#চিত্রলেখার_কাব্য
দ্বাবিংশ_পর্ব
~মিহি
কোর্টে অপ্রত্যাশিত মুখগুলো চিত্রলেখাকে অপ্রস্তুত করছে বারংবার। তৌহিদের উপস্থিতি যেমন তাকে কাঁটা দিচ্ছে তেমনি রঙ্গনের দৃষ্টিও! সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যে নজর তা হলো নওশাদের। চিত্রলেখা ভুলেও নওশাদের উপস্থিতি কামনা করেনি তবে অদ্ভুতভাবে সাথীর মা এবং ফুপু, কাকা এসেছে। রঙ্গন চিত্রলেখার দিকে তাকিয়েছে বেশ কয়েকবার। তৌহিদ যে অনিকের উকিল তা জানার পর থেকে সে সংকোচবোধ করছে। চিত্রলেখাকে অযথাই ভুল বুঝেছিল সে। আশফিনা আহমেদের উপস্থিতিতে চিত্রলেখার সাথে কথা বলার চেষ্টা করাও বৃথা। চুপচাপ নত মুখে বসে রইলো সে।
কোর্টের কার্যক্রম শুরু হলো। দীতির পক্ষের উকিল বেশ বড়সড় যুক্তির পসরা পেশ করলেন তবে লাভের লাভ কিছুই হলো না। তৌহিদ গতকালকের রেকর্ডিংটা শোনানোর ব্যবস্থা করলো এবং সমস্ত ঘটনা যৌক্তিক ভঙ্গিতে উপস্থাপন করলো। এমতাবস্থায় দীতির উকিল কী করবে কিছুই বুঝলো না। যেখানে তার মক্কেল নিজের দোষ স্বীকার করেছে সেখানে সে কোন যুক্তি দেখাবে! তবুও ফেক ভিডিও বলে সম্বোধন করার চেষ্টাতেও ডাহা ফেইল করার পর দীতিকে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি চাইলো তৌহিদ। অনুমতি দেওয়া হলো। দীতি ভয়ে ভয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়ালো।
-মিস.দীতি, আপনি যে অনিক মাহমুদকে ফাঁসিয়েছেন তা তো স্পষ্টত দৃশ্যমান কিন্তু এ কাজের পেছনে আপনার অপর সহযোগী কে?
-আমার আর কোনো সহযোগী নেই। আমি একাই করেছি।
-এখনো মিথ্যের আশ্রয় নিলে আপনার শাস্তি বাড়বে মিস.দীতি। সুতরাং চুপচাপ সত্যটা বলুন। কোম্পানির তথ্য আপনি কার কাছে বিক্রি করতেন? কোনো সহযোগী ছাড়া এত গভীর প্ল্যান করা আপনার পক্ষে সম্ভব না।
-আমি একাই করেছি।
-আচ্ছা, তাহলে ভিডিও অনুযায়ী আপনি তিন লাখ টাকা রেখে গিয়েছিলেন। এত টাকা কোথায় পেলেন আপনি?
-আমি কোম্পানির কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমাদের রাইভালের কাছে বিক্রি করেছি।
-আর এই ডিলটা কিভাবে হলো? কে এই রাইভাল?
দীতি থতমত খেয়ে গেল। এসব তার জানা নেই। সে কেবল তথ্য চুরি করতো এবং তার সহযোগীকে দিতো। তার সহযোগীই সব ডিল করতো। তাদের পরিকল্পনা ছিল কোনোভাবে ধরা পড়লে অনিককে যেন ফাঁসানো যায়।
-উত্তর নেই তাই না মিস.দীতি? আমি দিচ্ছি উত্তর। আপনার ফোন আমি ট্যাপ করিয়েছিলাম। কল রেকর্ডস অনুযায়ী আপনি একটা আননোন নম্বরে কিছুদিন হলো রেগুলার কল করেছেন। নম্বরটার কোনো ডিটেলস নেই তবে সেটার লোকেশন আমরা পেয়েছি? লোকেশন কোথাকার বলবো? আচ্ছা একটু পরে বলি। তার আগে আমার অনিককে কিছু প্রশ্ন করার আছে। আপনি আসুন। মে আই ইউর অনার?
জজসাহেব সম্মতি দিলেন। তৌহিদ বেশ বিচক্ষণ ভঙ্গিতে অনিকের মুখোমুখি দাঁড়ালো। অনিকের শরীর মোটামুটি অসুস্থ হলেও সে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে।
-মিস.অনিক, আপনার কর্মজীবনের কত বছর হলো?
অনিক উত্তর দেওয়ার আগেই প্রতিপক্ষ উকিল অবজেকশন দেখিয়ে বসলো। এটা নাকি অবান্তর! তৌহিদ শুধু বললো তাকে প্রশ্নগুলো শেষ করতে দিতে। জজসাহেব অনুমতি বজায় রাখলেন।
-আমার কর্মজীবন পাঁচ বছরের।
-এর মধ্যে আপনি কর্মক্ষেত্রে বেশ খ্যাত! দুইবার প্রমোশন পেয়েছেন। আপনার মনে হয়না আপনার এই বিষয়টা ঈর্ষণীয়?
-হতে পারে তবে কর্মক্ষেত্রে আমরা সবাই বন্ধুর মতো, ঈর্ষা করার প্রশ্ন আসেনা।
-আপনি তোফায়েল সরকারকে তো চেনেন?
-হ্যাঁ, আমাদের আসার এক বছর আগে জয়েন করেছিলেন। আমরা ওনাকে বড় ভাই হিসেবে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু ওনার কিছু সমস্যার কারণে আমাদের প্রমোশন হলেও ওনার হয়নি।
-কী সমস্যা জানতে পারি?
তৌহিদের প্রশ্নে বিব্রত হলো অনিক। অন্য কারো দোষত্রুটি সর্বসম্মুখে বলতে সে অভ্যস্ত নয়।
-আপনাকে প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে মিস.অনিক।
-উনি হঠাৎ হঠাৎ জুনিয়র স্টাফদের সাথে খুব বাজে ব্যবহার করতেন, আবার কখনো কখনো তাদের উপর অতিরিক্ত কাজ চাপিয়ে দিতেন।
-ওনার এ বিষয়ের কমপ্লেইন করেছিলেন আপনি কখনো?
-জ্বী, একবার করেছিলাম।
-উনি জানতে পেরেছিলেন?
-জ্বী এবং তারপর আমাদের মধ্যে তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। উনি ওনার মতোই ছিলেন।
-আচ্ছা ধন্যবাদ।
তৌহিদ অনিকের সাথে কথা শেষ করে দীতির কল রেকর্ডের ডিটেলস পেশ করলো। যে আননোন নম্বরে দীতি কথা বলতো তার লোকেশন তোফায়েল সরকারের বাড়ির সন্নিকটে। তৌহিদের এ তথ্য বের করতে কিছুটা সময় লেগেছে বটে তবে তথ্য নির্ভুল প্রমাণ পেয়ে তবেই সে কোর্টে পেশ করেছে। তৌহিদ আবারো দীতিকে কাঠগড়ায় ডাকলো।
-দীতি, এখন বলবেন সত্যিটা?
-তোফায়েল স্যার অনিক স্যারকে অপছন্দ করতেন। উনিই কোম্পানির তথ্য বিক্রি করার প্ল্যান করেন এবং এর জন্য আমাকে দশ লাখ টাকা দেন। তবে অনিক স্যারের আমার সত্যিটা জানতে পারাও ওনার প্ল্যান ছিল। উনি চেয়েছিলেন অনিক স্যার যেন একইসাথে রেইপ এবং জালিয়াতির কেসে ফেঁসে যান। এসব না করলে উনি আমাকে পুলিশে ধরানোর ভয় দেখিয়েছেন।
-দ্যাটস অল ইউর অনার।
তৌহিদের নৈপুণ্যে উপস্থিত সকলে হতবাক হলো। এতটুকু বয়সের একটা তরুণ এত বুদ্ধিমত্তার অধিকারী হতে পারে কেউ কল্পনা করেনি।জজসাহেব অনিককে বেকসুর খালাশ দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব তোফায়েল সরকারকে এরেস্ট করার নির্দেশ দিলেন।
_______________________
সাথীর চোখ থেকে অবিরত অশ্রু ঝরছে। অনিককে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে সে। কোনোভাবেই অনিককে ছাড়ছে না। সাথীর পরিবার সেখানে উপস্থিত তবুও সাথীর মধ্যে কোনোরূপ পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। অনিককে ছাড়লেই যেন সে বহুদূর চলে যাবে।
-সাথী ছাড়ো, সবাই দেখছে তো।
-দেখুক! সবার চোখ আছে তাই দেখছে।
-বাকি ভালবাসাটা বাসায় গিয়ে দেখায়ো।
সাথী চোখ মুছলো। তার বিশ্বাসের প্রতিদান সে পেয়েছে। আশফিনা আহমেদের একটুও ইচ্ছে করছে না সেখানে থাকতে। নিজের ভাবীকে ফেলেই তিনি সামনে এগোলেন। রঙ্গনের না চাইতেও চিত্রলেখার সাথে কথা না বলেই সামনে পা বাড়াতে হলো। তৌহিদকে বেশ ঘটা করেই ধন্যবাদ জানালো সবাই। এত সব খুশির মুহুর্তের মাঝে চিত্রলেখা চুপচাপ মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলো।
বাড়িতে ফেরার পর থেকে চিত্রলেখা ঘর থেকে বেরোলো না। দরজা লাগিয়ে চুপচাপ জানালা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল সে। ফোনের ভাইব্রেশনে বিরক্ত হলো সে। নম্বর না দেখেই রিসিভ করে কানে ধরলো ফোনটা।
-হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম।
-ওয়ালাইকুম সালাম। তুই ঠিক কতদিন পর আমার কল রিসিভ করলি! আগের যখন কল করেছিলাম কই ছিলি?
-ওহ সিয়াম ভাইয়া তুমি! আমি আসলে ফোনের দিকে তেমন নজর দেইনা তো।
-ভালো ছাত্রী বলে কথা! আচ্ছা শোন, চাচার শরীরটা নাকি ভালো নেই। আমি কাল বাড়িতে ফিরবো। তুই আসিস তো একটু।
-তুমি বাড়িতে ফিরবে দেখে আমার আসতে হবে?
-আজব তো, আসতে বলছি আসবি। এত বাড়তি কথা কিসের তোর?
-আচ্ছা ঠিক আছে।
সিয়াম কল কাটতেই চিত্রলেখার ফোনে আবারো কল আসলো। চিত্রলেখা ভেবেছিল সিয়াম বোধহয় আবার কল করেছে। কিন্তু নাহ! রঙ্গন কল করেছে তাকে। চিত্রলেখা রঙ্গনের কথাই ভাবছিল। রঙ্গনকে নিয়ে চিন্তা-ভাবনাগুলো ইদানিং অনাবশ্যক তার মনে জায়গা করে নিচ্ছে।
-ভালো আছো চিত্রলেখা? সব তো ঠিক হলো, বলেছিলাম না?
-হুম ভালো আছি।
-সাথী আপু নিশ্চয়ই এখন আগের মতো হয়ে গেছে, অনেক খুশি তো আপু।
-বিশ্বাসের প্রতিদান পেয়েছে।
-আমি কখনো ভাবিওনি সাথী আপু এই খারাপ সময়টাতে ভাইয়াকে এতটা সাপোর্ট করবে। মেয়েরা সচরাচর একটু সন্দেহবাতিক হয় কিনা!
আসলে ভালোবাসায় হারানোর ভয় থাকলে বিশ্বাসটাও থাকেই। আর বিশ্বাস যেখানে আছে ষেখানে ভালোবাসা হারানোর ভয় কাজ করেনা।
-সবার ক্ষেত্রে এমন হয়না। কেউ কেউ তীব্র ভালোবাসা আর বিশ্বাসের প্রতিদানে ধোকাও পায়!
-তোমার অভিজ্ঞতা আছে?
-নিজের মাকে দেখেছি তো তীব্র ভালোবাসায় নিঃস্ব হয়ে যেতে।
-আমি দুঃখিত! আমি আসলে…
-ফরমালিটি মেইনটেইন করতে আসতে হবে না। আপনি অযথা অনুতপ্ত হচ্ছেন।
-চিত্রলেখা, তোমার কিছু হয়েছে? তুমি এভাবে কথা বলছো যেন তুমি বড়সড় কোনো মানসিক চাপে আছো। তোমার মনে কিছু একটা নিয়ে যুদ্ধ চলছে।
চিত্রলেখার বুক কেঁপে উঠলো। তার মনে চলতে থাকা কথাগুলো যেন কেউ সামনে থেকে জেড করছে তাকে। চিত্রলেখার ইচ্ছে করলো রঙ্গনকে উত্তর দিয়ে দিতে কিন্তু সে পারবে না। অর্ণবের ব্যবহারে পাওয়া কষ্টের পরিমাপ করা তার পক্ষে সম্ভব নয় আর না সে কষ্ট অন্য কাউকে ব্যক্ত করা। চিত্রলেখা কিছু বলার আগেই দরজায় টোকা পড়লো।
“বাইরে কেউ ডাকছে, পরে কথা হবে।” চটজলদি কল কেটে দরজা খুললো চিত্রলেখা। অপর্ণা ভ্রু কুঁচকে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।
-সবসময় দরজা লাগায়ে থাকা লাগে কেন তোর? কী করিস একা ঘরে?
-কোনো কাজ ছিল ভাবী?
-হ্যাঁ, সবার জন্য একটু নাস্তা বানা তো, আমার শরীরটা কেমন যেন লাগছে।
অপর্ণা মাথায় হাত দিয়েই নিজের ঘরের দিকে এগোলো। চিত্রলেখা বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মানুষ এত বাহানা কী করে করতে পারে অপর্ণাকে না দেখলে সে বিশ্বাসই করতো না। চিত্রলেখা চুলগুলো হাতখোপা করে রান্নাঘরে ঢুকলো। ব্যস্ত ভঙ্গিতে এদিক সেদিক তাকিয়ে জিনিসপত্র একত্র করতে লাগলো।
অপর্ণা গভীর চিন্তায় ব্যস্ত। নওশাদ নামক লোকটার কথাবার্তা তার মাথায় ঘুরছে। অনিকের বের হওয়ার পরপরই লোকটা তাকে নিজের পারসোনাল নম্বর দিয়েছে এবং কল করতে বলেছে। অপর্ণা চেনে একে। চেয়ারম্যান, ভালোই টাকা-পয়সা আছে। অপর্ণা সিদ্ধান্ত নিল নওশাদের সাথে কথা বলবে সে। অবশ্যই নওশাদের কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে বলেই নম্বর দিয়েছে সে!
চলবে…
[সামনের সোমবার থেকে আমার পরীক্ষা অথচ একদিন গল্প না লিখলে নিজেরই শুন্যতা অনুভব হয়। পরীক্ষার খাতায় ‘শুন্য’ ইজ ওয়েটিং ফর মি। দোয়া করেন <3]