#দোলনচাঁপার_সুবাস
#পর্বঃ৭
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা
রিকশা চলেছে আপন গতিতে। রিকশাওয়ালার কাছে পলিথিন না থাকায় ভিজে ভিজে যেতে হচ্ছে দুজনকে। পাশাপাশি বসে থাকা দুটো ভেজা শরীর ঝুম বৃষ্টিতে ও বাতাসের তোপে খানিকটা কেপে কেপে উঠছে কিছুক্ষণ পরপর৷ নিশীথকে পাশে বসতে দিলেও দোলার মনে এখনো অস্বস্তি বিরাজমান। বলাবাহুল্য, এর আগে কখনো চেনাজানা ছাড়া এত স্বল্প পরিচয়ের কোনো পুরুষের সাথে সে রিকশায় চড়েছে। আজকেও বসার কোনো ইচ্ছে তার ছিলোনা কিন্তু এই যে ওর দরদী মন, বৃষ্টি নামতে দেখে নিশীথের জন্য না চাইতেও খারাপ লাগা সৃষ্টি হয়েছিলো ওর মনে। তাইতো উপকার ফেরত দেবার বাহানায় নিজেকে মানিয়ে সে নিশীথকে পাশে বসবার অনুমতি দিয়েছে। এসব ভেবেই নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে অস্বস্তি কাটানোর চেষ্টা করতে লাগলো দোলা। দৃষ্টি নিবন্ধ করলো রাস্তার দিকে। মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলো কি কি হচ্ছে সেথায়।
অপরদিকে নিশীথ, তার মনোযোগ অন্যদিকে। সে একটু পরপর আড়চোখে তাকাচ্ছে বৃষ্টিভেজা দোলনচাঁপার দিকে। নিশীথের মনে যেন আজ রং লেগেছে। এমন বৃষ্টির স্নিগ্ধতা মাখা প্রেমময় দিনে দোলার সাথে একি রিকশায় বসে ঘুরবে ভাবতেই ওর হৃদয় মেঘে ভর দিয়ে উড়ছে। এই যে কিছুক্ষণ বাদে বাদে যখনই রিকশা ঝাকি খাচ্ছে, ওর চওড়া প্রশস্ত কাধের সাথে দোলার উষ্ণ নমনীয় বাহুটা বাড়ি খাচ্ছে। সামান্য এই স্পর্শটাও যেন নিশীথের প্রেমিকসত্তাকে একটু একটু করে জাগিয়ে তুলছে। মন চাইছে আলতো করে চেপে ধরুক প্রিয়তমার কোমড়। কিন্তু সব ইচ্ছে কি আর চাইলেই পূর্ণতা পায়? এর জন্য দরকার সময় ও ধৈর্য। কিন্তু এ দুটোর একটাও নিশীথের নেই বললেই চলে! সে মানুষটা বরাবরই ভীষণ রকমের অধৈর্য, আর সময়ের কাজ সময়ে করেনা বললেই চলে। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে, দোলার ক্ষেত্রে নিশীথ তার ব্যক্তিত্বের বিপরীতে আচরণ করে। সে যেন এক অন্যরকম পুরুষে পরিণত হয় যার কাছে নিজের ভালো লাগা প্রেয়সীর উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেয়ে তার মনে ধীরেসুস্থে নিজের জন্য ভালোবাসার বীজ বপন করা বেশি উপযোগী বলে মনে হয়!
এভাবেই দেখতে দেখতে রিকশা পৌঁছে গেলো বাসার সামনের গলিতে৷ নিশীথের ভালো লাগার মুহূর্তটাও ফুরিয়ে এলো। মনে মনে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে রিকশাওয়ালাকে থামতে বললো। দোলা চোরাচোখে আশেপাশে তাকাচ্ছিলো, এমন সময় গলির প্রবেশমুখে নিশীথ রিকশা থামতে বলায় সে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে নিশীথের দিকে তাকায়। প্রত্যুত্তরে ভেজা চুলে হাত চালিয়ে নিশীথ জবাব দেয়,
—আমি বরং এখানেই নেমে যাই। বাকিটুকু হেটে যাবো। তুমি বাসা পর্যন্ত রিকশায় যাও! এলাকার লোকজনে আমাদের একসাথে দেখুক এটায় বোধহয় তুমি কমফোর্ট ফিল করবেনা।
নিশীথের কথায় দোলা মনে মনে চমকে উঠে। ছেলেটার চিন্তাবোধ, কোনোকিছু না বলেই ওর ইচ্ছেকে বুঝা, তাকে সম্মান করা সবটাই ওর মন ছুয়ে যায়। দোলা আনমনে হেসে ফেলে। এরই মাঝে নিশীথ মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে তখন চট করে বলে ফেলে,
—আপনার টাকা দিতে হবেনা। আমার কাছে আছে। আমি তো বললামই আজকে আমি আপনার উপকার ফিরিয়ে…
দোলার কথা শেষ না হতেই ওকে মাঝপথে থামিয়ে নিশীথ বলে,
—জানি আপনার কাছে টাকা আছে। তবু দিচ্ছি। আমায় পাশে বসতে দিয়েছেন এটুকুই উপকার ফেরানোর জন্য যথেষ্ট ছিলো।
কথা বলার মাঝে নিশীথ একটু থেমে যায়। গলার স্বরে কিছুটা ভিন্নতা এনে বলে,
—আজকের জন্য এটুকুই যথেষ্ট ছিলো। সামনে উপকার শোধ করার আরও অনেক সুযোগ পাবে।
দোলার মাথায় বিশেষ কিছু ঢুকলোনা। সে ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো,
—মানে? বুঝিনি!
—বুঝবেনা। বাসায় যাও। মামা রিকশা আগাও।
নিশীথের কথায় টাকা নিয়ে রিকশাওয়ালা পুনরায় চলতে শুরু করে। দোলা জিজ্ঞেস করতে চায়,
—আপনি আমায় হঠাৎ করে তুমি বলছেন কেন?
কিন্তু নিশীথের কান অব্দি পৌঁছানোর আগেই সে গলির ভেতরে চলে যায়। প্রশ্নটুকু আর করা হয়না। নিশীথ কিছুক্ষণ চেয়ে রয় রিকশার পানে। এরপর ফোনে কল আসায় সে-ও ফোন কানে নিয়ে গলির মুখে হাটা আরম্ভ করে!
_______________________
বৃষ্টিস্নাত শান্ত সন্ধ্যাবেলা। বর্ষণ শেষে ক্লান্ত প্রকৃতি বিশ্রাম নিচ্ছে যেন। বারান্দায় ঠান্ডা বাতাস বইছে। গোসল শেষে ওখানে বসে চা খাচ্ছে দোলা। অসময়ের বৃষ্টিতে ভিজে মাথা ধরেছে বেশ। এদিকে ওর মা পারভীন বেগম গরম গরম পেয়াজু বানাচ্ছেন রান্নাঘরে। দোলা রেস্ট নেওয়ায় মা-কে সাহায্য করছে কামিনি। বাইরে কাদা থাকায় শিমুলটাও নিজ রুমে পিসিতে গেম খেলতে ব্যস্ত। রুমের দরজা সব খোলা থাকায় ধোয়া উঠা পেয়াজুর গন্ধে মৌ মৌ করছে পুরো বাসা। দোলার পেট ক্ষুধায় মোচড় দিয়ে উঠে। সেই যে ভার্সিটি থেকে বেরোনোর আগে বন্ধুদের সাথে চা-সিংগারা খেয়েছিলো এটুকুই আজ পড়েছে পেটে। এসিডিটির সমস্যা থাকা সত্ত্বেও ভাজিপোড়া খাওয়ার লোভ সামলাতে পারেনা সে। কিন্তু মা জানলে তো বকা দিবে। তিনি বারবার ভাত খাওয়ার কথা বলছিলেন। তাইতো দোলা রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে পা না বাড়িয়ে সোজা চলে গেলো শিমুলের রুমে। ভাইকে পটিয়ে কয়েকটা পেয়াজু আনতে বলতেই সে উল্টো শর্ত জুড়ে দিলো,
—পেয়াজু এনে দিবো, আপু। তবে আমাকে তোমার ফোন দিতে হবে। নতুন গেম ডাউনলোড করেছি কালকে। ওটা খেলার সুযোগই পাইনি।
অন্যসময় হলে দোলা মোটেও রাজি হতোনা। কিন্তু এখন ওর ভীষণ পেয়াজু খাওয়ার লোভ জেগেছে। তাইতো শিমুলের শর্তে রাজি হয়েই ওকে পেয়াজু আনতে পাঠিয়ে দিলো। বাটি ভরে বেশ ক’টা পেয়াজু তুলে এনে শিমুল হাত পাতলেই দোলা মুখটা বাংলার পাচের ন্যায় করে ওর হাতে ফোন তুলে দেয়। কড়া ভাষায় বলে,
—শুধুমাত্র আধা ঘণ্টা ফোন পাবি। ৩০ মিনিট পর যেন সাথে সাথে আমার ফোন আমায় ফিরিয়ে দেওয়া হয়! এক মিনিট আগ-পিছ হলে তোর খবর করে দিবো!
বোনের কথা যেন শিমুল শুনেও শুনলোনা সেরকম ভান করে ফোন নিয়ে ছুটে গেলো বিছানায়। দোলাও এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে পেয়াজুর বাটি হাতে নিয়ে চলে এলো নিজ রুমের বারান্দায়। তার রুমটার অবস্থান বেশ ভালো একটা জায়গায়৷ এখানে বারান্দায় দাড়ালেই গলির শেষ মাথা অব্দি দেখা যায়। এই যেমন গলির শেষের চায়ের দোকানটা দেখা যাচ্ছে। সেখানে প্রতিদিনের ন্যায় আজকেও বিকেল গড়াতেই ছেলেপেলের আড্ডা বসেছে টং এর দোকানে। ওদিকে তাকাতেই আনমনে দোলার নিশীথের কথা মনে পড়লো। একিসাথে মনে পড়লো আজ দুপুরের ঘটনাগুলো। ছেলেটাকে প্রথম দেখায় সে যেমন ভেবেছিলো, সে তেমন নয়। ওর আচার আচরণ দোলা যেমন উচ্ছৃংখল ভেবেছিলো, তেমনটা নয় মোটেও! তাই কোনোকিছু না জেনেই নিশীথের সম্পর্কে এভাবে ধারণা করা নিয়ে দোলার অনুশোচনা হয়। একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে পেয়াজু মুখে নিয়ে চিবুতে চিবুতে আশেপাশে নজর বুলায় সে। এরই মাঝে খানিকটা হইচই শুনে দোলার কান খাড়া হয়। বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। রেলিং এ হাত রেখে চারদিক তাকাতেই দূরের দোকানটার দিকে নজর পড়ে। বেশ কিছু মানুষের ভীড় জমেছে সেখানে। ওখান থেকেই তো চিল্লাচিল্লির আওয়াজ আসছে।
দোলার মনে কৌতুহল জাগে। হয়েছেটা কি ওখানে? কেন-ই বা এত মানুষ হইচই করছে এ অসময়ে? কিন্তু ভীড়ের জন্য ঠিকভাবে কিছু দেখাও যায়না। মিনিট দুয়েক পর সামনে থেকে কিছু লোক সরে যাওয়ায় দোলার চোখে পড়ে একটা ছেলে বেশ ক্ষীপ্তভাবে কাকে যেন মারছে এবং আশেপাশের মানুষ জটলা ধরে সেটাই দেখছে। তবে মানুষের ভীড়ে ছেলেটাকে এতক্ষণ না দেখলেও এবার তার মুখ দোলার কাছে স্পষ্ট হয়! নিশীথকে দেখে দোলা ভড়কে যায়। ধূসর রঙা টিশার্ট গায়ে জড়িয়ে সামনের লোকটাকে বেধড়ক মারতে থাকা নিশীথ তখন এলাকার লোকজনদের মধ্যমণি। কিন্তু সে এভাবে নিজের চেয়ে বড় লোকটাকে মারছে কেন? আর আশেপাশের কেউ-ই বা কিছু বলছে না কেন?
দোলার মনে প্রশ্ন জাগে!
একিসাথে একটু আগে তার মনে নিশীথের প্রতি জন্মানো ভালো লাগাটুকু হঠাৎ চুপসে যাওয়া বেলুনের ন্যায় ফোস করে উবে যায়!
#চলবে