অনুভূতিরা_শব্দহীন লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী অন্তিম পর্ব (প্রথমাংশ)

0
263

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

অন্তিম পর্ব (প্রথমাংশ)

সারাহ্-কে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। র°ক্তচাপ কমানোর জন্য এতোটা দেরি করলেও এখনো সারাহ্-র অস্থিরতা কমেনি।

সকাল সাতটায় আহনাফ এসেছে, এখন দুপুর সাড়ে বারোটা। দশটার আগেই জাহাঙ্গীর সাহেব ও সামিহা এসে হাজির।

সারাহ্-কে প্রস্তুত করে নিয়ে যাওয়ার সময় সে আরেক গ্যা°ঞ্জা°ম বাধায়, আহনাফকেও সাথে যেতে হবে।

“ঐশী, এমন আচরণ কেন করছো তুমি?”

আহনাফের শান্ত কথায় সারাহ্ কান্না করে দেয়। খেই তুলে বলল,
“আপনাকে ছাড়া আমার ভ°য় লাগছে, আহনাফ। যদি ওখান থেকে বেরিয়ে আপনাকে আর না দেখি।”

আহনাফ ওর কপালে চুম্বন করে, গালে হাত রেখে বলল,
“সব ঠিক থাকবে। বেবিকে আমরা একসাথে ওয়েলকাম করবো।”

সারাহ্ আহনাফের হাত ধরে রাখে। আহনাফ জোরপূর্বক নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়। জাহাঙ্গীর সাহেব মেয়েকে আদর করে সান্ত্বনা দিয়ে দেয়।

সারাহ্-কে ভিতরে নিয়ে গেল। আহনাফ ধীরে ধীরে হেঁটে একটু দূরে এসে স্থির হয়। জীবনে যেসব ক্ষেত্রে ও বেশি প্ল্যান করে, সেখানেই কেন যেন বিপত্তি আসে। এখন সে তাই বেশি কিছু ভাবতে চাচ্ছে না।
______________________________________

বাসার সামনের রাস্তায় শাফিনকে মাঝে দাঁড় করিয়ে দিয়ে পিবিআই সদস্যরা ক্র°স°ফা°য়ারের প্রস্তুতি নেয়, তাৎক্ষণিকভাবে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। শাফিনের দুইহাত পিছনে বাঁধা, তার চোখও বেঁধে দিয়েছে।

ইমতিয়াজ ও মৃত্তিকা এসে গেইটের সামনে দাঁড়ায়৷ দুপাশে মানুষের ভীড়। নাহিদ মাইকিং করে সব মানুষকে একদিকে পাঠিয়ে দেয়।

“ইমতিয়াজ, ওরা এতো দেরি কেন করছে?”
ভ°য় জড়ানো কন্ঠে কথাটা বলে মৃত্তিকা।

“সবকিছুর প্রস্তুতি লাগে, মৃত্তিকা।”

মৃত্তিকা ইমতিয়াজের হাত ধরে কাঁধে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে থাকে। একটু অদ্ভুত লাগছে তার, আবার না শাফিন বেরিয়ে যায়।

রিজভি ওদের দুজনের দিকে কয়েকবার তাকায়। গলির মুখে শরীফকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইমতিয়াজ। শরীফ হাতের ইশারায় ওদেরকে চলে যেতে বলে।

ইমতিয়াজের কপাল কুঁচকে যায়। মৃত্তিকাকে বলে,
“তুমি চলে যাও, কিছু গন্ডগোল আছে।”

“কেন?”
অবাক হয় মৃত্তিকা।

ইমতিয়াজ ওকে একটু ধা°ক্কা দিয়ে বলল,
“পরিস্থিতি স্বাভাবিক লাগছে না। চলে যাও।”

আচমকা রিজভি গু°লি চালায় মৃত্তিকার দিকে। ইমতিয়াজ ওকে সরিয়ে দিলেও গু°লিটা ইমতিয়াজের বামহাতে লাগে, কনুইয়ের খুব কাছে লেগে হাত ছুঁয়ে বেরিয়ে গেছে।

উপস্থিত লোকজন চমকে উঠে। চিৎকার, চেঁচামেচিতে একটা হুলস্থুল কান্ড বেঁধে গেল। পায়ের আঘাতে রাস্তায় অবহেলায় পড়ে থাকা ধুলাবালি বাতাসে বিচরণ করতে শুরু করেছে।

ইমতিয়াজ মৃত্তিকাকে নিয়ে ছুটে ভিতরে চলে আসে। এরমধ্যে আরো কয়েকটা গু°লি পর পর চলে। নিশানা ওদের মৃত্তিকাই। বারবার ইমতিয়াজ-মৃত্তিকা নিজেদের জায়গা পরিবর্তন করায় ওদের নিশানা ঠিক থাকে না।

গালিবের উপর গু°লি লেগেছে, এএসপি নাহিদও খারাপভাবে আ°হত হয়েছে।

শরীফের লোকজনও পাল্টা গু°লি চালায়। এলোপাথাড়ি গুলিতে বেশ কয়েকটা লা°শ পড়ে, আ°হতও হয় অনেকে।

শাফিনের চোখ খুলে দেয়া হয়েছে অনেক আগেই, রিজভিই খুলেছে৷ হাত বাঁধা অবস্থায় শাফিনে দৌড়ে চলে গেল, রিজভির গাড়ি প্রস্তুত আছে তাতে করেই পালিয়ে গেল শাফিন।

গ্যারেজে একটা পিলারের পেছনে মৃত্তিকাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে যায় ইমতিয়াজ। ইমতিয়াজের হাত থেকে ক্রমাগত র°ক্ত গড়িয়ে পড়ছে। ইমতিয়াজ বারবার গেইটের দিকে তাকাচ্ছে, হাতের খেয়াল তার নেই। নিজেকে শেষ করে দিয়ে হলেও সে মৃত্তিকাকে বাঁচাবে।

মৃত্তিকা ওর হাতটা ধরে বলল,
“তাহলে কি রিজভিও এদের সাথেই ছিল?”

“এখন তো তাই মনে হচ্ছে, আর নাহয় বিজনেসের কাগজপত্র নাহিদের থেকে নেয়ার পর পাল্টি খেয়েছে।”

মৃত্তিকা ইমতিয়াজের হাতের দিকে তাকিয়ে বলে,
“র°ক্ত পড়ছে ইমতিয়াজ।”

ইমতিয়াজ মৃত্তিকাকে জড়িয়ে ধরে, ওর মাথাটা নিজের বুকে চেপে বলল,
“পড়ুক, (একটু থেমে) ওদের টার্গেট তুমি ছিলে। তুমি ঠিক আছো তাতেই চলবে।”

কিছুক্ষণ পর গোলাগু°লি থেমে যায়। পরিবেশ শান্ত হয়। ধুলায় পুরো জায়গা অন্ধকার হয়ে আছে, যেন মরুর ধূলিঝ°ড় এখানে হয়ে গেছে।

মৃত্তিকাকে ভিতরে রেখে ইমতিয়াজ বেরিয়ে আসে। গালিব আর নাহিদসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়ে রাস্তায় পড়ে আছে। কেউ যেন নেই যে তাদের সাহায্য করে।

এতোক্ষণ এতো লোক এখানে জড়ো ছিল, এতো মানুষ কি শুধুই তামাশা দেখতে এসেছিল?

উপায় না পেয়ে ইমতিয়াজ নিজেই এম্বুলেন্স কল করে এবং থানায়ও যোগাযোগ করে। মৃত্তিকা গেইটের কাছে এসে বলল,
“ইমতিয়াজ, এভাবে বাইরে থাকবেন না। ওরা আশেপাশেই থাকতে পারে।”

ইমতিয়াজের মন এমনিতেই ছটফট করছে। শাফিন যে আবার পালিয়ে গেল। রাগ হচ্ছে তাফ প্রচুর। বারবার কেন সে পালিয়ে যেতে পারে? এতোগুলো মানুষের মাঝখান থেকে কিভাবে পালিয়ে যেতে পারে?

মৃত্তিকাকে ধ°মক দিয়ে বলে,
“ভিতরে যাও, এখানে তোমার কোনো কাজ নেই।”

মৃত্তিকা কোথাও যায় না। এখানেই থম মে°রে দাঁড়িয়ে থাকে।

ইমতিয়াজের ফোন বেজে উঠে। শরীফের নাম্বার দেখে সে রিসিভও করে।

“আমি শাফিনের পিছনে আছি, ও সম্ভবত ঢাকার বাইরে যাবে, আমি ভুল না করলে খুলনা যেতে পারে। সুযোগ বুঝে ওকে মে°রে দিবো আমি।”

ইমতিয়াজ শুধুই ওর কথা শুনে, কিছুই বলে না। কল কেটে ফোনটা ছুঁড়ে ফেলতে নিয়েও ফেলে না।

কিছুক্ষণ পরই এম্বুলেন্স চলে আসে। সবাইকে হাসপাতালে পাঠানো হলেও ইমতিয়াজ নিজে যায় না। মৃত্তিকার সাথে এটা নিয়ে একদফা কথা কা°টাকা°টিও হয়ে যায়।

ধ°মক দিয়ে মৃত্তিকাকে বাসায় পাঠায় ইমতিয়াজ। মৃত্তিকার জেদ ইমতিয়াজের কাছে হার মানে, নিজের অনিচ্ছায় বাসায় এসেছে সে। দরজা খুলে ভিতরে এসেই কান্নায় ভে°ঙে পড়ে।

দেলোয়ারা রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ওকে দেখে। উনি কি আর বলবেন, উনার স্বামীর জন্যই তো আজ এ অবস্থা। একজন নারীর কাছে নিজের স্বামীর মৃ°ত্যু প্রার্থনা করা কতটা কঠিন তা দেলোয়ারা জানে।
______________________________________

দুশ্চিন্তা, অস্বস্তি সবকিছুর অবসান ঘটে ছোট্ট প্রাণের চিৎকারে। এই এক কান্না যা শুনে মানুষ খুশি হয়। আহনাফ মনের অজান্তে হেসে উঠে।

একদম সুস্থ একটা সন্তান পৃথিবীতে এসেছে, আহনাফের সাদাব এসেছে। আনুষ্ঠানিক ভাবটা শেষ হয়, জাহাঙ্গীর সাহেব নাতির কানে আযান দেন। এরপর তাকে সারাহ্-র কোলে দেয়া হয়।

তানজিম হাসপাতালে এসেছে, সে মৃত্তিকার বাসায় হওয়া ঘটনা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র কিছু জানে না। সামিহার কল পেয়ে এসে এসেছে।

সামিহা তানজিমকে দেখেই দৌড়ে এসে বলল,
“আমি খালামনি হয়ে গেছি, ছেলেবাবু হয়েছে।”

তানজিম হেসে বলল,
“বেচারা বেবি খালাম্মার য°ন্ত্র°ণায় শেষ হবে।”

সামিহা গাল ফুলিয়ে তাকায়। আহনাফকে দেখে তানজিম বলে,
“কনগ্রেচুলেশন ভাইয়া।”

আহনাফ হাসে। বলে,
“থ্যাংকস। আমি একটু আসছি।”

আহনাফ অন্যদিকে চলে যায়। সামিহা আর তানজিম এটা সেটা নিয়ে কথা বলতে থাকে। এরমধ্যে নার্গিস পারভিন এসে সরাসরি তানজিমকে প্রশ্ন করে,
“তুমি শাফিনের ভাগ্নে না?”

তানজিমের হাসিমুখটা চুপসে যায়। সামিহার দিকে একপলক তাকিয়ে হালকা মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,
“জি, আন্টি।”

সামিহা বুঝতে পারে মায়ের দৃষ্টি, উনি কিছুটা ঘৃ°ণার চোখে তানজিমকে দেখে। সামিহা বলে,
“আম্মু, ও আমার ফ্রেন্ড।”

নার্গিস পারভিন সামিহার হাত ধরে নিজের কাছে নিয়ে এসে বলল,
“এমন ফ্রেন্ড থাকার চেয়ে একা থাকা ভালো।”

সামিহাকে নিয়ে অন্যদিকে চলে যায় নার্গিস পারভিন। সামিহা ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তানজিমকে দেখে মায়ের সাথে সাথে যেতে থাকে।

তানজিম কষ্ট পায়। বুঝতে পারে এ অনুভূতি নিজের অপমানের জন্য না, সামিহার দূরে যাওয়ার জন্য। নিজেকে সংযত রাখে সে। তারপর ধীরেসুস্থে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যায়।

এদিকে সারাহ্-র কেবিনের সামনে গিয়ে উঁকি দেয় আহনাফ। সারাহ্ ওকে দেখে বলে,
“সাদাবের আব্বু কি তাকে দেখবে না?”

“সাদাবের আব্বুর সাইদা চাই।”
কথাটা বলে আহনাফ ভিতরে আসে।

সারাহ্ মুচকি হাসে। আহনাফ চেয়ারে না বসে সারাহ্-কে ঠেলেঠুলে কোনোমতে বেডের মধ্যেই জায়গা করে নেয়। সাদাব পৃথিবীতে নিজের প্রথম খাবার খেয়ে মায়ের কোল দখল করে ঘুমাচ্ছে।

কিছুক্ষণ ছেলেকে দেখে আহনাফ একহাতে সারাহ্-কে আগলে ধরে কপালে চুম্বন করে। তারপর বলল,
“আজকে যতবার আমাকে আহনাফ আহনাফ বলে ডেকেছো, আমি কি তার প্রতি°শো°ধ নিবো না?”

“কিভাবে নিবেন? আপনি তো এখন আর রাগ করেন না? আমার উপর রাগ মিটান না।”

সারাহ্-র দিকে তাকায় আহনাফ। সারাহ্ চোখ নামিয়ে নেয়। আহনাফ জানে ওর কথার মানে, সারাহ্-র লজ্জায় সে নিজের জানাকে আরো পাকাপোক্ত করে।

নিচু হয়ে সারাহ্-র গলায় মুখ গুঁজে দেয়। শক্ত ভারি ওষ্ঠের স্পর্শ পায় সারাহ্। কাঁপা কন্ঠে বলে,
“ছেলেটাকে একটু শান্তি দেন।”

আহনাফ ফিসফিস করে বলল,
“আমার রাগ হচ্ছে, ঐশী।”

আহনাফের গরম নিশ্বাস অনুভব করে সারাহ্ চোখ বন্ধ করে ফেলে, সমস্ত দেহ তার স্থির হয়ে গেছে। তার মনে হয় এক অদ্ভুত অন্ধকারে আছে সে, অদ্ভুত শান্তি পাচ্ছে। আহনাফ ভালোবাসি না বলেও যে প্রচন্ড ভালোবাসে।
______________________________________

সন্ধ্যা সাতটা বেজেছে, হাসপাতাল থেকে নিজের প্রাথমিক চিকিৎসাটুকু সেরে নিয়েছে ইমতিয়াজ। গু°লিটা বের হয়ে যাওয়ায় র°ক্ত°ক্ষরণ হলেও ভয়াবহ অবস্থা হয়নি।

গালিবের অবস্থা বেশি খারাপ হওয়ায় তাকে ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে নেয়া হয়েছে। নাহিদ মোটামুটি ভালো আছে, গু°লি বের হওয়ার পরই সে ফোন যোগে একটা টিমকে শাফিনের পিছু ধরার অর্ডার দিয়ে দিয়েছে।

ইমতিয়াজ নিজেও শরীফের সাথে যোগাযোগ করে শাফিনের পিছু নিয়েছে। শরীফ জানিয়েছে শাফিন খুলনার পথেই যাচ্ছে এবং রিজভি তার সাথেই আছে। খুব সম্ভবত ওরা জমিদার বাড়িতেই যাবে।

আজকে সকালে নাহিদের কাছ থেকে শাফিনের বিজনেসের কাগজপত্র রিজভি নিয়ে নেয়ার কারণ ইমতিয়াজ এখন ভালোই বুঝতে পারছে।

এদিকে মৃত্তিকা চিন্তায় চিন্তায় পাগলপ্রায় হয়ে আছে। একবার ভাবছে সে ইমতিয়াজকে খুঁজতে যাবে, আরেকবার ভাবছে বাসায় দেলোয়ারাকে একা রেখে যাওয়াটা কি ঠিক হবে কিনা।

ইমতিয়াজকে কল করেও উপায় হয় না। ফোন বাজলেও রিসিভ করছে না। অবশেষে সৌভাগ্য হলো, ইমতিয়াজ কলব্যাক করে।

“ইমতিয়াজ, কোথায় আছে? কোথায় আছেন আপনি? ঠিক আছেন? ডাক্তার দেখিয়েছেন? হাসপাতালে গিয়েছিলেন?”
একনাগাড়ে ছটফট করে প্রশ্ন করছে মৃত্তিকা।

ইমতিয়াজের শান্ত জবাব,
“আমি ঠিক আছি, একটু দূরে যাচ্ছি। আশা রাখতে পারো কালকের মধ্যেই ফিরে আসবো।”

“কোথায় যাচ্ছেন? শাফিনের খোঁজে যাচ্ছেন আপনি, তাই না? প্লিজ ফিরে আসুন।”

মৃত্তিকা কান্না করে দেয়। আজ আবারো সে অসহায় হয়ে গেছে।

“আমি যদি ফিরে না-ও আসি, তবুও তুমি নিজের খেয়াল রেখো। আমাদের বেবির খেয়াল রেখো।”

মৃত্তিকা অবাক হয়।
“এভাবে কেন বলছেন?”

“হতে পারে শেষবারের মতো আমার সাথে কথা বলছো, হয়তো আজ রাতেই আমি চলে যাবো ওই ফেরারির কাছে। আর এই কন্ঠস্বরটা আমাকে শেষবারের মতো ডাকছে..”

ইমতিয়াজের কথার মাঝেই মৃত্তিকা কান্নাভরা কন্ঠে বলে,
“ইমতিয়াজ?”

ইমতিয়াজ চুপ, মৃত্তিকাও চুপ। দুজনের ওষ্ঠোধর কাঁপছে, কণ্ঠনালি বারবার ধ্বনি পাঠালেও তা কেউ উচ্চারণ করছে না। হঠাৎ করে কলটা কে°টে যায়।

কান থেকে ফোনটা সরিয়ে মৃত্তিকা নিজে নিজেই ভাবে,
“তাহমিনাকে এতোই ভালোবাসেন যে তার কাছে যাবার জন্য এতো তাড়া আপনার। আমাকে একটু ভালোবাসলে কি হতো?”

ইমতিয়াজ ফোনের স্ক্রিনে মৃত্তিকার ছবিটা দেখে সিটে হেলান দেয়। আকাশে নিভুনিভু তারার দিকে তাকিয়ে বলে,
“শাফিনকে না মা°রলে সে তোমাকে মে°রে ফেলবে মৃত্তিকা। ভুল বুঝো না আমাকে, আর কাউকে আমি হারাতে পারবো না।”

ইমতিয়াজ চোখ বন্ধ করে। মৃত্তিকার লাজুক মুখখানা ভেসে উঠে, সেই হাসি যেন তার একদম সামনে। আবারো তার কাছে আসবে এক আবেদনময়ী হয়ে, আবারো চোখের ভাষায় বলবে, ‘আমাকে পাগল করে দাও’।
______________________________________

মধ্যরাতে খুলনা পৌঁছায় ইমতিয়াজ। বাস থেকে নেমে সিএনজি করে এসে পৌঁছায় জমিদার বাড়িতে৷

বাড়ির আশপাশটা শান্ত, নিরব। গা ছমছমে রহস্যময়তা ভেদ করে ইমতিয়াজ এগিয়ে চলে। বাড়ির পেছনদিকের দরজার কাছে গিয়ে সে কারো কথা বলার শব্দ শুনতে পায়। আবার সাথে দা-ব°টির টুংটাং শব্দ।

“আমার পি°স্তল কোথায়? এগুলো দিয়ে আমি কি করবো?”

কন্ঠটা শাফিনের। ইমতিয়াজ দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে থাকে।

এবারে রিজভির কন্ঠ পাওয়া যায়।
“পি°স্তলের গু°লি শেষ। তাছাড়া তোমাকে পি°স্তল দেয়া হবে না। তুমি বহু কুকীর্তি করেছো, আমি তোমাকে শুধুমাত্র বিজনেসের জন্যই বাঁচিয়েছি। এছাড়া তোমার সাথে আমার কোনো বোঝাপড়া নেই। (একটু থেমে) শরীফের থেকে বাঁচার জন্য আপাতত এই হাতি°য়ারই ব্যবহার করতে হবে।”

কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে শাফিন বলে,
“তবে কি এই বোঝাপড়ার পর আমাকে মে°রে দিবে?”

রিজভি হাসে। বলল,
“তোমার মতো কৃ°তঘ্ন আমি নই। প্রাণে বেঁচে যাবে।”

কিছুক্ষণের জন্য আবারো নিরবতা বিরাজ করে। তারপর শাফিন বলে,
“ঠিক আছে, আমি রাজি। এগুলো এখানে না রেখে অন্দরমহলে রাখো।”

“আমাকে আদেশ করো না শাফিন। নিজে নিয়ে রেখে দাও। আমি অনেক বড় রিস্ক নিয়েছি।”

ইমতিয়াজ হাত দিয়ে দরজায় আলতো করে ধা°ক্কা দিয়ে বুঝতে পারে দরজা বন্ধ। ভিতরে আবারো টুংটাং শব্দ শুরু হয়েছে।

রিজভি বলছে,
“সব শান দেয়া হয়েছে। অনেক ধা°রালো।”

“এটার ধার কম লাগছে, আমি একটু ধার করে আনি।”

“যা করার করো, তবে আগে আমার খাবারের ব্যবস্থা করো।”

শাফিন দরজা খুলে, ইমতিয়াজ দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। শাফিন বের হতেই পেছন থেকে দুহাতে ওর গলা শক্ত করে পেঁ°চিয়ে ধরে ভিতরে ছিটকে ফেলে।

রিজভি চমকে উঠে দরজার দিকে তাকায়। ইমতিয়াজ ভিতরে এসে দেখে বড় বড় রাম°দা আর তার সাথে ত°লো°য়ার থরে থরে সাজানো। তার পাশে কয়েকটা লোহার পাইপ আর পিভিসি ভাঙাচোরা পাইপের সারি।

“তর°বারির যুদ্ধ লাগাবে নাকি?”
হাসতে হাসতে কথাটা বলে ইমতিয়াজ।

রিজভি কাঁপাকাঁপা হাতে তার পি°স্তলটা হাতে নিয়ে বলল,
“দেখো ইমতিয়াজ, বাঁচবে না তুমি। আমার লোকজন কিন্তু চলে আসবে।”

ইমতিয়াজ হাসে। বলে,
“গু°লিতে যে ছেলে ভ°য় পায় না, তাকে গু°লি ছাড়া খেলনাসম পি°স্তল দিয়ে ভ°য় দেখাও। হাউ ফানি।”

ইমতিয়াজ একটা লোহার পাইপ নিয়ে রিজভির হাতে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে আ°ঘাত করে। খুব দ্রুত ঘটনা হয়ে যাওয়ায় রিজভি পালানোর সুযোগ পায় না। প্রচন্ড ব্য°থায় চিৎকার করে রিজভি পি°স্তল ফেলে দেয়।

ইমতিয়াজ পাইপটা ছুঁড়ে ফেলে শাফিনের পা নিশানা করে৷ নিশানা লক্ষ্যে গিয়ে পৌঁছায়। শাফিনের পা এখনো ঠিক হয়নি, ক্ষ°তও পুরোপুরি শুকায়। কেবল পঁচন বন্ধ হয়ে শুকাতে শুরু করেছে। এখন এতোবড় একটা আ°ঘাত পেয়ে সে মাটিতে পড়ে যায়, সাথে গো°ঙা°তে থাকে।

ইমতিয়াজ দ্রুত গতিতে ত°লো°য়ার হাতে তুলে নেয়। রিজভি এবারে পালাতে নিলে দৌড়ে গিয়ে ওর ডানহাতে এক কো°প বসায়, একবারই যথেষ্ট হয়েছে ওর হাতের কবজি আলাদা হতে।

রিজভির গগনবিদারী চিৎকার অবহেলা করে ইমতিয়াজ বলে,
“ত°লো°য়ারটা বেশি ধা°রা°লো করে ফেলেছো?”

শাফিন এবারে ভ°য় পেতে শুরু করে৷ তাহমিনাকে খু°নের সময় সে ভ°য় পায়নি, ভ°য় পায়নি একা বাসায় মৃত্তিকার উপর হা°মলা করতে, সে ভ°য় পায়নি ইমতিয়াজকে খু°নের চেষ্টা করতে। তবে আজ পাচ্ছে কেন?

ইমতিয়াজ যে আজ নেকড়ের রূপ ধারণ করেছে। নেকড়ে যেভাবে শি°কারের দিকে ধেয়ে আসে, ইমতিয়াজও খোলা তর°বারি হাতে এগিয়ে আসে। পিছনে চিৎকার করছে রিজভি। তার কা°টা হাত তারই সামনে পড়ে আছে।

শাফিন পায়ের জন্য উঠতেও পারছে না। তারউপর সে বামচোখে দেখে না, ওখানে একটা পট্টি বাঁধা আছে।

শাফিনে গড়িয়ে সরে গিয়ে ইমতিয়াজকে বলে,
“ইমতিয়াজ, তুমি আমাকে খু°ন করে জেলে যাবে, মৃত্তিকার কি হবে ভাবো তো? তোমার সন্তানের কি হবে?”

ইমতিয়াজ মাথা নাড়ে,
“আমি ভাবছি না ওসব নিয়ে।”

শাফিনের ডানহাত টেনে কভার খুলে ফেলে ইমতিয়াজ। ক্ষ°ত জায়গায় তলোয়ার ঢুকিয়ে দেয় সে। শাফিন চিৎকার করে বলে,
“ইমতিয়াজ, মে°রো না আমাকে।”

“ইমতিয়াজ ডাক শোনার খুব শখ হয়েছিল না তোমার?”
ত°লো°য়ারটা ঘুরাতে থাকে ইমতিয়াজ।

“হ্যাঁ হয়েছিল। তাহমিনার চিৎকার আমার ভালো লেগেছিল, তাই তো মৃত্তিকার থেকেও একই চিৎকার শুনতে চেয়েছিলাম।”

ইমতিয়াজ ত°লো°য়ার উঠিয়ে ছুঁড়ে ফেলে শাফিনের নাকেমুখে ঘু°ষি দিতে শুরু করে। শাফিনকে তুলে ওর মাথা নিয়ে দেয়ালের সাথে পর পর কয়েকবার আছড়ে ফেলে সে ক্ষান্ত হয়।

ইমতিয়াজ সরে আসে। এতো অত্যাচারে শাফিন আর চোখ খুলে তাকাতেও পারছে না। পুরোনো ব্য°থার সাথে নতুন করে আরো কিছু যুক্ত হয়েছে।

শাফিন মাটিতে বসে জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলে বলে,
“বাঁচতে দাও আমাকে।”

“আমার নিষ্পাপ সন্তানটাও এটা বলেছিল, আমার মিনা এটাই বলেছিল।”
ছন্নছাড়া ইমতিয়াজের এগোছালো জবাব।

এমনসময় বাইরে চারটা গু°লির শব্দ হয়। ইমতিয়াজ চমকে দরজা বন্ধ করতে গেলে শরীফ এসে ভিতরে ঢুকে। রিজভির দুজন লোককে মাত্রই গু°লি করে হ°ত্যা করেছে সে।

ভিতরের অবস্থা দেখে শরীফ থমকে যায়।
“এ কি করেছো, ইমতিয়াজ?”

ইমতিয়াজ আবারো গিয়ে ত°লো°য়ারটা তুলে বলল,
“শাফিনকে আমি নিজ হাতে মা°রবো। সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেও আবার পুরোনো সিদ্ধান্তে ফিরে যাচ্ছি।”

“এমন করো না..”

শরীফ কথার মাঝেই ইমতিয়াজ বলে,
“কেন? মৃত্তিকার কথা ভাবছেন? আমিও ওর কথাই ভাবছি, ওর কথা ভেবেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

রিজভি জ্ঞান হারাবে হারাবে ভাব। সে আর স্থির থাকতে পারছে না। চোখ তার নিভুনিভু, হাতের র°ক্তে সে মাখোমাখো হয়ে গেছে।

শরীফ তার কষ্ট আর বাড়ায় না। সোজা গু°লি করে তার বুকে, একটা গু°লিতেই সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।

ইমতিয়াজ একবার তাকায় রিজভির প্রাণহীন দেহের দিকে। বলে,
“এতো সহজভাবে শাফিন ম°রতে পারে না।”

“মৃ°ত্যুতে সহজ বলে কিছু নেই, মৃ°ত্যুর য°ন্ত্রণা কঠিনই হয়।”

ইমতিয়াজ শাফিনকে টে°নে তুলে। তড়িৎগতিতে ইমতিয়াজকে ধা°ক্কা দিয়ে ফেলে ওর হাতের তলোয়ার নিয়ে শাফিনের গলায় ঢুকিয়ে দেয় শরীফ।

গলার মাঝ বরাবর ঢুকে তা পেছন থেকে বেরিয়ে এসেছে। ফি°ন°কি দিয়ে র°ক্ত বেরিয়ে এসে শরীফকে ভিজিয়ে দেয়। তাৎক্ষণিক এমন ঘটনায় ইমতিয়াজ নিজেও হতবাক।

শরীফ ত°লো°য়ারটা ঘুরাতে শুরু করে। একবার ঘুরিয়ে একটা°নে বের করে নিয়ে আসে। শাফিন মাটিতে পড়ে যায়। কিছুক্ষণ শান্ত থেকে আবারো কেঁপে উঠলো, দুইপা একসাথে নড়ে উঠে, দুইহাত নড়তে নিয়ে থেমে যায়। সঙ্গে সঙ্গে র°ক্ত বেরিয়ে আসে গলার ছিদ্রপথে, নাকমুখ দিয়ে। র°ক্তের সাথে ‘কু’ ধরনের চিকন একটা শব্দ বের হয়।

শব্দের বেগ ধীরে ধীরে কমে, শাফিন শান্ত হয়। হাতপা ছেড়ে দিয়ে মাটিতে পড়ে থাকে। চোখ একটা তো চিরকালের মতো অন্ধ করেছিল আহনাফ, অন্যটা এখনো খোলা রয়েছে।

এতোদিনের ফে°ত°নার মৃ°ত্যু হয়েছে। অবশ্যই মৃ°ত্যু°য°ন্ত্রণা কঠিন, চরম কঠিন।

‘মৃ°ত্যু°য°ন্ত্রণা সত্যই আসবে। এটা হতে তোমরা অব্যাহতি চেয়ে এসেছ।’ (সুরা কাফ, আয়াত : ১৯)

চলবে……

(অন্তিম পর্বটি অনেক বড় হয়েছে, তাই শেষাংশ আগামীকাল দেয়া হবে ইনশাআল্লাহ। আর হ্যাঁ, টুইস্ট কিন্তু এখনো বাকি আছে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here