#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী
সপ্তপঞ্চাশৎ পর্ব (৫৭ পর্ব)
গাড়ির পিছনের সিটের নিচের অংশে শাফিনকে বেঁধে ফেলে রেখেছে। শরীফ ড্রাইভ করছে আর মৃত্তিকা পাশে বসা। শাফিনকে এমনভাবে রেখেছে যেন বাইরে থেকে না দেখা যায়। কিছুক্ষণ পর পর শরীফ তার দিকে তাকাচ্ছে।
গাড়িতে উঠে মৃত্তিকার আবারো শরীর খারাপ হওয়া শুরু হলো। প্রচুর বমি হলো, আবার মাই°গ্রে°নের ব্য°থা। সিটে গা এলিয়ে শুয়ে পড়লো। ঘুম আসলেও, সে ঘুমাচ্ছে না। সারারাত জেগে থাকা মেয়েটা এই ভোররাতে আর কিভাবে চোখ খুলে রাখতে পারে? কিন্তু শাফিনের জন্য জেগে থাকতে হবে ওর।
শরীফ ওর দিকে পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বলে,
“একটু খাও, মুখেও দিয়ে নাও।”
মৃত্তিকা তাই করলো। শরীফ গাড়ির এসি বন্ধ করে মৃত্তিকাকে বলে,
“জানলা খুলে দাও।”
এরমধ্যে শরীফের ফোন বেজে উঠে। মৃত্তিকা ফোন হাতে নিয়ে ইমতিয়াজের নাম্বার দেখে বলে,
“ফোন অন রাখা জরুরি?”
“হাসপাতাল বা কোম্পানি থেকে কল আসতে পারে।”
বেজে বেজে কল কে°টে গেল। মৃত্তিকা ফোন সাইলেন্ট করে রেখে দেয়। শরীফ এতে কিছুই বলে না। মেয়ে যে তার মতোই, কিছু বললেও শুনবে না।
রাস্তায় কোনো জ্যাম নেই। গাড়ি সাই সাই করে এসে পড়ে ঢাকায়। শাফিনকে শরীফের ধানমন্ডির ফ্ল্যাটে নেয় না, ওকে মতিঝিলের ফ্ল্যাটে নিয়ে আসে।
জাহাঙ্গীর সাহেবের ফ্ল্যাটের একতলা উপরেই সেই ফ্ল্যাট, মানে পাঁচতলায়। এই মাসেই ভাড়াটিয়া চলে যাওয়ায় ফাঁকা পড়ে আছে। বাসায় কোনো ফার্নিচার নেই, শুধু দুইরুমে লাইট লাগানো আছে।
বাসায় এসে শাফিনকে জানলার গ্রিলের সাথে শক্ত করে বেঁধে দেয়। মৃত্তিকা ফ্লোরে বসে পড়ে। হঠাৎ করে এতোটা লম্বা ভ্রমণ করায় সে ক্লান্ত।
শরীফ এসে ওকে বলল,
“ঠিক আছো?”
মৃত্তিকা মাথা নেড়ে বলল,
“যা আছি, ভালো আছি। অপরূপাকে এখানে আনার ব্যবস্থা করুন।”
শরীফ চিন্তায় পড়ে যায়। মৃত্তিকা এখন আর ধানমন্ডি যেতে পারবে না, আবার ওকে এখানে একা রেখে শরীফের যেতেও ইচ্ছা করছে না। শাফিনকে একা রাখাও বি°প°জ্জনক।
মৃত্তিকা বুঝতে পারে শরীফের চিন্তা, আশ্বাস দিয়ে বলে,
“আপনি যেতে পারেন, কোনো সমস্যা নেই।”
“তোমাকে একা রেখে?”
“আমি থাকতে পারবো।”
শরীফ যায় না। ফ্লোরে ওর পাশে বসে কল দেয় তানজিমকে। মতিঝিলের বাসার ঠিকানা আর ফ্ল্যাট নাম্বার দিয়ে, ওকে আসতে বলে। তানজিম দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে। সামিহার বাসায় শরীফ কেন যেতে বলছে?
তবুও সে বের হয়। বলা তো যায় না সামিহার কোনো বিপদ হলো কিনা। মাত্র কিছুক্ষণ আগে ফজরের আযান দিলো, এখনো সূর্য উঠেনি। নামাজ পড়েই বেরিয়ে যায় তানজিম।
এদিকে কাল থেকে মৃত্তিকাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে ইমতিয়াজ। ফোনের পর ফোন দিচ্ছে, কিন্তু বারবার বন্ধ দেখাচ্ছে। মৃত্তিকার ছড়ানো মি°থ্যা যে সত্য হয়েছে, তা ইমতিয়াজ জানে। এখন শাফিন যদি কোনো ক্ষতি করে, এই ভ°য়ে ক্রমাগত তার ভী°তি বাড়ছে।
শরীফ নামাজ পড়ছে। ড্রইংরুমেই একপাশে সে নামাজে দাঁড়িয়েছে। মৃত্তিকা এখনো ফ্লোরে বসা। ফোন অন করে সে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবারো ইমতিয়াজের কল আসে।
কল কা°টতে গিয়ে ভুলবশত রিসিভ করে ফেলে সে। এবারে আর কোনো উপায় না পেয়ে ফোন কানে দেয়।
“কোথায় তুমি, মিউকো?”
ইমতিয়াজের মুখ থেকে বারবার ‘মিউকো’ নাম শোনাটা মৃত্তিকার জন্য কষ্টেরই বটে। হতে পারে সে দোষী, খু°নি, অনেক কিছু। কিন্তু সে তো মৃত্তিকার ভালোবাসা নাম।
“মৃত্তিকা?”
এবারে ইমতিয়াজের কন্ঠে বেশ উৎ°ক°ন্ঠা বোঝা গেল। মৃত্তিকা মৃদুস্বরে বলে,
“হুম।”
“কোথায় আছো?”
“বাবার কাছে।”
মৃত্তিকার দুচোখ বেয়ে পানি পড়ছে, কিন্তু সে একদম স্বাভাবিক কন্ঠে কথা বলছে।
“ফোন বন্ধ ছিল কেন?”
মৃত্তিকা নিশ্চুপ। ইমতিয়াজ আবারো বলে,
“বাসায় আসো।”
মৃত্তিকা কিছু না বলে কল কে°টে দেয়। ফোন দূরে ফেলে কাচুমাচু করে বলে থাকে। শরীফ নামাজ শেষে মৃত্তিকাকে দেখে বলে,
“নামাজ পড়ে নাও।”
শরীফের সাহায্য নিয়ে উঠে মৃত্তিকা ওয়াশরুমে যায়। অযু করে, নামাজ পড়ে নেয়।
শরীফ ওকে পাশের রুমে নিয়ে বলে,
“যা সহ্য করতে পারছো না, তা কেন করছো?”
“ইমতিয়াজ..”
কথা শেষ করতে পারে না মৃত্তিকা, কাঁদতে শুরু করে দেয়। শরীফ ওকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“মা আমার, এভাবে নিজেকে কষ্ট দিও না। ইমতিয়াজ শাফিনকে আগে থেকে চেনে, হতে পারে সে ওই পঞ্চম ব্যক্তি। তাই বলে নিজেকে শেষ করো না।”
মৃত্তিকা মাথা তুলে না। বাবার মিউকো বাবার বুকেই আশ্রয় নেয়। শরীফ ওর মাথায় হাত বুলায়। এমনসময় সদর দরজায় নক পড়ে। কলিং বেল নেই, তাই তানজিম এসে নক করেছে।
শরীফ গিয়ে দরজা খুলে বলল,
“আসো।”
তানজিম ভিতরে এসে শাফিনকে দেখে রেগে যায়। তেড়ে যেতে নিলে শরীফ ওকে থামিয়ে বলে,
“শান্ত হও। আগে পুরো কথা শুনো, তারপর ভেবে দেখো কি করবে।”
“কি কথা?”
“মিউকো।”
মৃত্তিকা বাইরে এসে দাঁড়ায়। তানজিম এখনো বি°ভ্রা°ন্তিতে আছে। শরীফ বলে,
“এখন তুমি তোমার বোনকে পাহারা দাও, আমি অপরূপাকে নিয়ে আসি।”
তানজিম আর কিছু জিজ্ঞাসা করার সুযোগ পায় না। শরীফ বেরিয়ে যায়। মৃত্তিকা শান্ত গলায় বলল,
“তানজিম, বসো।”
______________________________________
সকাল সকাল উঠে সারাহ্ ঘর গুছিয়ে ফেলছে। যেহেতু আজ বৃহস্পতিবার, তাই আহনাফ আজকে আসলে হয়তো দুইদিন থাকবে। সামিহা ভার্সিটিতে গেছে। এজন্য একা একাই সব কাজ সেরে ফেলছে সে।
মাত্রই ড্রইংরুম গুছিয়েছে সারাহ্। নার্গিস পারভিন নাস্তা এনে ওকে দিয়ে বলে,
“এশাটাও হয়েছে, নাস্তা না করেই দৌড় লাগিয়েছে।”
সারাহ্ মাথা নেড়ে বসে বলে,
“দিনে দিনে বয়স বাড়ার থেকে কমতেছে।”
“তাই তো দেখছি। (একটু থেমে) জামাই আজকে আসলে থাকবে তো।”
“জানি না, ওর তো আবার মত বদলাতে সময় লাগে না।”
নার্গিস পারভিন ওর পাশে বসে বলল,
“শাফিনের কোনো খোঁজ এখনো পায়নি। ভয় হচ্ছে আমার।”
“ভ°য় পেয়ে কি হবে মা? যা ভাগ্যে আছে, তা কি আর মুছে ফেলা যাবে।”
“তা ঠিক, কিন্তু…”
দরজার বাইরের একটা শব্দে দুজনের কথা হঠাৎ থেমে যায়।
“ছেড়ে দিন আমাকে।”
বলে জোরে কেউ চিৎকার করলো।
মায়ের বাধা উপেক্ষা করে গিয়ে সারাহ্ দরজা খুলে, লিফট বন্ধ হয়ে গেছে। মানে কেউ লিফটে করে কাউকে জোরপূর্বক নিয়ে যাচ্ছে।
লিফট পাঁচতলায় গিয়ে থেমেছে। শরীফ অপরূপাকে নিয়ে এসেছে। অপরূপা জোরাজুরি করে চারতলায় লিফট থামিয়ে চেঁচিয়েছে, নিজেকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা তার ব্যর্থ।
সারাহ্ও পাঁচতলায় যায়। সব ফ্ল্যাটই স্বাভাবিক লাগছে। সারাহ্ ঘুরে ঘুরে চারটা ফ্ল্যাট দেখে নেমে যেতে নিলে শরীফ বের হয়। আচমকা সামনে চলে আসায় সারাহ্ চমকে উঠে।
“সরি, সরি, ধা°ক্কা লেগেছে নাকি?”
শরীফের কথায় সারাহ্ মাথা নেড়ে বলল,
“না, আমি ঠিক আছে।”
শরীফ লিফট খুলে সারাহ্-র সাথেই নিজে উঠলো। বলে,
“গ্রাউন্ড ফ্লোর?”
“না, থার্ড ফ্লোর।”
“ওকে।”
কন্ঠটা সারাহ্-র চেনা লেগেও অচেনা। তবে ভেবেচিন্তে সে চিনে যায়। এই কয়েক মাসে মৃত্তিকার পাঠানো ওই ভয়েসটা সে এতোবার শুনেছে, এই কন্ঠ ভুলে যাওয়ার নয়।
সারাহ্ বাসায় চলে আসে। নার্গিস পারভিন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সারাহ্ ঠোঁট উলটে বলে,
“সব নরমাল, কিন্তু শব্দ একটা হয়েছে।”
“যাক, তোমার আর বাইরে যেতে হবে না। বাসায় থাকো।”
“হ্যাঁ, আমি তোমাদের একমাত্র বন্দিনী।”
অপরূপার পর এবারে মমতাজ বেগমকে আনতে গেছে শরীফ। তিনজনকে একসাথে করেই কথা বলবে ওরা। শরীফের যে রাগটা শাফিনের উপর জমে আছে তা সে যেকোনো মূল্যে বি°স্ফো°রণ ঘটাবে।
শাফিনের মুখোমুখি অপরূপাকে বেঁধে বসিয়েছে মৃত্তিকা। তানজিমকে এতোক্ষণ সে ভ°য়া°নক পারিবারিক অতীতটা বলেছে। তানজিম পুরো ঘটনা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে বসে আছে। অতীতে একজনের চেয়ে অন্যজন নি°ষ্ঠুর। সেই নি°ষ্ঠুর°তার শাস্তি ওরা কেন পাচ্ছে? আর ওর বাবা? সন্তানের মুখ দেখেই কেন তার ভালোবাসার পরিবর্তন হলো? যদি তা না হতো তবে তার বোনেরা আজ বেঁচে থাকতো।
______________________________________
বিকালে আহনাফ বাসায় আসে। সামিহা দরজা খুলতেই ওর হাতে মিষ্টির প্যাকেট দিয়ে সে নার্গিস পারভিন ও জাহাঙ্গীর সাহেবের সাথে কুশল বিনিময় করে। তারপর রুমে চলে যায়। কাঁধে ব্যাগ থাকায় বোঝা যাচ্ছে ও আজ রাতটুকু হলেও থাকবে।
সারাহ্ মাত্রই আসরের নামাজ পড়ে উঠেছে। জায়নামাজ রেখে ফিরতে গিয়েই আহনাফের সামনে পড়ে। আহনাফকে দেখে নিজের অজান্তেই হেসে দেয় সারাহ্।
“বাহ, ঘরে আসতেই বাবুর আম্মুর মিষ্টি হাসি৷”
সারাহ্ একটু লজ্জা পেয়ে বসে। আহনাফকে ধা°ক্কা দিয়ে সরিয়ে সে হিজাব খুলে বলে,
“এরপরে শুধু কান্নাকাটি করবো।”
আহনাফ ব্যাগ রেখে শার্টের হাতার বোতাম সবে খুলতে শুরু করেছে, সারাহ্ এসে ওকে জড়িয়ে ধরে। একদম বুকে মাথা রেখে ওর সাথে মিশে গেছে। আহনাফ ওকে বেশ আলতো করে আগলে নেয়।
সারাহ্-র মাথায় চুম্বন করে বলল,
“বাবুটা লজ্জা পাবে মায়ের বেহায়াপনায়।”
সারাহ্ কিছু বলে না। সে নিজেই নিজের এই কাজে লজ্জায় ম°রছে। আহনাফের দিকে তাকানোর সাহসটুকু ওর অবশিষ্ট নেই। বুকের মধ্যিখানের স্থান দখল করেছে সে।
______________________________________
শরীফ হাসপাতালে গেছে, খুব জরুরি দরকার আছে বলেই যেতে হয়েছে। তানজিম এখনো বাসায় মৃত্তিকার কাছেই আছে।
মৃত্তিকা তানজিমকে বলে,
“আমি দশমিনিটের জন্য বাইরে যাবো। ওদের খেয়াল রেখো।”
“জি।”
বলে তানজিম মাথা হেলিয়ে সম্মতি দেয়।
মৃত্তিকা বাইরে গিয়ে কয়েকটা বড় বড় পে°রেক কিনে, সাথে একটা বড় হাতুড়ি নেয়। তারপর সে আবারো বাসায় ফিরে আসে। ড্রয়িং রুমে করা বিছানার উপর এগুলো রাখে। অপরূপা একটা শুকনো ঢোক গিলে।
অপরূপা জানে, এই মেয়ের দ্বারা অসম্ভব কোনো কাজ নেই। যেভাবে ওকে সি°গা°রেট দিয়ে পু°ড়িয়েছিল, গরম শি°কের ঘা দিয়েছিল, ওর মুখে সুই ঢু°কিয়েছিল, ঠোঁট সেলাই করার প্রস্তুতি নিয়েছিল, এমনকি ওর মুখে গরম পানি ঢে°লে ঝ°লছে দিয়েছিল। এই মেয়ে চাইলে, সমস্ত শরীরে পে°রেক ঢুকিয়ে দিতে খুব বেশি সময় নিবে না।
মৃত্তিকা শাফিনকে বলে,
“তুমি, জামিল, দুলাল- এই তিনজন ছাড়া খু°নের সাথে আর কে জড়িত?”
শাফিন একটু হেসে বলে,
“জামিল ম°রেছে, দুলাল ম°রেছে। আর ছিল কবির, যাকে তোমার মা সেদিন মে°রে ফেলেছে। আর আমি তোমার সামনে। কথা দিচ্ছি, তোমাকে না মে°রে এই শাফিন মরবে না।”
মৃত্তিকা বুঝতে পারে, মমতাজ বেগমের কথা সাথে শাফিনের কথার মিল আছে, চতুর্থ ব্যক্তি কবির।
“আর কে কে ছিল?”
শাফিন এবারে জোরে জোরে হেসে ওঠে। ওর হাসি শুনে মৃত্তিকার রাগ বাড়ে। ডান হাতের বাঁধন খুলে তা দেয়ালে চেপে ধরে তানজিমকে বলে,
“একটা পে°রেক দাও।”
মৃত্তিকার কথায় একটা ভ°য়া°নক রাগ আর ক্ষোভ আছে। তানজিম পে°রেক দিলে মৃত্তিকা শাফিনের হাতের উপর তা শক্ত করে চেপে ধরে বলে,
“হাতুড়ি।”
হাতুড়ি পাওয়া মাত্রই পে°রেকে আ°ঘাত করা শুরু করে মৃত্তিকা। হাতের তালু এ°ফোড় ও°ফোড় হয়ে পে°রেক গিয়ে লাগে দেয়ালে। শাফিন চিৎকার করতে নিলে, তানজিম কিছুক্ষণ আগে পে°রেকের সাথে আসা বড় শপিং ব্যাগটা ওর মুখে ঢু°কিয়ে দেয়।
মৃত্তিকা কি°ড়মি°ড় করে বলল,
“মুখ বন্ধ করো না। আমি ওর চিৎকার শুনতে চাই।”
গড় গড় করে র°ক্ত বেয়ে পড়তে লাগলো। সাদা দেয়াল মুহূর্তেই র°ঞ্জিত হয়ে গেল। মৃত্তিকার অ°গ্নিকু°ণ্ডের ন্যায় চোখের দিকে তাকিয়ে শাফিন যেন নিজের মৃ°ত্যু দেখছে।
শপিং ব্যাগটা বের করে মৃত্তিকা জিজ্ঞাসা করে,
“দ্বিতীয়বার সুযোগ দিলাম এবার বলো আর কে কে ছিল?”
“পঞ্চম ব্যক্তি বেঁচে আছে, আমি ম°রে গেলেও সে তোমাকে মা°রবে। তবে আমি চাই তাহমিনার মতো করে তোমাকে মা°রতে।”
হাতে লাগানো পেরেকটা মৃত্তিকা ঘুরাতে শুরু করে। এবারে মুখ খোলা থাকায় শাফিন জোরে চেঁচিয়ে উঠে।
মৃত্তিকা বলে,
“এই হাত দিয়ে স্পর্শ করতে না ওদের? খুব আনন্দ হতো ওদের চিৎকার শুনে? এখন আমি তোমার চিৎকার শুনে, খুব আনন্দ পাচ্ছি, খুব খুশি লাগছে আমার।”
মৃত্তিকা আরেকটা পে°রেক নিয়ে শাফিনের পায়ের পাতায় গেঁথে দেয়। শাফিনের ভ°য়ংকর এক মৃ°ত্যু চিৎকার বারবার প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। কিন্তু তবুও মৃত্তিকা থামে না, জোরে জোরে হাতুড়ি পি°টিয়ে পে°রেক আরও শক্ত করে দেয়। পায়ের পাতা ভেদ করে তা গিয়ে লাগে শক্ত টাইলসের গায়ে। মমতাজ বেগম পাশের রুমে থাকায়, এখানে ঘটনা উনি দেখেন না। তবে শব্দ উনি শুনেছেন।
“আপু, থামো। সে ম°রে যাবে, আর আমি চাই না এতো তাড়াতাড়ি সে ম°রে যাক।”
তানজিমের কথায় মৃত্তিকা সরে আসে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। এর মধ্যেই মনে হয় ইমতিয়াজের কথা। ওকে তো বাসায় যেতে বলেছিল, ও শোনেনি। হয়তো ইমতিয়াজ এখনো ওকে খুঁজছে।
______________________________________
হঠাৎ করে উপরের ফ্ল্যাটে খুব জোরে শব্দ হওয়ায়, সারাহ্ চমকে সরে আসে। আহনাফ হেসে উঠে একটু জোরে বলে,
“বাবুটা আমার, তোমার আম্মাজানের নির্লজ্জতায় লজ্জা পেয়ো না। সে একটু এমনই।”
“আহনাফ।”
সারাহ্-র ডাকে আহনাফ ওর সামনে মুখ দিয়ে বলে,
“আহনাফ বলবে না। হুটহাট নাম ধরে ডাকা আমার পছন্দ না, কেন ভুলে যাও এটা?”
সারাহ্ কোমড়ে হাত দিয়ে বলে,
“ওকে, একটা গল্প বলি। একসময় মানুষ স্বামীর নাম ধরে ডাকাকে খুব বড় অপ°রাধ মনে করতো, গল্পটা ওই সময়ের। এক মহিলা নদী পার হবে, তো তার নৌকা লাগবে। কিন্তু মহিলার কাছে কোনো টাকা নেই, এখন সে তার স্বামীর নাম বলে নদী পার হয়ে যাবে। পরে স্বামী টাকা শোধ করে দিবে। কিন্তু স্বামীর নাম তো সে বলতে পারবে না তাই মাঝিকে বলেছে- চব্বিশ গুণ দুই আর তিন গুণ চার, যোগ করে পেয়ে যাবেন সোয়ামির নাম আমার। তাহলে তার স্বামীর নাম কি?”
আহনাফ হেসে উঠে বলে,
“কি হবে?”
“কি আবার? চব্বিশ গুণ দুই মানে আটচল্লিশ, তিন গুণ চার মানে বারো। যোগ করলে হয় ষাট। মানে তার স্বামীর নাম ষাটেশ্বর।”
আহনাফ দাঁত বের করে হাসে। সারাহ্ বলে,
“উহু, হাসলে হবে না। নিজের নামের এমন সূত্র বের করেন ফিজিক্স স্যার। নাইলে দেখবেন কি করি?”
আহনাফ ওর কাছে এসে বলে,
“কি করবা?”
সারাহ্ ওকে সরিয়ে বলে,
“ফ্রেশ হয়ে নেন। তারপর বলবো।”
______________________________________
রাতে শরীফ বাসায় এসে শাফিনের এ অবস্থা দেখে ওর হাতে আর পায়ে ব্যা°ন্ডে°জ করে দেয়। মৃত্তিকাকে ধ°মকে বলে,
“নিজের এই অবস্থায় তুমি ওকে কেন এভাবে আ°ঘাত করেছো? তুমি জানো এই কাজের প্রভাব তোমার বেবির উপর পড়তে পারে? এত ভারী জিনিস তুমি কেন তুলছো?”
সত্যিই হাতুড়িটা অনেক ভারী ছিল। বড়সড় পে°রেক ঢুকানোর, বড়সড় হাতুড়ি এটা। স্বাভাবিকভাবেই অনেক বেশি ভারী হবে।
মৃত্তিকা কিছু বলে না। নিরবে প্রস্থান করে। বারান্দায় গিয়ে চুপচাপ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে চোখের জল বি°স°র্জন করতে থাকে। রিপার জন্য শরীফের কান্না এক আল্লাহ আর শরীফ ছাড়া আর কেউ যেমন জানেনা, ঠিক তেমনি ইমতিয়াজের জন্য মৃত্তিকার কান্না আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না।
শরীফ শাফিনকে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে মা°রতে শুরু করে। শাফিনের নাক মুখ দিয়ে র°ক্ত ঝরছে, গালে র°ক্ত জমাট বেঁধে কালো বর্ণ ধারণ করেছে।
আবারো একটা গরম শি°ক আনা হয়। তবে সেটা অপরূপার জন্য না, এটা শাফিনের জন্য। শাফিনের গায়ের শার্ট অনেকক্ষণ আগেই শরীফ খুলেছে, বুকে-পেটে বিরতিহীনভাবে আ°ঘাত করেছে সে।
শি°ক এনে শাফিনের বুকের বামপাশে ধরে শরীফ বলে,
“অতিরিক্ত গরমে শিলাও গলে যায়, এখন আমি দেখতে চাই তোমার হৃদপিণ্ড গ°লে কিনা। (একটু থেমে) আর কে কে ছিল? সত্যি করে বলো।”
মৃত্তিকা বেরিয়ে এসে দরজার পাশে দাঁড়ায়, উঁকি মে°রে দেখতে থাকে শরীফের সেই পুরনো ভ°য়ংকর রূপ।
অবশেষে শাফিন চেঁচিয়ে উঠে বলল,
“ইমতিয়াজ ছিল, ইমতিয়াজ।”
পেছনের দেয়ালের সাথে ধা°ক্কা দিয়ে দাঁড়িয়ে যায় মৃত্তিকা। জোরে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল,
“সবকিছুকে গুছিয়ে দাও তুমি, আল্লাহ্। আমার ইমতিয়াজকে এতো নি°কৃষ্ট করো না। আমার এতো বড় পরীক্ষা তুমি নিও না, হে আল্লাহ্।”
চলবে……
(Happy New Year)