প্রিয়াঙ্গন #পার্ট_১১ জাওয়াদ জামী জামী

0
181

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_১১
জাওয়াদ জামী জামী

” নানিমা, এই যে গত আট বছর ধরে একটামাত্র ছেলেকে দেখোনি, তোমার কষ্ট হয়না? তোমার কত আদরের ছেলে ছিল সে। কেন তাকে যেতে দিলে? মেয়েদের কথা শুনে, ছেলেকে পর করে দিলে! আজ কোনও মেয়ে কি তোমাকে দেখছে? তুমি তোমার স্বামীর বাড়িতে আছ, তার টাকায়ই তোমার চিকিৎসা চলছে। তবে সেদিন কেন মেয়েদের কথা শুনতে গেলে! আমার বলতে খারাপ লাগছে, তবুও বলতে হচ্ছে, তুমি সারাজীবন মরিচীকার পেছনে ছুটেছ। নিজেও যেমন সম্পর্কের মূল্য দিতে পারোনি, ছেলেমেয়েদেরও তেমনভাবে গড়ে তুলেছ। কি পেলে এসব করে? ছেলেমেয়েরাও আজ তোমাকে বোঝা মনে করে। ” তাহমিদ ফাতিমা খানমের হাত ধরে রেখে করুণ স্বরে বলল।

বাকহীনা ফাতিমা খানম কোন কথা বলতে না পারলেও, তার দুচোখ দিয়ে অনর্গল অশ্রু ঝরতে থাকে। তিনি হাতের ইশারায় তাহমিদকে কিছু বলছেন। তাহমিদ মনোযোগ দিয়ে তার ইশারা বোঝার চেষ্টা করছে।

বৃদ্ধা বেশ কিছুক্ষণ হাত নেড়ে ক্ষান্ত হন। কিন্তু তার কান্না থামলনা। তাহমিদও বুঝতে পারছে ওর নানিমা কি বলতে চায়।

” নানিমা, আমি মামার সাথে যোগাযোগ করব। তাকে দেশে আসার কথা বলব। কিন্তু তারা দেশে আসলে তোমার মেয়েরা যদি তাদেরকে কিছু বলে, সেদিন কিন্তু আমি তোমার মেয়েদের ছেড়ে কথা বলবনা। ”

বৃদ্ধা কাঁপা কাঁপা হাতে তাহমিদের হাত চেপে ধরে কাঁদতে থাকেন।

কুহু ফাতিমা খানমকে খাইয়ে দিয়েই রান্নাঘরে চলে এসেছে। রাজিয়া খালার সাথে হাতে হাত লাগিয়ে কাজ করতে থাকে।

রায়হান আহমেদ ডাইনিং টেবিলে এসে তাহমিদের খোঁজ করলেন। ততক্ষনে নায়লা আঞ্জুমও চলে এসেছে। সে কুহুকে দেখেও না দেখার ভান করে চেয়ার টেনে বসল।

” কুহু মা, সৃজন কোথায়? ওকে ডাক। ”

রায়হান আহমেদের কথা শুনে নায়লা আঞ্জুমের মন বিরক্তিতে ছেয়ে যায়। সে তার স্বামীর নিজের ভাতিজা-ভাতিজীর ওপর এমন আদিখ্যেতা সইতে পারছেনা।

” কুহুপু, সৃজন কই? ওকে তারাতারি ডাক। ” নিশো চেয়ারে বসতে বসতে বলল।

” কুহুপু, তুমি আমাদের সাথে বসবেনা? এসো আজ একসাথে খাই। ” রিশা হাসিমুখে বলল।

” তুমি খাও, রিশা। আমি পরে খাব। সকালে আমি খেতে পারিনা। ”

রাজিয়া খালা সৃজনকে ডাক দিলে সৃজন কুহুর পাশে এসে দাঁড়ায়। নিশো সৃজনকে নিজের পাশের চেয়ারে বসাল।

” কেমন আছো, খালামণি? রিশা, নিশো তোরা কেমন আছিস? ”

” তুমি কখন এসেছ, তাহমিদ! ” নায়লা আঞ্জুম বিস্মিত।

” গতরাতে এসেছি। তা তোমাদের দিনকাল কেমন যাচ্ছে? ” কুহুর দিকে তাকিয়ে নায়লা আঞ্জুমকে জিজ্ঞেস করল তাহমিদ।

” ভাইয়া, আগে আমাদের সাথে কথা বল। পরে আম্মুর সাথে গল্প করবে। তুমি কতদিন পর আসলে! আজকে নাস্তা করেই আমাকে পড়া দেখিয়ে দেবে। তোমার মত করে কেউই পড়ায়না। ” নিশোর গলায় অভিযোগ খেলা করছে।

তাহমিদ ছেলেটার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,

” আগে খেয়ে নে। তারপর বই নিয়ে আসবি। ”

” ভাইয়া, তুমি কুহুপুকে চেন? আর সৃজনকে? ওরা কিন্তু এখন আমাদের সাথেই থাকে। এই সৃজন, তুই ভাইয়ার সাথে কথা বলছিসনা কেন? তুই জানিস আমার ভাইয়া কত ভালো পড়ায়? ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে তার স্টুডেন্টরা তার ওপর ফিদা। ভার্সিটির মোষ্ট হ্যান্ডু টিচার ভাইয়া। আমি ঠিক বলেছিনা, ভাইয়া? ” রিশা একনাগাড়ে কথাগুলো বলে তাকায় তাহমিদের দিকে।

” এই ফাজিল মেয়ে, তুই চুপ করবি? এত বকবক করিস কেন? পড়াশোনা রেখে শুধু চাপাবাজী করা? এতদিন পড়াশোনা কেমন করেছিস, তা একটু পরেই দেখছি। একটা করে ভুল করবি, একটা করে স্কেলের ঘা পড়বে পিঠে। ”

তাহমিদের ধমকে রিশা মুখ কাঁচুমাচু করে এদিকওদিক তাকায়।

” সৃজন, তুমি যেন কোন ক্লাসে পড়ছ? এখানে কোন স্কুলে ভর্তি হয়েছ? ঠিকমত পড়াশোনা করছ তো? কোন টিচারের কাছে পড়ছ? ” এবার সৃজনকে জিজ্ঞেস করল তাহমিদ।

” আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি, ভাইয়া। কলেজিয়েট স্কুলে চাচা আমাকে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে। স্কুলেরই এক স্যারের কাছে পড়ি। ”

” গুড। আমি প্রতি সপ্তাহে দুইদিন এখানে এসে থাকি। আমি আসলে রিশা, নিশো আমার কাছে পড়া দেখিয়ে নেয়। তুমিও ওদের সাথে বই নিয়ে চলে আসবে। আর এখানে থাকতে কোন সমস্যা হচ্ছেনাতো? সমস্যা হলে আমার খালামণিকে বলবে। যখন যেটা প্রয়োজন হবে সব তাকেই বলবে। ” তাহমিদ আড়চোখে তাকায় নায়লা আঞ্জুমের দিকে।

তাহমিদের কথা শুনে নায়লা আঞ্জুমের চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। যা তাহমিদের নজর এড়ায়নি।

টুকটাক কথা বলতে বলতে ওরা খেতে থাকে।
খাওয়া শেষ করে রিশা, নিশো, সৃজন বই নিয়ে ড্রয়িংরুমে এসে তাহমিদের কাছে পড়া দেখিয়ে নেয়।

রাজিয়া খালা টেবিল পরিষ্কার করে রান্নাঘরে বসেই কুহুকে নিয়ে খেয়ে নেয়। যদিওবা কুহু খেতে চায়নি, কিন্তু খালার জোড়াজুড়িতে বাধ্য হয়ে ওকে খেতে হয়। এবং এটা গত বিশদিন যাবৎ প্রতিদিন সকালেই হয়ে আসছে। অন্যদিন তারা ডাইনিং টেবিলেই বসে। কিন্তু আজ তাহমিদ ড্রয়িংরুমে থাকায় কুহু রান্নাঘরে খাওয়ার বায়না ধরলে, খালা তাতে সায় দেয়। খাওয়ার পর কুহু কোচিং-এর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়। তাহমিদ আঁড়চোখে কুহুর চলে যাওয়া দেখে, রিশাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল, কুহু সাহেব বাজারে অবস্থিত একটা কোচিং-এ ভর্তি হয়েছে। ও চালাকি করে কোচিং-এর নামও জেনে নিল।

” মেজো চাচি, আপনার চা এখানেই নিয়ে আসব নাকি ড্রয়িং রুমে গিয়ে খাবেন? ” কুহুর প্রশ্নে মাথা তুলে তাকায় নায়লা আঞ্জুম। তার ঠোঁটের কোনে ঝুলছে তাচ্ছিল্যের হাসি।

” গুড, নিজের পজিশন ঠিকই বুঝে নিয়েছ তাহলে। মন দিয়ে সব কাজ করবে। এখানে থাকছ জন্যেই নিজেকে এই বাড়ির মালিক ভাবতে যেওনা। সব সময়ই একটা কথা মাথায় রাখবে, তোমরা দুই ভাইবোন এই বাড়িতে আশ্রিত। আমার দয়ায় এখানে থাকতে পারছ। তাই একটু কৃতজ্ঞতা তোমাদের কাছ থেকে আশা করতেই পারি। আর সেই কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আশা করব তোমার চাচাকে কিছুই জানাবেনা। ”

” না চাচি, কাউকেই কিছু জানাবোনা। আমরা খুব ভালো করেই জানি, এখানে আমরা আশ্রিত। তাই এই বাড়িতে নিজের বাড়ি ভাবার কোন প্রশ্নই আসেনা। তবে আশা করছি বেশিদিন এখানে আমাদের থাকতে হবেনা। তিনমাসের মধ্যে কিংবা এ্যাডমিশনের পর কিছু একটা ব্যবস্থা করে ফেলব। আপনার ঘাড়ে বোঝা হয়ে থাকার ইচ্ছেও আমার নেই। আপনার চা কি এখানেই নিয়ে আসব? ”

কুহুর সোজাসাপটা উত্তর শুনে নায়লা আঞ্জুম কপাল কুঁচকে তাকায়। ঠোঁট ভেংচে হেসে উঠল।

” এখানেই নিয়ে এস। আজ তোমার কনফিডেন্স দেখে একটা প্রবাদই মনে আসছে, ছাল নাই কু’ত্তা’র বা’ঘা নাম। মুরোদ থাকলে তো আর এখানে এসে পরে থাকতেনা। সেই আবার গলা উঁচিয়ে কথা বলে! ”

কুহু বুঝতে পারছে এই মুহূর্তে চাচির সাথে বিতন্ডায় জড়ানো ঠিক হবেনা। কিন্তু নায়লা আঞ্জুমের কথা শুনে ওর চোখে পানি এসেছে ঠিকই। তার তিক্ত কথার বাণ কুহুর বুকে আঘাত করেছে।

ঘোর অমানিশা। আকাশ সেজেছে আঁধারের ঝালোর নিয়ে। গায়ে মেখেছে অমাবস্যার প্রলেপ। মৃদুমন্দ হাওয়া ছুঁয়ে দিচ্ছে বিটপীদের শাখা-প্রশাখা। হাওয়ার তোড়ে যেন দুলছে ধরাধাম। আশেপাশে কোথাও একনাগাড়ে ডেকেই চলেছে ঝিঁঝিঁদের দল। কয়েকটা রাতচোরা পাখি উড়ে গেল মেঘেদের গা ছুঁয়ে দিয়ে। ইট-পাথরের এই রাজ্যে পাখিদের কদাচিৎ দর্শন পাওয়া যায়।

কুহু মুখ তুলে উর্ধ্বাকাশে চাইল। ঘন আঁধারে ছাওয়া অম্বরে পাখির দলকে দেখার বৃথাই চেষ্টা করল সে। ওর কানে শুধু বাজল একঝাঁক পাখির কিচিরমিচির ধ্বনি।
হাওয়ায় দুলছে ওর কৃষ্ণবরণ কেশরাশি। আজি এ কৃঞ্চকালো রজনীতে উন্মুক্ত অন্তরীক্ষ তলে এক শ্যামাঙ্গীনি অষ্টাদশী কন্যার ডাগর আঁখিতে জমা হয়েছে এক সরোবর অশ্রুরাশি। তার আঁখিতে জমেছে অভিযোগের পাহাড়। কেন ওরা আজ অবহেলিত? কেন পরিজনদের নিকট ওরা বোঝা? বারবার খুঁজে চলেছে প্রশ্নগুলোর উত্তর।

” এত রাতে তুমি বাহিরে কি করছ! তোমার ভয় করছেনা? ”

কারও গলা শুনে চমকে উঠে কুহু। পাশে তাকিয়ে দেখল তাহমিদ দাঁড়িয়ে আছে। তাহমিদকে দেখে আপনাআপনিই ওর মাথা নিচু হয়ে যায়। কন্ঠায় এসে মুখনিঃসৃত বাণী আটকে গেছে।

” কি ব্যাপার? এমন সাইলেন্ট মোডে কনভার্ট হলে কেন? শোন মেয়ে, সাইলেন্ট মোড আমার ভিষণ অপছন্দের। চাইলে ভাইব্রেট মোডেও যেতে পারো, কিন্তু আমার সামনে আসলে সাইলেন্ট মোড সাইডে রাখবে। এবার ভায়োলেন্ট মোডে আসো জলদি। ” কুহুর মুখের তুড়ি বাজিয়ে বলল তাহমিদ।

” ঘুম আসছিলনা, তাই বাগানে এসেছিলাম। ” অস্ফুট স্বরে বলল কুহু।

” বাগানে কি ঘুমের ঔষধের বীজ পুঁতে রাখা আছে! বীজ থেকে কি চারাগাছ জন্মায়? কতবড় হয় সেই গাছ? ফুল-ফল কিছু ধরে সেই গাছে? ফুলের সুবাস আছে? ফল কি মিষ্টি হয়? ঘুম গাছের ফুল দিয়ে কি বাসর সাজানো যায়? ”

” কিহ্! ”

কুহুর মুখে আর কোন কথা জোগায়না। ওর মনে কেবল একটা কথাই বাজছে, সামনে দাঁড়ানো এই লোক বিরাট মাপের ত্যাঁদর। এর আশেপাশে থাকলেই শুধু খোঁ’চা হজম করতে হবে। তাই ও বাসায় যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।

” আমি চিন্তা করে দেখলাম, ঘুম গাছের ফুল দিয়ে বাসর সাজালে আমার লস হয়ে যাবে। তাই সেই প্ল্যান ক্যান্সেল। বউকে ভালোবেসে ঘুম পাড়াতে হয়। বউ জাতী হয় ভালোবাসায় কাবু। তাদের ভালো……

তাহমিদ কথা শেষ করতে পারলনা। তার আগেই কুহু হুড়মুড়িয়ে বাসার ভেতর ঢুকে গেছে।

তাহমিদ গমনরত কুহুর পানে তাকিয়ে হো হো করে হেসে উঠল।

বিঃদ্রঃ আমি সংসারের যাবতীয় কাজ সামলে লিখার চেষ্টা করি। তাই প্রতিদিন গল্প দেয়া সম্ভব হয়না। আপনারা প্রতিদিন গল্প চাইলেও, আমি লিখতে পারিনা বিষয়টি আমার কাছে ভিষণই খারাপ লাগে। আমি আমার অপারগতার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী।
ও হ্যাঁ, আজ সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত একটু একটু করে লিখতে লিখতে ২০০০ শব্দ লিখেছিলাম। কিন্তু আমার ভুলের কারনে ডিলিট হয়ে গেছে। তাই সন্ধ্যায় আবার লিখতে শুরু করি। তাই আজকের পার্ট ছোট হয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here