লুকোচুরি_গল্প #পর্ব_১৩ #ইশরাত_জাহান 🦋

0
306

#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_১৩
#ইশরাত_জাহান
🦋
নাস্তা শেষ করে নীরা ঘরে আসে।দ্বীপ ও মিস্টার সমুদ্র মিটিং করছেন নিজেদের ব্যাবসা নিয়ে।দ্বীপ বাবার ব্যাবসায় যোগ না দিলেও বিভিন্ন পরামর্শে বাবার সাথে থাকে।

নীরা ঘরে এসে ঘরটিকে ভালোভাবে পরখ করে।দ্বীপের ঘরের পাশে একটি বড় শেলফ আছে যেখানে ভিন্ন ভিন্ন গল্পের বইতে ভরা।বিসিএস এর বইগুলো এখনও সাজানো আছে।নীরা শেলফের কাছে এসে বইগুলো দেখতে থাকে।নীরা নিজেও টুকটাক গল্প পড়ে।শেলফের ভিতর ভালোভাবে চোখ বুলিয়ে একটি কালো মোটা ডায়েরি দেখতে পেলো দ্বীপ।ডায়েরিটি দেখে নীরার মনে আতঙ্ক বিরাজ করলো।সাথে সাথে ডায়েরিটি হাতে নিয়ে প্রথম পৃষ্ঠা বের করলো।অনেক পুরনো লেখা এখানে।খুব সুন্দর করে প্রথম পৃষ্টায় লেখা,
চন্দ্রের সাথে করিতে দেখিলাম তোমাকে আলিঙ্গন।
উড়ন্ত পাখি যখন চন্দ্রকে সাক্ষী রেখে প্রকাশ করে মনের অনুভূতি।
সেই চিত্র দেখিয়া তোমাকে ডাকিলাম ‘আমার চন্দ্রপাখি’।
অশ্রু ভরা নয়নে চন্দ্রের দিকে ফিরে আছে আমার সেই কিশোরী কন্যার অনুভূতি।
আজই উপলব্ধি করেছি আমি,
ভালোবাসি ভালোবাসি তোমায় আমার চন্দ্রপাখি।”

লেখাটুকু পড়ে নীরা বুঝলো দ্বীপ কাউকে ভালোবাসে এবং তাকেই সে চন্দ্রপাখি বলে ডাকে।কিউরিসিটি নিয়ে বাকি পৃষ্ঠা পড়তে যাবে ঠিক তখনই দীপান্বিতা এসে বলে,”আমার লিটিল ভাবী আসবো কি?”

নীরা ডায়েরির পাতা বন্ধ করে শেলফে রেখে দেয়।তারপর দীপান্বিতার দিকে তাকিয়ে বলে,”আমার সুইট কিউট ননদিনী আসো।”

দীপান্বিতা ঘরে ঢুকে নীরার দিকে ফোন এগিয়ে দিয়ে বলে,”তোমার কল এসেছিলো। আর ফোন সবসময় এদিক ওদিক রেখো না।জানোই তো না চাইতেও এক কালসাপ পুষতে হয়।আমার দাদীন আম্মু এরা তো সুখে ছিলোই না এবার উঠে পড়ে লেগেছে তোমার পিছনে।নিজের সেফটি নিজেকে বুঝতে হবে।দাদাইয়ের কথা রাখতে বাবা এগুলো সহ্য করে।যতই হোক দাদাই তো বাবার বাবা ছিলেন।রক্ত ধোঁকা দিলেও রক্তের টান ফিকে হয় না।আমার বাবা তার প্রমাণ।তাই বলছি যতটুকু পারো নিজের জিনিসগুলোর প্রতি যত্নশীল হও।”

“পিংকি এখন কেমন আছে?”

“আমি ওকে লেবুর রস খাইয়ে দিয়েছি।ঝাল কমেছে অনেকটাই।এখন ঘুমিয়ে আছে।তোমার খাদ্য বিশেষজ্ঞ ভাই কল দিয়েছিলো অনেক আগে।বলতে ভুলে গিয়েছিলাম।টেবিল পরিষ্কার করার সময় তোমার ফোন দেখে মনে পড়লো।এই নেও।”

বলেই দীপান্বিতা ঘর থেকে বের হতে নিবে কিন্তু নীরার কথায় থমকে গেলো।নীরা বলে ওঠে,”আমার ভাইয়ের কথা উঠলে তোমার গলা কাপে কেনো?অন্য সময় কথা বলতে গেলে তো এমন হয় না!”

দীপান্বিতা এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,”তোমার বুঝতে ভুল হয়েছে হয়তো।তেমন কিছুই নেই আমার গলার ভিতর।অন্যদের বেলায় যেভাবে কথা বলি তোমার ভাইয়ের বেলায়ও সেভাবেই কথা বলি।”

বলেই প্রস্থান করে দীপান্বিতা।দীপান্বিতা পিছন ফিরে কথা বললেও আয়নায় দীপান্বিতার চোখের পানি দেখতে পায় নীরা। বুকশেলফ এর পাশেই যে আড়াআড়িভাবে আয়না রাখা আছে।সেখানে দীপান্বিতার এক পাশ খুব ভালোভাবেই দেখা যাচ্ছে।দীপান্বিতার চোখ থেকে বের হওয়া অশ্রুর রহস্য বুঝতে পরলো না।কিন্তু কিছু একটি কাহিনী তো আছে এবং তা ভালোবাসার পর্যায়ে এটা উপলব্ধি করতে পারছে নীরা।

বেশি কিছু না ভেবে নীরবকে কল দেয়।সাথে সাথে কল রিসিভ করে নীরব।বোনকে দেখে বলে,”তোর জন্য একটি সারপ্রাইজ আছে শুধু তুই না বাসার সবার জন্য।বলতো কি সেই সারপ্রাইজ?”

“ক্যাডার সাহেবকে বিয়ে করে যে সারপ্রাইজ হতে হয় তাতে তোমার দেওয়া নতুন সারপ্রাইজ মাথায় আসছে না।তুমিই বলে ফেলো।”

হো হো করে হেসে দেয় নীরব।দ্বীপকে নীরব ভালো করেই জানে।একসাথে প্রায় চায়ের দোকানে আড্ডা জমাতো।নীরব যেতো দীপান্বিতার হয়ে দ্বীপকে পটাতে। বড় ভাই পটে গেলে আর তো কিছুই লাগে না।কিন্তু দ্বীপ তার বিদ্যাসাগর নিয়ে কথা বলতো বেশি।এখন সে বুঝতে পারছে নীরাকেও ঠিক কিভাবে ট্রিট করে।রসকষহীন বই পড়ুয়া দ্বীপ আর তার উড়নচণ্ডী ফাঁকিবাজি বোন যেনো বইয়ের এপিঠ ওপিঠ।নীরব হাসি থামিয়ে বলে ওঠে,”আমার পরীক্ষা শেষ হয়েছে অনেক আগে।আজ রেজাল্ট পাবলিক হয়েছে।আমি সাকসেস হয়েছি বোন।আমার এত বছরের কষ্টের ফল পেয়েছি। আর তোদের থেকে দূরে থাকছি না।এক মাসের মধ্যে বাংলাদেশে ব্যাক করছি।”

ভাইয়ের কথা শুনে নীরা খুশিতে লাফিয়ে ওঠে।সাথে সাথে বলে,”হুররে আমার ভাই খুব তাড়াতাড়ি চলে আসবে।”

কিছুক্ষণ মজা করে দীপান্বিতার কথা মনে পড়লো নীরার।তাই সে নীরবকে ইন্ডিরেক্টলি বলে,”তুমি বিডিতে আসার পর আমরা তোমার জন্য মেয়ে দেখবো।রূপবতী গুনবতী কর্মঠ ভদ্র দেখে মেয়ে নিয়ে আসবো।যেমনটা তুমি চাও।জাস্ট এক্সাম্পল আমার কিউট ননদ দীপান্বিতা আপু।তার মতো দেখে বউ পেলে খুশি হবে তো?”

নিজের বিয়ের কথা শুনে মুখ ফ্যাকাশে হয়ে আসে নীরবের।আবার তারউপর দীপান্বিতার নাম নিয়ে উদাহরণ।পুরো দীপান্বিতাকেই তো তার চাই।তার মতো আবার কি!কিন্তু কোনো প্রতিউত্তর করলো না নীরব।লোক দেখানো এক স্মিত হাসি দিয়ে নীরব বলে,”সবে তো পড়াশোনা শেষ এখন সেটেল হয়ে নেই।তারপর দেখা যাবে।রাখছি বোন,ভালো থাকিস।”

ভাইয়ের শুকনো মুখ দেখে নীরা শিওর হলো ডাল মে কুছ কালা হে।কল কাটার পর বলে,”ভাই আর ননদের কেমিস্ট্রি খুব গভীর।আমাকে এখন ডিটেকটিভ নীরা হতে হবে।কি থেকে কি হয়েছে এগুলো আমাকে বের করতে হবে।সাথে আবার আছে ক্যাডার সাহেবের ওই চন্দ্রপাখি।কতকিছু সম্পর্কের গোয়েন্দা গিরি করবো আমি!উফ এত প্রেসার নেওয়া যায় না।”

“কিসের প্রেসার নেওয়ার কথা বলছো তুমি?”

ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে দ্বীপ।নীরা তাকায় দ্বীপের দিকে।আপাতত এনাকে কিছু বলা যাবে না।ইনি থাকুক ইনার বিদ্যা নিয়ে।

“কিছুই না।এই যে আর আড়াই মাস পর আমার এক্সাম।এখন তো স্যার আমার স্বামী তাই তার শুনাম রাখতে ভালো রেজাল্ট করতে হবে।এটাই ভাবছি।”

“বাব্বা এত চিন্তা আমার জন্য?”

উত্তর দেয় না নীরা।সাথে সাথেই কেয়ার কল আসে।নীরা রিসিভ করে বলে,”হ্যা বল!”

“দোস্ত আমাদের বিদায় অনুষ্ঠান হবে।সবাই শাড়ি পড়বো। আর বিভিন্ন প্রতিযোগিতা আছে।আমি নৃত্যে নাম দিবো।তুই কি করবি?”

“আমি কি করবো মানে?আমিও নৃত্য করবো।”

ওপাশ থেকে কোনো উত্তর আসার আগে নীরার কান থেকে ফোনটি নিয়ে দ্বীপ বলে,”ও কোনো নৃত্য করবে না।যাবে বক্তৃতা শুনে চলে আসবে।”

বলেই কল কেটে দেয়।কেয়া ভয় পায় দ্বীপের কর্কশ কণ্ঠ শুনে।দ্বীপ ফোন কাটার পর বলে,”সাইকো স্যার।”

নীরা কোমরে হাত দিয়ে দ্বীপের দিকে ডান ভ্রু উচু করে তাকিয়ে বলে,”আমি নৃত্য করলে আপনার সমস্যা কোথায়?”

“আমি বলেছি তো তুমি নৃত্য করবে না মানে করবে না।”

“আমি নৃত্ততে নাম দিবো এবং নৃত্য করবো।”

“আমি বলেছি তো না।”

“হ্যা দিবো নাম।আমি নাকি কোনো কিছু পারি না।অযোগ্য তাহলে নৃত্য করে দেখিয়ে দেই আমার কি কি যোগ্যতা আছে।”

“তোমাকে যতটুকু যোগ্য হওয়া লাগবে তা আমি দেখে নিবো।ভালোভাবে বলছি কোনো নৃত্য করতে পারবে না তুমি।”

“আমি নাম দিবো দিবো দিবো।”

কিছুটা চিল্লিয়ে বলে নীরা।ব্যালান্স হারা হয়ে দ্বীপ ঠাস করে এক থাপ্পড় বসিয়ে দেয় নীরার গালে।নীরা অবাক হয়ে যায়।এতদিন থাপ্পড় দিলেও অন্তত বুঝতো পড়াশোনার জন্য কিন্তু আজকের থাপ্পড় কি না সামান্য এক অংশগ্রহণের জন্য।এটাও নীরার সমস্যা না।সমস্যা হলো দ্বীপ ও নীরার কথাগুলো দরজার পাশে থেকে পিংকি আরি পেতে শুনতে থাকে।এখন দ্বীপ তাকে থাপ্পড় দিয়েছে এটাও পিংকি দেখে খুশি হয়।সবকিছু নীরা ভালোভাবেই লক্ষ্য করে কিন্তু দ্বীপ উল্টোদিকে ফিরে ছিলো বলে পিংকিকে দেখে না।

নীরা বাম গালে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে ছিলো। দ্বীপ নীরাকে আদেশের সুরে বলে,”আমার কথার হেরফের হওয়া আমি পছন্দ করি না।নেক্সট টাইম যেনো কোনো অন্যায় আবদার নিয়ে তর্ক করতে না দেখি।”

বলেই ব্যালকনিতে যেয়ে দাড়ায় দ্বীপ।নীরা আজ প্রচুর কষ্ট পায়।কোনো কথা না বলে মিনিকে জড়িয়ে কম্বল মুড়ি দেয়।কম্বলের নিচে ফুফাতে থাকে।

ঘন্টাখানেক নিরবতা পালন করে দ্বীপ।রাতের খাবার কেউই খায় না।দীপান্বিতা এসে দেখে নীরা ঘুমিয়ে আছে। দ্বীপও ব্যালকনিতে চুপচাপ।ভাই রেগে থাকলে দীপান্বিতাও কোনো কথা বলে না।রাগের সময় দ্বীপের মাথা কাজ করে না।তাই তখন সবাই নিরবতা পালন করে।

এগারোটার দিকে ঘরে এসে দ্বীপ দেখে নীরা ঘুমিয়ে গেছে।কোলে মিনিকে নিয়েছে।হালকা হাসে দ্বীপ।ঘুমন্ত নীরার অতি নিকটে এসে নীরার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।নীরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,”আমার চন্দ্রপাখিকে কারো সামনে যোগ্য প্রমাণ হতে হবে না।সে যেমন আছে তেমনই বেস্ট।আমিতো আমার এই দুষ্টু মিষ্টি বউকে বেশি ভালোবাসি।কেনো হতে হবে তোমাকে সবার সামনে পারফেক্ট?তুমি আমার কাছে এমনিতেও পারফেক্ট।সবার সামনে কোমর দুলিয়ে ধেই ধেই করে নৃত্য করবে আর ছেলেরা তাকিয়ে থাকবে এটা আমি কিছুতেই সহ্য করবো না।এটা তো এক অন্যায় আবদার।তুমি কেনো অন্য ছেলেদের সামনে নাচতে যাবে।তুমি আমার জীবনে আমার ব্যাক্তিগত নারী আমার চন্দ্রপাখি।”

বলেই ঘুমন্ত নীরার বাম গালে গুনে গুনে দশটি চুম্বন এঁকে দেয়।তারপর লাইট অফ করে অন্যপাশ হয়ে ঘুমিয়ে পরে।

দ্বীপ লাইট অফ করার সাথে সাথে চোখ মেলে তাকায় নীরা।সে এতক্ষণ চোখ বন্ধ করে হালকা নিদ্রায় ছিলো।গভীর নিদ্রা তখনও বিরাজ করেনি নীরার চোখে।অন্ধকার রুমে বাইরে থেকে আসা চাঁদের আবছা আলোয় দেখলে থাকে দ্বীপকে।তারপর তার বাম গালে হাত দিয়ে অনুভব করলো।এই মাত্র তার ক্যাডার সাহেব তাকে চুম্বন এঁকে দিলো।তাও আবার গুনে গুনে দশটি।যখন দ্বীপ এই কাজটি করেছিলো নীরার হৃদপিণ্ড কেপে উঠেছিলো।দ্বীপের মুখে চন্দ্রপাখি নাম শুনে নীরা বুঝতে পারলো ডায়েরির ওই কন্যাটি কেউ না বরং সে নিজে।সময় করে দ্বীপের অগোচরে পড়তে হবে ডায়েরিটি।জানতে হবে দ্বীপের মনে তাকে নিয়ে বিচরণ করা অনুভূতি।

চলবে…?

পরবর্তী পর্ব পেতে ইশরাত জাহান পেজটি ফলো দিয়ে সাপোর্ট করুন 🖤🦋

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here