#দোলনচাঁপার_সুবাস
#পর্বঃ৫
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা
বেলা ১২টা বেজে ১০ মিনিট। তালুকদার বাড়ির দোতলার সবচে ডানপাশের রুমটার দরজা এখনো লাগানো। ভেতরে হিমশীতল তাপমাত্রা, এসির টেম্পারেচার বেশ কমানো। সদ্য হওয়া দুপুরেও মেলা হয়নি জানালার পর্দাগুলো। রুমের মালিক উপুড় হয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। যেন বাহিরে ক’টা বাজে, কি হচ্ছে এসবে কোনো হেলদোলই নেই তার! সে দিব্যি আছে নিজের মতোন! এমন সময় দরজা খুলে রুমে প্রবেশ করেন নিশীথের মা, আসমা বেগম। রুমে ঢুকতেই হিমশীতল তাপমাত্রায় ভ্রুযুগলে ভাজ পড়ে তার। বাইরে থেকে এসেও তার গা শিরশির করছে। অথচ তার ছেলেটা দিব্যি খালি গতরে এত ঠান্ডার মধ্যে ঘুমোয় কেমনে? তিনি ভেবে পাননা।
কদম এগিয়ে সর্বপ্রথম পাশের টেবিল থেকে এসির রিমোট নিয়ে বন্ধ করে দেন বৈদ্যুতিক যন্ত্রটাকে। অতঃপর এক এক করে জানালার পর্দা সরিয়ে বারান্দার দরজা খুলে দেন প্রাকৃতিক আলো-বাতাস ঘরে প্রবেশ করবার জন্য! উনার মতে, তার ছোট ছেলে পুরোপুরি কৃত্রিমতায় অভ্যস্ত। আধুনিকতা ও চাকচিক্যের প্রতি নিশীথের এ আকর্ষণ তার কস্মিনকালেও পছন্দ নয়। রোজ বাসায় আসবে রাত করে, ঘুমোতে যায় ভোরে- এসব আচরণ তার মোটেও পছন্দ নয়। কিন্তু নিশানের বিদেশ যাওয়ার পর নিশীথই তার একমাত্র যক্ষের ধন এখানে, তাইতো ছোটছেলের প্রতি গভীর অনুরাগে কখনোই সেভাবে কিছু বলতে পারেননা তিনি ছেলেকে!
কেবলমাত্র রোজ সকালে নিয়ম করে তিনি নিশীথের রুমে আসেন। এসি অফ করে, দরজা-জানালা সব খুলে দিয়ে চলে যান। এতে ছেলে যারপরনাই বিরক্ত হলেও তিনি বিশেষ পাত্তা দেন না। তবে আজকে এ সময় রুমে আসার একটি কারণও আছে বটে! বেশ ক’দিন ধরেই তিনি মেয়ের প্রস্তাব পাচ্ছেন ছেলের জন্য। কিন্তু তার ছেলে আদৌ রাজি হবে কিনা অথবা মেয়ে দেখতে চাবে কিনা এ নিয়ে বেশ দ্বিধাদ্বন্দে আছেন তিনি। ছেলের সাথে কিভাবে কথা এগোবেন এসব নিয়ে আসমা বেগমের ভাবনার মাঝেই নিশীথ ঘুম ভাঙা কণ্ঠে বলে উঠলো,
—মা, এসি অফ করলে কেন? আর পর্দা টেনে দিলে কেন? এত আলো কেন রুমে! উফফ, এসব সহ্য হয়না!
ছেলের বিরক্তিতে আনমনে হাসেন আসমা বেগম। পরপরই নিশীথের পাশে গিয়ে দাড়ান, কোমড়ে হাত রেখে চিরাচরিত ভভংগিমায় বলেন,
—বেলা ১২টা যে পার হয়ে গেছে সে খেয়াল আছে, বাপ? নাকি সারাদিন লাটসাহেবের মতো পড়ে পড়ে ঘুমোলেই শুধু হবে? তোকে নিয়ে কি করবো আমি?
এতক্ষণে নিশীথের ঘুম পুরোপুরি ভেঙে গেছে। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে বিছানায়। দু হাতে চোখ ডলতে ডলতে বালিশের নিচ হতে কালো হাতাকাটা গেঞ্জিটা বের করে পড়তে পড়তে মায়ের উদ্দেশ্যে জবাব দেয়,
—তোমার কিচ্ছু করতে হবেনা, আম্মিজান। এক কাজ করো, আমায় বিয়ে দিয়ে দাও। বউ আসবে, আমার খেয়াল রাখবে। আর তুমি বসে বসে আরাম করবে।
আচমকা ছেলের মুখে বিয়ের কথায় যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে যান আসমা বেগম! তার জ্ঞানমতে, এর আগে কখনোই নিশীথকে তিনি বিয়ের কথা বলতে শুনেননি। যার ফলে ছেলেটার নিজের বিয়ের ব্যাপারে ওর আগ্রহ আছে কিনা সেটা নিয়েই এতদিন চিন্তিত ছিলেন তিনি। কিন্তু আজকে হঠাৎ ওর নিজ মুখে বিয়ের কথা বলায় যেন মৃতপ্রায় সব আশা প্রাণ ফিরে পায় তার! বেজায় খুশি হয়ে ছেলের পাশে বসে তিনি বলেন,
—সত্যিই তুই বিয়ে করতে চাইছিস? আবার মেয়ে আনলে মুখ ফেরাবি তো?
মায়ের কথার ধরনে নিশীথ হেসে ফেলে। মজার ছলেই বলে,
—তুমি পারবে আমার পছন্দের মেয়েকে এনে দিতে? যদি পারো তবে মুখ ফেরাবো কেন? নিজ উদ্যোগেই ওকে ঘরে তুলবো।
ছেলের কথায় যেন বেজায় উৎসাহ পেলেন আসমা বেগম। খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন,
—তোর কেমন মেয়ে পছন্দ আমায় বল! আমি যেখান থেকে পারি তোকে এনে দিবো।
মায়ের কথায় মুচকি হাসে নিশীথ। চোখ বন্ধ করে জানালা থেকে প্রবেশ করা শীতল বাতাসে বড় করে একটা নিঃশ্বাস নেয়। স্মৃতির মানসপটে মুহূর্তেই ভেসে উঠে ওড়নায় আবৃত মেয়েটার নিষ্পাপ মুখখানি। সে মুখে নেই কোনো কৃত্রিমতার ছাপ, নেই কোনো বাড়তি কিছু। শুধু আছে একরাশ মায়া ও প্রাকৃতিক শুভ্রতা। যে মেয়েটার ডাগর ডাগর চোখদুটোর এক পলকের চাহনি নিশীথের সমগ্র রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। যার কথা মাথায় এলে আজকাল নিশীথের আর কিছুই ভালো লাগেনা। ওর মা কি পারবে সেই মেয়েকে ওর জন্য এনে দিতে?
তবে নিশীথ কিছু বলে না। একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিঃশব্দে বারান্দার দিকে হেটে যায়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আশেপাশের লোকজনকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। এরই মাঝে আসমা বেগমের চোখ যায় জানালার কাছে মাটির টবে রাখা দোলনচাঁপার গাছটার দিকে। শুভ্র রাঙা ফুলগুলো যেন কাল রাতেই ফুটেছে সেভাবেই রুমের কোণে থেকে নিজ দ্যুতি ছড়াচ্ছে চারপাশে। বেশ আগ্রহ ভরে তিনি ফুলের কাছে গিয়ে প্রাণভরে দোলনচাঁপার মিস্টি সুবাস নেন। অতঃপর বারান্দায় হেটে যান নিশীথের কাছে। ছেলের কাধে হাত রেখে ওই ফুলের দিকে ইশারা করে বলেন,
—আচ্ছা বিয়ের কথা বাদ দিলাম। একটা কথা সেদিন থেকে বলবো বলবো ভাবছিলাম পরে আর বলাই হলোনা। তুই কবে থেকে গাছপ্রেমি হয়ে গেলি রে? কিছুদিন থেকে লক্ষ্য করছি তোর রুমে রাখা এই দোলনচাঁপার গাছটা। এটা হঠাৎ এনেছিস যে?
মায়ের কথায় নিশীথের চোখ যায় রুমে রাখা সেই দোলনচাঁপার গাছের দিকে। কি মনে করে যেন সে হেটে চলে যায় গাছের দিকে। ফুলের গুচ্ছ হাতে নিয়ে প্রাণভরে ঘ্রাণ নিয়ে মায়ের দিক ফিরে হাসিমুখে বলে,
—সুন্দর না? স্মেলটা দেখেছো কত মিষ্টি? মনটাই ভালো হয়ে যায়!
ছেলের কথায় মাথা নাড়িয়ে হাসেন আসমা বেগম। খানিকটা বিস্মিত সুরেই বলেন,
—দোলনচাঁপা তোর এতো ভাল্লাগে? কই আগে তো কখনো জানতাম না!
মায়ের কথায় রহস্যময় হাসি দিয়ে নিশীথ শান্তভাবে জবাব দেয়,
—আমিও জানতাম না বিশ্বাস করো! তবে যেদিন থেকে জেনেছি, আর ভুলতেই পারছিনা!
ছেলের কথার আগামাথা কিছুই বুঝলেন না আসমা বেগম। সামান্য একটা ফুলের প্রতি ভালো লাগা যে নিশীথ এভাবে প্রকাশ করলো তিনি অবাক না হয়ে পারলেন না। তার ছেলেটার যে কি হয়েছে কে জানে? বেশ ক’দিন ধরে কেমন উদ্ভট আচরণ করছে! তবু বাহিরে থেকে ডাক পড়ায় বেশিকিছু না ভেবে তিনি চলে গেলেন নিচে।
মায়ের যাওয়ার পর নিশীথ পুনরায় বারান্দায় আসে। বারকয়েক হাত দুটো এক্সারসাইজ এর ভংগিতে এদিক সেদিক করতেই নিচে চোখে পড়লো কাংক্ষিত মানবীকে। ফোনে কথা বলতে বলতে ওর বাসার সামনে দিয়েই সে হেটে যাচ্ছে! পরনে লাল জামা তার, দু’গাল ফেপে উঠছে হাসির দমকে। সে যে হেটে চলে গেলো নিজের মতোন। অথচ উপর থেকে যে কারও মুগ্ধ চোখ তাকে দেখে গেলো একধ্যানে, তা মেয়েটা জানলোও না!
_____________________
আজকাল নিশীথের সময় কাটে বড্ড ছটফটিয়ে। দিনের বেলা বন্ধুবান্ধব, এলাকার ভাই-ব্রাদার দের সাথে কাটালেও রাত যত গভীর হয় মনের অসুখ ততটাই বেড়ে চলে! নিশীথ ভেবে পায়না তার মতো ছন্নছাড়া একটা ছেলে কিভাবে সপ্তাহখানেক আগে প্রথম চোখে দেখা একটা মেয়ের প্রতি এতখানি আসক্ত হতে পারে? এটা কিভাবে সম্ভব? এমন কি আদৌ হয়েছে কারও সাথে যেখানে বিনা পরিচয়ে বিনা কথাবার্তায় একটা মেয়ের প্রতি এতটা মুগ্ধতা কাজ করে যে সারারাত তাকে ভেবেই কাটিয়ে দেওয়া যায়? অবিশ্বাস্য তাই না?
হ্যাঁ, নিশীথের কাছেও বিষয়টা অবিশ্বাস্যই লাগতো যদি না সে নিজে এ অবস্থায় না পড়তো! তাইতো এতদিন ভালো লাগা সত্বেও সে দোলার থেকে দূরে দূরে থেকেছে। নিজের মন ও অনুভুতিকে বুঝার চেস্টা করেছে। কিন্তু এখন দিনকে দিন আপন মনের বেহাল দশা দেখে সে খুব ভালোভাবেই উপলব্ধি করে ফেলেছে দোলনচাঁপা তার কাছে শুধু ক্ষণিকের মোহ নয়, মেয়েটাকে ওর সত্যিই প্রয়োজন। তাইতো নিশীথ এবার পাকাপোক্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে করেই হোক, সে দোলার মন জয় করার চেষ্টা করবে। যেভাবেই না কেন, মেয়েটাকে নিজের করেই ছাড়বে সে!
কারণ সে বুঝে গেছে, অন্তরের প্রশান্তির জন্য হলেও অথবা দু’চোখের শীতলতার জন্য হলেও নিশীথের এই জামজমকপূর্ণ জীবনে স্নিগ্ধ-শুভ্র দোলনচাঁপার বড্ড প্রয়োজন!
#চলবে