#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_০৭,৮
বাংলায় ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’ বলে একটা শব্দ আছে। যার অর্থ — কিং সাহেব যখন তার কর্তব্য পালন করতে না পেরে বিমূঢ় হয়ে যান! নিখিলের একটু আগে বলা কথাটা শুনে সৌভিকও নতুন একটি শব্দের আবিষ্কার করলো– সৌভিককর্তব্যবিমূঢ়!
হতবুদ্ধি চোখে বন্ধুর দিকে চেয়ে আছে সৌভিক। কোনমতে মুখ খুলে বললো,
— “কি বললি তুই? কে?”
ওর এমন আশ্চর্যজনক চাহনি, নিখিলকে ভাবান্বিত করে তুললো। সে কি কোনো ভুল কিছু বলে ফেলেছে? চারুলতাকে কি ভালোবাসা যায় না? নাকি সে অধিকার তার পাওয়ার যোগ্যতা নেই? মৃদু কণ্ঠে ফের স্বগোক্তি করলো,
— “চারুলতা জাফরিন!”
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নিজস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো সৌভিক,
— “আর ইয়্যু কিডিং? ফাজলামি করছিস তুই?”
— “না। মজা করবো কে—”
হঠাৎ করেই ছেলেটাকে কেমন ক্ষেপাটে মনে হতে লাগলো। গৌড় বর্ণের উজ্জ্বল দেহকান্তের রং পাল্টাতে লাগলো। রক্তিমাভা ধারণ করলো মুখশ্রী, চোয়াল হলো শক্ত। আকস্মিক ওর এই পরিবর্তনে অবাক হলো নিখিল। কিছু বলবে তার আগেই ধমকে উঠলো ও,
— “চারুকে তুই কতটুকু চিনিস? তুই কি জানিস ওর সম্বন্ধে? তাতেই ওকে নিয়ে এসব ভাবতে পারিস কি করে?”
— “তুই এতো রেগে যাচ্ছিস কেন?”
ফ্যাকাশে মুখে জিজ্ঞেস করে। সৌভিক আরও তেঁতে গেল। বারুদের মত দপ করে জ্বলে উঠলো,
— “রেগে যাচ্ছি কেন, মানে? তুই রাগার মত কথা বলে বলিস, রাগছি কেন? হু?”
বলেই ওর বুকের বাঁ পাশে হাত দিয়ে ধাক্কা দিলো। তাল সামলাতে দু’ কদম ছিটকে বিছানার অন্যপ্রান্তে পড়ে গেল নিখিল। সেভাবেই ওর গাল বরাবর ছুঁড়ে দিলো একটি শক্তপোক্ত, মুখ তুবড়ে দেয়া ঘুষি। উঠতে গিয়েও, উঠতে পারলো না ছেলেটা। পড়ে যেতে গিয়েও বাঁদুরঝোলা হয়ে ঝুলে রইলো মশারির সঙ্গে! ভাগ্যিস, ওটা টাঙানো ছিল! তাই রক্ষে!
অকস্মাৎ আক্রমণে অপ্রস্তুত হলেও, দিশেহারা হলো না নিখিল। দ্বিতীয়বার ওর দিকে আঘাতের মুষ্ঠি ধেয়ে এলেই, আটকে দিলো সবেগে। ঝপ করে উঠে বসে সৌভিকের বাড়িয়ে দেয়া মুঠবদ্ধ হাত করায়ত্ত করে ফেললো নিমিষেই। তারপর একেবারে ফিল্মি স্টাইলে ওরই বাড়িয়ে দেয়া মুঠি, ওরই মুখের সামনে ধরে হিসহিস করে উঠলো,
— “হোয়াট আর ইয়্যু ডুইং? হ্যাভ ইয়্যু গন ম্যাড? শুধু তো ভালোবাসার কথা বলেছি। তাতেই এতো ক্ষেপছিস কেন? বোন হয় তোর। কোনো সম্পত্তি না যে, এরকম পাগলের মতো আচরণ করবি! আর আমি তো খারাপ কিছুও বলি নি। তাহলে?”
সৌভিক সহসা কোনো কথা বলতে পারলো না। ফ্যালফ্যাল নয়নে চেয়ে রইলো কেবল। একটু ধাতস্থ হতেই ওকে ছেড়ে দিলো নিখিল। কাছ থেকে সরে গিয়ে, নিরাপদ দূরত্বে বসলো। শান্ত কিন্তু দৃঢ়তার সহিত বললো,
— “এতো ছোট একটা ব্যাপার নিয়ে মারামারি করতে পারে আমার ধারণাই ছিল না! তুই এরকম ইমম্যাচিউর তাও জানতাম না। চারুলতাকে আমার প্রথম দেখায় ভালোলেগেছে। আমি ভাবছিলাম, কীভাবে তোকে কথাটা জানাবো। একটু লজ্জা লাগছিল, ভেবে পাচ্ছিলাম না কিছু। এরমধ্যে তুই জিজ্ঞেস করলি — আমি বলে দিলাম আমার মনে কি আছে। কিন্তু তোর এরকম রিয়েকশন—”
একটু থেমে আবার বললো,
— “তোর সমস্যা কি আমি জানি না। কেন এরকম ষাঁড়ের মতো তেড়ে এলি, জানি না। কিন্তু আমি আশা করবো, তুই আমাকে কারণটা বলবি। এখন হয় তো বলতে চাচ্ছিস না। যখন ইচ্ছে হবে তবে তখন বলিস। কিন্তু একটা কথা মনে রাখিস, চারুকে আমি ভালোবেসেছি। সবসময়ই বাসবো!”
কথা শেষ করে ওর দিকে চোখ তুলে চাইলো। সৌভিকের কোনো হেলদোল নেই। এখনো ঠায় বসে আছে। মুখটা নিচু, ঘনঘন শ্বাস ফেলার আওয়াজ আসছে। ওকে চেনে নিখিল। সহজে এমন রাগ করবার পাত্র নয়। তবে আজ হঠাৎ কেন এতো রেগে গেল কারণটা বোধগম্য হচ্ছে না। ওকে ওর মতো সময় নিতে দিয়ে ঘুমিয়ে গেল নিখিল। থাকুক, ও ওর মতন। শান্ত হয়ে ভাবুক!
___
দোতলায় চারুর ঘরটার সামনে দাড়িয়ে আছে অনুলেখা – মাহাদ। দু’ জনের পরনেই বাইরে যাবার পোশাক। মাহাদের হাতে একটা লাগেজ। বোঝাই যাচ্ছে, চলে যাবার প্রস্তুতি! বৌভাতের দ্বিতীয়দিন আজ। বাঙালিয়ানা নিয়মে বিয়ের পর নাইওর এসেছিল অনু। আজ তার সময় ফুরালো, ফেরৎ যেতে হবে নতুন ঠিকানায়। তার স্বামীর ঠিকানায়!
যাওয়ার আগে চারুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে ওরা। অনুর আসবার মন ছিল না, হয় তো আসতোও না। কিন্তু মাহাদের অনুরোধ ফেলতে পারলো না। ছেলেটা এতো মিষ্টি করে বললো, “যাওয়ার আগে চারু ভাবীকে বলবে না?” — ওর সরল চাহনির বিপরীতে কোনো ত্যাড়া উত্তর দিতে ইচ্ছে হলো না আর। শতহোক, প্রিয় মানুষের আবদার!
দরজা খুলে অনুকে দেখে বেশ অবাকই হলো চারু। গত দুদিন এই মেয়ের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয় নি বললেই চলে। হলেও দু’ জনেই এড়িয়ে গেছে। আজ হঠাৎ? জিজ্ঞেস করবার জন্য মুখ খুলতে গেলেই অনু সোজাসাপ্টা বললো,
— “আমি শশুরবাড়ি যাচ্ছি। যাওয়ার আগে দেখা করতে এসেছি।”
ওর দায়সারা গোছের কথাটা শুনে একটু হাসলো চারু। শ্লেষ মিশ্রিত কণ্ঠে বললো,
— “না এলেই পারতি। শুধু শুধু এতটা রাস্তা হেঁটে কষ্ট করা!”
এরচেয়েও ত্যাড়া জবাব তৈরি ছিল অনুর। ও সেটা প্রয়োগ করেই ফেলতো, কিন্তু মাহাদের উপস্থিতির জন্য সতর্ক হতে হলো। বিচিত্র কারণে চারুকে ভীষণ শ্রদ্ধা করে মাহাদ। সেই বড় আপার সঙ্গে খারাপ আচরণ ও সহ্য করবে না। নব পরিণীতার জীবনে ঝঞ্ঝাট চায় না অনু। তাই চুপ রইলো।
ওর পক্ষ থেকে উত্তরটা দিলো মাহাদ। বিনয়ী হেসে বললো,
— “ওভাবে বলছ কেন, ভাবী? তোমার সঙ্গে দেখা না করে আমি চলে যেতে পারি?”
মাহাদের এমন সহজ স্বীকারক্তি পুরোনো কিছু স্মৃতি জাগিয়ে দিলো মনে। খুব যত্ন করে আবদ্ধ রাখা, বুকের গভীরে লুকোনো কিছু মধুর সম্পর্ক, কিছু অমলিন সময়! পরক্ষণেই পুরোনো ঘায়ে টান পড়লো যেন। রlক্ত ছলকে বেরোলো, ভিজিয়ে তাজা করে দিলো ক্ষতটা। ঠোঁটটা কেমন বাঁকা করে বললো চারু,
— “পরশু বিয়ের সময় তো আমাকে মনেও করো নি। এখন হঠাৎ?”
— “কে বলেছে মনে করিনি? আম্মা তো বললো, তুমি অসুস্থ ছিলে। তাই আর— তুমি ভুল বুঝ না, ভাবী! আমি তোমার খোঁজ নিয়েছিলাম।”
কাঠিন্য স্বরে চারুর প্রত্যুত্তর,
— “আমাকে ভাবী ডাকা বন্ধ করো, মাহাদ। তোমার সঙ্গে সে সম্পর্ক আর আমার নেই।”
— “কিন্তু ভাবী ডেকেই তো আমি অভ্যস্ত। ভাইয়া, ও-বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হতে পারে, তাই বলে কি আমার সঙ্গেও?”
আকুল চোখে তাকায়। চারু নির্বিকার,
— “যেখানে আসল মানুষটার সঙ্গেই সব চুকে-বুকে গেছে, সেখানে তুমি তো— যাক গে, বাদ দাও। আমি যেহেতু তোমার স্ত্রীর বড় বোন, সে হিসেবে আপু ডাকলেই খুশি হব। পুরোন সম্পর্ক, যার কিনা কোনো অস্তিত্ব নেই তার প্রয়োজন কি?”
হাসার চেষ্টা করলো। ভাবী ডাকায় ঘোর আপত্তি বুঝতে পেরে দমে গেল মাহাদ। কিছুই আর আগের মত নেই। সেই সুন্দর ভাবী- দেবরের সম্পর্ক, খুনসুটি — হারিয়ে গেছে সব! মিইয়ে যাওয়া গলায় বলে,
— “ঠিক আছে। আপা ডাকবো তবে।”
— “আচ্ছা।” চারু হাসে।
মাহাদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অনুকে বললো,
— “তুমি যাও। আম্মা – আব্বার কাছে বিদায় নাও। আমি আসছি।”
ওকে চারুর কাছে ফেলে চলে যেতে যদিও ইচ্ছে ছিল না অনুর তবুও দিরুক্তি না করে নিঃশব্দে প্রস্থান করলো।
চারু প্রশ্নাত্মক চোখে চাইলো,
— “কিছু বলবে, মাহাদ?”
কয়েক সেকেন্ড নীরবতার পর মাহাদ শুধায়,
— “তুমি কি আমাদের উপর রাগ করে আছ? বিয়েটাকে মেনে নিয়েছ তো?”
— “তোমার কেন মনে হচ্ছে, আমি রাগ করবো? কেন মানব না তোমাদের বিয়ে? যেটা আমার পুরো পরিবার মেনে নিয়েছে সেটা আমি না মানার কে? আর আমার না মানা দিয়ে তোমাদের কি যায় আসে?”
ইতঃস্তত হয়ে বলে,
— “তোমাকে অনুর বড় আপা বলবার আগে, ভাবী বলে ডেকেছি। তুমি যদিও সব ভুলে যেতে চাও। ভুলে যাওয়াই উচিৎ। কিন্তু আমার কাছে সেই সম্পর্কটার গুরুত্ব আছে। জীবনে প্রথম যে নারীকে বড় ভাবীর জায়গা দিয়েছি; মায়ের পর যাকে শ্রদ্ধা করেছি; তার দোয়া না নিয়ে আমি সংসার করতে পারি? তাকে ব্যথা দিয়ে আমি—”
ঠোঁটের কোণে হাসিটা লেগেই রয়েছে ওর,
— “হয়েছে হয়েছে। আর বলতে হবে না। আমি বুঝেছি মাহাদ। তুমি এখনও সেরকমই আছো। পাল্টাও নি। তেমন সহজ – সরল। আমি দুঃখ পাই নি মোটেও। খুশি হয়েছি এই ভেবে যে আমার উড়নচন্ডী, বেখেয়ালি বোনটাকে তোমার কাছে তুলে দিতে পেরেছি। দোয়া করি, সুখী হও। অনেক বেশি সুখী হও।”
কাঙ্ক্ষিত প্রতিক্রিয়া পেয়ে ভীষণ খুশি হয় ছেলেটা। উজ্জ্বল অনুপ্রভা ছড়িয়ে পড়ে ওর সুদর্শন চেহারাখানা জুড়ে। মাথা হেলিয়ে বিদায় নেয় সে,
— “আসছি, ভাবী। তুমি ভালো থেকো!”
শেষবারের মতো ভাবী ডাকটা শুনে চোখে জল ভীড় করলো চারুর। ঝাপসা দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে থাকে ধীরে ধীরে গমনদ্যোত মাহাদের পানে। বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরোয়,
— “আহা রে, জীবন!”
___
অন্ধকার ‘দখিন হাওয়া’য় একা বসে নিখিল। আশেপাশে কেউ নেই। নির্জন, জনশূণ্য। আজ সারাদিনে সৌভিকের সঙ্গে দেখা হয় নি ওর। ঘুম থেকে উঠে ঘরে পায় নি। সৌভিক ছিল না। অথচ, গতোকাল দুই বন্ধু একসঙ্গে বাইরে বেরিয়ে নাশতা করেছে, ঘুরেছে আশেপাশের এলাকা। আজকের জন্যও প্ল্যানিং করা ছিল। কোথায় কোথায় যাবে, এ এলাকার আর কি কি জায়গা দেখবার মতো। কিন্তু তারমধ্যেই কি-না-কি হয়ে গেল!
সৌভিকের ব্যাপারটা নিয়ে ও খুব অবাক হয়েছে। সেই আমলের বাংলা সিনেমার ভিলেনের মত আচরণ! নায়িকাকে পছন্দ করে শুনলে, নায়কের উপর নায়িকার ভাই যেমন চড়াও হয়! খলনায়কের ভূমিকায় অবতরণ করে, ঠিক তেমন! অথচ সৌভিকের চরিত্রের সাথে এ যায় না। একদমই না! তাহলে?
উদাস হয়ে ভাবে। আচ্ছা, কোনোভাবে কি সে ভুল করে ফেললো? সৌভিক নিজেই চারুকে পছন্দ করে না তো? কিংবা ওদের মধ্যে সম্পর্ক নেই তো? ওদের সম্পর্কে ও নিজেই অনধিকার প্রবেশ করে ফেললো কি?
কিন্তু তাও বা কি করে হয়? সৌভিকের সঙ্গে দীর্ঘদিনের পরিচয়, বন্ধুত্ত্ব। প্রাণের সম্পর্ক ওদের। কই, কোনদিন তো দেখে নি এমন কিছু! এমনকি ওর কোনো মেয়ের সাথে সম্পর্ক আছে — এমন কিছুও শোনে নি। চারুকে দেখেও তো মনে হয় নি। তবে? কি করে?
ছটফট করে ওঠে সমস্ত মন। আনচান করে প্রাণ। অদ্ভুত গোলকধাঁধায় ফেঁসে গেছে সে! যার কোনো কূল-কিনারা খুঁজে পাচ্ছে না!
চলবে___
#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_০৮
[মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত]
রক্তিম সূর্যটা পশ্চিমে ডুবেছে অনেক্ষণ হলো। অন্তরীক্ষে লালাভ বর্ণের ছড়াছড়ি। দূরের ঘন বৃক্ষরাজি কৃষ্ণরূপ নিয়েছে। একটানা ঝিঁঝিঁ ডেকে যাচ্ছে কাছেই কোনো গাছে বসে। পুরোপুরি আলো হারায় নি, আবছা আঁধারি নিয়ে সন্ধ্যা নেমেছে ধরণীর বুকে। ধোঁয়া ওঠা কফির মগ নিয়ে বাগানে এলো চারুলতা। গতকাল রাতেই অর্ধেক বাড়ি ফাঁকা হয়ে গেছে। অভ্যাগত অতিথিরা অনেকেই চলে গেছেন কাল বৌভাত থেকে ফিরবার পর। বাকি যারা ছিলেন, তারাও আজ সকালেই গেছেন যার যার নিজস্ব ঠিকানায়। কয়েকদিনের হৈ-চৈয়ের পর তাই বাড়িটা আজ বেশ ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। কেমন অদ্ভুত শূন্যতা চারপাশে!
অন্ধকারে পথ হেঁটে ‘দখিন হাওয়া’র দিকটায় আসছিল চারু। হঠাৎ মনে হলো কে যেন ওখানে বসে। আওয়াজ আসছে। চমকে উঠে ‘কে?’ — প্রশ্ন করতে গিয়েও করলো না চারু। ঠোঁটের ডগায় আসা প্রশ্নটা বন্ধ করে, চুপ করে দাড়িয়ে রইলো অন্ধকারে। নিশ্চুপে শুনলো কোনো আগন্তুক গুনগুন করে সুর ভাজছেন। রবিঠাকুরের ভীষণ জনপ্রিয়, প্রেম-বিরহের করুণ সুরের গানটি এই গায়ক তার সম্মোহনী কণ্ঠে গাইছেন,
— “যদি আরও কাহে, তুমি ভালোবাসো
যদি আরও ফিরে, নাহি আসো
তবে তুমি যা চাও, তাই যেন হয়!
আমি যতোই দুঃখ পাই গো~”
বিকেল থেকে উদাস ছিল চারু। পুরনো স্মৃতিরা বারেবারে দোলা লাগাচ্ছিল মনে। বেরিয়ে আসতে চাইছিল বুকের ভেতর আবদ্ধ সিন্দুকটা ছেড়ে। যে সিন্দুকের অবস্থান তার গহীনে, তার তিক্ত অতীতের গল্প মুড়িয়ে!
অচেনা মানুষটির এই মর্মস্পর্শী করুণ সুর ওর দুঃখের ব্যথায় আগুন ধরিয়ে দিলো। হৃদয়ের দুয়ারে আঘাত হেনে স্মৃতিরা বেরোলো ঝুলি থেকে। একে-একে করে। সেই আড়াই বছর আগের কথা। সেই বিয়ের রাত। বাসর রাতে প্রথম দেখা, অচেনা পুরুষ মাহতাবের সঙ্গে। অন্তর্মুখী চারুর বিয়েটা পারিবারিক ভাবেই হয়। বিয়ের আগে তেমন দেখা-সাক্ষাৎ হয় নি। একবার শুধু মাহতাবের সঙ্গে কফি খেতে গিয়েছিল রেস্তোরাঁয়। তাও বিয়ের দিন চারেক আগে। আধ ঘণ্টার সেই সময়টুকুতে কতটুকুই বা চেনা-জানা হয়?
বিয়ের রাতে তাই স্বল্প পরিচিত পুরুষটির সামনে আড়ষ্টতার মর্মে মlরে যাচ্ছিল চারু। লজ্জিত আনত মুখ তুলে তাকানো হয় নি। আগে থেকে ভেবে রাখা একটা পরিকল্পনাও পূরণ হয় নি। কল্পনায় এঁকে রাখা কতো শত গল্প, কতো কি ভাবনা! সারা রাত গল্প হবে, লোকটাও যেন কেমন। মনের দেয়া নেয়ার আগেই শরীরের দেয়া-নেয়া হয়ে গেল। লজ্জায় চারু দ্বিমতটুকু করবার সুযোগ পায় নি। আট-দশটা দম্পতির মতো অতি সাধারণ নিয়মেই সংসার জীবনে প্রবেশ করলো চারু। স্বামী-শ্বশুরবাড়ি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো দ্রুতই!
মাহতাবদের পরিবারে সে বড় ছেলে। দাদার বংশে প্রথম নাতি। দাদা বেঁচে নেই, দাদিরও যাই-যাই করছেন। বড় সাধ নাতির সন্তান দেখে মlরবেন। অতএব, মাহতাবের বিয়েটা তড়িঘড়ি করেই দিয়েছে তার পরিবার। মাস খানেকের মধ্যেই শ্বশুরবাড়ির সবার ‘বাচ্চা নাও, বাচ্চা নাও’– শুনতে শুনতে বিষয়টা বুঝতে পারে চারু। একে স্বামী নামক লোকটার সঙ্গে তার তেমন বোঝাপড়া হয় নি। এখনো সেভাবে ভালোবাসাটাই হয়ে উঠে নি, তাতেই বাচ্চার দায়িত্ব? চারু সময় চাচ্ছিল। মাহতাব মানতে নারাজ। সেও দ্রুতই বাবা হওয়ার বাসনা করে। অপারগ চারুকে শেষ অবধি রাজি হতে হয়। কিন্তু মেনে নেওয়া আর মনে নেওয়া, এই দুইয়ের মধ্যে তফাৎ আছে। চারু মেনে নিয়েছিল, মনে নিতে তার সময় দরকার ছিল।
ক্রমাগত চেষ্টার পরও বারবার ব্যর্থ হয় ওরা। পরিবার চাপ দিতে থাকে। ভাইবোন সবাই বড় হয়ে যাওয়ায় বাড়িটা ওদের ফাঁকা ফাঁকা। বাচ্চা-কাচ্চা এলে তা পূর্ণ হবে যেন। তাই সবার মুখেই এক কথা — “একটা সন্তান চাই। একটা সন্তান চাই।” পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, সবারই ওই এক কথা। শুনতে শুনতে বিরক্ত হয় চারু। মাঝে মাঝে বিতৃষ্ণা আসে। সবাই এমন করে কেন? সময় হলে কি বাচ্চা হবে না? এতো জোর দেয়ার কি আছে? তারা তো চেষ্টা করছেই।
কিন্তু চেষ্টাটা সফলতার মুখ দেখে না। চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে তিনি একসময় সত্যতা জানান। “চারু ইজ অ্যান ইনফার্টেইল উম্যান। শি ক্যান নেভার বি অ্যা মাদার।” সাজানো সংসার ভাঙতে দেরি হয় নি আর। খুব দ্রুতই ডিভোর্সের মাধ্যমেই সম্পর্কের ইতি টানে মাহতাব!
নিজের বিয়েতেও চারুর ভূমিকা ছিল না, বিয়ে ভাঙাতেও তার ভূমিকা রইলো না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, পুরুষের কথাই গ্রহণ করলো। মাহতাব সব চুকাতে চাইলেই চুকে গেল সবকিছু! চারু ফিরলো তার নীড়ে। কপালে তালাকের তকমা লাগিয়ে!
একা দাড়িয়ে স্মৃতিচারণ করছিল চারু। গান থেমে গেছে কখন সে জানে না। চটকা ভাঙলো গায়কের দরাজ গলায়,
— “কে ওখানে?”
চকিতে ফিরে তাকালো মেয়েটা। অন্ধকারে অস্পষ্ট সব। ভেতরে কে বসে বোঝা যাচ্ছে না। আগন্তুক উঠে বাতি জ্বাললো। হলদে আলোয় আলোকিত হয়ে উঠতেই লোকটাকে দেখতে পেল চারু। নিখিল নওশাদ!
— “ও আপনি?”
উৎকণ্ঠিত অবস্থা স্তিমিত হয়ে এলো। নিখিল এগিয়ে এসে দরজায় দাড়িয়ে বললো,
— “আসুন না। বাইরে দাড়িয়ে কেন?”
স্বাগত জানানোর ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে দেখালো। চারু এগোলো না। নড়লোও না একটু। উপচে পড়া কান্নাটাকে এক ঢোক গিলে রুদ্ধ করলো। কাষ্ঠ হেসে জানালো,
— “না থাক। আপনি গান গাইছেন, বিরক্ত না করি।”
— “শুনে ফেলেছেন বুঝি? ইসস, এই বাজে কণ্ঠটা নিয়ে যে কি করি। হুটহাট মুখ ফসকে সুর বেরিয়ে যায়! তাও যদি ভালো হতো—”
— “না। না। আপনার গানকে মোটেও খারাপ বলি নি। আমি বললাম–”
চারু প্রতিবাদ করবার চেষ্টা করে। প্রশ্রয় পেয়ে নিখিল হাসে,
— “খারাপ যদি না বলেন, তবে ভেতরে এসে বসুন না। ভয় নেই, জোর করে গান শোনাবো না। এমনই গল্প করবো। আসুন না, প্লিজ?”
গল্প করবার মানসিকতা তার নেই। ভঙ্গুর মন তার। কবেই ঝুরঝুর করে ভেঙে গেছে! হারিয়ে গেছে কতো সুর, কতো ছন্দ!
এতদিন ধরে একটু একটু করে সামলে নেয়া, শক্ত আবরণে নিজেকে মুড়িয়ে নেয়া — সবটাই বিফলে গেছে ক্ষনিকের তরে। ফিরে এসেছে পুরোনো, ব্যথিত চারুলতা। ফুলের মত কোমল, একটুতেই নুয়ে পড়া লতা।
কিন্তু লোকটা এতো করে অনুরোধ করছে, তাকে না বলাটাও কেমন ঠেকলো ওর কাছে। অগত্যা রাজী হলো,
— “আচ্ছা, আসছি।”
নিখিল সরে গিয়ে ভেতরে ঢুকবার স্থান করে দিলো। চারুকে বসবার ইঙ্গিত দিয়ে নিজে বসলো ওর বিপরীতে। চারু হাসলো একটু। নিতান্তই কথা খুঁজে না পেয়ে শুধালো,
— “আপনি কি নিয়মিত গান নাকি? প্রফেশনাল?”
নিখিল যেন লজ্জিত হয়ে তড়িঘড়ি করে বললো,
— “না-না। প্রফেশনাল নই। এই একটু-আধটু সাধ হলে মাঝে মাঝে। আসলে কথা পাগল মানুষ তো। বেশিক্ষণ চুপ করে থাকতে পারি না। সৌভিক নেই অনেক্ষণ হলো। এখানে এসে একা বসে আছি। ভাবলাম একটু গাই। এরমধ্যে আপনার কানে গিয়ে পৌঁছল ফাটা বাঁশের চ্যানচ্যানানি — হা হা হা।”
— “আপনি যেভাবে বলছেন অতটাও খারাপ নয়।”
বাধ সাধতেই নিখিলের চটপট জবাব,
— “বারবার ও-কথা বলবেন না। আমাকে আবার পেয়ে বসলে, আপনাকে ধরে জোর করে গান শুনাতে বসবো। তখন ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি অবস্থা হবে!”
ওর বলার ধরন দেখে আর চুপ করে থাকতে পারলো না চারু। নিমিষেই মন খারাপ ভুলে, হেসে ফেললো খিলখিল করে। সেই হাসির সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাসতে লাগলো নিখিলও!
সৌভিক সারাদিন বাড়ি ছিল না। বাড়ির একটা দরকারে গিয়েছিল শহরে। সারাটা দিন সেই কাজে কর্তন করে ও যখন ফিরলো তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত। গেট দিয়ে ঢুকে লন পেরোবার সময় ওর হঠাৎ কানে বাজলো হাসির আওয়াজ। শব্দ আসছে বাগানের দিক থেকে। এই ঝিঁঝিঁ ডাকা নিঝুম রাতে ওখানে বসবে কে? কৌতুহলী হয়েই পা বাড়ালো সে। একটু দূরে যেতেই চোখে পড়লো দৃশ্যটা। না কোনো অশালীন কিছু নয়, তবে অপ্রত্যাশিত তো বটেই!
‘দখিন হাওয়া’য় নিখিল আর চারু মুখোমুখি বসে। দু’জনেই কি নিয়ে যেন হাসছে খুব। প্রফুল্ল সে হাসি, কানায় কানায় আনন্দ পূর্ণ। বহুদিন পর চারুকে এমন প্রাঞ্জল দেখে অবাক হলো সৌভিক। চারুর খুশিতে সে অবশ্যই খুশি হয়, কিন্তু নিখিল? নিখিল কেন হাসছে ওর সঙ্গে? হঠাৎ কী একটা গোপন ব্যথায় চিনচিন করে ওঠে ওর বুক। অব্যক্ত আক্রোশে ফুঁসে ওঠে মন। ক্রোধান্বিত হয়ে নীরবে প্রস্থান করে সে!
__
ঘর গোছাতে ব্যস্ত ছিল অনুলেখা। হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন উদর ছুঁলো ওর। হিমশীতল ঠাণ্ডা দু’ হাতে ঘনিষ্ট ভাবে জড়িয়ে ধরতেই পিলে চমকে উঠলো। চেঁচানোর জন্য মুখ খুলতে নিলেই একটা আহ্লাদী সুর ভেসে এলো কানে,
— “কি করছে আমার বৌটা?”
বলা বাহুল্য, এ কার কণ্ঠ! অনু মিষ্টি করে হাসলো,
— “দেখছ না ঘর গোছাচ্ছি?”
— “ঘর তো গোছানোই আছে। তুমি বরং আমাকে গুছিয়ে দাও।”
একঝটকায় ওকে ঘুরিয়ে নিজের দিকে ফেরালো। একহাতে পিঠ জড়িয়ে, অন্য হাতে কোমড় চেপে মিশিয়ে নিলো নিজের সঙ্গে। চোখে ইঙ্গিতপূর্ণ ভাষা। ওর নেশালু সে চোখের দৃষ্টি দেখে, অনু ভুবন ভুলানো হাসি দিলো। ওর থুতনিতে একটা চিমটি দিয়ে বললো,
— “এটা কি সেই সময়? অসময়ে উল্টো-পাল্টা না বললেই নয়?”
— “না নয়। কারণ, বৌ আমার, সময়ও আমার। এখন আমি যা খুশি বলবো। যা কিছু করবো।”
বলেই নিজের কথার প্রমাণ দেখাতে মত্ত হলো। ঠেসে ধরে চুমু খেল ওর গালে-মুখে। অবাধ্য হলো হাতের বিচরণ। অনু দেয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে ছটফটিয়ে উঠলো,
— “আহা, কি করছ মাহাদ? দরজা খোলা, এক্ষুনি কেউ এসে পড়বে। দেখে ফেললে কি ভাববে বলো তো?”
— “কেউ আসবে না। আর এসে দেখলেও বা কি। আমি আমার বৌয়ের সাথে কি করছি, না করছি তাতে কার কি? বরং নিজেই লজ্জা পেয়ে পালাবে!”
— “ইসস! তুমি কি নির্লজ্জ গো!”
বলেই ওকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো অনু। মাহাদ কিন্তু ছাড়লো না। বরং আষ্টেপিষ্টে আঁকড়ে ধরলো। কাঁধে নাক ঘষতে ঘষতে বললো,
— “হুম। একটু তো বটেই!”
কিছুটা সময় পার হলো এভাবেই। ছটফট করতে করতে একসময় হাল ছেড়ে দিলো অনু। মৃদু স্বরে জানতে চাইলো,
— “আচ্ছা, একটা কথা বলি?”
— “শুধু একটা? একশোটা বলো? আমি কিছু মনে করবো না। শতহোক, একটাই বৌ আমার!”
ওর দুষ্টুমিতে বিরক্ত হয়ে বললো,
— “আহ্ হা। শোনোই না!”
মাহাদ ওর নাক টিপে দিয়ে বললো,
— “আচ্ছা। বলোই না।”
অনু চুপ করে রয়। কিয়ৎক্ষণ পর হঠাৎ শুধায়,
— “তখন তুমি আপাকে কি বললে? আমি চলে আসবার পর?”
এ-প্রশ্নে অবাক হয় ছেলেটা,
— “কেন?”
— “আহ্ হা। বলো তো!”
জোর দেখায় খুব। মাহাদ একটু ভেবে জানায়,
— “তেমন কিছু না। তার বোনকে নিয়ে যাচ্ছি। তার কাছে একটু মত নিতে হবে না? তাই আর-কি!”
— “সেজন্যে আমাকে চলে যেতে বলবার কি ছিল? আর ওর কাছেই বা বলবার কি? ও কে?”
হুট করেই যেন রেগে ওঠে অনু। আগের চেয়ে কণ্ঠ বেশ উঁচু শোনায়। হাত ছেড়ে দিয়ে দূরত্বে দাড়ায় মাহাদের। আকস্মিক ওর এহেন আচরণে বেশ অবাক হয় মাহাদ,
— “তুমি তাতে রেগে যাচ্ছ কেন? আমি কি ভুল কিছু করেছি? সে তো তোমার বোন!”
— “হ্যাঁ। বোন। কিন্তু তাতে কি? বোন হয়েছে বলে আমার মাথা কিনে নিয়েছে? যে ওর কাছে পারমিশন নিতে হবে?”
দপ করে আগুন জ্বলে ওর মাথায়। বারুদের মত ফুঁসে ওঠে মেয়েটা। সহসা এই ক্রোধান্বিত অনুকে চিনতে পারে না মাহাদ। প্রবল বিস্ময়ে হতবিহ্বল চোখে চেয়ে রয়,
— “এভাবে বলছো কেন? কি হয়েছে তোমার?”
সে প্রশ্নের জবাব দেয় না অনু। প্রচন্ড রাগে জ্বলতে থাকে ওর শরীর। হিস্টিরিয়া রোগীর মতো কাঁপতে কাঁপতে নিজের মতো চেঁচিয়ে যায়,
— “সবাই ওর মধ্যে পেয়েছেটা কি? খেতে চারু, বসতে চারু, সবকিছুতে চারু, চারু আর চারু! সমস্যা কি সবার? কি এমন কলোজাদু করেছে ও? যে ওকে ছাড়া কেউ কিচ্ছু বোঝে না?”
চলবে___