অবাক হয়নি। জন্মদিন শব্দটাই চিত্রলেখার পছন্দ না তবুও সে চেয়েছিল একটু কিছু করতে কিন্তু চিত্রলেখার নিষেধাজ্ঞার পর আর সাহস পায়নি। জন্মদিন নিয়ে মেয়েটার স্মৃতি মোটেও সুখকর নয়। চিত্রলেখার পাঁচ কি ছয় বছর বয়সের সময় জন্মদিনে মেয়েটা তার বাবার হাতে বেধড়ক মার খেয়েছিল। এরপর থেকেই এ দিনটা তার জন্য অভিশপ্ত। ঘটনাটা সাথী রঙ্গনকে বুঝিয়ে বলেছিল তবুও রঙ্গন মানতে পারেনি। একটা ঘটনাকে এভাবে বয়ে বেড়াবে এটার কোনো মানে নেই। তবে সাথীও রঙ্গনকে নিষেধ করে। চিত্রলেখার জন্মদিন পালন করতে না পারার খারাপ লাগাটা যেন আজ কয়েকগুণ বিষিয়ে তুলছে রঙ্গনের মনটাকে। চাইলেও আজ কোনোকিছুতে মন বসছে না তার। অফিস থেকে ছুটি নিতে চেয়েছিল তবে ফ্রি থাকলে মন আরো খারাপ হবে। অফিসে এসে মন ভালো হওয়া তো দূর উল্টো আরো খারাপ হয়ে আসলো। একেকজন এসে উইশ করছে, রঙ্গনের মনের অবস্থা আরো খারাপ হচ্ছে। জন্মদিন শব্দটার উপর যেন এখন তারও রাগ উঠে গেছে। কাজের উপরও ঠিকঠাক মনোযোগ আসছে না। অফিস টাইম শেষ ছয়টায়। পাঁচটার পর রঙ্গনের মন কোনভাবেই টিকলো না। মন অদ্ভুত রকমভাবে আনচান করছে। রঙ্গনের ফোনটা অনেকটা আচমকাই বেজে উঠলো। চিত্রলেখার নম্বর ভেসে উঠলো স্ক্রিনে। রঙ্গন চোখ কচলালো। সত্যিই চিত্রলেখা কল করেছে! তড়িঘড়ি করে চল রিসিভ করলো সে।

-লেখা, কিছু হয়েছে? তুমি এই অসময়ে কল? ঠিক আছে সব?

-শশশশ! এত বেশি বোঝেন কেন? আমি কি এমনি কল করতে পারি না? অফিস টাইম শেষ কখন?

-ছয়টা!

-এখন বেরোতে পারবেন একটু?

-কোথায় আসতে হবে?

-আপনার অফিসের নিচে আমি অপেক্ষা করছি!

-তুমি এখানে এসেছো? কখন? কিভাবে?

-এতগুলো প্রশ্ন একসাথে? নিচে আসেন বলতেছি।

রঙ্গন কাজগুলো গুছিয়ে রেখে পাঁচ মিনিটের মধ্যে নিচে নামলো। চিত্রলেখা পার্কিং সাইটের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। রঙ্গনের দৃষ্টি তার উপর পড়তে কয়েক ন্যানোসেকেন্ড লাগলো মাত্র। চিত্রলেখাকে দেখে রঙ্গনের হৃদস্পন্দন যথানিয়মে কম্পন তুললো। মেয়েটাকে যখনই দেখে সে, তার হৃদস্পন্দনের ঊর্ধ্বগতি যেন অনিবার্য। রঙ্গন জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে চিত্রলেখার মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো।

-এখন বলো এখানে তুমি হঠাৎ?

-এদিকে একটা কাজে এসেছিলাম তাই ভাবলাম দেখা করি একটু। তোমার বাসাটা কোথায়? দেখাও তো।

-তুমি বাসায় যাবে? পরে নিয়ে যাবো কখনো, এখন তোমায় বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি চলো।

-বাসায় নিয়ে যাবেনা সরাসরি বললেও চলতো।

-কেন নিয়ে যেতে চাচ্ছিনা তা বুঝতেছো না? অন্য কোথাও নিয়ে যাই?

-হুম চলো। তোমার চেনা জায়গায় অনেক ঘুরেছি, এখন আমার পছন্দের একটা জায়গায় চলো।

-কোথায়?

-আসো।

চিত্রলেখার পিছু পিছু চলতে শুরু করলো রঙ্গন। চিত্রলেখা রিকশা ধরলো। রঙ্গন আদেশমতো চিত্রলেখার পাশাপাশি বসলো। চিত্রলেখার পড়নে সাদা নীলের সংমিশ্রণে একটি গোল জামা। রঙ্গনের মনে হচ্ছে আজ পৃথিবীর সমস্ত শুভ্রতা এসে চিত্রলেখাকে ছুঁয়েছে। রঙ্গন এ শুভ্রতায় কোনো কলঙ্কের দাগ লাগাতে পারে না। রিকশা বেশ ধীরগতিতে চলছে। রঙ্গনের অবশ্য বেশ ভালো লাগছে। চিত্রলেখার দিকে একধ্যানে তাকিয়ে আছে সে। মেয়েটার চুল হালকা বাতাসে উড়ছে। বারংবার লেখা কানের পিছে তা গুঁজে দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছে। রঙ্গন দৃশ্যটা উপভোগ করছে। সেদিকে তাকিয়ে থাকার বাহানায় কখন যে রিকশা থেমেছে সেদিকেও ধ্যান নেই তার। চিত্রলেখা নামাতে রঙ্গনের ঘোর কাটলো। নিজের খামখেয়ালিপনার জন্য নিজেই নিজের কপাল চাপড়ালো।

-কী জনাব? ধ্যানজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন? আসুন নৌকায় উঠবো।

-নৌকা? এখন? সন্ধ্যে হয়ে এসেছে তো। নৌকা কোথায় পাবে?

-আসবেন চুপচাপ?

রঙ্গন কথা না বাড়িয়ে পিছু পিছু গেল। চিত্রলেখার এক নাবিকের সাথে কী যেন কথা বললো। অতঃপর রঙ্গনকে ডেকে নিল সে। রঙ্গন খানিকটা বিস্মিত হয়ে নৌকার দিকে এগোলো। চিত্রলেখার হাবভাব আজ বড্ড অন্যরকম লাগছে রঙ্গনের। নৌকায় একপাশ হয়ে বসলো দুজন। রঙ্গন খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে বসলেও চিত্রলেখা রঙ্গনের এক হাত নিজের মুঠোয় আবদ্ধ করে নিলো।

-দেখেছেন রঙ্গন তারারা আমাদের জন্য মিটিমিটি করছে?

-চাঁদ ছেড়ে তারার দিকে তাকানোর বোকামি কিভাবে করি বলো তো রঙ্গনা! যেখানে চাঁদ আভায় স্পর্শ করে আছে, আমি কি এমন যে চাঁদকে উপেক্ষা করে তারার দিকে দৃষ্টিপাত করবো?

-কাব্যচর্চা বেশি হয়ে যাচ্ছে না?

-মোটেও না! আজ হঠাৎ একসাথে তারাবিলাস করতে ইচ্ছে হলো যে? বই বেচারা প্রত্যাখ্যান করেছে আমার প্রেয়সীকে?

-উহু। শুভ জন্মদিন রঙ্গন। এই তারাগুলোর চেয়েও আপনার জীবন উজ্জ্বল হোক।

-তুমি তো জন্মদিন পছন্দ করো না!

-আমার বেলায় সেটা। আপনার বেলায় না! তাছাড়া আজ বইগুলো আসলেই আমাকে তিরস্কার করেছে। আমার কেবলমাত্র সাদা এপ্রোন দরকার। ঢাকা মেডিকেলে টপ করতে চাইনা আমি। পাগলের মতো সেদিকে আর ছুটতেও চাইনা। আমার রঙ্গনকে চাই, আমার পাশে সবসময় আমার রঙ্গনকে চাই।

-স্বপ্ন সবসময় বড়ই দেখতে হয় রঙ্গনা। স্বপ্ন না দেখলে তা পূরণ হবে কী করে? তুমি না চাইলেও আমি চাই তুমি মেডিকেলে টপ করো! এতে তোমার উপর আনীত সব মিথ্যে অভিযোগ মুছে যাবে। আমি সবসময় আছিই, স্বপ্নের পেছনে ছোটো তুমি।

-সিরিয়াস আলাপ থাকুক এখন?

-যথা আজ্ঞা রানীসাহেবা। বলেন কী হুকুম।

-জন্মদিন উপলক্ষে আমাকে একটা গান শোনাতে হবে এখনি।

-উমম..যা আদেশ করবেন শিরোধার্য!

রঙ্গন একবার আকাশের দিকে তাকালো। অতঃপর চিত্রলেখার দিকে তাকিয়ে গাইতে শুরু করলো,

“এই মায়াবী চাঁদের রাতে, রেখে হাত তোমার হাতে
মনের এক গোপন কথা তোমায় বলতে চাই…”

চিত্রলেখা আনমনেই রঙ্গনের কাঁধে হেলান দিল। মুহূর্তগুলো থেমে যাক! এভাবেই রঙ্গনের পাশে বসে আজীবন অতিবাহিত করুক সে। চিত্রলেখার ভাবনায় কেবল এটাই ঘুরপাক খেতে থাকে। রঙ্গন বোধহয় বুঝতে পারলো চিত্রলেখার মনের অবস্থাটা কিন্তু চাইলেই সবসময় সব সম্ভব হয় না। এই মুহূর্তটুকুও শেষ হওয়ার ছিল।

-তোমায় রেখে আসি চলো।

-আমি যেতে পারবো।

-তুমি যেতে পারলেও আমি যেতে দিব না। তোমার সাথে আরো কিছু মুহূর্ত অতিবাহিত করার সুযোগ আমি হাতছাড়া করতে চাইনা।

-আপনি আন্টিকে কল করেছেন আজ?

-উহুম। মা-ই কল করবে তবে সবার শেষে। মা বলে প্রথমে জন্মদিনে উইশ করার চেয়ে শেষে উইশ করাটা বেশি মনে থাকে। এতে মায়া বেশি থাকে।

চিত্রলেখা মুচকি হাসলো। রঙ্গন ছেলেটা বড্ড ভাগ্যবান। আশফিনা আহমেদের মতো একজন মা সে পেয়েছে। চিত্রলেখার মাঝে মাঝে বড্ড আফসোস হয়। আশফিনা আহমেদ হয়তো কখনোই তাকে মেনে নিবেন না। তখন রঙ্গনের সাথে তার সম্পর্কে যদি ভাটা পড়ে? চিত্রলেখা তা কোনোক্রমেই চায় না। রঙ্গন না জানুক, চিত্রলেখা তো ডানে আশফিনা আহমেদ রঙ্গনকে ঠিক কতটা ভালোবেসে আগলে রেখেছেন। এ ভালোবাসার কাছে চিত্রলেখার ভালোবাসার মূল্য কতটুকূ? যদিও ভালোবাসা পরিমাপ করা যায় না তবুও চিত্রলেখা আন্দাজ করতে পারে আশফিনা আহমেদের ভালোবাসা এক সুবিশাল সমুদ্রের ন্যায়। রঙ্গন সে সমুদ্রে আজীবন ভেসে বেড়াতে পারবে আর চিত্রলেখার ভালোবাসা বোধহয় ছোট্ট একটা নদী। এ নদীর স্রোতে ভেসে কতদূরই বা যেতে পারবে রঙ্গন? অবান্তর সব প্রশ্নে চিত্রলেখার মস্তিষ্কে জ্যাম বাঁধে। চিত্রলেখার আনমনা রূপটা রঙ্গনেরও নজর এড়ায় না। রঙ্গনের ইচ্ছে করে আলতো করে চিত্রলেখার ঠোঁটের কোণে স্পর্শ করে মেয়েটাকে ভড়কে দিতে।

চলবে …

[এখনো যারা জেগে আছেন, দুঃখিত এবং ভালোবাসা💜]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here