অনুভূতিরা_শব্দহীন লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী চতুঃপঞ্চাশৎ পর্ব (৫৪ পর্ব)

0
344

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

চতুঃপঞ্চাশৎ পর্ব (৫৪ পর্ব)

(আজকের পর্বটি গতানুগতিক পর্ব থেকে একটু ভিন্ন)

“বড়মণি কেমন আছে?”

মৃত্তিকার কথায় পল্লবী ঘাড় নাড়িয়ে বলে,
“এখন ভালোই আছে। তবে কিছুই খায়নি।”
“হুম।”

মৃত্তিকা খাবারের প্লেট নিয়ে ভিতরে আসে। মমতাজ বেগম ওকে দেখে বলে,
“এতো দরদ উ°তলে পড়তেছে কেন?”

মৃত্তিকা সামনে বসে রুটি ছিঁ°ড়ে উনার মুখের সামনে ধরে বলে,
“খাও, কালরাতে অর্ধেক খাইয়ে চলে গেলাম আর তো খাওনি।”
“খাবো না, মেহেরিবার মতো দরদ দেখাচ্ছো।”

মৃত্তিকা কপাল কুঁচকে জোর করে উনার মুখে রুটি দিয়ে বলে,
“তোমাকে আমি মা°রতে পারতাম, অপরূপার মতো হাত ভে°ঙে দিতে পারতাম। কিন্তু পারিনি। আমার দুর্বলতা হয়তো এখানেই, যাকে ভালোবাসি তাকে আ°ঘাত করতে পারি না।”

মমতাজ বেগম আর কথা বাড়ায় না। চুপচাপ খেতে থাকেন। খাওয়া শেষে বলেন,
“তোমার মনে হয় আমি কোনো অপ°রাধ করেছি? আমার তো মনে হয় না। বাবাকে কথা দিয়েছিলাম এই বংশের প্রতিটা র°ক্ত°কণাকে শেষ করে দিবো, তাই রিপাকে মে°রে ফেলেছি। আর শাফিন তো তোমাকেও মা°রবে।”

শান্তভাবে চেয়ে থাকে মৃত্তিকা। এতোটা সহজে সে নিজেকে নির্দোষ বলছে কিভাবে?

“তোমরা কি এ বংশের নও?”

মমতাজ বেগম মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, কিন্তু রিপার বাবা আর আমার বাবা আলাদা।”
“সেটা শাফিন আমাকে বলেছে। তবে মা°রতে কেন চাও? আমার নানুমণির সাথেও তোমার বাবা নি°কৃষ্ট আচরণ করেছিল, কিন্তু এতো রাগ কিসের?”

মমতাজ বেগম বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ উপরে ঘুরতে থাকা ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলা শুরু করে,
“খুলনায় গিয়ে জমিদার বাড়ি দেখেছিলে না? অনেক আগের জমিদারি ছিল আমাদের। ইংরেজ আমলেরও আগের জমিদারি, বুঝতে পারছো? অনেক পুরনো জমিদারি এটা। খুলনার বিশাল অংশ জুড়ে এবং পশ্চিমবঙ্গের কিছু অংশসহ এই জমিদারি ছিল।

আমার দাদিমা বলেছিলেন, উনি যখন বিয়ের পর প্রথম খুলনায় আসেন, তখন জমিদারি দেখে উনি অবাক হয়েছিলেন। হওয়ারই কথা, আটদশ জন দাসী সব সময় তাকে পাহারা দিয়ে রাখতো, কিছু করা লাগতো না। একটা রানী রানী ভাব থাকতো তার মধ্যে। উনার দুই ছেলে ছিল, ইউসুফ আর ইউনুস। পরহেজগার মানুষ ছিলেন, তাই নবীদের নামে ছেলেদের নাম রেখেছিলেন।

এরপর ভারত-পাকিস্তান ভাগ হয়, আমাদের জমিদারিও ভাগ হয়। তবে পাকিস্তান আমলেও জমিদারি শেষ হয়নি, কিছুটা ছোট পরিসরে তখনও চলছিল।

আমার দাদা, জমিদার আকবরের ভয়ে তখনও ওই এলাকার লোকজন কাঁপতো। উনি ছেলেদের অনেক যত্নে বড় করলেও ইউসুফ কোনো ভালোমানুষ হলেন না। সে হলো এক ব°খাটে, কু°ৎ°সিত স্বভাবের মানুষ।

ইউসুফ নবীর নামে নাম হলেও নামের মর্যাদা সে রাখেনি। তার কাছে এলাকার কোনো মেয়ে নিরাপদ ছিল না। আমার দাদি এসবের জন্য অনেক শা°সন করেও কোনো লাভ হয়নি।

তাই তাকে দ্রুত বিয়ে করানো হলো এলাকার এক দরিদ্র পরিবারের মেয়েকে। মেয়ের নাম ছিল জোসনা। রূপে গুণে পরিপূর্ণ মেয়েটার জীবন জেনেবুঝে নষ্ট করা হয়েছিল।”

মমতাজ বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“প্রতিরাতে মেয়েটির চিৎকারে পৈ°শা°চিক আনন্দ পেতো ইউসুফ। পি°শা°চের সন্তান কি আর ভালো হবে? হলো না। দুই সন্তান মমতাজ আর শাফিন, কেউই ভালো মানুষ হলো না। দুজনই খারাপ, জঘন্য হলো।”

মৃত্তিকা হা করে তাকিয়ে আছে। চোখের পলক তার পড়ছে না। কি শুনছে সে?

“তবে শাফিন, মমতাজ কিন্তু একদিনে খারাপ হয়নি। তাদেরকে খারাপ করা হয়েছে।”

মৃত্তিকা নিচুস্বরে জিজ্ঞাসা করে,
“মামের নাম কেন পরিবর্তন করেছিলে?”

মমতাজ বেগম হেসে বলল,
“সম্মান রক্ষার্থে, রিপা যাতে বুঝতে না পারে সে কে? কি তার পরিচয়? কে তার বাবা-মা?”

মৃত্তিকার মনে এখনো হাজার প্রশ্ন, কিন্তু করতে পারছে না সে। গুছিয়ে আনতে কষ্ট হচ্ছে, আবার না জানি কি শুনতে হয়?

মমতাজ বেগম থম মে°রে বসে থেকে বলল,
“রিপার বাবার কথা শুনবে না? কি করেছিল সে?”
“বলো।”

“উনার নাম ছিল ইউনুস। উনি ছিলেন বাবার বিপরীত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। লেখাপড়ায় ছিল তার প্রচুর আগ্রহ। সাথে সাথে অ°স্ত্র চালনাও শিখেছে। পড়াশোনার জন্য লাহোরে থেকেছে বহুদিন, সেখানেই পরিচয় হয় পাকিস্তানি কন্যা মেহরিবার সাথে।

প্রেম আদান প্রদান না হলেও বিয়ে ঠিকই হয়, সাথে হয় ভালোবাসায় পরিপূর্ণ একটা সংসার। পর্দাশীল মেহরিবাকে হুর বলে ডাকতো ইউনুস। তার চক্ষু শীতলকারী স্ত্রী, তার প্রাণে সখায় পরিণত হয়।

স্ত্রী নিয়ে দেশে ফিরলে পিতা আকবর নিজের জমিদারি দুইভাগ না করে পুরো জমিদারি দিয়ে দেয় ইউনুস চাচাকে। শ°ত্রু°তার শুরু হয় তখনই।

১৯৭০ সালে জমিদারি হস্তান্তরের কিছুদিন পরই মারা যায় দাদা আকবর ও দাদিমা। রহস্যজনক মৃ°ত্যু হয় তাদের। কে মে°রেছিল? ইউসুফ আর জোসনা মে°রেছিল, আমার মা-বাবা খু°ন করেছিল।”

মমতাজ বেগম চেঁচিয়ে উঠে,
“আমরা দুজন তখনই দেখেছিলাম দুই দুইটা খু°ন। নিজেদের দাদা-দাদির খু°ন। আমাদেরকে বোঝানো হয় এটাই ঠিক। আমাদের বয়স কত ছিল জানো? আমার বয়স ছিল নয় আর শাফিনের সাত।”

মৃত্তিকা কেঁপে উঠলো। নিজের হাতে নিজের বাবা-মাকে খু°ন করাও সম্ভব? তাও জমিদারির জন্য?

মমতাজ বেগম অনেকক্ষণ চুপ থাকেন। তারপর শান্ত গলায় বলেন,

“দেশে যখন যু°দ্ধাবস্থা, তখন একরাতে জন্ম হয় রাহা সুলতানার। তোমার মা, রাহা। আমরা দেখেছিলাম কি অপরূপ সুন্দরী ছিলো সে। মেহরিবাও সুন্দরী ছিল, তুমিও তার মতোই হয়েছো। (একটু থেমে) তবে জানো তো ওই রাতটা আমাদের জন্য সুখের হয়নি। দাদা-দাদিকে খু°নের জন্য বাবাকে সন্দেহ করে চাচা।

সাক্ষী হিসেবে শাফিনকে যখন জিজ্ঞাসা করেছিল, তখন শাফিন সব স্বীকার করেছিল। ওই রাতেই বাবা-মাকে কা°রা°গারে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। অকথ্য নি°র্যাতন চলেছিল বাবার উপর। মা তখন অন্তঃসত্ত্বা ছিল, তাই মাকে মা°রেনি। তবে মায়ের সামনে বাবাকে পাশবিক নির্যাতন করেছিল চাচা। চাচার এমন ভ°য়ংকর রূপ আগে কখনো দেখিনি।”

মমতাজ বেগম থেকে গেলেও মৃত্তিকার শোনার পিপাসা থামে না। জিজ্ঞাসা করে,
“তোমাদের আর কোনো ভাইবোন আছে?”

মমতাজ বেগম মাথা নেড়ে না বোঝানো। তারপর বলল,
“না, আমার মায়ের ওই সন্তান, পৃথিবীর মুখ দেখেনি। মেহেরিবা চাচি প্রতিদিন উনাকে খাবার দিতে যেতো, কিন্তু মা ঠিকমতো খেতো না। কারণ খাবার শুধু উনার জন্য বরাদ্দ ছিল, আমার বাবার জন্য না। আমার বাবাকে একদিন পর পর খাবার দেওয়া হতো, তাও শুকনো শক্ত রুটি। এটা ছিল আমার চাচার অভিনব শাস্তি। একেবারে না মে°রে, তিলে তিলে মা°রতে চেয়েছিল। এর চেয়ে শি°র°শ্ছেদ বা ফাঁ°সি অনেক ভালো।

মা কাঁদতো এসব দেখে, এসবের জন্যই একদিন মা অসুস্থ হয়ে যায়। আমি দেখেছিলাম সেদিন মাকে।

সেদিন একটা কথা ভালোমতো বুঝেছিলাম, যত স্বা°র্থপর হবে, তত ভালো থাকবে। আর সত্য যত কম বলবে, প্রিয়জন তত কম হারাবে। যার যত টাকা, তার তত ক্ষমতা আর ক্ষমতা বেশি মানেই, তুমি যা চাইবে তাই করবে।

বাবা এই খবরটা পেয়ে সেদিন আমাদের দুজনকে বলেছিল এই পরিবারের একটা সদস্যকেও বাঁচতে দিবেন না উনি। যদি উনি না থাকে তবেও যেন ওরা না বাঁচে। আমার মনে আছে, বাবার কথা।

অনেকদিন বাবা মা আমাদের থেকে দূরে থাকে। চাচি আমাদের খেয়াল রাখলেও, বাবা মায়ের অভাব কি আর উনি দূর করতে পারবে?

প্রায় ছয় সাত মাস পর একদিন বাবা পালিয়ে যায়। বাবাকে খুঁজতে আশেপাশে অনেক লোক লাগানো হয়, ঠিক যেমন এখন শাফিনকে সবাই খুঁজছে।

এরমধ্যে আমরা খবর পাই দেশ স্বাধীন হয়েছে। চারদিকে রমরমা থাকলেও আমাদের জমিদার বাড়ি শুনশান ছিল। চাচা আর চাচি আনন্দ করলেও, আমরা দুই ভাইবোন কিছুই করতে পারিনি। আমার বাবাকে খুঁজে পাচ্ছি না, মা কারাগারে, আমাদের অবস্থাটা কেউ বোঝেনি।”

মমতাজ বেগম চুপ হয়ে যায়। মৃত্তিকা এসে উনার পাশে বসে বলল,
“বড়মণি, তোমার বাবার খোঁজ কিভাবে পেয়েছিলে?”
“খোঁজ পাইনি উনি এসেছিলেন।”

মৃত্তিকার দিকে তাকিয়ে বলেন,
“রাহার বয়স তখন কেবল নয়মাস। প্রতিরাতের মতো একরাতে চাচা ইউনুস ঘরে ফিরে মেহরিবার সাথে গল্পে মশগুল ছিল। মেহরিবা তখন তিনমাসের অন্তঃসত্ত্বা। নিজেদের সুন্দর সময়টাকে কাটাতে ছাদে যায় ওরা। চাঁদনি রাত্র জ্যোৎস্নাবিলাস সুখকর হয় না।

বাবা এসে হাজির হয়, একা নয়। সাথে ছিল বাড়ির সব চাকরবাকর আর পাহারাদাররাও। চাচাকে সেইরাতেই মেহরিবার সামনেই কু°পিয়ে হত্যা করা হয়। আমরা তখন সামনে ছিলাম, রাহা ছিল। আমি নিজে দেখেছিলাম কিভাবে বাবা রাম°দা দিয়ে চাচাকে কু°পিয়েছিল। বড় হা°তুড়ি দিতে থেঁ°তলে দিয়েছিল উনার মাথা।

চাচির চিৎকার আজও আমার কানে বাজে। ইউনুস, ইউনুস করে আকুতিভরা চিৎকার করেছিল। বাবা শুনেনি।

চাচার পর অন্তঃসত্ত্বা মেহরিবার উপর চালানো হয় শারিরীক নি°র্যা°তন। সবসময় পর্দার আড়ালে থাকা মেহরিবাকে সকলের সামনে বস্ত্র°হ°রণ করে হাঁটতে বাধ্য করা হয়। আমার জীবনের নি°কৃষ্টতম দৃশ্য সেদিন দেখেছিলাম। আমার বাবা আমারই চোখের সামনে আমারই চাচিকে রে°প করেছে। শাফিন ছিল সেখানে, চাচির চিৎ°কারে সে হেসেছিল।

বারবার শারিরীক নির্যাতনে র°ক্ত°ক্ষরণে মা°রা যায় চাচি মেহেরিবা। তার খোলা চোখদুটো দেখেছিলাম খুব কাছ থেকে। একটা অধ্যায় যেন মুছে গিয়েছিল। জমিদারিতে একটা কালো দাগ পড়েছিল।”

“থামো, থামো।”
বলে মৃত্তিকা সরে গেল। চিৎকার করে কেঁদে উঠে সে। এতোটা নি°কৃষ্ট কেউ কিভাবে হতে পারে?

অনেকক্ষণ পর মৃত্তিকা শান্ত হয়। মমতাজ বেগম বলেন,
“ঘৃ°ণা হচ্ছে না আমাকে?”

মৃত্তিকা কান্নাভরা কন্ঠে জবাব দেয়,
“এই দৃশ্য দেখেও তুমি কি করে এতোটা নিচে নামতে পারলে?”

মমতাজ বেগম একটু নড়েচড়ে বসে বলল,

“আমার চেয়েও খারাপ শাফিন হয়েছে, সেদিন চাচির চি°ৎ°কারে যেখানে সবাই কাঁদছিলো, সেখানে সে হেসেছিল। সেদিন থেকেই মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। মেয়েদের এই কষ্টের চিৎকারটা সে উপভোগ করতো।”

মৃত্তিকার চোখ দিয়ে এখনো পানি পড়ছে। মমতাজ বেগম বলেন,
“সেদিন এসব দৃশ্য দেখেছিল যেসব চাকররা, তাদেরকেও হ°ত্যা করেছিল বাবা। রাহাকে হ°ত্যা করতে দেয় না আমার মা, বেঁচে যায় রাহা। নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় রিপা। রাহা সুলতানা থেকে রিপা বেগম।

রাতারাতি জমিদারি দখল করে বসে বাবা ইউসুফ। তবে প্রকৃতি বাবাকে এর যোগ্য শা°স্তি দিয়েছিল। ট্রেনে কা°টা পড়ে কিছুদিন পরই মারা যায় সে। আমার মা জোসনা আমাদের সাথে রিপাকেও বড় করতে থাকে। রিপা জানতেও পারে না, তার মা বাবার সাথে কি হয়েছিল। সে জানতো তার বাবা ট্রেনে কা°টা পড়ে মা°রা গেছে।”

মৃত্তিকার চোখের সামনে ঘটনাগুলো ভাসছে। সে দেখছে আকবরের মৃ°ত্যু, ইউসুফের উপর হওয়া নি°র্যা°তন, জোসনার সন্তান হারানোর দুঃখ, ইউনুসের করুন মৃ°ত্যু, মেহেরিবার চি°ৎ°কার, জোসনার মাতৃসুলভ আচরণে রাহার বেঁচে যাওয়া।

সব যেন একই মালার একেকটি মুক্তা, সুতোটায় টা°ন পড়তেই সবগুলো টপটপ করে ঝরে পড়লো।

মমতাজ বেগমের কথায় মৃত্তিকার ঘোর কাটে,

“শাফিন তার বাবার মতোই হলো। তারও প্রতিরাতে মেয়ে চাই, নতুন নতুন মেয়ে। শাফিন মেয়েদের জীবন নিয়ে পুতুল খেলায় মেতে থাকে, সাথে চলে জুয়ার কারবারি। জমিদারি শেষ হতে থাকলো। একপর্যায়ে দেখা যায়, যাও কিছু আছে তা শাফিনের পেছনেই খরচ হচ্ছে।

১৯৮৮ সাল, রিপা তখন ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিবে। যৌবনের রূপ তখন তার সর্বাঙ্গে। মায়ের মতো রূপবতী তরুণী রিপার দিকে নজর যায় শাফিনের। প্রতিটা মুহূর্ত শাফিনের নোং°রা চিন্তায় রিপা।

সবার আগে বিষয়টা মায়ের নজরে পড়ে। মা কখনো চায়নি রিপার ক্ষতি হোক। তখন মায়ের সিদ্ধান্তে ম্যাট্রিকের পর পরই রিপাকে কুমিল্লা পাঠানো হয়।

এই ঘটনায় শাফিন রেগে যায়। রিপাকে নিজের করার বাসনা তার বাড়তে থাকে। এদিকে রিপা তখন ইন্টার পাশ করে অনার্সে পড়াশুনা করছে।

কিছুদিন পর শাফিনকে নিয়ে আমরা ঢাকায় চলে আসি। গ্রামে ওর এতোই বদ°নাম হয়েছিল যে ওখানে থাকাই দুষ্কর ছিল। শাফিন চাকরি নেয়, তারপর ওর বিয়ে হয় দেলোয়ারার সাথে।

তবে গোপনে সে অন্ধকার জগতের বিজনেসের সাথে যুক্ত হয়। হুমায়ুন নামের একজন তখন থেকেই ওর সঙ্গী ছিল, তবে বিজনেস দখলের জন্য সে হুমায়ুনকেও মে°রে ফেলেছিল।”

মমতাজ বেগম একটু বিরতি নিয়ে আবারো বলা শুরু করে,

“রিপা মাঝে মাঝে আমাদের বাসায় বেড়াতে আসতো। শাড়ির ভাঁজে তখনও তার ভরা যৌবনের ছোঁয়া। একবার বাড়িতে আসে তোমার বাবা শরীফের সাথে, দুজনে নাকি বিয়ে করে নিয়েছে। শরীফ তখন ঢাকা মেডিকেলে ইন্টারশীপ করছিল।

শাফিনের জন্য এটা কোনো ভালো খবর হলো না। শরীফ-রিপার সংসার ভা°ঙার জন্য উঠে পড়ে লাগে সে। তবে নিজের স্ত্রীর সামনে একটা মুখোশ পড়ে নেয় সে। ভালো মানুষের মুখোশ। সুরভি আর দেলোয়ারার জন্য যেন তার কত ভালোবাসা।

যখন তোমার জন্ম হয়, তখন রাগে শাফিন আমাদের মাকে মা°র°ধর করে বাড়ি থেকে বের করে দেয়, মাকে আর খুঁজে পাইনি। জানি না বেঁচে আছে নাকি ম°রে গেছে। সব ঘটনা জেনেও আমি চুপ ছিল। অ°ন্যায়কে শুরু থেকে প্রশ্রয় দিয়েছিলাম আমি।

শাফিন অবশেষে সফল হয়। শরীফের রাগকে কাজে লাগিয়ে রিপার ডি°ভো°র্স হয়। তবে রিপা এবারে আর দেশে থাকে না। তোমাকে নিয়ে পাড়ি দেয় ইতালিতে। আর দেশে শাফিন হয় ঢাকার এক বড় অফিসের কর্মকর্তা আর একজন সাধারণ ব্যবসায়ী।”

একটু নিচুস্বরে মমতাজ বেগম বলেন,

“শাফিন কিন্তু এই দিনগুলোতে থেমে থাকেনি, একের পর এক মেয়ের জীবন সে শেষ করেছে। তবে ঢাকায় স্থায়ী হওয়ার পর সে আর এসব করেনি, সে তখন…”

মমতাজ বেগমের কথার মাঝেই মৃত্তিকা বলে,
“অপরূপার মতো মেয়েদের কাছে যেতো, আর অপরূপাকে বিয়ে করে।”
“হুম।”

মৃত্তিকা দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে। লাইটের আলোয় হাতের বালাদুটো চকচক করছে তার। তার বুক চি°ড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়।

মানুষের মধ্যে দুইটা সত্ত্বা থাকে, একটা ভালো আর অন্যটা খারাপ। কিন্তু যখন মানুষটা ভালো সত্ত্বাকে মে°রে ফেলে, তখন খারাপটা তার রক্তনালি দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। কেউ জন্ম থেকে খারাপ নয়, পরিস্থিতি তাকে খারাপ হতে বাধ্য করে। সে হতে পারে অপরূপা, হতে পারে মমতাজ বেগম কিংবা শাফিন।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here