এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায় #পর্বসংখ্যা_১১

0
207

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_১১

আকস্মিক হওয়া কাণ্ডে হতভম্ব চারু। ফ্যালফ্যাল নয়নে, চোয়াল ঝুলিয়ে ছোট ভাইদের মুখের দিকে চেয়ে! রিংকু – টিংকু আনন্দে চেঁচাচ্ছে,
— “বড়’পা ভীতু! ভীতুর ডিম!”
উল্লাসে ফেটে পড়ছে যেন। সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলো চারু। দোয়া পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে ভাইদের দিকে তাকালো। একটু রাগবার চেষ্টা করে বললো,
— “কেমন আচরণ এটা রিংকু-টিংকু? তোরা আমাকে ভয় দেখালি কেন?”
— “কোথায় ভয় দেখিয়েছি?”
অবাক হবার ভান ধরলো টিংকু। রিংকুর সায় তাতে,
— “আমরা তো তোমার কানটা একটু দেখছিলাম। তুমি যে ভীতু, তাতেই ভয় পেয়েছ। এতে আমাদের দোষ কোথায়?”
অতি সরল জবাব। নিষ্পাপ চেহারা। চারু রাগ করলো,
— “আমার কান তোদের দেখতে হবে কেন? নিজেদের কান দেখতে পারিস না?”
বড়’পা সহজে রাগে না — এটা ওদের অজানা নয়। তাই চারুর এই রাগবার আপ্রাণ চেষ্টাটা যেন পাত্তাই দিলো না ওরা। নির্বিকার গলায় বললো,
— “কি যে বলো না, বড়’পা। তোমার প্রতি আমাদের দায়িত্ব আছে না? এই যে তুমি কান পরিষ্কার না করতে করতে, দিন-কে-দিন ঠসা হয়ে যাচ্ছো; কতক্ষণ ধরে আমরা তোমাকে ডেকে যাচ্ছি তুমি শুনছোও না, উঠছোও না— এটা আমাদের দেখতে হবে না? তাই তোমার কানটা একটু—”
চারু হাত দেখিয়ে মৃদু স্বরে চেঁচিয়ে উঠলো,
— “এই থাম, ফাজিলের দল! কান পরিষ্কার করছিলি না সুড়সুড়ি দিচ্ছিলি?”
দু’ ভাই হেসে উঠলো কিছু না বলে। সেই সুন্দর হাসির দিকে তাকিয়ে চারু রাগতে গিয়েও আর পারলো না। তবুও সেটা ওদের বুঝতে না দিয়ে চেহারায় কপট একটা গাম্ভীর্য ধরবার প্রয়াস চালালো। নয় তো এরা যা বিচ্ছু, ওর দুর্বলতা ধরে ফেললে আরও বেশি বlদমাlয়েশি করবে! বললো,
— “কি জন্য এসেছিলি তোরা? ডাকছিলি কেন?”
হাসি থামিয়ে রিংকুর জবাব,
— “সৌভিক ভাইয়া সবাইকে নিয়ে তিস্তার পাড়ে বেড়াতে যাবে বলেছে। তাই তোমাকে ডাকতে এলাম।”
— “সবাই বলতে?”
চারু জিজ্ঞেস করে। টিংকুর চটপট প্রত্যুত্তর,
— “সবাই বলতে সবাই। আমাদের সবক’টা ভাই-বোন। তবে বড়রা কেউ যাচ্ছে না। ওরা কেউ গেলে আমরা যেতে রাজি হতাম না-কি? গিয়েই বলবে, এটা করিস না, সেটা করিস না। দুনিয়ার রেlস্ট্রিকlশন!”
শেষের কথা বলবার সময় ওর চেহারার বিরক্তি ভাব লক্ষ্য করলো চারু। একহাতে ওর কান মুচড়ে বললো,
— “তারা মনে হয় ওসব এমনি এমনি বলে? তোমরা যেন খুব সাধু?”
— “আহা, বড়’পা। ব্যথা লাগছে তো!”
হাত ছাড়িয়ে নিতে চায়। চারু হেসে ছেড়ে দিতে দিতে শুধায়,
— “তাহলে বল, আজ কোনো দুষ্টুমি করবি না? কোনো রকমের দুর্নাম শুনলে কিন্তু বাড়ি এসে চাচাকে বলে দেব!”
— “আচ্ছা, আচ্ছা। সে দেখা যাবে!”
বলেই কান ডলতে থাকে। যদিও চারু অতো জোড়ে ধরে নি। কিন্তু টিংকু ঢং করেই বলে,
— “আগে তুমি ভালো ছিলে। এখন তুমিও বদ হয়ে যাচ্ছো, সুযোগ পেলেই মাসুম বাচ্চাগুলোকে ধরো! হুহ!”
চারু হেসে বিছানা ছাড়লো। বাইরে যাবার জন্য ড্রয়ার থেকে জামা-কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে গেল তৈরি হতে। রিংকু – টিংকু ততোক্ষণে বসে বসে বড়’পার ফোন ঘাঁটায় ব্যস্ত!

**********

বিকেলের দিকে অরুণা ম্যানশন থেকে তেরোজনের একটা গ্রুপ বেরোল তিস্তা পাড়ে বেড়াতে যাওয়ার জন্য। কবির আর কাব্য ছাড়া গ্রুপের সবগুলোই ব্যাচেলর। এতোগুলো মানুষ কীভাবে যাবে? দফায় দফায় রিকশা ঠিক করা হলো। কবির আর কাব্য দু’জনেই তাদের যার যার বৌ বিয়ে বাইক ছুটিয়ে চললো। বাকিগুলো ধীরে-সুস্থে আসতে থাকলো সুবিধা মত।

নিখিল তৈরি হয়ে বেরিয়ে বাগানে পায়চারি করছে। বাইরে সৌভিক তার বোনদের নিয়ে ব্যস্ত। কি যেন নাম ওদের, ঋতু ইরা, আর ইমা বোধ হয়। ওদের জন্য রিকশা ঠিক করছে। কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে না বিধায় দাড়িয়ে আছে রাস্তায়। অদূরেই দুই জমজ ভাই গুজগুজ করছে বসে বসে। এতো মানুষের মাঝে নিখিলের দু’ চোখ যে নারীর প্রিয় বদন দেখবার অপেক্ষায় চাতকের মতো চেয়ে, তারই দেখা নেই!
চারু এখনো আসে নি। আচ্ছা, কেন আসে নি? সে কি যাবে না? তাকে কি জানানো হয় নি? তবে?

রিংকু – টিংকু দুই ছটফটে ধরনের ছেলে, তাদেরও প্রস্তুত হতে মিনিট পাঁচেকের বেশি লাগে নি। তৈরি হয়েই ওরা নেমে পরেছে অভিযানে। দখিন হাওয়ায় বসে দুজন লক্ষ্য রাখছে নিখিলের উপর। বাজের শাণিত নজরে নজরবন্দি করে রেখেছে ওকে!
রিংকু বললো,
— “আমার মনে হচ্ছে তুই বেশি বেশি ভাবছিস, ব্যাপারটা মোটেও এমন না। তোর ভুল হচ্ছে।”
টিংকু তার যুক্তিতে অটল,
— “কাউকে দেখেই কিছু ধারণা করা ঠিক না রে, পাগলা! চোখের দেখায় ভুল আছে। সেজন্য গভীর ভাবে ভাবতে হয়। নিখিল ভাইকে আমি সেভাবেই দেখছি। দেখেই বুঝেছি, ডাল মে কুচ কালা হ্যায়!”
— “তেরা মাথা ভি ডাল হ্যায়!”
রাগ করে ছেলেটা। টিংকু অভিজ্ঞ ব্যক্তির মতো হাসে। ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আদেশি সুরে বলে,
— “শোন, আজকেই আমি তোর কাছে প্রমাণ করে দেব সবকিছু। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, নিখিল ভাই বড়’পাকে লাইন মারছে। আগে ভেবেছিলাম, ঋতু’পার পেছনে, পড়ে ভালো করে বুঝলাম তা নয়। চারু’পার পিছে পড়েছে এই ব্যাটা!”
— “কি করে প্রমাণ করবি?”
অনেকটা রাগত স্বরেই বললো। টিংকুর এই জ্যাঠামি ওর ঠিক ভালো লাগছে না। জানা নেই, শোনা নেই — এমনি একটা কথা!
প্রত্যুত্তরে বাঁকা হাসে টিংকু। শার্টের গলায় ঝুলতে থাকা কালো রোদ চশমাটা তুলে ফুঁ দেয় তাতে। দারুণ একটা ভাব নিয়ে সেটা চোখে পড়তে পড়তে বলে,
— “আগে আগে দেখো হোতা হ্যায় কেয়া!”
পরপরই বেরিয়ে আসে দখিন হাওয়ার থেকে। অগত্যা রিংকুও ভাইকে অনুসরণ করে।

ইমাদের রিকশায় তুলে দিয়ে ভেতরে ফিরে আসে সৌভিক। নিখিল তখনো একা দাড়িয়ে। এসেই হাঁক ছাড়ে ছেলেটা,
— “কি রে, চারু এখনো এলো না? এ্যাই চারু? তাড়াতাড়ি আয়! আর ওই বিচ্ছু দুটো কই? এ্যাই রিংকু? টিংকু?”
— “আসছি, ব্রাদার। টেনশন নট!”
বলেই হেলেদুলে আসতে থাকে দুই ভাই। তার ঠিক মিনিট দুয়েক পরেই দেখা মিলে চারুলতার। সাদা আর পার্পলের মিশেলে সাদামাটা একটা শাড়ি পরনে মেয়েটার। মাথায় শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে পরা হিজাবে মেয়েটার চেহারায় অন্যরকম স্নিগ্ধতা খেলা করছে। বড় বড় পা ফেলে ত্বরিতে কাছে এসে দাড়ায় চারু। ভাইদের উদ্দেশ্যে বলে,
— “স্যরি, সৌভিক ভাইয়া। বড় ফুপু ডেকেছিল বলে দেরি হয়ে গেল। তুমি রাগ করো না।”
রাগ? তাও করবে সৌভিক, চারুর উপর? ওর এই শুভ্র-নির্মল দেবীর মতো সুন্দর মুখটির দিকে চেয়ে সে কখনো রাগ করতে পারে? সে তো কিছুক্ষণের জন্য কথা বলতেই ভুলে গেল। পাশে দাড়ানো নিখিলের অবস্থাও ব্যতিক্রম নয়। সেও চারুর লাবণ্যময়ী রূপের ঝলকানিতে মুগ্ধ, বিমোহিত!
রিংকু – টিংকুর চিৎকারে চটকা ভাঙলো ওদের,
— “আরে বড়’পা! কি দারুণ লাগছে তোমায়! উফ্, তোমাকে তো কোত্থাও নিয়ে যাওয়া যাবে না। লোকে দেখলেই নিতে যেতে চাইবে!”
বলেই ছুটে গিয়ে দু’ জন হাত ধরলো ওর। চারু হেসে কথা বলতে লাগলো ওদের সঙ্গে। নিজেকে ধাতস্থ করে সৌভিকও তারা দিলো ওদেরকে,
— “এ্যাই, চল। চল। রিকশা ঠিক করা হয়েছে। চারু আর তোরা দু’জন এক রিকশায়। একজন উপরে উঠবি। আর নিখিল, আমি পেছনের রিকশায় আসছি!”

*******

হেমন্তের বেলা। নদীতে পানির প্রবাহ কম। চর জেগেছে স্থানে স্থানে। সেই চরের উপর খুব লোকে সবজি চাষ করেছে। মিষ্টি কুমড়া, বাদাম, আর কিছু সবুজ শাক-পাতা। নদীর বেশি গভীর অংশটুকুতেই শুধু পানি বিদ্যমান। দু’একটা ইঞ্জিনচালিত নৌকা তাতেই ঘাট বেঁধে দাড়িয়ে। যাত্রী পারাপার করবে, নয় তো নদীতে ঘুরিয়ে আনবে!
চারুরা নামতেই ইমাদের সঙ্গে দেখা হলো। সময়টা হেমন্ত হলেও এখনো কাশফুল ফোটে। নদীর পাড়ের একদিকে বেশ বড় এক ফাঁকা জায়গায় সেরকমই এক কাশবাগান। ইমারা ছুটে এলো বড় বোনকে দেখে। তাকে বগলদাবা করে ফের ছুটলো, কাশবাগানের দিকে। ছবি তুলতে হবে তো!
ছবি তোলার পর্ব শেষ হতেই ভাইদের ডাক পড়ে। অদূরেই একটা ফুচকার স্টল আছে। আজ সবাইকে ফুচকা খাওয়াবে সৌভিক। প্রস্তাব শুনেই হৈহৈ করে ওঠে রিংকু – টিংকু, ইরা, ঋতুরা। ভাবীরাও বেশ সায় দেয়। একমাত্র নির্বিকার থাকে চারু। ফুচকা তার পছন্দের নয় বলে!

একে-একে অর্ডার দেয়া সবগুলো প্লেট এসে হাজির হয়। যে যারটা নেবার পর দেখা যায়, দুটি হাত খালি। চারু নেয় নি। নিখিলও নয়। নিজের ভুলটা বুঝতে পেরে ওদের কাছে মাফ চায় সৌভিক। তার একটুও মনে ছিল না এ-কথা। ওদের জন্য আলাদা করে চটপটির অর্ডার করে অপেক্ষা করতে বলে। চারু হেসে সায় দেয়। কিছুক্ষণ নীরবে হাঁটতে বেরিয়ে আসে দোকান থেকে।

এখন প্রায় সন্ধ্যা। ডুবুডুবু সূর্যটা পশ্চিমে, রlক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। নদীর ওই পাড়ে, দূরের গাছগুলোকে দেখাচ্ছে কালচে কালচে। ইতোমধ্যেই জ্বলে উঠেছে সড়কের বাতিগুলো। ব্রিজের নিচে, সড়ক সেতু থেকে রেল সেতুতে যাওয়ার কংক্রিটের পথটায় দাড়ানো চারু। নিরিবিলি সন্ধ্যের বাতাস গায়ে মাখছে। হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন বলে উঠলো,
— “কি করছেন, চারুলতা?”
ফিরে তাকালে আবছা আলোয় নিখিলকে চোখে পড়ে ওর। লোকটা না ভেতরে ছিল? এলো কখন? অবাক হলেও তা প্রকাশ না করে বলে,
— “কি করবো বলুন, দাড়িয়ে দাড়িয়ে বাতাস খাওয়া ছাড়া?—”
— “ফুচকা তো জুটলো না কপালে!”
ওর অর্ধসমাপ্ত কথাটা শেষ করে দিলো নিখিল। তারপরেই হেসে উঠলো হো হো করে। চারুও হাসলো, তবে মার্জিত হয়ে। ঠোঁট নাড়িয়ে। একটুপর নিখিল বললো,
— “তা কি করা হয় আপনার? পড়ালেখা? না চাকরি?”
নদীর দিকে তাকিয়ে ছিল চারু। সেভাবেই উত্তর দিলো,
— “আপাদত অনার্স শেষ করেছি। মাস্টার্সে ভর্তি হওয়া বাকি। আপনি? সৌভিক ভাইয়ার কলিগ তো, না?”
— “হুম। বেশ জানেন দেখছি!”
মাথা ঝাঁকায় নিখিল। চারু একঝলক চেয়ে মুচকি হাসে। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে নিতে শুধায়,
— “একা এসেছেন কেন? ভাবীকে আনলেই পারতেন। অনুর বিয়ে ছিল, আনন্দ হতো।”
ঠোঁটের হাসি চওড়া হয় নিখিলের,
— “আনা যেত অবশ্য। কিন্তু কি করব বলুন? তার সঙ্গে যে এখনো পরিচয়ই হলো না।”
— “মা-নে?”
অবাক চোখে তাকাতেই হঠাৎ বুঝে ফেলে লজ্জিত গলায় বললো,
— “দুঃখিত, আপনি অবিবাহিত ভাবি না।”
— “ভাববেন না কেন? সৌভিকও তো ব্যাচেলর!”
— “না, মানে। ভাইদের সবার বন্ধু-বান্ধবরাই বিবাহিত তো। তাই—”
মাথা নোয়ায় চারু। নিখিল আর কিছু বলবে তার আগেই সেখানে এসে হাজির হয় দুই বিচ্ছু। রিংকু – টিংকু এসেই চেঁচায়,
— “ট্যান ট্যানান। আপা! তোমাদের চটপটি রেডি। চল, চল।”
বলেই ওর দু’হাত ধরে দুজন দুপাশে টানতে থাকে। চারু ওদের বুঝিয়ে নিরস্ত্র করে,
— “একটু পর যাচ্ছি। তোরা যা।”
দুজনেই মাথা নাড়িয়ে দিরুক্তি জানায়,
— “না, না, না। তোমাদের তো ফেলে যাওয়াই যাবে না!”
চারু ভ্রু কুঁচকায়,
— “কেন?”
কেউ কোনো উত্তর দেয়ার প্রয়োজন মনে করে না। চারুর হাত ছেড়ে দু ভাই এগোয় নিখিলের দিকে। নদীর পানি নিয়ে গম্ভীর মুখভঙ্গি করে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা শুরু করে দেয় ওর সঙ্গে। সারাবছর বইখাতার আশেপাশে না গিয়েও দুজন, তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে হাজারটা কথা কি অবলীলায় বলে যাচ্ছে। বলছে, ফারাক্কা বাঁধ থেকে শুরু করে নানা রকমের নদী বন্দর নিয়ে আলাপ। নিখিলকেও দেখা গেল সেই সকল আলোচনাকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে। আকস্মিক, হাওয়া পাল্টাতে দেখে চারু অবাক হয়। ওদের হাবভাব বুঝতে পারে না। হঠাৎ কি হলো? তার সঙ্গে দুষ্টুমি করতে করতে আবার, দেশের আলোচনায় ঢুকে গেল কেন দুই বিচ্ছু?
ওর বিস্ময়ের রেশ ছাড়ায় তখন যখন দেখে, রিংকু – টিংকু খুব দ্রুতই প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলে। নদীর পানির গুরুত্ব থেকে ওরা এগোয় সাঁতারের দিকে। ছেলেবেলায় নদীতে গোসলের গল্প বলে নিখিলকে। সেও মনোযোগ দিয়ে শোনে। একটুপর দেখা যায়, দু’ বlদমাশ কি কি ভুজুং-ভাজুং বুঝাচ্ছে নিখিলকে এই ভর সন্ধ্যায় পানিতে নামবার জন্য,

— “বুঝলে ভাইয়া, আমার খুব শখ। চল না, নামি? সৌভিক ভাইয়াকে এর আগেও বলেছিলাম, ভাইয়া রাজী হয় না। ও একটা আস্ত ভীতু। আরে বাবা সন্ধ্যা হয়েছে তো কি? নদীতে নামা যাবে না? আরে — ”
— “হ্যাঁ, চাইলেই অবশ্য নামা যেত। কিন্তু প্রিপারেশন নেই নি যে?”
— “ওটা কোনো ব্যাপার না। তুমি চাইলেই হবে। আসলে আমাদের দুই জনের খুব ইচ্ছে ছিল একদিন বিকেলে এসে নদীতে গোসল করে যাবো। কিন্তু সময়ের যে টানাটানি। স্কুল গিয়েই কুল পাচ্ছি না —”
মুখটা দুঃখী দুঃখী করে ওরা। ভাইদের মতলব বুঝে পেরে আঁতকে ওঠে চারু। চোখ বড় বড় করে ওদের দিকে তাকায়। রিংকুর হাত চেপে ফিসফিস করে বলে,
— “তোদের মাথা ঠিক আছে? কি করতে চাইছিস কি তোরা?”

টিংকু তখনও নিখিলের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত। ওকে ভুলিয়ে কিভাবে নদীর পানিতে চুবানো যায়, সেই চিন্তায় মস্তিষ্কে চলছে। ভাইয়ের দিকে একপল চেয়ে চোখ টিপে দেয় রিংকু,
— “আহ্ হা। আপা! মজা দেখই না! নিখিল ভাই তো আস্ত হাঁদারাম! এক্ষুনি লাফিয়ে পড়বে—”
— “খবরদার, রিংকু! তোদের কিন্তু দুষ্টুমি করতে মানা করেছি। আমি কিন্তু ছোট চাচাকে সব বলবো!”
— “তুমি দেখই না, বড়’পা! মজা হবে তো!”
চারু হতভম্ব হয়ে যায়। তার আগেই বোঝা উচিৎ ছিল, এই দুই বিচ্ছু ঠিক কী পরিমাণ বাঁদর! সে তৎক্ষণাৎ কান মুচড়ে ধরে রিংকুর, ওকে সহ এগিয়ে যায় নিখিলের দিকে। হড়বড় করে বলে,
— “নিখিল সাহেব, শুনুন? আপনি এই বদমায়েশ দুটোর কথা শুনবেন না প্লিজ! ওরা কিন্তু আপনাকে পানিতে চুবিয়ে ছাড়বে। প্লিজ, নিখিল সাহেব। শুনুন আমার কথা!”

হঠাৎ চারুর এমন ব্যাকুলতা টিংকু ভড়কায়। বড়’পাটা কি? একটু মজাও করত দেবে না? আর কিছু ভাববার আগেই চারু এসে অন্য হাতে কান মুচড়ে ধরে ওরও। বলে,
— “তোরা এত ফাজিল? আজ বাড়ি যাই শুধু, তোদের হবে! দিন-কে-দিন বেয়াদব হচ্ছিস! নিখিল সাহেব, আপনি চলুন। এদের বিচার হবে।”
দু হাতে দুজনের কান ধরে চারু এগোতে থাকে। নিখিলেরও তখন হুশ হয়। কি বোকামিটাই না করতে যাচ্ছিল সে? আসলে সৌভিক ঠিকই বলে, এই দুই ভাই আস্ত ফাজিল! তাকে কীভাবে ভুলিয়ে – ভালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। আর সেও কি বোকা!
চারুর সামনে নিজের বোকামি প্রকাশ পেয়ে যাওয়ায় ভীষণ লজ্জিত হয় নিখিল। কিছু না বলে সরে আসে।
একটু দূর যাবার পরেই বোনের কাছ থেকে নিজেদের কান উদ্ধার করে রিংকু – টিংকু। বড়’পা বেশ ক্ষেপে আছে। তারমানে বাসায় গিয়ে সত্যি সত্যিই বাবার কাছে নালিশ দিয়ে বসবে! সেই ভয়েই হোক, বা অন্য কারণে দু’ভাই ওর হাত জড়িয়ে ধরে। নিজেদের কৃতকর্মের জন্য মাফ চাইতে থাকে। অন্যসময় হলে চারু ছেড়ে দিতো। কিন্তু এখন ছাড়তে চাইলো না। অপরিচিত একজন মানুষের সঙ্গে ওদের এই মজা ও ঠিক মানতে পারছিল না। এসব কি? নিখিলের সঙ্গে কেন ওদের এমন আচরণ? সবার সঙ্গে কি সবকিছু মানায়? সে তো এ-বাড়ির আত্মীয়!
যাহোক, নিখিলের হস্তক্ষেপেই শেষমেষ পরিস্থিতি সামাল দেয়া গেল। নিখিল নিজেই অনুরোধ করলো ওকে, কাউকে কিছু না বলবার জন্য। আর ওদেরও ছেড়ে দেবার জন্য। ছোট মানুষ দুষ্টুমি করতে গিয়ে করেছে, ছেড়ে দেয়াই ভালো। শুধু শুধু সিনক্রিয়েট করা!
চারু ছেড়ে দিলো বটে। কিন্তু খুব রাগ করলো ওদের উপর। এতটা সে আশা করে নি। রিংকু – টিংকুকে দাড় করিয়ে সে বকাঝকা করতে লাগল। এমন কেউ করে? ফাজলামির একটা সীমা থাকা উচিৎ!

হঠাৎ বিপরীত দিক থেকে আসা এক দম্পতিকে চোখে পড়তেই মুখের কথা বিলীন হলো চারুর। থমকে যাওয়া চাহনিতে তাকালো সে অনিমেষ। নিখিল ওদের গিহয়ে কি যেন বলছিল, সেসব আর কানে এলো না। নিরুত্তর চারুর হতবিহ্বল দৃষ্টি তখনো সম্মুখে। মুখ তুলে বড়’পার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাতেই নিজেরাও দেখতে পেল রিংকু – টিংকু; সেই দম্পতিকে। কালো পাঞ্জাবি পরনে লোকটা, সঙ্গে কালো শাড়ির আব্রুতে ঢাকা রূপসী নারী। গোল-গাল মুখচ্ছবিতে হাসি লেপ্টে; সঙ্গের পুরুষের বাহুতে মাথা ঠেকানো। দু’জনের মুগ্ধ দৃষ্টি, শুধু দু’জনাতে নিবদ্ধ!

দেখতে দেখতেই ওরা এগিয়ে এলো। ওদের প্রায় কাছাকাছি। এতক্ষণে চারুকে খেয়াল করলো ওরা। নিমিষেই হাসিমাখা মুখ দু’টোতে কালো ছায়া নামলো। তথাপি সৌজন্যতার খাতিরে পুরুষটি শুধায়,
— “কেমন আছ, চারু?”
ধ্যান ভাঙে চারুর। হতবাক চোখে সে খুব কাছ থেকে দম্পতিটিকে দেখে, অবলোকন করে তাদের শক্ত হাতের বাঁধন আর হাসি হাসি চেহারা। পুরোনো স্মৃতির দুয়ারে আঘাত হানে যেন কিছু, পলকেই ঝাপসা হয়ে আসে চোখ। নেহাৎ সৌজন্যের ধারও ধারে না সে, প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই হঠাৎ উল্টো ঘুরে হাঁটতে শুরু করে!

চলবে___

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
সকল পর্বের লিংক
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=122111588804106938&id=61553208165829&mibextid=2JQ9oc

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here