এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায় #পর্বসংখ্যা_২১

0
377

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_২১

দুপুরে খেয়ে একটু শুয়েছিল অনুলেখা। সাধারণত সে এসময় ঘুমোয় না। শুয়ে শুয়ে একটু ফেসবুক স্ক্রোল করে, ইউটিউব ঘাঁটে। আজ কেন যেন চোখ লেগে এসেছিল। নিদ্রা দেবীর কৃপায় অক্ষিপাতা জুড়ে নেমে এসেছিল শান্তিময় ঘুম!
অনুর সেই সুখ বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। গাঢ় সুপ্তির পুরু আস্তর খুব শীঘ্রই ক্ষয় হতে লাগলো কানের কাছে ক্যাচ-ম্যাচ শব্দ শুনে। হালকা হতে হতে একসময় পুরোপুরি ঘোর কেটে গেল ওর। বিরক্ত চোখ কচলে হাই তুলতে তুলতে শয্যা ছাড়লো অনু। আলগা করে চাপিয়ে দেয়া দরজার ওপাশে পোর্চ থেকে আলোর রেখা আসছে। মেহমান এসেছে বোধ হয়, ভাবলো অনু। আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বিছানা থেকে নামল।

ফ্রেশ হয়ে ঘর থেকে বেরোতেই অনু দেখতে পেল বসবার ঘরে কিছু মানুষজনের সমাগম। কলহাস্যে মুখরিত সভা। ভালো করে চেয়ে দেখলো, সবাই অপরিচিত ওর। একমাত্র সমাগমের মধ্যমণি মাহিয়া ছাড়া। অনু দাড়িয়ে থাকতে থাকতেই কোত্থেকে ওর শাশুড়ি চলে এলেন। ছোট বৌকে ডাকলেন সাদরে,
— “বৌমা, এসো এসো। বেয়াই – বেয়াইনের সাথে পরিচিত হও। আরে, মাহিয়ার বাবা – মা এসেছে তো!”
অনু এতক্ষণ চুপচাপ দাড়িয়ে থেকে দেখছিল সব। এবারে বুঝলো মাহিয়ার এতো হাসিখুশি ভাবের কারণ। বাপের বাড়ি থেকে লোক এসেছে! হুহ, মনে মনে ভেংচি কাটলো। পরক্ষণেই ধ্যান ভাঙলো শাশুড়ির ডাকে,
— “কই? এলে না যে?”
মনে মনে বিরক্ত হলেও শান্ত হয়ে এগিয়ে এলো অনু। বসলো গিয়ে ওদের সামনে।
___

বিকেলবেলা। ফোনের ওপাশে নিখিলের সঙ্গে মৃদু স্বরে আলাপ করছে চারুলতা। টুকটাক গল্প শেষে কল কাটবার আগমুহূর্তে বললো,
— “রাখছি তবে…”
তৎক্ষণাৎ নিখিলের মন খারাপের গলা,
— “এতো জলদিই? তাড়া আছে কোনো? কোনো জরুরি কাজ?”
চারু ইতস্তত করে,
— “না, তেমন কোনো কাজ নেই। তবে…”
— “আমার সঙ্গে আর কথা বলতে ভালোলাগছে না? আমি প্রচুর কথা বলি, তাই?”
দাঁত দিয়ে জিভ কামড়ে ধরলো। ইসস, লোকটা বুঝে ফেললো? ভীষণ লজ্জিত হলো চারু। সত্যিই সে একটু-আধটু বিরক্ত বোধ করছিল। নিখিল আসলেই প্রচুর কথা বলে!
কিন্তু ওর এই ছোট্ট কথাতে লোকটা জেনে ফেললো কি করে?
বললো,
— “না, আসলে…”
নিখিল সহাস্যে জানালো,
— “আমি বোকা নই, চারুলতা। কিংবা সহজে রাগ করবার মানুষও নই। আপনি আমাকে যতটুকু সময় দিবেন আমি ততটুকুতেই খুশি। আর তাছাড়া সম্পর্কের এখনো শুরুই হয় নি। যেদিন পূর্ণ অধিকার পাবো, সেদিন আপনি যতই বিরক্ত হোন না কেন ঠেসে ধরে বসিয়ে রাখবো। কোলের উপর বসিয়ে কানের কাছে ইচ্ছেমত বকবক করবো। কিচ্ছু বলতে পারবেন না!”
ওর বলবার ঢং দেখে হেসে ফেললো চারু। নিজেও ততোধিক রসিয়ে বললো,
— “মুখের ভেতর আলু ঠুসে দেব না!”
বলেই আবার হাসি। নিখিলও এবার হো হো করে হেসে উঠলো।

নিখিল কল কাটবার পর ফোনটা পাশে রেখে দিলো চারু। বিছানায় আধশোয়া হয়ে আছে সে, বাঁ পাশে খোলা জানালা। চোখ ঘুরিয়ে তাকালে দূরের নীল অন্তরীক্ষ খুব সুন্দর ভাবে দেখা যায়। চারু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো সেদিকে। ধূসর মেঘগুলো পেঁজা তুলোর একটু একটু করে ছড়িয়ে, সুদূরে তপন মশাইকে ঢেকে লুকোচুরি খেলছে যেন। মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ পুরনো কথা মনে হলো ওর। আড়াই বছর আগের, তার সেই বিবাহিত জীবনের দিনগুলো…
মাহতাবের ঘরেও এরকম একটা জানালা ছিল দক্ষিণ দিকে। জানালা সংলগ্ন হয়ে বিছানা। চারু রোজ ঘুম থেকে উঠে কিছুক্ষণ ওই জানালা দিয়ে চেয়ে থাকতো। দৃষ্টি ন্যস্ত করতো গগনমানে। মন তখনো থাকতো অদ্ভুৎ বিষাদময়!
বিয়ের পর ও-বাড়িতে গিয়ে একটুও ভালো লাগে নি ওর। একদম অপরিচিত একটা জায়গা। অপরিচিত মানুষজন। সবাইকে মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছিল। সবচেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছিল মাহতাবকে মানতে। লোকটা যেন কেমন!
একটুও সময় দেয় নি তাকে। কবুল বলে যেই না বিয়েটা হলো, অমনই সমস্ত অধিকার চেয়ে বসলো? ভালো করে মিশবার আগেই তার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল চারু। লোকটা তাকে কি যে ভাবত!
‘আমার নীল শাড়ি পছন্দ, তুমি নীল পরবে। কমলা আমার একটুও পছন্দ নয়। কক্ষণো পরবে না!’ —অথচ চারুর নীল রঙ ভালো লাগতো না, কমলা ছিল প্রিয়!
চিংড়িতে মাহতাবের এলার্জি, বিবাহিত জীবনের ক’ মাস চারু বোধ চিংড়ি ছুঁয়েও দেখে নি। খুঁজতে গেলে এরকম আরো কতো গল্প বের হবে!
মাহতাব খুব ব্যস্ত মানুষ। উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। স্বভাবতই সে ব্যস্ত। সপ্তাহের ছুটির দিনগুলোতেও কীভাবে কীভাবে যেন তার স্ক্যাজিউল পড়ে যেত। বৌকে নিয়ে ঘুরবে কথা দিয়েও, শেষ মুহূর্তে সব ছেড়ে সে ফিল্ডে ছুটতো। হুট করে পাওয়া ছুটিগুলোতেও সে নিজের মতো প্ল্যানিং করত বেরোবার। চারুকে হয় তো সারপ্রাইজ দিতেই এমন করতো। কিন্তু কখনো চারু কোথায় যেতে ইচ্ছুক বা অনাগ্রহী — সে মতটুকু নিতে প্রয়োজন বোধ করে নি।
শরীরের টানে একে – অপরের কাছাকাছি ওরা বহুবার গিয়েছে; কিন্তু মনের টানে কোনদিন গিয়ে এসেছিল সংস্পর্শে?
প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরোলো বুক চিড়ে।

একই ছাদের নিচে থেকেও বহুদিন যেন লোকটা ওর অচেনাই ছিল। হয় তো সেও অচেনা ছিল মাহতাবের কাছে।
ধীরে-ধীরে যখন সব চেনা হয়ে গেল, তখন চারু তার পরিবারের করা ভুলটা বুঝতে পারলো। বড় বড় পাশ দিয়ে ডিগ্রি নিলেই কেউ শিক্ষিত হয়ে যায় না। শিক্ষা অন্তরের ব্যাপার। যা সবাই পাশ করেও অর্জন করতে সক্ষম হয় না!

হঠাৎ দরজায় টুকটুক শব্দে ধ্যান ভাঙলো চারুর। কপোলে অনুভব করলো নোনা জলের। হাতের উল্টো পিঠে অশ্রু মোচন করতে করতে পেছনে ঘুরলো সে, ভেজা গলায় শুধালো,
— “কে?”
— “বড়’পা, আসবো?”
একসঙ্গে দুটি কণ্ঠস্বর। চারু শুনলো, ছোট ভাইদের গলা। রিংকু – টিংকু এসেছে। গত দুদিন ধরেই ওর আশেপাশে ঘুরঘুর করছে এরা। চারু ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গেছে। একটু সাজা দেয়া দরকার! যা বিচ্ছু হচ্ছে!
চোখ দুটো পুনরায় ভালো করে মুছে নিলো চারু। হালকা কেশে গলা ঝেড়ে ডাকলো,
— “আয়।”
সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে গেল। অনুমতি পেয়ে সুরসুর করে ভেতরে প্রবেশ করলো জমজ দ্বয়। মুখ নিচু করে, অপরাধী ন্যায় দুজনে এগিয়ে এলো বড় বোনের কাছে। ওদের এই চুপসানো চেহারা দেখে ভেতরে ভেতরে হাসি ঠিকরে বেরোতে চাইলেও, নিজেকে যথাসম্ভব গাম্ভীর্যের খোলসে মুড়িয়ে চারু বললো,
— “কি চাই?”
— “তোমার কাছে একটু বসবো, আপা?”
কি করুণ শোনালো টিংকুর গলাটা। চারু রাগ করে কিছু বলতে চাইলো, কিন্তু ভাইয়ের মুখ দেখে আর বলা হলো না। আবদার রাখলো,
— “বস্।”
দু’ জনে উঠে বসলো ওর পাশে। মিনমিন করে জড়িয়ে ধরতে চাইলো ওকে। মুখ ঘুরিয়ে কপট রাগ দেখালো চারু,
— “অতো ঢং কীসের? অকারণে জড়াজড়ি ভালো লাগে না আমার!”
— “তুমি এখনো রেগে আছো?”
কণ্ঠের স্বর খাদে নামিয়ে শুধায় টিংকু।
— “আমি কে, যে রাগ করবো? আমাকে কেউ ভালোবাসে? না আলাদা করে গুরুত্ব দেয়?”
অভিমানি ভঙ্গিতে কথাগুলো বলছিল চারু। মুখ থেকে ধ্বনি নিঃসৃত হতে না হতেই হঠাৎ দু’ ভাই জাপটে ধরলো ওকে। দু’জনে দু’হাত আঁকড়ে ছোট্ট আদুরে বাচ্চা ছেলের মত মাফ চাইলো তাদের বড় বোনের কাছে,
— “স্যরি, আপা। খুব খুব খুব স্যরি। তুমি প্লিজ রাগ করে থেকো না! প্লিজ, আপা!”
চারু গলে মোম তখন! আর রাগ করে থাকা যায় যায়? সেও দু’ বাহু প্রসারিত করে দুজনকে আগলে নিলো। আদুরে স্বরে বললো,
— “দুষ্টুমি ভালো, ভাইয়া। কিন্তু সেটা অতিরিক্ত করতে গিয়ে বেয়াদবির পর্যায়ে যাওয়া ভালো নয়। আশা করি পরের বার এমন হবে না!”
— “আর হবে না, আপা। আর হবে না!”
অস্পষ্ট স্বরে আওড়ায়। চারু শান্তির শ্বাস ছাড়ে। এদেরকে সে ভীষণ ভালোবাসে, শাসন করতে তারও বুকে লাগে! কিন্তু বাচ্চাদের শাসন না করলে কি হয়?
__

ক্যান্টিনে আজ কেন যেন ভীড় খুব। সচারচর এমন হয় না। ছোট্ট ক্যান্টিনটা ফাঁকাই থাকে। আজ হঠাৎ এতো মানুষ কোত্থেকে উদয় হলো ভেবে পেল না সৌভিক। এদিক – সেদিক তাকিয়ে ফাঁকা টেবিলের সন্ধান করলো। একটা যদি থাকতো!
সবগুলোতে লোকে ভর্তি। মাত্র দু’টো টেবিলে জায়গা আছে বসবার। তাও একটাতে এক দম্পতি বসেছেন, অন্যটাতে একটা মেয়ে। সৌভিক কোথায় বসবে? দম্পতির কাছে বসায় মন সায় দিচ্ছিল না। অগত্যা নাশতার প্লেট হাতে মেয়েটির টেবিলের কাছেই এগোলো।
মেয়েটি পেছনে ফিরে বসেছে। খোলা রেশম চুলগুলো এলোমেলো ভাবে ছড়ানো। ‘এভাবে এরা কাজ করে কি করে? বিরক্ত হয় না? চুল বাঁধলে কি ক্ষতি?’– ভাবনাটা সৌভিকের মনে আসার কথা নয়। তবুও এসে গেল। সে কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে সামনে এসে দাড়ালো মেয়েটির, দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বললো,
— “মিস, এখানে বসা যাবে? কেউ আছে এখানে? আমি আসলে জায়গা পাচ্ছিলাম না…”
বলতে বলতেই মেয়েটা চকিতে মুখ তুলে তাকালো। ওকে দেখে এমন ভাব করলো যেন, লহমার কোনো জাদুকর চিল্লিয়ে ‘স্ট্যাচু’ বলে মূর্তি বানিয়ে দিয়েছে তাকে। অপলক চেয়ে রইলো মুহূর্তগুলো। হাতে সসের বোতল ছিল, পেটিসে ঢালছিল; প্রয়োজনের অতিরিক্ত হওয়ায় উপচেও পড়লো — সেটা মেয়েটা খেয়াল না করলেও সৌভিকের অগোচর রইলো না!
সে বিরক্ত মুখে সামনে বসা মূর্তি আনিকা’র উদ্দেশ্যে বললো,
— “কি হলো? অমন করে চেয়ে আছেন কেন? বসবো আমি?”
চটকা ভাঙলো আনিকার। তড়িঘড়ি করে সসের বোতল রাখতে রাখতে বললো,
— “জ্বি, স্যার। জ্বি, স্যার আপনি বসুন। আমি যাই।”
— “আপনাকে যেতে হবে না, খাচ্ছেন খান। আমি বরং একটু বসি।”
মেয়েটার বিনয় দেখে বলতে বাধ্য হলো সৌভিক।
কিন্তু আনিকা নামক এলোমেলো টlর্নেlডো থামলো না।
— “না, না, স্যার। আমি উঠছি।”
বলতে বলতে সে হন্তদন্ত হয়ে উঠতে গিয়ে চেয়ারের সঙ্গে হোঁচট খেল, প্যাঁচ প্যাঁচ করে ওড়না ফাঁড়লো। শব্দে ভ্রু কুঁচকে সৌভিকসহ অনেকেই ফিরে তাকাতেই জিভ কামড়ে টেবিল থেকে ব্যাগ তুলতে গিয়ে প্লেটের উপর থেকে একটা সিঙারা, পাশের পানির বোতল উল্টে ফেলে দিলো!
এই মেয়ের কাণ্ড দেখে এবার বেশ রাগ হলো ওর। চেঁচিয়ে উঠলো প্রায়,
— “এ্যাই, আপনি বসুন তো। এতো কিসের তাড়া আপনার? ট্রেন ছুটে যাচ্ছে?”
ধমকে চুপসে গেল মেয়েটা। তৎক্ষণাৎ মাথা নিচু করে ফেললো। অস্ফুট স্বরে বলবার চেষ্টা করলো,
— “না, মানে…”
— “কীসের ‘না, মানে’? বসেন বলছি, এক্ষুণি বসেন!”
চিৎকার করে উঠলো সৌভিক। আশেপাশে দৃষ্টি ফেলে ত্বরিতে বসে পড়লো আনিকা। ইসস, কতগুলো মানুষের সামনে লজ্জা!

একটু সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলো সৌভিক। নিচু গলায় বললো,
— “আপনি আমাকে এত ভয় পান কেন? আমি কি বাlঘ – ভাlল্লুlক যে আপনাকে খেয়ে ফেলবো?”
আনিকা ভীতু হরিণীর ন্যায় করুণ চোখে তাকালো। লজ্জায় নুইয়ে গিয়ে কোনোমতে বললো,
— “আপনি অনেক রাগী!”
বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেল সৌভিক। সে এই মেয়েকে রাগ করলো কখন? আশ্চর্য!

চলবে___

#মৌরিন_আহমেদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here