দোলনচাঁপার_সুবাস #পর্বঃ৬ #লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা

0
370

#দোলনচাঁপার_সুবাস
#পর্বঃ৬
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা

ভার্সিটি শেষে বাড়ি ফিরছিলো দোলা। আজকে ওর টিউশনি ছুটি। যে মেয়েটাকে পড়ায়, ওরা গ্রামে বিয়ে খেতে গেছে। তাইতো আজ বিকেল না হতেই ফিরছিলো বাসায়। ফ্রি টাইম পেয়ে ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে বেশ খানিকটা হেটে নিউ মার্কেট এরিয়ার দিকে নিজের মতোন হাটছিলো সে। ঠিক সে সময় চুড়ি, কানের দুলের প্রতি নজর পড়তেই মেয়েলি স্বভাবসুলভ কারণে রাস্তার ধারে বসা দোকানগুলো ঘুরে ঘুরে দেখছিলো সে। আশেপাশে চোখ ঘুরাতেই একটি দোকানে রাখা ঝুমকো জোড়া ভীষণ মনে ধরলো তার! দোকানদারকে দাম জিজ্ঞেস করায় সে-ও সুযোগ বুঝে দাম হাকলো ৪০০ টাকা।
দোলা ভারি বিরক্ত হলো বটে!

এতটুকু ঝুমকোখানার দাম আবার ৪০০ টাকা হয় নাকি? সে বুঝলো দোকানদার বুঝেছে ওর পছন্দ হয়েছে, এজন্যই এত দাম চেয়েছে। তবুও নিজের সাধ্যমতো দামাদামির চেস্টা করলো। কিন্তু দোকানদার দাম ছাড়তে নারাজ। একদাম ৩০০ টাকার নিচে দিবেইনা বলে দিয়েছে। দামাদামিতে জিততে না পারায় দোলা চটে গেলো, সে-ও পালটা রাগ দেখাতে গিয়ে নিজের পছন্দকে পাত্তা দিলোনা। দোকানদারকে বললো,

—শুনো মামা, জিনিস ভালো লেগেছিলো দেখেই নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি সেই সুযোগ বুঝে এত দাম চাইছো এটা তো অন্যায়। ২০০ পর্যন্ত দিতে চেয়েছিলাম তবু তুমি দাম ছাড়বেনা। বেশ! আর নিবোই না আমি এই ঝুমকো। চললাম তবে।

দোলা তেড়েমেরে এগিয়ে চললো সামনের দিকে। পেছন থেকে দোকানদার ডাকলো বোধহয় কিন্তু সে আর কানে নিলোনা। মন উঠে গেছে ওর। একিভাবে হাটতে হাটতে দোলা চলে এলো রাস্তার অন্যপাশে রিকশা নেওয়ার জন্য। এদিক সেদিক চেয়ে রিকশা ডাকে কিন্তু বাধ সাধলো ভাড়া, আজকে রিকশাওয়ালা মামারাও বড্ড ভাব নিচ্ছে। সকাল থেকে রৌদ্রজ্বল থাকা আকাশে সবেমাত্র মেঘ নামতে দেখে এখন বেশি ভাড়া চেয়ে বসছে।

দোলার অবস্থা এখন দেখার মতো! একে তো একটু আগে দোকানীর সাথে দামাদামি নিয়ে ওর মেজাজ ছিলো খারাপ, এবার তো ওর কা’টা ঘা’য়ে যেন সরাসরি নুনের ছি’টাই পড়লো!
রিকশাওয়ালার সাথে কিছুক্ষণ তর্কাতর্কি করে শেষমেশ হাল ছেড়ে হাটা ধরলো সে। এরই মাঝে পেছন থেকে নিজের নাম শুনে থেমে গেলো মেয়েটার কদম।

—দোলনচাঁপা!

ভরাট পুরুষালি আওয়াজে দোলা থেমে যায়। পেছন ফিরে তাকাতেই সুউচ্চ নিশীথকে দেখে বেশ খানিকটা চমকে উঠে! সেভাবেই শুধায়,

—আরে, আপনি এখানে?

নিশীথ হালকা হাসে, তবে সে হাসির রেখা বিশেষ মনোযোগ দিয়ে না দেখলে দৃষ্টিগোচর করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। এ কারণেই দোলার নজরে এলোনা। সে একেই বিরক্ত একটু আগে হওয়া সব ঘটনাসমূহের কারণে, তার মধ্যে নিশীথ থামিয়ে দেওয়ায় মনে মনে আরেকটু বিরক্ত হয়েছে সে। তবুও স্বভাবসুলভ ভদ্রতার খাতিরে তা বাহিরে প্রকাশ করতে পারছেনা। এরই মাঝে নিশীথের কণ্ঠ শুনা যায়,

—একটু কাজ ছিলো আশেপাশেই। বাড়ি ফিরছিলাম এখন। এর মাঝেই রাস্তায় আপনাকে হেটে যেতে দেখলাম তাই ডাক দিলাম! মার্কেট করতে এসেছিলেন বুঝি?

নিশীথের প্রশ্নে মুখে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে দোলা জবাব দেয়,

—হ্যাঁ, ভার্সিটি শেষে বাড়ি ফিরছিলাম। ভাবলাম একটু মার্কেট ঘুরে যাই। এই আর কি!

দোলার জবাবে খুশির আভাস দেখা দেয় নিশীথের চোখেমুখে। বেশ যত্নে তা লুকিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে সে বলে,

—বাহ! আপনিও বাসায় যাচ্ছেন, আমিও বাসায় ফিরছি। দুজনে তো একি জায়গায় থাকি। চলুন একসাথে যাই!

নিশীথের এমন স্বতঃস্ফূর্ত প্রস্তাবে দোলা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। এভাবে হুট করে সে একসাথে বাড়ি ফিরতে চাইবে মেয়েটা ভাবেনি। কিন্তু সে রাজি হয়না। কাঠকাঠ কণ্ঠে উত্তর দেয়,

—কোনো দরকার নেই৷ আমি একাই যেতে পারবো, ভাইয়া…

—নিশীথ! আমার নাম নিশীথ। ওকে?

দোলার কথা শেষ না হতেই তড়িৎ বেগে শক্ত কণ্ঠের জবাব ভেসে আসে সামনে থেকে। ফলশ্রুতিতে, মেয়েটা খানিকটা ঘাবড়ে যায়। ওর মুখ ফস্কে বেরিয়ে আসে,

—জানি।

নিশীথ ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রয় কিছুক্ষণ। অতঃপর প্রশ্ন করে,

—কিভাবে জানলেন? আমার যতদূর মনে পড়ে সেদিন আমি শুধু আপনার নামটাই শুনেছি, আমার নাম বলিনি। তবে! হু?

নিশীথের এহেন প্রশ্নে দোলা সামান্য লজ্জা পায়। ইশ, মুখ ফসকে কেন বলতে গেলো সে জানে ওর নাম! না জানি ছেলেটা কি মনে করছে! এখন কি বলবে সে? কেননা নিশীথকে ভুল করেও তো বলা যাবেনা যে শিমুল ওর সম্পর্কে তাকে কি কি বলেছে। তবে এবার কি করবে সে? দোলা চিন্তা করতে থাকে। শিমুলের কথাগুলো মনে হতেই লজ্জায় ওর গাল গরম হয়।

অতঃপর কিছুক্ষণ মাথা খাটাতেই বুদ্ধির উদয় হয়। নিজেকে ধাতস্থ করে সে বলে,

—সে-সেদিন বাসায় ফিরছিলাম এলাকার গলি দিয়ে তখন এক ছেলে আপনাকে নিশীথ ভাই বলে ডেকেছে। আমি শুনেছি। এভাবেই জানি!

—ওহ! কবে?

নিশীথ পালটা প্রশ্ন করে। দোলা এবার চটে যায়। একেতো বানিয়ে বানিয়ে এত সুন্দর একটা জবাব দিলো, চুপচাপ মেনে নিবে তা না! লোকটা দেখি উলটো প্রশ্ন করেই যাচ্ছে! তাইতো নিজ বিরক্তি না চেপে সে জবাব দেয়,

—দেখুন নিশীথ ভাই, এমনিতেই আকাশের অবস্থা ভালো না। যেকোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে। আমি ছাতা নিয়ে আসিনি সাথে। আমি বাসায় যেতে চাইছি। আপনার সাথে পরে কথা বলবো!

একনাগাড়ে কথাগুলো বলে দোলা হাটা ধরে। একটি রিকশাকে ডাকতেই পিছু পিছু নিশীথকে আসতে দেখে। ভ্রু কুচকে সেদিকে তাকাতেই নিশীথ ভদ্রতাসূচক হেসে বলে,

—আপনি কি বিরক্ত হচ্ছিলেন? আমি তো এমনিতেই জিজ্ঞেস করছিলাম। আসলে আমার সাথেও ছাতা নেই, তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে বাসায়। বৃষ্টিতে ভিজলে আমার জ্বর হয়! এজন্যই তো তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে চাইছিলাম একসাথে।

দোলা কিছু বলবে তার আগে রিকশাওয়ালা দাম চেয়ে বসে। আগেকার সবার মতোই বৃষ্টি দেখে ইনিও বেশি দাম চাইলে দোলা কিছু বলার আগে এবার নিশীথ মাঝখানে কথা বলে। এমন লম্বাচওড়া জোয়ান পুরুষদের সাথে সচারাচর রিকশাওয়ালারা তর্কে জড়তে চায়না। এবারও তার ব্যতিক্রম হলোনা। দোলাকে দেখে বেশি দাম চাইলেও যেই না নিশীথ কথা বললো, ওমনি ন্যায্য ভাড়ায় যেতে রাজি হয়ে গেলো রিকশাটা। নিশীথ উঠতে ইশারা করলে দোলা খানিকটা অস্বস্তি নিয়ে রিকশায় উঠে বসে। নিশীথ তা লক্ষ্য করে। নিজে উঠতে যেয়েও আর উঠেনা।
বরং দোলাকে অবাক করে দিয়ে রিকশাওয়ালার উদ্দেশ্যে সে বলে,

—সামনের রাস্তা ভাঙা আছে, মামা। দেখেশুনে নিয়ে যাইয়েন!

রিকশাওয়ালা মাথা নাড়িয়ে চলতে শুরু করে। হুড তোলা রিকশার ফাঁক দিয়ে দোলা আড়চোখে পেছন ফিরে তাকায় নিশীথের দিকে। যে কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটা তো আসতে চেয়েছিলো ওর সাথে, তবে এলোনা কেন? তবে কি সে একটু বেশিই কড়া ব্যবহার করে ফেলেছে? দোলা মনে মনে ভাবে। ওর ভাবনায় ছেদ পড়ে আকাশের বুক চিড়ে ধরণীর বুকে বৃষ্টি নামলে!

বৃষ্টি নামতে দেখে নিশীথ এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আকাশের দিক চেয়ে আনমনে বলে,

—আমি চাইলেই যেতে পারতাম তোমার সাথে কিন্তু তোমার চোখে অস্বস্তি দেখে যাওয়ার সাহসটা আর পেলাম না। আমার দোলনচাঁপার অস্বস্তি হোক এমন কিছুই আমি করবোনা। দেখি তুমি কতদিনে আমার সাথে সহজ হও!

নিশীথের বুক চিড়ে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাসে যেন বৃষ্টির বেগ আরেকটু বাড়ে। সেই বৃষ্টিতে ভেজা চুলে হাত ভিজিয়ে নিশীথ সামনের দিকে হাটা ধরে। সে মুহুর্তে দোলার রিকশা তার দিকে আসতে দেখে অবাক হয়ে যায়। রিকশা থেমে যায়। নিশীথ কিছু বলবে তার আগে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে দোলা বলে,

—উঠে পড়ুন তাড়াতাড়ি। সেদিন আমার উপকার করেছিলেন বলে আজ আপনাকে ফিরিয়ে দিচ্ছি। বৃষ্টি বাড়ছে, আসুন জলদি।

দোলার এহেন ঠান্ডা জবাবেও নিশীথের তনুমন আনন্দের জোয়ারে ভাসে। সময় বিলম্ব না করে উঠে পড়ে তার দোলনচাঁপার পাশে। মেয়েটার পাশে বসতেই নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করে মেয়েলি মিস্টি সুবাস। চোখ বন্ধ করে তার ঘ্রাণ নেয় নিশীথ। আকাশের দিক চেয়ে কৃতজ্ঞতার হাসি ফুটে উঠে ওর ঠোঁটে!

#চলবে

পরীক্ষার প্রেশারে এ ক’দিনের বিলম্ব। আশা করি বুঝবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here