চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা #ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া #পর্ব-৩০

0
396

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৩০
৯৫.
পুতুল বিয়ের জন্য হ্যা বলতেই স্বাধীন আলহামদুলিল্লাহ বলল।দিহান সাহেবকে খবর পাঠানোর আগেই সে নিজেই স্বাধীনের বাসায় হাজির হয়।মেয়ের রাজি হওয়ার কথাটা জানায়।বিয়ে কথাবার্তা সব ঠিকঠাক চলছে।কথা হয়,ছেলে দেশে ফিরলেই পুতুলের বিয়ে শুরু হবে।সবকিছু বন্দবস্ত করতে বলেন দিহান সাহেব।স্বাধীন তার হাত ধরে বারবার বলতে লাগলেন।তার বিয়ে পরেও যেন পুতুলকে পড়তে দেন।তার স্বপ্ন পূরণ করা হয়।দিহান সাহেব অভয় দিচ্ছেন।পুতুলের স্বপ্ন পূরণ করা হবে।দিহান কথায় কিছুটা শান্তি পান।ঠিক হয় একমাস পরে বিয়ে হবে।এবং পুতুলের এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হলেই বউ নিয়ে বিদেশের মাটিতে চলে যাবে।মেয়েকে অতদূরে দিতে কষ্ট হচ্ছে। তবু্ও তার জন্য এত ভালো ছেলে।হাত ছাড়া করতে চায়নি।এবং তার স্বপ্নের কথা ভেবে স্বাধীন না করতে পারেনি।

অসীম তালুকদার দিহানকে এতটা খুশি মনে গোছগাছ করতে দেখে এগিয়ে আসে।

কি ‘ বন্ধু এত খুশি কেন?

খুশি হব না মানে?আজ তোও আমার খুশির দিন।সামনে ছেলের বিয়ে কত কাজ এখনো বাকি।সেগুলো সেরে আসতে হবে।বউ,ছেলেকে নিয়ে বাংলাদেশে ব্যাক করতে হবে।বাবা থেকে শ্বশুর মশাই হওয়ার ফিলিংসটা জোস।ওইসব তুই এখন বুঝতে পারছিস না।তোর সময় হলে তখন তুই বুঝতে পারবি।আমি আজ রাতেই চলে যাচ্ছি।খুব শ্রীর্ঘই ফিরে আসবো।

দিহান কথায় অসীম তালুকদার মন খারাপ করেন নিই।একমাত্র ছেলেকে নিয়ে এখনও তার আশা আছে।একদিন তার বাড়িতে বউমা আসবে।তিনিও দিহানের মতোও প্রতি নিয়ত অপেক্ষা করছেন।ভাগ্যের চাকায় কি হতে চলেছে জানা নেই?

নিজ অফিস রুমে বসে অর্পণ যতবার কাজে মনযোগ দেওয়ার চেষ্টা করেছে।ততবারই পুতুলের কান্না জড়িত মুখটা ভেসে উঠেছে।কি হচ্ছে তার?পুতুলের অতীত জানার পর থেকেই সে নিজেকে একটু একটু করে বদলাচ্ছে।পুতুলের জন্য আলাদা সফট কর্নার সৃষ্টি আরো আগেই হয়েছে।এখনো মুখে তা প্রকাশ করে নিই।পুতুল তার স্বপ্ন অবধি পৌঁছে যাক।তারপর তার মনের মানুষটিকে জানিয়ে দিবে তার মনের কথা।তাঁকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন।তাকে পুরোপুরি একটা কম্পিলিট পরিবার দেওয়া।যেখানে মা,বাবা নামক দুটি মিষ্টি শব্দ থাকবে।
ভাইয়ের মুখে হাসিটাকে লক্ষ্য করছে জিহান,রিহান দুই ভাই।কিন্তু তার খুশি কারণটা বুঝতে পারে নিই।

৯৬.
তোমার লজ্জা পাওয়া উচিত।তুমি আমার ছেলের জন্য ওমন একটা গাইয়া মেয়ে আনবে।আমি এটা মানতেই পারবো না।তবে হ্যা মেনে নিতাম।যদি আমাদের ক্লাসের হতো।ওই মেয়েটা লো ক্লাসের।ওর মধ্যে কোনো যোগ্যতা নেই।একটা গাইয়া আনকালচার মেয়ে।সে কোনোভাবেই আমাদের সাথে যায় না।দিহান ডালিং তুমি বিয়েটা ভেঙে দেও।আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের মেয়ে আছে।যেমন স্মাট তেমনই সুন্দরী।তার চলাফেরা হাইফাই মর্ডেনের।সে আমাদের ছেলের জন্য একদম পারফেক্ট।

দিহান ল্যাপটপের কাজ বন্ধ করে বলল,

জেভিন তোমার সমস্যা কি জানো?তুমি নিজে যা তেমনই সবাইকে পেতে চাও।তোমার পোশাক,তোমার কথাবার্তায় এবং বিদেশি কালচারালে বড় হ’য়েছো।তোমার মধ্যে বাঙালি আনা খুঁজতে যাওয়া নির্বোধের কাজ।তবুও তোমায় ভালোবাসি।আর ভালোবাসিই ব’লে যখন যা ব’লেছো।তাই মেনেছি।কখনো কষ্ট পাওয় এমন কাজ করিনি।কিন্তু তুমি তোমার মতো সবাইকে চালাতে চাইলে হবেনা।আমি তোমার কথা নাচবো ব’লে ছেলেকেও নাচতে হবে তার কোনো মানে নেই।আমি মুখ বুঝে তোমার সব আবদার মেনে নিলেও ছেলের ওপরে কোনো বাহানা শুনব না।সামনে ছেলের বিয়ে তৈরি থাকো।আমরা কয়েকদিনের মধ্যেই ছেলেকে নিয়ে বাংলাদেশে ফিরব।স্বামীকে যতই বুঝাতে চাইছেন ততই তিনি বেঁকে বসছেন।ছেলের বিয়ে না-কি বাংলাদেশেই দিবেন।তিনি রেগে মনে মনে ব’লেন।

আমি দেখব ওই মেয়ে কি করে আমাদের সাথে জড়ায়?একবার বিয়েটা হোক।তারপরে বুঝবে মজা।তুমি শুধু দেখবে এই জেভিন তোমার সাথে কি কি ঘটায়?

আজ অনেকদিন পরে তালুকদার বাড়িতে অর্পণ পা রাখল।ভাইয়ের হঠাৎ গ্রামে ছুটে আসা নিয়ে জিহান,রিহান কিছুই ব’লে না।এতদিন পর ছেলেকে দেখে অসীম তালুকদার হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে থাকেন।ছেলের কাছে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে ছুটে আসেন।বাবা এমন হুর মুরিয়ে সামনে আসায় নিজেকে আবার গম্ভীর মুখ করে দাঁড়িয়ে রয়।বাবাকে কিছু বলতে চাইলে।তিনি প্রশ্ন করেন।

কেমন আছে আমার শের?আমার আদরের একমাত্র সন্তান কি মনে করে আজ তালুকদার বাড়িতে?

কেন আসতে পারি না?

সে তুমি অবশ্যই আসতে পারো।তোমার যখন খুশি তখনই আসতে পারো।এই তালুকদার বাড়ির দরজা তোমার জন্য সব সময় খোলা।

বা.. বা আমি তোমায় কিছু বলতে চাই।

আজ এতদিন পরে ছেলের মুখ থেকে বাবা ডাকটি শুনে চমকে উঠেন।তবুও নিজেকে শান্ত রেখে ছেলের পরবর্তী কথা শুনতে অপেক্ষা করছে অসীম তালুকদার।
কিন্তু অর্পণ তার কথা মুখে বলবার আগেই তালুকদার বাড়ির ল্যান লাইনের মোবাইলটা উচ্চ শব্দে কেঁপে ওঠে।অসীম তালুকদার ছেলের কথা শুনার জন্য অপেক্ষা করছেন।কিন্তু ফোন একটুও পর পরই বেজেই যাচ্ছে। সে আজ থামতেই চাইছে না।এত বাজার
পরেও যখন অসীম তালুকদার এগিয়ে গিয়ে মোবাইলটা রিসিভ করেনি।তখন
অর্পণ এগিয়ে গিয়ে মোবাইলটা কানের কাছে নেয়।

৯৭.
হ্যালো অসীম।আমি দিহান বলছি।আমরা আগামী কালই বাংলাদেশে আসছি।পুতুলের জন্য বিয়ের গহনা থেকে শুরু করে সবকিছুই আনা হচ্ছে।তুই তোও জানিস স্বাধীনের ভাগ্নীর সাথে আমার ছেলের বিয়ে হচ্ছে।এবং সেটা এই সপ্তাহ মধ্যেই পড়েছে।পুতুল আর অন্তরকে যা মানাবেনা।ভাবতেই খুশি লাগছে। মেয়েটা কি শান্ত সৃষ্ট?একদম পরী।আমার ছেলের ভালোবাসা।বিয়ে পরই মেয়েদের আসল ঠিকানা স্বামীর ঘর।সেই পুতুল আজ আমার ছেলের জীবনে পুরোপুরি বাঁধতে চলেছে।

অর্পণের কানটা মনে হয় বিষাক্ত সাপে কামড়ে দিয়েছে।শরীরের রক্ত চলাচল মনে হয় বন্ধ হয়ে গেলো।বুকের ভিতরের ছোট হার্টবিটটা আজ জোরে জোরে বাজছে।মনে হচ্ছে এখুনই বেরিয়ে আসবে।এটা কি শুনলো?তার পুতুল অন্য কারো ভালোবাসা।
তার পুতুলের মনে অন্য কারো বসবাস।হাত থেকে মোবাইল পড়ে গেছে সেই কখন।ওপাশ থেকে দিহান ব’লে যাচ্ছে।

হ্যালো,অসীম আমার কথা শুনতে পারছিস।অনেকবার হ্যালো হ্যালো ব’লে যখন কোনো রেন্সপন্স পেলো না।তখন ফোনটা কেটে গেছে ভেবেই রেখে দিল।পরে আবার ফোন দিবে।

অর্পণের কপাল বেয়ে চিকন ঘাম বেয়ে নিজে পড়তে লাগল।তার চোখ লাল হয়ে উঠেছে।হঠাৎ করে নিজের বুকটা চেপে ধরে।এখানে অসয্য ব্যাথা করছে।কেমন অস্থির লাগছে।অসীম তালুকদার ছেলের এমন অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে যান।ছেলে কে দুই হাতে জড়িয়ে ডাকতে লাগল।

অর্পণ,বাবা আমার কি হয়েছে তোর?এই অর্পণ কথা বল।জিহান,রিহান এতখন বাবা,ছেলেকে আলাদা কথা বলতে দেখে উপরে গিয়েছিল।চাচার এমন চিতকারে দৌড়ে ছুটে আসে।

নিজ চোখের সামনে ভাইয়ের সুন্দর মুখখানা টকটকে লাল হয়ে উঠেছে।বুকটা চেপে কেমন নিশ্বাস ফেলছে।মনে হচ্ছে প্রাণ পাখিটা খাঁচা ছেড়ে উড়াল দিবে।অর্পণ এই অবস্থা দেখে মাসুদা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসেন।চোখের সামনে এটা কোন অর্পণকে দেখছেন।তাড়াতাড়ি ডাক্তারকে খবর দিলেন।

৯৮.
“হলুদ বাঁটো, মেন্দি বাঁটো,বাঁটো ফুলের মৌ,
বিয়ার সাজে সাজবে কন্যা নরম নরম ব’রে।

সুরমা-কাজল পরাও কন্নার ডাগর নয়নে,
আলতা বিছপা রাঙা দুটি,রাঙা চরণে
ভরা কলস ছলাৎ ছলাৎ ডাঙা এ নিতল।

নদীর ঘাটে এসেছে কিছু মহিলা।তাদের মধ্যে স্বাধীনের বউ আছে।পুতুলের গায়ে হলুদ দিয়ে গোসল করাবে।সেইজন্য পানি নিতে আসছে।পুকুরের পানি নিতে শেষ সিঁড়িতে বসে খালি কলস ডুবিয়ে পানি নিচ্ছে।এত সুন্দর দৃশ্যটা ফটো ক্লিক করছে অন্তর কিছু কাজিনরা।তারা বিদেশে মাটিতে বড় হয়েছে।এর আগে এমন দৃশ্য দেখে নিই।বয়স্ক মহিলাদের দেখলো,হলুদ শিল নুড়িতে পিশে নিয়েছে।এবং সেটা মিহিন হতেই বাটিতে তুলে নিচ্ছে।তাদের মুখে এসব গ্রাম গানগুলো শুনা যাচ্ছে।

পুতুলের গায়ে হলুদ শাড়ি।চুলগুলো হাত কোপা করা।হিজাব ছাড়া কখনো বের হয়নি।আজ এতগুলো পুরুষের সামনে ঘর থেকে বের হতে হবে।ভাবতেই বুকটা হু হু করে কাঁদছে।সে এভাবে বিয়ে করতে চায়নি।তাকে কেন পরপুরুষে দেখবে এবং হলুদ ছুয়ে দিবে।সেসব ভেবেই অস্থির হচ্ছে।মামাকে ঘরে এনেছে।বাড়িতে এত এত কাজ সেখানে থেকে ছুটে এসেছে।পুতুলের অস্থিরতা কারণ বুঝতে পারেন।ধীর পায়ে এগিয়ে এসে মেয়ের কপালে চুমু বসিয়ে বলল,

আমার আম্মাটা কবে এত বড় হয়ে গেলো?এই তোও সেইদিন ছোট ছোট পায়ে সাড়া উঠোনে খেলেছে,দৌড়েছে।সারাদিন খাটাখাটুনি করে বাসায় ফিরতেই লেবু শরবত করে দিয়েছে।লেবু না থাক এক গ্লাস ঠান্ডা পানি অন্তত দিয়েছে।শীত আসলেই আমার গায়ে চাদরে মুড়িয়েছে।আমি আমার আম্মার থেকে কতটা ভালোবাসা পেয়েছি।আজ সেই আম্মাটা না-কি সারাজীবনের মতো পরের ঘরে চলে যাবে।ভাবতেই ভীষণ কান্না পায়।আমার আম্মা এত বড় না হলেই ভালো হতো।আমার আম্মা চলে গেলে আমি কি নিয়ে থাকব।মেয়েরা বড় হয় কেন?আর কেন বাবার মায়া কাটিয়ে চলে যায়।স্বাধীনকে কাঁদতে দেখে পুতুলের কান্না পায়।সে ফুফিয়ে কাদে।মাথা নাড়িয়ে ব’লে সে কোথাও যাবে না?মেয়ে এমন পাগলামিতে সায় দিলো না।অনেক বুঝিয়ে চলে আসেন।একটু পরেই পুতুলের গায়ে এক এক করে হলুদ ছোঁয়া হয়।তবে কোনো পুরুষকে সেখানে যেতে দেওয়া হয়নি।পুতুলের জন্য স্বাধীন নিষিদ্ধ করে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here