চিত্রলেখার_কাব্য বিয়াল্লিশতম_পর্ব ~মিহি

0
580

#চিত্রলেখার_কাব্য
বিয়াল্লিশতম_পর্ব
~মিহি

“দেখো তোমার কাছে কোনো সলিড প্রমাণ নেই। কেবলমাত্র তোমার একটা কথার উপর ভিত্তি করে আমরা একজন রেসপেক্টিভ টিচারকে কেন কোচিং থেকে বের করবো?” এ প্রশ্নের সম্মুখে চিত্রলেখা সত্যিই বলার মতো কিছু পেল না। সে একজন সাধারণ শিক্ষার্থী, তার কাছে পাকাপোক্ত কোনো প্রমাণ নেই। আগের নম্বরের মেসেজগুলোও সে ডিলিট করে ফেলেছে। বাস্তবিক অর্থে সে কোনো প্রমাণ ছাড়াই অভিযোগ দায়ের করছে। আর কিছু বললো না চিত্রলেখা। বোকামিটা সে করেই ফেলেছে। এখন তা শোধরানোর সময় নয়। আহাদ লোকটাকে পরাস্ত করার সময় সামনে সে আরো পাবে তবে এই দুই মাস তাকে ভর্তিযুদ্ধ জয় করতে হবে। সাদা এপ্রোন আর তার মাঝে এখন যত বাধা আছে সব অতিক্রম করতে হবে তাকে। চিত্রলেখা টিচার্স কেবিন থেকে বের হওয়ার জন্য উদ্যত হলো চিত্রলেখা। আহাদও সেখানে উপস্থিত ছিল। এবার তার কর্কশ রূপটা খানিকটা ফুটে উঠলো কথাবার্তায়।

-স্যার, এই মেয়েটা আমার উপর মিথ্যা দোষারোপ করেছে। অবশ্যই আমার উপর তার কোনো রাগ রয়েছে। আপনার অনুমতি থাকলে আমি তার সাথে একান্তে কিছু কথা বলতে চাই।

চিত্রলেখা ভ্রু কুঁচকালো। সিনিয়র লোকটা মাথা নেড়ে চলে গেল। চিত্ কেন যেন মনে হচ্ছে এই লোকটা সব বুঝেও কিছু বলছে না অসম্মান হবে এই ভয়ে। আহাদের অগ্নিদৃষ্টি চিত্রলেখার বড্ড বিরক্ত লাগলো। কথা বলার রুচিটুকুও অবশিষ্ট নেই তার। এমনিতেই রেজাল্টের পর থেকে সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে মারাত্মকভাবে। এখন এসব বিষয়গুলোতে জড়ানোর ইচ্ছেও নেই তার। চিত্রলেখা চলে যেতে উদ্যত হলো আহাদ শক্ত করে তার হাতটা ধরলো এবং অপর হাতটা দিয়ে মুখ চেপে ধরলো। চিত্রলেখা বিস্ফোরিত দৃষ্টি মেলে তাকালো সেদিকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আহাদের নোংরা হাত তাকে বিশ্রিভাবে স্পর্শ করার চেষ্টা করলো। চিত্রলেখা ছিটকে সরে গিয়ে পরক্ষণেই সজোরে থাপ্পড় বসিয়ে দিল আহাদের গালে। শব্দটা এতটাই তীব্র শোনালো যে কেবিনের বাইরে থেকে সিনিয়র শিক্ষকটির আসতে সময় লাগলো না। কেবিনের পরিস্থিতি দেখে তিনি যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেলেন।

-আহাদ কী হয়েছে তোমার?

-স্যার, এই মেয়ে পাগল! আমি ওকে বোঝানোর চেষ্টা করাতে আমায় থাপ্পড় মেরেছে। শিক্ষকের গায়ে হাত তোলার মতো বেয়াদবি যে করতে পারে সেই মেয়ের কথা আপনি বিশ্বাস করবেন স্যার?

-আমি তো প্রথমেই বুঝেছি এই মেয়ের সমস্যা আছে। এই মেয়ে! পড়াশোনা না করে এডমিশনে ভালো করতে চাও? বাপরে শখ! এসবের জন্য শিক্ষকদের নোংরা অপবাদ দিয়ে তাদেরই দোষ দাও, তোমার মতো মেয়ের কোথাও চান্স হবেনা।

চিত্রলেখার হাত পা যেন জমে গেছে। তোকে কেবিনে বেশ ভীড় জমেছে। চিত্রলেখা তখন আড্ডার বিষয়বস্তুতে রূপ নিয়েছে। অন্তর্মুখী চিত্রলেখার কাছে এত ভীড় স্বাভাবিক নয়। বরাবরই তার চিরায়ত দুর্বল রূপটা এখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে। চিত্রলেখা কোনো উত্তর দিল না। আহাদের মুখের বিশ্রি হাসি বলে দিচ্ছে লোকটা কতটা নোংরা একটা চাল চেলেছে। চিত্রলেখা কেবল নিঃশব্দে সেখান থেকে প্রস্থান করলো।

-লেখা তুই কেন কিছু বললি না? তোর কি একটাবার সব ক্লিয়ার করা উচিত ছিল না?

-বাদ দাও ভাবী। ঐ রকম নোংরা লোকের নাম নিতেও আমার নিজের উপর ঘৃণা লাগছে। ওরা নাকি শিক্ষক! ছিঃ!

সাথী কথা বাড়ালো না। চিত্রলেখার মনের অবস্থা অল্প হলেও বুঝতে পারছে সে। রঙ্গনকে এসব ঘটনা জানাবে কি? জানানো উচিত হবে। ভাবতে ভাবতেই সে ফোনের দিকে তাকালো। তৎক্ষণাৎ চোখ কপালে উঠলো তার। রঙ্গন কল করেছিল। ফোন ইয়ারফোনের সাথে কানেক্টেড থাকায় অটোম্যাটিক রিসিভ হয়েছে। সাথী ভয়ে ঢোক গিলল। ইয়ারফোনটা খুলে ফোন কানে ধরলো সে। কিছু বলার পূর্বেই কলটা কেটে গেল। সাথী বুঝতেই পারলো না কী হলো একটু আগে। রঙ্গন কতটুকু কথা শুনেছে তা আন্দাজ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে।

_________________________

চিত্রলেখার বিষয়টা কোচিংয়ে ভালোই ছড়িয়েছে। স্টুডেন্টরাও বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতে শুরু করেছে। অবশ্য আলোচনার মুখ্য কালপ্রিট চিত্রলেখাই। আহাদ নিজের বুদ্ধির প্রশংসা করছে। কাউকে ফাঁদে ফেলা বোধহয় তার থেকে ভালো কেউ পারবেনা। মনে মনে নিজেই নিজের কাঁধ চাপড়ালো। ক্লাস নিতে নিতে এসবই ভাবছিল সে। স্টুডেন্টদের মধ্যে কিছুক্ষণ ফিসফাস চললেও আহাদ এবার তাদের চুপ করিয়ে দিল। ক্লাসে মনোযোগ দিতে বললো সবাইকে। মুহূর্তেই সারা কক্ষে পিনপতন নীরবতা সৃষ্টি হলো। আহাদ হোয়াইট বোর্ডের দিকে তাকাতেই অনুভব করলো কেউ একজন তার কলার ধরে তাকে পেছনে টানছে। বিব্রত হয়ে পেছনে ফিরলো সে। লম্বা-চওড়া এক ছেলে তার কলারে হাত দিয়েছে। ক্লাসে আবারো শোরগোল পড়ে গেল। “সাইলেন্স” বলে চেঁচিয়ে উঠলো আহাদ কিন্তু সামনে থাকা ব্যক্তিটি তাকে কোনো সুযোগ না দিয়েই আহাদের মুখ বরাবর ঘুষি হাঁকালো। তীব্র রাগের আঁচটা যেন স্পষ্ট টের পেল আহাদ। ছেলেটার পরিচয় জানেনা সে। অপরিচিত একজন ছেলে তারই ক্লাসে ঢুকে তাকেই মারছে এ যেন দুঃসাহসিক ব্যাপার। কতিপয় স্টুডেন্ট ইতোমধ্যে ভিডিও করতে শুরু করেছে। আহাদ কিছু বলার সুযোগই পেল না। যতগুলো চড় থাপ্পড় সে খেয়েছে তাতে তার দাঁত অবধি নড়ে উঠেছে। ক্লাসে শোরগোল শুনে শেষমেশ সকলে আহাদের ক্লাসে ঢুকলো। অপরিচিতের ছেলেটাকে আহাদের থেকে সরানোর চেষ্টা চালাতে লাগলো। টানাটানিতে আহাদের কলার ছিঁড়ে ছেলেটার হাতেই রয়ে গেল। তবুও যেন তার রাগ কমলো না। আহার এবার যেন একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।

-কে তুই? তোর সাহস তো কম না! আমার ক্লাসে ঢুকে আমার গায়েই হাত দিস!

-তোর মতো নোংরা কীটের গায়ে হাত দিছি এইটা আমার জন্য লজ্জাজনক। তোর মতো কীট শিক্ষক হওয়ার যোগ্যই না। তোদের জন্য শিক্ষকতার মতো একটা মহান প্রফেশনের অপমান হচ্ছে এখন।

-তুই কে এসব বলার? কী প্রমাণ আছে তোর কাছে?

রঙ্গন এবার খানিকটা শান্ত হলো। নিজের পরিচয় জানালো না আগেই বরং উপস্থিত শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি দাঁড়ালো। কিছু কথা যে সে বলবে তা স্পষ্ট বোঝা গেল।

-তোমরা সবাই একটু আগের ঘটনা দেখেছো। আমায় ভুলও বুঝতে পারো তবে কাজটা আমি কেন করেছি তা তোমাদের জানা প্রয়োজন। একটা মেয়ের উপর অপবাদ দেওয়া খুব সোজা। মেয়েদের দোষ দেওয়াটাও খুব সোজা। তোমরা যেমন আজ দুপুরের ঘটনার জন্য নিশ্চয়ই মেয়েটাকে দায়ী করেছো! একবারো ভেবেছো মেয়েটা আদতে সত্যি বলতেও তো পারে! তোমাদের বোনের উপর এমন এলিগেশন আসলেও মেনে নিতা? আর এই নোংরা লোকের তো চেহারা দেখলেও বোঝা যায় শালা লুচ্চা! তোমাদের মনে হয়তো একে নিয়ে অনেক রেস্পেক্ট আছে কিন্তু বি অনেস্ট, এই লোকটা তোমাদের মধ্যে কোনো মেয়েকে বিরক্ত করেছে? এখনই সময়, নিজের উপর হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করো!

ক্লাসের কেউই দাঁড়ালো না। রঙ্গন জানতো এত সাহস কেউ দেখাবে না। তবে রঙ্গনের এ আশাহত হওয়াটা যেন ভালো লাগলো আহাদের। ঠোঁট বেয়ে তার রক্ত গড়াচ্ছে তবুও কুৎসিত হাসিটা ঠোঁটের কোণে বহাল তবিয়তে রয়েছে। রঙ্গনের রাগ যেন আরো কয়েক গুণ বাড়লো। ইচ্ছে করলো হাতের কাছে যা আছে তা দিয়েই লোকটার মাথা ফাটিয়ে দিতে। চিত্রলেখার কথাগুলো শোনার পর থেকে তার ঠিক কী পরিমাণ রাগ হয়েছে তা সে কাউকেই বোঝাতে পারবে না। আহাদকে খুন করলেও হয়তো এখন তার মন শান্ত হবে না কোনভাবেই।

“দেখো আজ যদি তোমরা চুপ থাকো, লোকটা কয়েক মাস পর তোমাদের জুনিয়রদের সাথেও সেইম কাজ করবে। হতে পারে ভবিষ্যতে তোমার বোনের সাথেও এমন করবে! আজ চুপ থাকার মানে হচ্ছে লোকটাকে প্রশ্রয় দেওয়া!” রঙ্গন শেষবারের মতো চেঁচিয়ে কথাগুলো বললো। এতে যদি কারো বোধবুদ্ধি ফেরে! এতেও যদি কেউ কিছু না বলে তবে রঙ্গন আর এসবের ধার ধারবে না। সোজা ঐ লোকটার কান ধরে টেনে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে মারবে।

চলবে…

[আগামীকাল গল্প আসবে না।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here