চিত্রলেখার_কাব্য ষোড়শ_পর্ব ~মিহি

0
644

#চিত্রলেখার_কাব্য
ষোড়শ_পর্ব
~মিহি

রঙ্গন এসেছে মিনিট দশেক হয়েছে কেবল। নির্বাচনের ঝামেলার কারণে তার পরীক্ষা দেড়মাস পিছিয়েছে, ক্লাসও বন্ধ। ভেবেছিল এখানে এসে সবাইকে সারপ্রাইজ দিবে কিন্তু এখন সে নিজেই সারপ্রাইজড। ফুপাতো ভাই হিসেবে সাথীর সাথে রঙ্গনের বিশেষ সখ্যতা নেই। রঙ্গন বরাবরই শহরেই বড় হয়েছে, নানিবাড়িতে খুব কমই যাওয়া হয়েছে তার। কিন্তু সাথীর সাথে জুড়ে থাকা আরেকটা নাম চিত্রলেখা। রঙ্গন সাথীর কথা জানতে পারার পর থেকেই খানিকটা ম্লান হয়ে পড়েছে। তারপর যখন শুনলো তার মা তার মামীসমেত সাথীকে জোর করে শ্বশুরবাড়ি থেকে আনার চেষ্টা করেছে, এতে সে আরো উদাস হয়ে পড়লো।

-রঙ্গন, তোর মা কল করেছিল। সাথী আসেনি, এখন ও সাথীর মাকে নিয়ে ও বাড়িতেই আছে।

-সাথী আপু যখন আসবেই না, তখন তাকে জোর করে লাভ কী বাবা?

-সেটা তোর মা বুঝলে তো হতোই। এ বিয়েটা শুরু থেকেই মানেনি সে, এমনকি বাড়ির প্রতিটা সদস্যকে অপছন্দ করতো সে। চিত্রলেখা এখানে আসাতে তার প্রতি তোর মায়ের অপছন্দ বেড়েছে। এখন সুযোগ পেয়েছে নিজেকে সঠিক এবং সাথীর বরকে ভুল প্রমাণ করার। এ সুযোগ সে কী করে ছাড়বে সে?

-ও বাড়িতে তাহলে যাওয়া উচিত বাবা।

-রঙ্গন, তুমি এসব থেকে দূরে থাকো।

-কিন্তু বাবা…

-যা বলছিলাম করো। বাইরে থেকে এসেছো, যাও ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নাও।

রঙ্গন কিছু না বলে নিজের ঘরের দিকে এগোল। বাড়ির পরিবেশ বেশ শান্ত। নির্ঘাত অহম ঘুমিয়েছে। রঙ্গন ঘরে ঢুকেও স্বস্তি পেল না। চিত্রলেখার জন্য মন কেমন করতে থাকলো তার। অদ্ভুত রকমের অস্বস্তিতে তার আর খাওয়াও হলো না রাতে।

ঘড়ির কাঁটায় এগারোটা। সাথী নিজের ঘরে বিনিদ্র রাত্রি যাপন করছে। অপর্ণা, অর্ণব ঘুমিয়েছে। চিত্রলেখা নিজের ঘরে বসে সাথীর কথা ভাবছে। অনিকের থেকে যথাযথ স্নেহ না পেলেও সে তাকে সর্বদাই সম্মান করে এসেছে কিন্তু গতদিন নিজের ভাইয়ের মেসেঞ্জারে আসা ছবিটা তার মনে সন্দেহ বাড়িয়ে তুলেছে। তার মনে ভয় হয় কেবল নিজের ভাবীকে নিয়ে। যে মানুষটা প্রেমের টানে নিজের পারিবারিক সুখ বিসর্জন দিয়ে এসেছে, সে যেন দিনশেষে কষ্ট না পায়। চিত্রলেখার ফোন ভাইব্রেট করে উঠলো। রঙ্গন কল করেছে। চিত্রলেখা কল রিসিভ করবে কিনা ভেবে তৎক্ষণাৎ রিসিভ করলো। ঘরের দরজা লাগানোই আছে তবে শব্দ বাইরে যেতে পারে ভেবে সে শীতের মধ্যেও ফ্যানের সুইচ অন করলো।

-আসসালামু আলাইকুম।

-ওয়ালাইকুম সালাম। কেমন আছো চিত্রলেখা?

-আল্লাহ যেমন রেখেছেন তেমনই আছি। আপনি এতো রাতে কল করলেন?

-আসলে আমি খুব দুঃখিত। মা তোমাদের ওখানে গিয়েছিল শুনলাম। সাথী আপুকে জোর করে আনার চেষ্টাও করেছে নাকি।

-আপনার দুঃখিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। আপনি তো কিছু জানতেনও না। তাছাড়া এমন পরিস্থিতিতে পড়লে অনেক সময় স্ত্রীরাই স্বামীকে বিশ্বাস করতে পারে না, আর তো শ্বশুরবাড়ির লোকজন।

-সাথী আপু তো বিশ্বাস করছে, ভালোবাসার টান এটাই হয়তো।

-ভালোবাসার টানেই সবসময় এমন হয়না, অনেক ভালোবাসার সম্পর্কেই বিশ্বাস থাকে না।

-আমার মন বলছে অনিক ভাইয়া কিছু করেনি, তুমি দুশ্চিন্তা করো না চিত্রলেখা।

-আমার ভাইকে আমিই পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছি না, আপনি কিভাবে পারছেন?

-আমার মন বলছে। আমার পরিচিত একজন উকিল আছে।

-আমরা কথা বলেছি উকিলের সাথে। উনি সব কাগজপত্র রেডি করছেন বেইলের জন্য।

-ওহ আচ্ছা। চিন্তা কোরো না, সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।

-হুম ইনশাআল্লাহ। আর কিছু বলবেন আপনি?

-না, মনে হলো বন্ধু হিসেবে বিপদের সময় পাশে থাকা দরকার।

-আমরা বন্ধু?

-বন্ধু নই?

চিত্রলেখা কিছু না বলেই কল কেটে দিল। রঙ্গনের থেকে দূরে থাকার চেষ্টাটা সে বরাবরই করে। আশফিনা আহমেদের দৃষ্টি ভয় পায় সে। ভদ্রমহিলা তার গোটা পরিবারকে অপছন্দ করে আর চিত্রলেখা যেন অপছন্দের তালিকায় শীর্ষে। সে জায়গা থেকে রঙ্গনের সাথে বন্ধুত্ব করা আশফিনা আহমেদের কাঠগড়ায় মৃত্যুদণ্ড সমপরিমাণ পাপ। তবুও রঙ্গনকে অবহেলা করার সর্বাত্মক চেষ্টা করেও সে ব্যর্থ। একটু বাদেই রঙ্গনের দ্বিতীয়বার কল আসলো। রিসিভ করলো চিত্রলেখা।

-এমন পরিস্থিতিতে এসব বলা আমার সত্যিই উচিত না। দুঃখিত, তবে আমি বন্ধু হিসেবে এতটাই অযোগ্য? চিত্রলেখা, আমার খারাপ সময়ে যখন আমি মানসিকভাবে অনেকটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলাম তখন তোমার সাথে কাটানো কিছুটা মুহূর্ত আমাকে ভালো রেখেছে। আমি তাই ধরেই নিয়েছিলাম আমরা বন্ধু। তুমি সত্যিই আমার জন্য খুব ভালো একটা বন্ধুর জায়গা দখল করে আছো। আমরা কি সত্যিই বন্ধু না?

-হ্যাঁ আমরা বন্ধু। এখন কল রাখুন।

চিত্রলেখা কেন যেন না বলতে পারলো না রঙ্গনকে। মুখের উপর বলে দিতে পারলো না যে আমরা বন্ধু না আর না কখনো বন্ধু হতে পারবো। এই না বলতে না পারাটা বোধহয় ভবিষ্যতে তাকে আরো বিপদে ফেলবে।

_______________

শনিবার আশফিনা আহমেদ আর এলেন না চিত্রলেখার বাড়িতে তবে সাথীর বাবা আলতাফ হোসেন এলেন। তিনি অবশ্য আশফিনা আহমেদের মতো সবাইকে উপেক্ষা করলেন না। সকলের সাথে বসে কথা বলে তবে সাথীর সাথে কথা বলার জন্য এগোলেন। সাথী নিরুত্তাপ ভাবলেশহীন হয়ে এক কোণে বসে আছে। এক টুকরো বিশ্বাসের ভেলায় চড়ে সমুদ্র পাড়ি দিতে নেমেছে সে। সারা রাত নির্ঘুম থাকার ফলে চোখজোড়া লাল হয়ে এসেছে।

-সাথী, মা আমার। এ কী অবস্থা তোর?

-আমি ঠিক আছি বাবা। তুমি কেন এসেছো এখানে?

-আমি অনিককে বিশ্বাস করি মা। ওকে নিরপরাধ প্রমাণ করতে যা করতে হয় আমি করবো। তুই চিন্তা করিস না।

-ধন্যবাদ বাবা।

-কিন্তু তুই নিজের এ অবস্থা করলে অনিককে কিভাবে সামলাবি মা? তোকে আমি এ অবস্থায় এখানে রেখে যেতে পারিনা। তোকে আমি ভরসা করতে পারছি না। তুই যদি নিজের ক্ষতি করে বসিস? তোকে আমি নিজের কাছে রেখে যা করার করবো। তুই চল আমার সাথে।

-বুদ্ধিটা খারাপ না বাবা। এটাও কি আমার ফুপুর বুদ্ধি? সাবাশ! কী তীক্ষ্ম বুদ্ধি!

-সাথী, তুই আমাকে বিশ্বাস করছিস না?

-বিশ্বাসের একটা অদ্ভুত ঘ্রাণ আছে বাবা। তোমার নিকট থেকে আমি সেটা পাচ্ছি না।

আলতাফ হোসেনের মুখের ভাব তৎক্ষণাৎ পাল্টে গেল। সাথীর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো।

-এরপর যদি তোমরা আমাকে জোর করো তবে তোমাদের নিজের মেয়েকে হারাতে খুব বেশি সময় লাগবে না বাবা।

-যার জন্য এতটা পাগল হয়েছিস, সে রেখেছে ভালোবাসার মর্যাদা? ও দোষী সাব্যস্ত হলে কী করবি তখন? কাউকে এতটা বিশ্বাস করিস না যেন বিশ্বাস ভাঙলে জীবনটাও চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায়।

-বিশ্বাসের বিশেষত্বই এটা বাবা। আমি না আমার বিশ্বাস ভাঙতে দেব আর না আমার জীবন।

আলতাফ হোসেন রেগে বেরিয়ে গেলেন। সাথী মেঝেতে বসে হাঁটু মুড়ে সেখানে মাথা রাখলো। চিত্রলেখা সাথীর পাশে গিয়ে সাথীকে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো। সাথী ভেঙে পড়লো না। শক্ত ইস্পাতের ন্যায় দৃঢ় সে কেবল প্রার্থনা করলো,”আল্লাহ আমাকে ধৈর্য দিও আমি যেন আসন্ন সব বিপদ মোকাবিলা করে আমার বিশ্বাস অটুট রাখতে পারি।” সাথীর চোখ শুষ্ক অথচ যাবতীয় যন্ত্রণা সে জমিয়ে রেখে বুকে এ মুহূর্তে। চিত্রলেখার চোখ ভিজে উঠে। মানুষটা এতটা দৃঢ় কী করে? এতটা বিশ্বাস? শুধুই কি ভালোবাসার কারণে?

অর্ণবের ফোন বেজে উঠলো। পুলিশ অফিসারের নম্বর ভেসে উঠছে স্ক্রিণে। আচমকা স্টেশন থেকে কল পেয়ে খানিকটা ভীত হলো সে। চটজলদি ফোন রিসিভ করলো। সেকেন্ড তিরিশেক সময় লাগলো অর্ণবের অপর প্রান্তের কথা বুঝতে। অতঃপর তার চোখের সামনে অন্ধকার ছেঁয়ে গেল। সামনে বসে থাকা সাথীকে কিভাবে কথাটা বলবে ভেবে তার বুক কাঁপতে লাগলো। কান্নাগুলো আটকে আছে কোনোরকম, সাথীর সামনে কাঁদতে পারবে না সে আর না সাথীকে এ মুহূর্তে কিছু জানানোর সামর্থ তার আছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here