অনুভূতিরা_শব্দহীন লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী একচত্বারিংশ পর্ব (৪১ পর্ব)

0
354

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

একচত্বারিংশ পর্ব (৪১ পর্ব)

“আহনাফ, দা°ফ°নের কাজ শেষ হয়েছে। আমি তো ভ°য়ে ছিলাম, কোনো ঝা°মেলা না হয়।”
“যাক, তাও আলহামদুলিল্লাহ।”
“হুম, ক°ফি°নে শাফিনই ছিল। চেহারা আমি নিজে দেখেছি৷ কবরে যখন নামিয়েছে তখনও ছিলাম, কবর দেয়ার পর সরেছি ওখান থেকে।”
“আজকে ফিরে আসবেন?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, এইতো গাড়িতে উঠে যাবো।”
“আচ্ছা, সাবধানে আসেন।”

আহনাফের সাথে ফোনযোগে কথা বলছে ইমতিয়াজ। এখানের সকল ঘটনাই তাকে জানানো হয়েছে। এখনি বের হবে ওরা।

হঠাৎ সুরভি চিৎকার করে উঠে। মৃত্তিকা দৌড়ে গিয়ে ওকে ধরে। মমতাজ বেগম ওর অবস্থা দেখে বলেন,
“লেবার°পে°ইন।”
“সর্ব°না°শ, এখানে কিভাবে কি?”

মৃত্তিকার কথায় তানজিম বলল,
“বাড়ির ভিতরে নিয়ে যাই?”
“হ্যাঁ, তাই করো।”

মমতাজ বেগমের অনুমতি পেয়ে ইমতিয়াজ ও তানজিম মিলে ওকে ভিতরে নিয়ে যায়। গ্রামের একজনকে দিয়ে দাঈ ডেকে আনা হলো আর তারই পরিচিত একজন নার্সকেও আনলো।

মৃত্তিকা জমিদার বাড়ির দরজা খুলে। ভেতরে গন্ধ কম। মৃত্তিকার কপাল কুঁচকে গেল। এতোবছরের পুরোনো বাড়ির ভেতর গন্ধ নেই কেন? এখানে তো গন্ধ, ধুলা সবই থাকার কথা। সুরভির এ অবস্থায় কেউই কথা বলার মতো নেই।

মহিলাদের ভীড় বাড়ে। ইমতিয়াজ, তানজিম, লুৎফর রহমান বাইরে যায়। মৃত্তিকা বাইরে না গেলেও এখানে থাকে না। সে জমিদার বাড়ির ভিতরের রুমগুলো দেখতে বেরিয়ে পড়ে।

সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে সে। একটা রুমের সামনে গিয়ে কাঠের খোদাইকৃত ডিজাইনের চকচকে দরজা দেখে দাঁড়িয়ে যায়। সব দরজা পুরোনো হলেও এটা নতুন কেন? প্রশ্ন জাগে ওর মনে। ক্রমাগত দরজা খোলার চেষ্টা করতে থাকে। ভিতরে কান পেতে শুনতে চেষ্টা করে, কিন্তু ভিতর থেকে কোনো শব্দই আসে না। জোরে জোরে দরজায় ধা°ক্কা দেয় সে। দরজা খুলতে ব্য°র্থ হয়।

অনেকটা সময় পার হয়। একসময় মৃত্তিকাকে ডাকে মমতাজ বেগম। মৃত্তিকা যাওয়ার সময় আবারো দরজার দিকে তাকায়। এখনই কাউকে এর কথা বলা যাবে না, আগে দেখতে হবে এর পেছনে কি আছে।

মৃত্তিকা নিচে যায়, সুরভির বাবুর কান্না শোনা যাচ্ছে। মৃত্তিকা একটা রুমে যায়, সুরভিকে সেখানেই রেখেছে। ছেলেবাবু হয়েছে, সুরভি বাচ্চাকে এখনো দেখেনি। সে দেখবে না, অজানা কারণে নিজের ছেলের উপর রেগে আছে সে। মৃত্তিকা বাবুকে কোলে নেয়। সদ্য জন্ম নেয়া বাবুটা কাঁদছে, তার লাল লাল মুখের দিকে তাকিয়ে আছে মৃত্তিকা।

সুরভির কাছে নিয়ে গিয়ে বলল,
“নিজের ছেলেকে আদর করবে না আপু?”
“আগে ওর কানে আযান দিতে বলো, ভালো করে বুঝিয়ে দাও নানার মতো যেন না হয়।”

মৃত্তিকা ওকে কোলে নিয়ে বাইরে আসে। লুৎফর রহমান এখানে নেই, উনিই তো আযান দিতে পারতো। ইমতিয়াজকে একটু দূরে দেখে ডাকে,
“শুনুন, ইমতিয়াজ।”

ইমতিয়াজ এগিয়ে আসে। বাবুর দিকে তাকালে মৃত্তিকা বলে,
“ওর কানে আযান দেন, নইলে আপু ওকে দেখবেও না।”
“এ কেমন কথা?”
“নিন।”

বাবুকে কোলে নিয়ে তার কানে খুব আস্তেধীরে আযান দেয় ইমতিয়াজ। ওর কানে আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিয়ে বুঝিয়ে দেয়, এক আল্লাহ্ মহান, তুমি তারই সৃষ্টি। সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ্-র।

আযান দেয়া হলে মৃত্তিকা বাবুকে কোলে নিয়ে বলে,
“নানার মতো হইয়ো না, তোমার মা তবে তোমার সাথে এই আযান দাতাকেও ঝে°রে ফেলবে।”

মৃত্তিকা ভিতরে চলে যায়। ইমতিয়াজ হেসে দেয়। বাচ্চার সাথে এ কেমন বাচ্চামো।
______________________________________

“জামিল ফুপা কি আপনার বন্ধু হয়?”

আহনাফের প্রশ্নে জাহাঙ্গীর সাহেব না বোধক মাথা নেড়ে বলল,
“না।”
“কিন্তু আমাকে তাই বলা হয়েছিল, ফুপার বন্ধু। পরে জানতে পারি এই বিয়ে পরিকল্পিত এবং শাফিন জড়িত ছিল এতে।”

নার্গিস পারভিন ভয় পান। কেউ জেনেশুনে তার মেয়েকে তার থেকে দূরে নিয়ে গেছে। আহনাফ আবারো বলে,
“শাফিনের ফাঁ°সি হয়েছে, দা°ফ°নও শেষ। তবে জামিল ফুপা এখনো বাইরেই ঘুরাঘুরি করছে।”
“তাকে তলব করো।”

জাহাঙ্গীর সাহেবের কথায় আব্বাস ফয়েজ সম্মত হলেন। বলেন,
“হ্যাঁ, তাকে আমাদের বাসায় আসতে বলি আর আপনারাও আসেন। ঘটনা বিস্তারিত জানা যাবে।”

আহনাফ ঠোঁট বাঁ°কিয়ে বলল,
“আপনাদের মনে হয় সে এতো সহজে মুখ খুলবে?”
“কখনোই না।”
আহনাফের প্রশ্নের সাথে সাথেই উত্তর দেয় নার্গিস পারভিন।

আহনাফ উনার দিকে তাকালে বলল,
“তুমি বের করো। আলোচনা আর যার সাথেই হোক তার সাথে নয়।”

আহনাফ মাথা নেড়ে উঠে যায়। নার্গিস পারভিন সবদিক থেকে সঠিক, জামিলের সাথে আলোচনা করে বা কথা বলে লাভ নেই। তাকে বুঝিয়ে কাজ নেই। তার থেকে জোর করে কথা বের করতে হবে।

রুমে বসে সারাহ্ সকল কথাই শুনেছে। নিজের স্বামীর সাথে পরিকল্পিত বিয়ের কথাটা শুধু সারাহ্ কেন যেকোনো মেয়ের জন্যই খুবই অপমানের আর লজ্জার হবে।

“ঐশী?”

আহনাফের ডাকে সারাহ্ একটু চমকে তাকায়। অন্যমনস্ক হয়ে ছিল সে। ওর চোখে পানি দেখে আহনাফ কপাল কুঁচকে বলল,
“কান্না করছো কেন?”

সারাহ্ ছলছল চোখে তাকায়৷ আহনাফ ওর চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বলে,
“জানার ছিল এসব, লুকানো যাবে না।”
“আমাকে ছেড়ে চলে যাবেন?”

নিষ্প্রাণ প্রশ্ন করে বসে সারাহ্৷ আহনাফ ওর কপালে চুম্বন করে বলল,
“এতোটা সন্দেহ করো না।”

সারাহ্ হয়তো সম্পূর্ণ আশ্বস্থ হয় না। তবুও মাথা ঝাঁ°কিয়ে সম্মতি দেয়।
______________________________________

আজকের মতো ঢাকায় ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা বন্ধ করে সবাই। সুরভির এই অবস্থায় ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়৷ জমিদার বাড়ির চারটা রুম পরিষ্কার করে কোনোমতে থাকার উপযোগী করা হলো। ইফতার বাইরে থেকে কিনে এনে খাওয়া হলো।

ইফতার শেষে মৃত্তিকা সুরভির সাথে বসে আছে৷ মৃত্তিকা বাবুকে কোলে নিয়ে বসে আছে, সুরভি ঘুমিয়ে পড়েছে। মমতাজ বেগম আসলে মৃত্তিকা বাবুকে উনার কাছে রেখে দোতলায় চলে যায়।

সেই দরজার কাছে যেতেই দেখে ইমতিয়াজ সেখানে দাঁড়ানো। ওকে আঙ্গুলের ইশারায় চুপ থাকতে বলে হাত ধরে নিচে নিয়ে আসে। নিজেদের রুমে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে বলে,
“মা, ওই রুমে ছিল। আমাকে দেখে দরজা লাগিয়ে চলে এসেছে। নতুন দরজা কোথা থেকে এলো ওখানে?”

মৃত্তিকার কাছে উত্তর নেই। তবে মমতাজ বেগমকে সন্দেহ করে যাচ্ছে সে। তবে কি এতোগুলো মানুষের মৃ°ত্যুর পিছনে শাফিনের সাথে মমতাজ বেগমও জড়িত?

রাত বাড়ে, পাশের বাড়ির চুলা থেকে সেহরি রান্না করে আনে মৃত্তিকা। এরমধ্যে মমতাজ বেগম আর রুম থেকে বের হননি। সবকিছু সামলে রেখে রুমে আসে। ইমতিয়াজ নামাজ পড়ে এসেই শুয়ে আছে, দুইদিনের ধ°ক°ল গেছে শরীরের উপর দিয়ে।

মৃত্তিকা এসে বালিশ ঝে°ড়ে শুতে নিয়ে বুঝে বালিশ অনেক শক্ত। এগুলোও তো নিজেদের নয়। আশেপাশের পরিচিত কিছু মানুষ দিয়ে গেছে। এরচেয়ে বেশি আর কিই বা আশা করা যায়।

ইমতিয়াজ নিজের একহাত এগিয়ে দিয়ে বলে,
“শুয়ে পড়ো।”

মৃত্তিকা একটু তাকিয়ে থেকে ইমতিয়াজের হাতের উপর শুয়ে পড়ে। ইমতিয়াজ ওকে কাছে নিয়ে আসে। মৃত্তিকা ওর বুকে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে।

“ইমতিয়াজ, আমার অদ্ভুত ফিল হচ্ছে৷ সবকিছু অদ্ভুত লাগছে৷ ওই শব্দটা কিসের ছিল?”

ইমতিয়াজ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“বেশি চিন্তা করছো, তাই এমন হচ্ছে।”
“একবার শাফিনের কবরটা চেক করবেন প্লিজ?”
“সকালে।”
“ঠিক আছে।”

মৃত্তিকা ইমতিয়াজকে ভালো করে জড়িয়ে ধরে। ইমতিয়াজও তাকে আগলে নেয়, মিশিয়ে নেয় নিজের বুকে।

রাত পেরিয়ে সকাল হলো, দুজন লোককে সাথে নিয়ে শাফিনের কবরের কাছে গিয়ে দাঁড়ায় ইমতিয়াজ। কবরের আশেপাশে অস্বাভাবিক কিছু নেই। তবুও মন চাইলো তার, শুরু হলো কবর খোঁ°ড়া।

কবর খুঁ°ড়েই অবাক হলো সে। ক°ফি°নের মুখটা খোলা, ভিতরে শাফিনের দেহ নেই। লোক দুজনও ভ°য় পায়। একজন চেঁচিয়ে উঠে৷ চিৎকার শুনে মৃত্তিকা, তানজিম ছুটে আসে। মৃত্তিকা অবস্থা দেখে মুখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

ইমতিয়াজ কবরের ভিতরে নামে। কবরের একপাশের দেয়াল ভা°ঙা, সেখানে একটা সুরঙ্গ। মৃত্তিকাও ভিতরে নামে। দুজনে সুরঙ্গে প্রবেশ করে। সুরঙ্গটা বেশ বড়, অনেকদূর পর্যন্ত প্রসারিত।

সুরঙ্গের মাথায় মাটির সিঁড়ি কাটা। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে জমিদার বাড়ির একটা রুমে এসে পৌঁছায় ওরা। কারুকার্যে শোভিত বড় একটা কাঠের পালঙ্ক আছে এখানে, বড় বড় দুটো আরাম কেদারাও আছে, বিশাল একটা আয়না আর তারপাশে কিছু তাক। দুজনে ঘুরেফিরে রুমটা দেখে।

ইমতিয়াজ কপাল কুঁচকে রুমের দরজার দিকে তাকিয়ে বলল,
“নতুন কাঠের দরজা, এটাই কি সেই রুম?”

মৃত্তিকা এবারে নিজের সন্দেহ প্রকাশ করে বলে,
“তবে কি বড়মণি এসবে যুক্ত?”

ইমতিয়াজ চোখ বড় করে তাকায়। মমতাজ বেগম নিজের মেয়েদের খু°নের জন্য দায়ী? ভ°য়ং°কর ব্যাপার এটা।

ইমতিয়াজ কিছু বলার আগেই মৃত্তিকা বলে,
“উনাকে আমার সন্দেহ হচ্ছিল অনেকদিন থেকেই, তবে এখন এটাও শিউর যে শাফিন বেঁচে আছে।”
“নিচ চোখে দেখা মৃত মানুষ জীবিত কিভাবে হয়?”

মৃত্তিকা চিন্তায় পড়ে। আলাদা কোন জিনিসটা সে ভুলে যাচ্ছে? স্মৃ°তির পাতার পৃষ্ঠাগুলো উল্টেপাল্টে দেখে বুঝে শাফিন বলেছিল, ওর অনেককিছু জানার আছে। অবশ্যই জানার আছে, কিন্তু এ জানার অ°ন্ত কোথায়?

রুমে ইমতিয়াজ একটা চিঠি পায়,
“আমি চললাম আমার পথে,
যেখানে জোসনা থাকে অনেক
একটা বেশি দামি।
অনেক অনেক তারার মাঝে
সবচেয়ে উজ্জ্বল আমি।”

ইমতিয়াজ একটু ভেবে বলল,
“ধাঁধা রেখে গেছে। এটা নিশ্চয়ই কোনো ক্লু।”

মৃত্তিকা কাগজটা দেখে। ইমতিয়াজ এটি ভাঁজ করে পকেটে ঢুকায়। কবর থেকে লা°শ উধাও, নাকি লা°শের ভাণ ধরা জীবিত কেউ উধাও? প্রশ্নের সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছে ওরা, উত্তরের জন্য অতল গভীরে ডু°ব দিতে হবে।

চলবে….

(পর্ব ছোট হয়েছে জানি, দুঃখিত। কাজিনের বিয়ে+ফ্যামিলি প্রোগ্রামে ব্যস্ত। এতো এতো মানুষের মাঝে লেখা কঠিন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here