#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী
দ্বিচত্বারিংশ পর্ব (৪২ পর্ব)
মৃত্তিকার কাজটুকু ঠিকমতোই করছে সে৷ কাজই হলো মমতাজ বেগমের উপর নজর রাখা৷ সে রাখছে, উনার সব আচরণই স্বাভাবিক। এরমধ্যে শাফিনের কোনো খোঁজ পায়নি ওরা। সবই কেমন যেন শান্ত।
দিন পেরিয়ে যায়, সময়ের নিয়মে রমজানও চলে গেছে৷ শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা গেছে, কাল ইদ।
মৃত্তিকা পায়েস বানাচ্ছে, ইমতিয়াজ এসে রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়ায়। সুরভি আর দেলোয়ারা বাসায় থাকলেও মৃত্তিকা তাদেরকে রান্না করতে দিচ্ছে না, দিবে না৷ সে নিজে নিজে একা কাজ করবে।
ইমতিয়াজকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে মৃত্তিকা ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
“কি ভাবছেন আমি এসব বানাতে পারি না?”
ইমতিয়াজ হাসলো। বলে,
“তা কখন বললাম?”
“না, তাকানোটা অদ্ভুত।”
ইমতিয়াজ এসে ওর পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“তোমার চোখ তো সহজে ফসকায় না। তাই তাকানোর স্টাইলটাও দেখেছো।”
মৃত্তিকা একচামচ পায়েস তুলে ফুঁ দিয়ে ইমতিয়াজের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
“মিষ্টি ঠিক আছে কিনা দেখেন।”
ইমতিয়াজ একটু খেয়ে বলে,
“একটু কম, বাট চলবে।”
ইমতিয়াজের ঠোঁটের কোণায় একটু পায়েস লেগে আছে৷ মৃত্তিকা আঙ্গুল দিয়ে সেটুকু নিয়ে এসে নিজের খেয়ে ফেলে। ইমতিয়াজ একটু তাকিয়ে থেকে রুমে চলে যায়। এখন মৃত্তিকার মনে হয় সে কি করেছে। লজ্জা পায়, মুখখানা লাল হয়ে গেছে তার। আবারো বুকের বামপাশে তীব্র ধু°কপু°ক।
______________________________________
সারাহ্ আজ খুব ব্যস্ত৷ আহনাফের সাথে তার প্রথম ইদ, অবশ্যই বিশেষ কিছু করা চাই৷ তাজা ফুল এনে পুরোনো ফুলের স্থানে রাখা হয়েছে। বিছানার চাদর, সোফার কভার সব পালটে ফেলেছে। পুরো বাসা ঝকঝকে। নিজের জানা ভালো ভালো রেসিপি করার জন্য সব গোছগাছও চলছে একই তালে।
আহনাফ ইফতার করেই বেরিয়ে গিয়েছিল। এখন বাসায় এসেই ড্রইংরুমে বসে কাউকে ফোন করায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আব্বাস সাহেব নিজ রুম থেকে বেরিয়ে আহনাফকে বলল,
“কোথায় গিয়েছিলে আহনাফ?”
আহনাফ ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলল,
“ছোট ফুপ্পির বাসায়৷ ফুপা বাসায় নেই। আজ নিয়ে সাতদিন গেলাম আর আসলাম।”
“জামিল বুঝতে পেরেছে তুমি ওর পিছু করছো, এজন্যই গা ঢাকা দিয়েছে।”
“কয়দিন দেয় আমিও দেখবো।”
সারাহ্ রান্নাঘরে পেঁয়াজ কা°টছিল, দুজনের কথা শুনে ছু°ড়ি চালানো থামিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এতোসব সাজ ওর এলোমেলো করতে ইচ্ছা করছে। সব এলোমেলো হয়ে যাক, সব ধ্বং°স হোক।
এতো আয়োজনের মাঝেই আহনাফ ওকে মনে করিয়ে দিয়েছে বিয়েটাই পরিকল্পিত। এ পরিকল্পনা ওরা নয়, একজন লুকায়িত শ°ত্রু করেছে। এই কথা ও বারবার ভুলে যাচ্ছে। একটা বাটারফ্লাই ইফেক্ট হলে সারাহ্ আর আহনাফের হতো না।
ভুলবশত ছু°ড়িটা ও নিজের হাতেই চালিয়ে দেয়৷ কে°টে র°ক্ত পড়ায় টের পায়। “আহ” বলে অস্ফুট স্বরে চেঁচিয়ে উঠে।
আহনাফ ড্রইংরুম থেকে ছুটে এসে ওর হাত ধরে ধ°মক দিয়ে বলে,
“কাজ গুছিয়ে করতে না পারলে করবে না।”
সারাহ্-র কাছে এই ধ°মকটাও খারাপ লাগলো। আহনাফের প্রতি ভুল ভাবনা আসছে তার৷ আহনাফ ওকে ডাইনিং এ এনে বসিয়ে কাটাস্থানে স্যাভলন লাগিয়ে একটা এককালীন ব্যা°ন্ডে°জ দিয়ে দেয়।
আব্বাস সাহেব পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলে,
“একা এতোকিছু কেন করছো, মা?”
“পারবো আমি।”
ছোট করে জবাব দিয়ে সারাহ্ আবারো রান্নাঘরে চলে যায়। আহনাফ ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। সারাহ্-র এমন পরিবর্তন কি শুধুই প্রেগন্যান্সির সময়ের মুড সুইং? সন্দেহ হয় আহনাফের৷ অবশ্যই সারাহ্ বিয়ের বিষয়টা নিয়ে ভাবছে৷
______________________________________
পায়েসটুকু বানিয়ে এসেই মেহেদী দিতে বসে মৃত্তিকা। অনেকদিন পর মেহেদী ধরেছে, তাই হাত কাঁপছে। ইমতিয়াজ বিছানার একপাশে বসে ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে, অফিসের কোনো একটা কাজে সে ব্যস্ত।
“শরীফ সাহেব অস্ট্রেলিয়া যাবে।”
ইমতিয়াজের কথায় মৃত্তিকা মুখ ভেংচিয়ে বলে,
“সাহেব? উনাকে এতো ভদ্র করে ডাকার কি দরকার?”
“আমার শশুর তো।”
মৃত্তিকা উঠে এসে একটুখানি মেহেদী লাগানো হাতটা ওর সামনে ধরে বলল,
“কিসের শশুর? আমি যাকে বাবা মানি না আপনি তাকে শশুর ভাবেন কেন?”
ইমতিয়াজ ওকে টে°নে নিজের কোলে বসিয়ে একহাতে কোমড় জড়িয়ে বলল,
“তোমার বাবা, আমার শশুর। তোমার মানা কিংবা না মানার উপর আমার কিচ্ছু আসে যায় না।”
ইমতিয়াজের হাতের বাঁধন হালকা হলে মৃত্তিকা উঠে যায়৷ ঘটনাক্রমে হওয়া নিজের অস্বাভাবিক ভাব মুখে না এনে বলে,
“সুরভি আপুকেও আমার সন্দেহ হয়েছিল, বেশ অনেকদিন তাই নজরব°ন্দি রেখেছি। কিন্তু সব তো স্বাভাবিকই দেখলাম।”
ইমতিয়াজ ল্যাপটপ বন্ধ করে বলে,
“সব আমাদের ভাবনার কয়েক ধাপ উপর দিয়ে হচ্ছে৷ ধাঁধার সমাধান হয়নি। শাফিন নারী পাচারে যুক্ত ছিল, কোথায় সেই স্থান তাও খুঁজে পাইনি। বুঝতে পারছো আমরা পিছিয়ে আছি?”
কথা সত্য, শ°য়°তান এমন সব বুদ্ধি খাটায় যা আমরা ভাবতেও পারি না। ভদ্র সুরতে ক্ষতি করে আমাদের। মৃত্তিকা মাথা নেড়ে বলল,
“তা তো বুঝেছি, তবে শাফিন জীবিত থেকে কবর পর্যন্ত গেলে এখানে বড় বড় লোকের আনাগোনা আছে।”
“প্রথম কথা হলো জে°লারের হাত আছে।”
মৃত্তিকা ওর পাশে এসে বসে বলে,
“হ্যাঁ, তবে জে°লারের থেকে আগে শাফিনকে বের করে আনতে হবে। নিখুঁতভাবে গা ঢাকা দিয়ে আছে সে। ঝ°ড়ের আগে আকাশ এভাবেই শান্ত থাকে।”
“তোমার কি মনে হয় ধাঁধার সমাধানে শাফিনকে পাওয়া যাবে? ওকে খুঁজে পাওয়ার জন্য ধাঁধা দেয়নি।”
মৃত্তিকা মৃদু হেসে বলল,
“তা আমি জানি, এরচেয়ে শর্টকাট পদ্ধতি আছে।”
“কি?”
মৃত্তিকা মুখে হাসি বজায় রেখে মেহেদীর প্যাকেট হাতে নিয়ে উঠে যায়৷ ইমতিয়াজ কপাল কুঁচকে বলল,
“পদ্ধতিটা কি?”
মৃত্তিকা ফিরে তাকিয়ে আবারো হাসলো। ইমতিয়াজ বোকাসোকা চেহারা করে তাকিয়ে থাকে৷ সুরভির রুমে গিয়ে মৃত্তিকা ওর হাতে মেহেদী ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“সুন্দর করে দিয়ে দাও তো।”
______________________________________
গরম গরম স্যুপ খাচ্ছে শাফিন, পাশে অপরূপা আছে। তার গায়ে আকর্ষণীয় পোশাক, আবেদনময়ী হয়ে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে শাফিনের কাছে ধরা দেয় সে। প্রতিদিন এই একই কাজ তার।
সেদিন ফাঁ°সি না দিয়ে ঘুমের ই°ঞ্জে°কশন প্রয়োগ করে ঘুম পাড়ানো হয়েছিল শাফিনকে। তারপর নিজেদের লোক দিয়ে গোসল ও ক°ফি°নব°ন্দি করা হয়। ক°ফি°নে বেশ অনেকগুলো ফুটো ছিল হাওয়া চলাচলের জন্য। কবরের নকশা তো আগেই অপরূপাকে দেয়া হয়েছিল আর এতো পরিকল্পনায় আজ সে মুক্ত বাতাসে বিচরণ করছে।
“ওই নোটটা কেন ছেড়েছিল?”
অপরূপার প্রশ্নে শাফিন হেসে বলে,
“মৃত্তিকা খুঁজবে তার উত্তর, আর খুঁজে জানতে পারবে আমার মায়ের নাম ছিল জোসনা৷ তখন নিজের নানীর নাম তা°লা°শ করবে।”
“ওর নানী?”
“মেহরিবা সুলতানা, আমার চাচী।”
“তাতে আমাদের লাভ?”
শাফিন অপরূপার কোলে মাথা রেখে শুয়ে বলল,
“এতে আমরা পাকাপোক্ত কিছু ভাবতে সময় পাবো, এখন যেমন পাচ্ছি।”
অপরূপা একটু করে মাথা ঝাঁকায়। একজন মানুষ কতটা নি°কৃ°ষ্ট হতে পারে তার উদাহরণ বোধহয় শাফিন। অপরূপা জানে এই লোকটা একটা সা°ই°কো, সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ কখনোই এমন আচরণ করবে না। ডা. আরিফা ওকে একবার বলেছিল, এই মানুষকে হাজার চিকিৎসা করেও সুস্থ করা যাবে না, কারণ সে তো সুস্থ হতেই চায় না।
“মমতাজ জানে আমি এখানে?”
অপরূপা হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ে৷ শাফিন ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল,
“একমাত্র ওকেই কেউ সন্দেহ করে না, ওকে এমনভাবে থাকতে বলো যাতে কেউ টের না পায়৷ আমি সময় করে কথা বলবো।”
“ঠিক আছে।”
______________________________________
আফরোজা বাসার সবার সাথে ভিডিও কলে কথা বলছে। সারাহ্-র সাথে কথা বলার সময় বলে,
“ওমা সারাহ্, মেহেদী দাওনি?”
“না আপু, হাত কে°টে গেছে৷”
“তো কি হয়েছে? বিয়ের পরে প্রথম ইদ, হাত ভরে মেহেদী দিবে। (একটু থেমে) আহনাফকে দাও।”
সারাহ্ আহনাফের দিকে ফোন এগিয়ে দেয়৷ আহনাফ ফোন নিলে আফরোজা বলে,
“কিরে, সারাহ্-র হাত খালি কেন? মেহেদী দিয়ে দিবি।”
“আমি দিতে পারি না।”
“যা পারিস তাই দিবি।”
“আচ্ছা আচ্ছা।”
আহনাফ আব্বাস সাহেবকে ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে রুমে আসে। সারাহ্ টেবিলের উপরে থাকা বইগুলো গোছাতে ব্যস্ত।
আহনাফ এসে ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আপু বলেছে তোমাকে মেহেদী দিয়ে দিতে।”
“দিবো না আমি।”
সারাহ্-কে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
“কি হয়েছে?”
সারাহ্ মাথা নেড়ে না বোঝায়। আহনাফ একটু হেসে গিয়ে আলমারি খুলে। একটা শাড়ি বের করে সারাহ্-র হাতে গিয়ে বলল,
“এটা পড়ো, তারপর মেহেদী দেয়ার ব্যবস্থা আমি করছি।”
সারাহ্ শাড়িটা হাতে নেয়। আহনাফ শান্ত কন্ঠে বলে,
“পড়ে নাও, আমি অপেক্ষা করছি।”
আহনাফ বাইরে চলে যায়। কি করবে, পড়বে কি পড়বে না ভেবে ভেবে অবশেষে শাড়িটা পড়েই নেয় সারাহ্। চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে আঁচড়ানোর সময়ই আহনাফ বাইরে থেকে ডেকে বলল,
“ঐশী, আসবো আমি?”
“আসেন।”
মিনমিনে করে জবাব দিলো সারাহ্।
আহনাফ ভিতরে আসে। হঠাৎ সারাহ্-র দিকে তাকাতেই সে থমকে যায়। ছোটবেলায় খেলার ছলে যেমন দাঁড়িয়ে থাকতো বা স্কু°ই°ড গেমে যেমন হঠাৎ থামতে হয়, ঠিক তেমনি আছে আহনাফ।
সারাহ্ একটু লজ্জা পায়। আহনাফ কাছে আসার সাথে সাথে তার লজ্জার পরিসর বাড়ে৷ সারাহ্ চঞ্চল দৃষ্টির চোখদুটো নামিয়ে নেয়। আহনাফ ওর সামনে এসে দাঁড়িয়ে চেয়ে থাকে ওর দিকে৷ নিজের ঐশীর রূপের প্রশংসা সে করে না, অন্যদিনের মতো আজ লজ্জাও দিচ্ছে না কিন্তু সারাহ্ অনবরত লজ্জা পাচ্ছে।
আহনাফ ওর হাতদুটো একহাতে ধরে, অন্যহাতে ওর মুখটা তুলে। দুজনের চোখ দুজনকে দেখে। ঘনঘন ফেলতে থাকা সারাহ্-র চোখের পাপড়ির ছন্দে কোনো এক নৃত্য দেখছে আহনাফ।
আহনাফের কৌতুহলী দৃষ্টি, বড়বড় চোখ, মোটা ঠোঁটজোড়া দেখে দেখে লজ্জা বাড়ে সারাহ্-র৷ কন্ঠ তো সেই কবেই থেমে গেছে, আহনাফ ওর বাধা মানে না।
আহনাফ ওর হাত ধরে এনে বিছনায় বসায়, নিজে বসে মুখোমুখি। ওর হাত টে°নে তালুতে চুম্বন করে, তারপর টেবিল থেকে মেহেদী নিয়ে এসে ডিজাইন করা শুরু করে। ঠিকমতো তো বহু দূর, কোনোমতে মেহেদী লেগেছে। এলোমেলো আর এবড়ো থেবড়ো ডিজাইনে সারাহ্-র হাত লেপ্টে গেছে।
তবে এতে সারাহ্-র সংশয় দূর হয়েছে। আহনাফকে নিয়ে ভুল চিন্তার জন্য নিজেই অনুতপ্ত সে। ভালোবাসি না বললেও এ ভালোবাসা এভাবেই বাড়তে থাকুক।
চলবে…..