#চিত্রলেখার_কাব্য
পঁয়তাল্লিশতম_পর্ব
~মিহি
“চিত্রলেখাকে এখন এসব জানিয়ো না অর্ণব। মেয়েটার কাল পরীক্ষা। এসব নিয়ে ভাবলে ওর পরীক্ষা খারাপ হবে।” আশফিনা আহমেদের কথায় মুখ তুলে তাকালো অর্ণব। পরিস্থিতি এতটা দ্রুত এমন বদল দেখাবে কল্পনাও করেনি সে। অপর্ণাকে বোধহয় খানিকটা ঘৃণা করতে শুরু করেছিল সে কিন্তু এমন পরিণতি কখনো চায়নি। অপর্ণাকে তুলে নিয়ে যেতে নওশাদ লোক পাঠিয়েছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে সেদিন অপর্ণার এক আত্মীয়ের বিয়েতে সবাই গিয়েছিল। অপর্ণা বাসায় একা ছিল, সাথে এক কাজের মহিলা। নওশাদের ভাড়া করা লোকগুলো এসেছিল অপর্ণাকে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে কিন্তু অপর্ণাকে দেখে তাদের মনে যে কুমতলব ভর করে তার পরিণাম হয়ে উঠে ভয়াবহ। অতর্কিত আক্রমণ চলে অপর্ণার উপর। কাজের মেয়েটাকে বেঁধে রেখে অত্যাচার করা হয়েছে দিন দুপুরে! অত্যাচারের এক পর্যায়ে অপর্ণার নিঃশ্বাস ক্ষীণ হয়ে আসলে ছেলেগুলো ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়। তাদেরকে পালাতে দেখে নিকটস্থ প্রতিবেশী। তিনি চটজলদি অপর্ণাদের বাড়িতে ঢুকে দেখেন এই অবস্থা। এম্বুলেন্সে কল করে অপর্ণাকে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন অল্প সময়ের মধ্যেই। পাশাপাশি অপর্ণার বাড়ির লোক এবং অর্ণবকেও তিনিই খবর দেন। অর্ণব বুঝতেই পারছে এসবে নওশাদ ছাড়া কারো হাত নেই। আশফিনা আহমেদ কিভাবে এসব খবর পেলেন এখনো জানে না সে তবে অপর্ণার জন্য করুণা হচ্ছে তার। প্রায় চার ঘণ্টা ধরে মেয়েটা অজ্ঞান হয়ে আছে। বাচ্চা দুটো অর্ণবের পাশে ঝিম ধরে বসে আছে। তারা বুঝতে পারছে না তাদের মায়ের কী হয়েছে। কাজের মেয়েটার শরীরেও বেশ কিছু ক্ষত। অপর্ণার জ্ঞান না ফিরলে বড়সড় ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। অর্ণব ভেবেছিল অপর্ণার মা এসব নিয়ে একটা কাণ্ড নিশ্চিত বাধাবেন কিন্তু তা হলো না। ভদ্রমহিলা চুপচাপ এককোণে দাঁড়িয়ে আছেন। এ সবকিছুর জন্য যেন নিজেকেই আংশিক দায়ী করছেন এখন তিনি। কোনো একসময় চিত্রলেখার সাথেও এমন করার মতলব তিনিই বাতলে দিয়েছিলেন। আজ সে যন্ত্রণা হারে হারে টের পাচ্ছেন। নিজের কলিজার টুকরো সন্তানের উপর আঁচ আসলে মা সহ্য করতে পারে কখনো? সেখানে চিত্রলেখা মা হারা প্রাণ ছিল, তার মাথা রাখার জন্য তো মায়ের আঁচলটুকুও ছিল না। আজ বড্ড অসহায় লাগছে তার নিজেকে। মেয়ের এ অবস্থার কিয়দংশ দায়ভার নিজ কাঁধে নিয়ে প্রাণত্যাগ করার তীব্র বাসনা যেন জেঁকে বসেছে তাকে।
আশফিনা আহমেদ হাসপাতালে এসেছেন তাও এক ঘণ্টা হতে চললো। তিনি মূলত অর্ণবের সাথে কথা বলার জন্যই এসেছিলেন কিন্তু কথা শেষ হয়নি এখনো। কথা হওয়ার সুযোগও নেই। এমন একটা পরিস্থিতি এখানে, তিনি হুট করে বলতেও পারছেন না এসবের জন্য তিনি তার ভাইকে শাস্তি দিতে চান। অনেকটা গরু মেরে জুতো দানের মতো শোনাবে বিষয়টা তবে আশফিনা আহমেদ এবার দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। নওশাদের এ ভুলের ক্ষমা তিনি করবেন না। ক্ষমতা কেবল নওশাদের একার নেই, তারও রয়েছে। নওশাদের চেয়ে বরং কয়েকগুণ বেশি ক্ষমতা এখন তার হাতে। অর্ণবকে এককোণে দাঁড়াতে দেখে আবারো কথা বলার চেষ্টা করলেন আশফিনা আহমেদ।
-অর্ণব?
-দুঃখিত আন্টি, আমি আপনাকে এড়িয়ে যেতে চাইছি না কিন্তু পরিস্থিতিটাই এমন যে ঠিকমতো কথা বলার অবস্থা নেই।
-সমস্যা নেই। আমার শুধু একটা কথাই বলার ছিল। নওশাদের উপর তুমি যাকে নজর রাখতে বলেছো, তার সংগ্রহ করা প্রমাণসহ তাকে আমার সাথে দেখা করতে পাঠিয়ো। আমি চাই নওশাদ তার ভুলের শাস্তি পাক।
-আচ্ছা আন্টি, আমি তৌহিদকে জানাবো।
-এদিকে সামলে নিও। আমি আসছি।
-জ্বী আচ্ছা।
আশফিনা আহমেদ বেশিক্ষণ দাঁড়ালেন না আর। অর্ণব এখনো অপর্ণার কেবিনের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কোথাও একটু হলেও মায়া যেন রয়েই গেছে। অপর্ণার এই অবস্থাটা অর্ণবের মনকে ঠিকই পোড়াচ্ছে। মেয়েটার কিছু হয়ে গেলে অর্ণব বোধহয় কখনো নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না। পরোক্ষভাবে সেও কিছুটা দায়ী এসবের জন্য।
_________________________________
-ভাবী আমার প্রচণ্ড ভয় করছে। মনে হচ্ছে কাল কিছুই পূরণ করতে পারবো না আমি।
-লেখা! ঘুমা তুই এখন। আজকে রাত জাগিস না অন্তত। এতদিন যা পড়েছিস তা যথেষ্ট। আজকে শান্তিতে একটু ঘুমা তাহলেই কাল ঠাণ্ডা মাথায় পরীক্ষা দিতে পারবি।
-আচ্ছা তুমি যাও। আমি ঘুমাচ্ছি।
-আমার সামনেও রঙ্গনকে কল করতেই পারিস!
কথাটা বলে মুখ টিপে হাসলো সাথী। চিত্রলেখার লজ্জারাঙা মুখটা প্রত্যক্ষ না করেই কক্ষ ত্যাগ করলো সে। সাথীর কথাতে চিত্রলেখার যেন আরো মন চাইলো রঙ্গনকে একটু কল করতে। পরক্ষণেই মনে হলো কথা বলার পর যদি আরো অস্থির হয়ে পড়ে সে? তখন তো আরো ঝামেলা বাঁধবে! এ দ্বিধাদ্বন্দ্বে বেশিক্ষণ থাকতে হলো না চিত্রলেখার। রঙ্গন নিজেই কল করলো। তড়িৎ গতিতে রিসিভ করলো চিত্রলেখা।
-আসসালামু আলাইকুম। ঠিক আছেন ম্যাডাম? নাকি চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েছেন?
-ঠিক আছি।
-তুমি জীবনেও ঠিক নাই! এত ওভারথিংক করলে হয় সোনা? তুমি যা প্রিপারেশন নিয়েছো, সেটা শুধু কাল এপ্লাই করবে। এখনো জেগে আছো কেন? এখনি ঘুমাবা!
-আমার ঘুম আসতেছে না। প্রচণ্ড চিন্তা হচ্ছে, মনে হচ্ছে কিছু পারবো না।
-চিত্রলেখা, আমরা হারানোর ভয় তখন পাই যখন আমাদের চাওয়াটা অনেক বেশি হয় আর এ চাওয়াটা খাঁটিও হয়। খাঁটি চাওয়ার ফলাফল আল্লাহ ঠিকই দিবেন। তুমি কেবল নিজের উপর ভরসা রাখো। আমি জানি তুমি ভালোমতোই পরীক্ষা দিবে।
-আমার যদি মেডিকেলে না হয়?
-জীবন শেষ হয়ে যাবে তাতে? মেডিকেল কিংবা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা সীট শুধু সমাজের সামনে তোমায় একটা যোগ্যতার আসন দেয়। দিনশেষে ঠিকই ডাক্তাররা বেতন না পেয়ে আন্দোলনে নামে। তখন সমাজের মানুষ কোথায় থাকে? জীবনে একটা কিছু এচিভ করতে পারাটা সফলতা বটে তবে তার উপর জীবন মরণ নির্ভর করানো নিছক বোকামি। তোমাকে আমিই বলেছিলাম বড় স্বপ্ন দেখতে কিন্তু এতটাও বড় স্বপ্ন না যেটা ভাঙলে তুমি আর দাঁড়াতেই পারবে না!
-এত কথা কোথায় পান আপনি?
-পরিস্থিতি বা অন্য কোনভাবে হয়তো শিখে গেছি। রঙ্গন শুধু তোমার সামনেই বড্ড বেশি চঞ্চল, অন্যদের কাছে সে বড্ড ম্যাচিউর। বুঝেছো রঙ্গনা?
-বুঝেছি।
-ঘুমাও এখন। সবরকম দুশ্চিন্তা বাইরে ছুঁড়ে পেলে নিদ্রার জগতে পাড়ি জমাও।
-আচ্ছা।
চিত্রলেখা ফোন রাখলো। কালকের দিনটা বিশেষ। সকালে তাড়াতাড়ি উঠবে সে। একবার অর্ণব ভাইয়ের সাথে কথা বলা উচিত। এখানে আসার পর থেকে হাতেগোনা কয়েকবার কথা হয়েছে। কাল একটা বিশেষ দিন। বড় ভাইয়ের দোয়া নেওয়াই উচিত। যেই ভাবা সেই কাজ। অর্ণবের নম্বর ডায়াল করলো চিত্রলেখা। প্রথমবারে রিসিভ করলো না অর্ণব। কিছুক্ষণ পর নিজেই কল ব্যাক করলো সে।
-ভাইয়া, কল ধরলে না যে? ব্যস্ত ছিলে?
-একটু। তুই ঘুমাসনি? কাল না পরীক্ষা তোর?
-তোমার মনে আছে? একবার তো কলও করোনি আমায়! আমি ভাবলাম ভুলেই গেছো।
-তোকে বিরক্ত করতে চাইনি পিচ্চি।
অর্ণব কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওয়ার্ড বয় পাশে থেকে কিছু একটা বলে চেঁচিয়ে উঠলো। অর্ণব কোনোরকম পাশ কাটিয়ে এক কোণে গিয়ে দাঁড়ালো। চিত্রলেখা জানতে পারলে বিষয়টা আরো জটিল হবে। তাই অর্ণব যতটা পারছে সবকিছু আড়াল করার চেষ্টা করছে।
-ভাইয়া কোথায় তুমি? কে যেন কিছু একটা বলে উঠলো, ওষুধ না কী যেন একটা। হাসপাতালে তুমি?
-আরে নাহ পিচ্চি। একটূ জ্বর এসেছে তাই ফার্মেসিতে ওষুধ কিনতে এসেছি। তুই অযথা চিন্তা করা বাদ দিয়ে ঘুমা তো।
-আচ্ছা ভাইয়া দোয়া রেখো আমার জন্য।
-ফি-আমানিল্লাহ।
চিত্রলেখা কল কেটে দিলেও তার মনের মধ্যে খচখচ করতে লাগলো। অর্ণব ফার্মেসিতে এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তার। চিত্রলেখার কেন যেন মনে হচ্ছে অর্ণব তার থেকে কিছু একটা লুকোচ্ছে কিন্তু কী লুকোচ্ছে বুঝে উঠতে পারছে না সে। বিছানায় হেলান দিয়ে ভাবতে শুরু করলো সে। ঘুমের আগমন ঘটতে বেশি সময় লাগলো না। কাল এক নতুন যুদ্ধ চিত্রলেখার জীবনের, হতেই পারে এটাই শেষ যুদ্ধ হবে।
চলবে…