#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৪
১০.
আমাদের সমাজে রাজিয়া,রেণু মতো কিছু মেয়েরা আছে।যারা টাকা খোঁজে না।একটা ভালো মনের মানুষ খোঁজে।একটা ভালোবাসার হাত খুঁজে।যাকে বিশ্বস্ত করে বাকিটা জীবন পার করে দিতে পারে।যে হাত আঁকড়ে ধরেছে তা মৃত্যু আগ পর্যন্ত ছাড়ে না।টাকায় যদি সুখ কেনা যেতো।তাহলে পৃথিবীতে বিশ্বাস,ভালোবাসা নামক বস্তুটি থাকতো না।
স্বামী,স্ত্রীর সম্পর্ক পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পবিত্র সম্পর্ক।যখন স্বামী,স্ত্রীর মাঝে ভালোবাসা থাকে।তখন সেই পরিবারটা অনেক সুন্দর হয়।এবং তাদের সন্তানরা অনেক ভালোভাবে বেড়ে উঠতে পারে।একটা পরিবারে সুন্দর পরিবেশ তখনই গড়ে ওঠে যখন স্বামী,স্ত্রীর মাঝে আন্ডারস্ট্যান্ডিং ভালোবাসাও বিশ্বাস থাকে।এবং সময় থাকতে ভালোবাসার মানুষটাকে যত্ন নেয়া দরকার।কারণ যেদিন সেই ভালোবাসার মানুষটা থাকবে না।সেদিন আফসোস করা ছাড়া আর কোন কিছুই করার থাকে না।
“ইকড়ি মিকড়ি চাম-চিকড়ি,
চামের কাঁটা মজুমদার,
ধেয়ে এল দামোদর।
দামোদরের হাঁড়ি-কুঁড়ি,
দাওয়ায় বসে চাল কাঁড়ি।
চাল কাঁড়তে হল বেলা,
ভাত খাওগে দুপুরবেলা।
ভাতে পড়ল মাছি,
কোদাল দিয়ে চাঁছি।
কোদাল হল ভোঁতা,
খা কামারের মাথা।”
রেণু সন্ধ্যা বেলা ছেলেকে সরিষা তেল মাখছিল।স্বাধীন মাগরিবের নামাজ পড়ে চাল নিয়ে আসবে ব’লেছে।তাই স্বামী না আশা পর্যন্ত ছেলের হাতে,পায়ে তেল মালিশ করছে।পুতুল পাশে বসে বাবুর হাত পা নাড়াচাড়া দেখছে।মুখ দিয়ে কিসব অদ্ভুত আওয়াজ করে।সেসব শুনতে ভালোই লাগছে।মামী ছড়া বলতে বলতে ছেলের তেল দেওয়া শেষ করে।পুতুল মুখে হাসি ফুটে।
-;পুতুল মা,একবার গিয়ে দেখে এসো।তোমার মায়ের নামাজ পড়া শেষ হয়েছে কি-না।সে কখন বসেছে নামাজে এখনো উঠে আসলো না।তুমি একটু দেখে এসোও।
মামী বলতে দেড়ি পুতুল দৌড়ে মায়ের ঘরে যেতে দেড়ি করলো না।রুমে আসতেই দেখে মা জায়নামাজে ঘুমিয়ে পড়েছে।চোখে তার পানি দৃশ্যমান।পুতুল মায়ের চোখের পানি নিজের হাত দিয়ে মুছে দিতে নিলেই রাজিয়ার ঘুম ভেঙে যায়।মেয়েকে দেখে বলল,
-;আমার মা’টা কি করে হুম?লুকিয়ে বুঝি মায়ের চোখের পানি মুছে দেওয়া হচ্ছে।এই দিকে এসে বসো।পুতুল বসে পড়তেই তিনবার সূরা ইখলাস,দুইবার আয়তুল কুরসি পড়ে মেয়ের পুরো শরীরে পর পর তিনবার ফু দিয়ে দিলো।
-;আল্লাহ যেনো আমার মায়ের সকল বালা মসিবত দূর করে দিক।
১১.
স্বাধীন ভাই বাসায় আছেন না-কি?একটু বাহিরে আসুন।কথা আছে।
-;কেডা ডাকে? দাঁড়া আইতাছি।
স্বাধীন বাহিরে হারিকেন নিয়ে আসতেই।
-;আরে সুমন তুমি।এত রাইতে আমার বাড়ি।কি মনে করে আইলা?
-;মেম্বার,মাদবরের কাছে বিচার দিছে।কাল সকালে আপনাদের পরিবারের সবাইকে মাদবের বাড়িতে ডাকছে।আপনার নামে বিচার বসাবে।
-;আমার নামে বিচার?আমার অপরাধ কি? কি করেছি আমি?
-;সেটা কালকে মাদবরে বাড়িতে গেলেই জানতে পারবেন।সুমন চলে গেছে।স্বাধীন চিন্তায় পড়ে গেল।
সকাল নয়টা মাদবরে বাড়িতে বিচার বসেছে।রাজিয়া,রেনু,পুতুল মহিলা আসনে দাঁড়িয়ে আছে।পর্দা ওপাশে দাঁড়িয়ে শুনছে এলাকার গুনি মান্য লোকদের কথা।স্বাধীন পুরুষদের প্রথম সারিতে!দুই হাত পিছনে ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে।
-;মেম্বার যা বলো তা শুনলাম।তুমি তোমার বোনরে বাড়িতে জায়গায় দিয়েছো।তা মিয়া তুমি কি গ্রাম নিয়ম নীত ভুলে গেছো?তোমার বোনের জন্য গ্রামের মেয়েরা বিশৃঙ্খল পথে যাইবো।তা আমরা মাইনা নিবো কেন?আমরা চাইনা আমাদের গ্রামের মেয়েরা পথভ্রষ্ট হোক।তোমার বোনের মতো এই গ্রামের মেয়েরা পরপুরুষ সাথে পালিয়ে যাক।এটা কোনোদিন মাইনা নিমুনা।তাই আজ রাতের মধ্যেই তুমি তোমার বোনরে গ্রাম ছাড়তে বলবা।যদি না ছাড়ে তাহলে কিন্তু খুব খারাপ হইবো।
-;মাদবর চাচা আপনি রায় দিয়েছেন আমি এবং গ্রামের সকলে তা শুনছে।কিন্তু আমার বাবা বেঁচে থাকতে যে কথা দিয়ে গেছে।তার কথা কিভাবে ফেলে দেই কন?
-;কি বইলা গেছে তোমার বাপ?একটু খুইল্লা বল দেখি।
-;আপনি তো জানেন আমরা এক ভাই এক বোন।এতে আর কোনো অংশীদার নেই।আব্বা মৃত্যু আগে সম্পত্তির দলিল লিখিত করে গেছেন।সেখানে উল্লেখযোগ্য করা হয়েছে তার সম্পত্তি ছেলে,মেয়ের দু’জন উভয় প্যাপ্ত হক।আমি তোও আমার সমস্ত সম্পত্তি ভাগ বুঝে নিয়েছি।কিন্তু তার মেয়ে ভাগের অংশের দাবিদার আমি নই।আব্বা বলেছিলেন।তার মেয়ের সেই সংসারের বেশিদিন ঠিকতে পারবেনা।ঠিক চলে আসবে।যদি ফিরে আসে গ্রামে কেউ তাকে গ্রহণ করুক বা না করুক।তার ভাগের অংশের জায়গায় একটা ঘর তুলে দিতে।সেখানে সে নিজের মতো থাকবে।সমাজের সাথে তার কোনো লেনদেন হবে না।সমাজ থেকে বিতারিত এক ঘরে ঠাঁই হইবো।কারো সাথে তার কোনো কথা নাই।গ্রামের মেয়ে হয়ে যখন পালাইয়া গেছে।এটা তার শাস্তি হইবো।আর যদি ফিরে এসে!আবার যদি অন্য কোথাও চলে যায়?তাহলে সে তার শাস্তি থেকে বেঁচে গিয়ে ভালোই থাকবে।মাঝ থেকে তারা সাজা মাফ।আর আব্বা খুব কষ্ট পাইবো।এখন আপনারা ভাবেন তাকে শাস্তি দিবেন।না-কি গ্রাম ছাড়া করবেন।এই যে তার লিখিত দলিল।মাদবরের সামনে টেবিলের ওপর দলিল রাখলাম।আমার কথা বিশ্বাস না হইলে স্ব চোখে দেইখালন।স্বাধীনের কথা শুনে মেম্বারের কপালে সূক্ষ ভাজ পড়ে।স্বাধীন যে চালাকি করে তার খেল খতম করবে।একটু ধারণা ছিল না।স্বাধীনের কথায় সবাই চিন্তায় পড়ে গেল।
-;সত্যি তোও গ্রাম ছেড়ে চলে গেলে সে আরো ভালো থাকবে।কিন্তু গ্রামে রাইখা সাজা দিলে সব মাইয়াগো ভুল করার সাহস পাইবো না।তাই মাদবর দলিল অনুসারে নিজের বক্তব্য পেশ করেন।
-;রাজিয়া এই গ্রামে থাকব এক ঘরে।কেউ তার সাথে মিশতে পারবে না।যদি মিশবার চেষ্টা করে তাহলে তার সাজা হইয়া যাবো সঙ্গে সঙ্গে।মাদবরে কথার ওপর গ্রামের মানুষ আর কোনো কথা বলতে পারলো না।তার সিদ্ধান্ত ওপর সবাই মান্য করল।কিন্তু মেম্বার মিয়ার শান্তি লাগলো না।সে ভরা মজলিস থেকে হনহন করে চলে গেলো।সবাই চলে যেতেই স্বাধীন বিজয়ের হাসি দিলো।আর যাই হোকনা কেন?সে বোনকে একলা পথে আর ছাড়বে না।এতে যত বিপদসংকুল হোকনা কেন?
-;তোরা সাবধানে বাড়িতে যা আমি আইতাছি।
ভাইয়ের কথা সায় দিয়ে বাড়ি পথে হাঁটা ধরলো রাজিয়া।শরীরটা তার আজকাল ভালো যায় না।মনে মাঝে ভয় হয় সে তার সন্তানকে সুষ্ঠুভাবে দুনিয়ায় আনতে পারবে তোও?
১২.
রোহিতপুর গ্রামে ঘটক সাব আসছেন।মুখে তার পান।সাড়া রাস্তার পথে পিক ফালায়।আর স্বাধীনদের বাড়ি খোঁজ করেন।
স্বাধীন উকিল সাহেবের সামনেই বসে আছে।
উকিল সাহেব দলিলটা পড়ে স্বাধীন দিকে তাকিয়ে বলল,
-;আর ইউ শিয়র।তুমি এটাই করতে চাও।
-;হ্যা।আমি সবটা ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।এই দলিল অনুসারে আপনি দু’টো দলিল লিখিত তৈরি করুন।একটা রাজিয়া অপরটি স্বাধীন।
-;ওকে হয়ে যাবে।তবে সময় লাগবে।নামজারী,রেজিষ্ট্রেশন,দলিল সব মিলিয়ে দুটো করে ভাগে প্রচুর টাকা টালতে হবে।এই মুহূর্তে এত টাকা তোমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব।তোমার কষ্ট হবে স্বাধীন।
-;হোক।তবুও সব কিছু করুন।
-;তিন,চারমাস মধ্যেই তুমি তোমার সব কাগজ পএ পেয়ে যাবে।
-;ধন্যবাদ।আসছি।
-;এটা কিন্তু ঠিক নয় স্বাধীন।তুমি আমার বন্ধু হও।কোনোদিন তুমি আমার সাথে ঠিক করে দুটো কথা অন্তত বলোনি।এতে আমার দোষ কোথায়?হ্যা মানছি আমি,এক সময় রাজিয়াকে আমার ভালো লাগতো।সেই অবধি সীমা রেখেছি।কখন তা পার করিনি।শুধু বিয়ে ব্যাপারটা তোমার আব্বাকে জানিয়ে রেখেছিলাম।পড়াশোনা শেষ করেই আমাদের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল।যে অনুভূতি তার জন্য অনুভব করতাম।সে বুঝতে পারেনি।কেউ তার অপেক্ষা করছিল।সাতটা বছর চলে গেল।কিন্তু তুমি সেই একই রকম সরল,হাসি খুশি রইলেনা।রাজিয়া চলে যাওয়ার,চার বছর পর আমি মায়ের কথায় তার বান্ধবী মেয়ে বিয়ে করেছি।চারটি বছর তোও কম নয়।তুমি বিয়ে করেছে তিন বছর হলো।আমরা কি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারি না আগের মতোও?সব ভুলে কি বন্ধু সম্পর্ক আবার গড়ে তোলা যায় না।
-;আপনি একজন সম্মানিত ব্যক্তি।আপনার সাথে আমার মতো গরিব চাষার ছেলের বন্ধুত্ব জমে না।
-;স্বাধীন আমার কথা শোন।স্বাধীন চলে যেতেই হতাশার শ্বাস ফেললো রাদিফ শেখ।
তুই আজ ও আমায় বুঝতে পারলি না।
১৩.
রাজিয়া চোখের সামনেই ঘটক সলিমুল্লাহ দাঁড়িয়ে।তাঁকে দেখেই চমকে উঠে ভেতর রুমে চলে যায়।স্বাধীন ছোট্ট মোড়া টেনে বসতে দিলো।
-;বসতে আসি নাই।কিছু কথা ব’ইলা চইলা যামু।
-;কি কথা ব’লেন?
-;তোমার বোন জামাই আবার বিয়ার পিরিতে বসতাছে।তা কি জানো?এবার মা,পোলা মিইলা মাইয়া বাড়ি থেকে মোটা অংঙ্কে টাকা আর ঘরের জিনিসপত্র চাইছে।তাদের চাহিদা ব্যাপক।এতো চাহিদা আমি জীবনেও দেখি নাই।
পনেরো লাখ টাকা যৌতুক হিসেবে চাইছে।ছেলের জন্য মোটরবাইক।ঘরে জিনিসপএ সেগুন কাঠের তৈরি।এমন আর কত চাহিদা তাদের।মাইয়ার বাপের বিদেশি টাকা,পয়সা অনেক।তাদের এসব চাহিদা মেটানোর ক্ষমতা আছে।কিন্তু আপনাদের ব্যাপারটা তাদের কাছ থেকে লুকিয়ে বিয়ে ঠিক করছে।এখন আপনি যদি সকল প্রমাণ নিয়ে সব সত্যি কথা ব’লেন।তাহলে মা,ছেলের হাজতবাস নিশ্চিত।
-;বিয়া কবে?
-;সামনের শুক্রবার।
-;ঠিক আছে আমি এটা নিয়ে পড়ে ভেবে দেখবো।
-;আচ্ছা তাইলে আসি।ওহ আরেকটা কথা। বলছিলাম যে,আমি যে আইসা আপনারে খবরটা দিয়েছি।এটা জেনো তারা না জানে!
-;হুম জানবে না।
চলবে…
এই যে দুষ্ট পাঠকমহলবাসী।সবাই মোস্তফা সরোয়ারে বিয়ার দাওয়াত খাওয়ার জন্য রেডি হন।আর সাথে গিফট নিয়ে আসতে কিপ্টামি কইরেন না।আমি মোস্তফা সরোয়ার জন্য কি গিফট নিবো ভাবছি?আপনারা কি দিবেন সেটা কমেন্ট ঝটপট ব’লে ফেলুন?