#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_১৪
জাওয়াদ জামী জামী
পুরোটা পথ কুহু গুটিসুটি মে’রে বসে রইল। তাহমিদও পূর্বের ন্যায় পেছনে হাত রেখে কুহুকে নিরাপদ রাখতে তৎপর।
শেষ বিকেল। উর্ধ্ব অম্বরে লালাভ দিবাকর আঁধারের কোলে ঢলে পড়বার আয়োজনে মত্ত। ঘন সবুজ বৃক্ষরাজির শাখে-প্রশাখে ঝাঁকে ঝাঁকে বিহঙ্গের কলতানে চারপাশ মুখরিত। কুহু মুখ তুলে বিহঙ্গের দলকে দেখার বৃথাই চেষ্টা করল।
এক প্রেমিক পুরুষের হিয়া এই র’ক্ত রাঙ্গা বিকেলে সদ্য ফোটা হিজলের ন্যায় প্রস্ফুটিত হলো। সে আঁড়চোখে থেকে থেকেই দেখে চলেছে তার হৃদয়হরণীকে। তার চোখের তৃষ্ণা কিছুতেই মিটছেনা। সে গত দুইমাসের বেশি সময় ধরে নিজের সাথে বোঝাপড়া করে ক্লান্ত। দূরত্বের অনলে সে জ্বলছে। অপেক্ষার প্রহর আজ তার বুকে জগদ্দল পাথরের ন্যায় চেপে বসেছে। তবে তাহমিদ তার শ্যামাঙ্গীনিকে পাওয়ার জন্য অপেক্ষায় কাটাতে পারে। সে যতই কষ্ট হোকনা কেন। সে কোন সামান্যতম ভুলের জন্যও তার শ্যামাঙ্গীনিকে হারাতে চায়না। দীর্ঘশ্বাস গোপন করে সূদুরে তাকায় তাহমিদ।
বাসার সামনে রিক্সা এসে দাঁড়ালে কুহুকে নামতে বলল তাহমিদ। কুহু রিক্সা থেকে নেমে ব্যাগ থেকে টাকা বের করে রিক্সাওয়ার সামনে বাড়িয়ে দিতেই তাহমিদ ওর দিকে কটমটিয়ে তাকায়।
” তোমার টাকা দিয়ে তুমি কয়েক হালি হাঁসের ডিম কিনে খেও, গা’ধা মেয়ে। তাতে যদি একটু বুদ্ধি খোলে। টাকা নিয়ে চুপচাপ ভেতরে যাও। ”
তাহমিদের ধমক খেয়ে কুহু সুড়সুড় করে ভেতরে প্রবেশ করল। ওকে ভেতরে যেতে দেখে তাহমিদ রিক্সাওয়ালাকে রিক্সা ঘোরাতে বলল।
বাসায় ঢুকতেই রাজিয়া খালা কুহুকে জরুরীভাবে নিজের কাছে ডাকলেন। কুহু পোশাক পাল্টে খালার কাছে যায়।
” খালা, এত জরুরী তলব কেন? কি হয়েছে? ”
” মাগো, তুমি একটু চিংড়ির মালাইকারী কইরা দিবা? তাহমিদ বাপজান মেলা বাজার কইরা আনছে। সেইগুলান সামাল দিতেই আমার সইন্ধ্যা হইয়া যাইব। বাপে আমার চিংড়ির মালাইকারী পছন্দ করে। দেখ কতগুলা চিংড়ি আনছে! এই টাটকা মাছগুলান যদি না রাইন্ধা তুইলা রাখি, সেইডা কি ভালো দেখায়? ”
খালার কথা শুনে কুহু বেশ অবাক হয়েছে।
” উনি বাজার করেছেন কেন, খালা! ফ্রিজে মাছ-মাংস সবইতো আছে। ” কুহু সবিস্ময়ে জানতে চাইল।
” বাপজানে প্রতি সপ্তাহেই বাজর করে। সে রাজশাহী নাইমাই বাজারে যায়। একগাদা বাজার হাতে নিয়া তবেই বাসায় ঢোকে। খালি গত তিনদিন আগে যে আইছিল তখন বাজার নিয়া আসেনি। সেই বাজার পরেরদিন করছিল। আর আইজকা খাইয়া সোজা বাজারে গেছিল। ”
” কিন্তু তিনি বাজার করবেন কেন? ”
” তুমি তারে চেননা, মা। সে কারও দয়া নিবার চায়না। কিংবা এইখানে প্রতি সপ্তাহে আসার জন্য, থাকার জন্য কোন কথা হোক তা সে চায়না। তাই এইখানে আসলে বাজার করে। সে প্রতি সপ্তাহে এই বাসায় একটু শান্তির জন্য আসে। এছাড়া তার নানিমা অসুস্থ। সে আবার নানিমার ভক্ত। নানিমারে না দেইখা সে থাববার পারেনা। আম্মায় বিছানা নেয়ার পর থাইকা পোলাডা খুব কষ্ট পাইতাছে। ”
কুহু খালার কথা শুনে খুব অবাক হয়। ততক্ষণে খালা ওর দিকে চিংড়ির পাত্র এগিয়ে দিয়েছেন। কুহু আর কোন কথা না বলে চিংড়িগুলো কা’ট’তে শুরু করে।
” বেইবি, কখন এসেছ তুমি! তোমার জন্য চিন্তা করতে করতে আমার হার্ট শুকিয়ে গেছে। সে প্রতি মিনিটে মাত্র দশবার বিট করছে। আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তুমিই পারো আমাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে। তারাতারি এসে একটা কিসি দিয়ে আমার হার্টকে স্বাভাবিক করে দাও। ”
এতক্ষণ কুহু দিব্যি জয়কে ভুলে ছিল। হঠাৎ করেই ওর সামনে জয় এসে কথা বলাতে মেয়েটা ভয়ে কেঁপে উঠল। ও দ্রুতই রাজিয়া খালার আড়ালে গিয়ে লুকায়। একহাতে ধরে রেখেছে খালার বাহু।
রাজিয়া খালা জয়ের এরূপ কথায় রা’গ করলেও ওপরে ওপরে শান্ত থাকলেন। তবে তিনি কুহুকে রক্ষা করতে ভুল করলেননা।
” জয় বাবা, তুমি এইখানে ক্যা? কি লাগব কও, আর নিজের ঘরে যাও। আমি তোমার ঘরে নিয়া আসতাছি। ”
” খালা, আমার যেটা লাগবে সেটা তুমি দিতে পারবেনা। তোমার আড়ালে দাঁড়ানো ঐ হটি কুইনই পারবে আমার সব সমস্যার সমাধান করতে। তুমি ওকে আমার রুমে পাঠিয়ে দাও। ” জয় জিহবা দিয়ে ঠোঁট ভেজাল।
” জয় বাবা, তুমি এখনই এইখান থাইকা যাইবা। নইলে আমি কিন্তু তোমার আম্মারে এখনই ডাক দিমু। সাথে তোমার খালামনিরেও ডাকমু। ”
খালার কথায় এবার কাজ হয়। তার কথা শুনে জয় একটু থমকে যায়। সে আর কিছু না বলে কুহুর দিকে অগ্নী দৃষ্টি হেনে প্রস্থান করল।
জয় চলে যেতেই কুহু খালার পেছন থেকে বেরিয়ে আসে।
” শোন মাইয়া, দুনিয়াডা খুব একটা সহজ জায়গা নয় কইলাম। এখানে টিক্কা থাকতে হইলে তোমারে শক্ত হইতে হইব। অল্পতেই এমন কুঁকড়ে গেলে হইব? তোমার বাপ-মা কেউই নাই। নিজের ছোট ভাইডার দ্বায়িত্ব এখন তোমার উপর। নিজের পাশাপাশি তারেও মানুষ করনের দ্বায়িত্ব তোমার। সেই তুমিই যদি এত অল্পেই ভয়ে পিছায় যাও, তাইলে লড়াই করবা কেম্নে? নিজের মনোবল বাড়াও, মাইয়া। কে তোমার ভালো চায়, আর কে ক্ষতি করবার চায়, প্রথমেই তাগোরে চিনতে শিখ। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শিখ। তুমি লেখাপড়া জানো। ভবিষ্যতে আরও ম্যালা পড়াশোনা করবা। নিজের জীবনকে নিজেই গড়তে পারবা। তাইলে এত ভয় কিসের? আল্লাহর উপর ভরসা আর নিজের প্রতি আত্নবিশ্বাস থাকলে তোমারে উপরে আগায় যাইতে ঠ্যাকায় কার সাধ্যি? ”
কুহু অবাক হয়ে খালার কথা শুনছিল। এক অশিক্ষিত বয়োবৃদ্ধা তাকে এভাবে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল! সত্যিই কি ও শক্তিহীনা! নিজের দ্বায়িত্ব সম্পর্কে সজাগ নয়? সেই সাথে আরেকটা কথা মনে হতেই ওর বুক শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। এটা জয়ের নানার বাড়ি। আর সে এই বাড়ির নাতি হিসেবে যখন খুশি তখন এখানে আসবে। আর সে এখানে আসলেই কুহুর সাথে অসভ্যতা করবে। কতদিন ও জয়ের কাছ থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখবে? আর কিন্তু ভাবতে পারছেনা কুহু। নিজেকে আজ বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে। আজ আরেকবার বাবা-মা’ র শুণ্যতা ও হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছে।
” দোস্ত, চল বাসায় যাই। মায়া অলরেডি তোর জন্য রান্না শুরু করে দিয়েছে। তুই না গেলে ও মন খারাপ করবে। ”
সজল অনুনয় করছে। কিন্তু তাহমিদ ওর সিদ্ধান্তে অনড় থাকে। ও আপাতত সজলের কথা কানে না নিয়ে ক্যাম্পাসের বৃক্ষদ্বয়ের আড়ালে সূর্যের লুকোচুরি দেখতে ব্যস্ত। কিন্তু সজলের সেদিকে খেয়ালই নেই। ও তাহমিদকে নিজের বাসায় নেয়ার জন্য ঘ্যানঘ্যান করছেই।
” ধুর শা’ লা, তোর কাছে এসেছি একটু রিল্যাক্স করতে। কিন্তু তুই দেখছি আমাকে আরও বেশি প্যারা দিচ্ছিস! বললামইতো আজকে তোর বাসায় যাবনা। কিন্তু তুই আমার কথা না শুনে মায়াকে ফোন করলি। আজকে আমার ভাগের খাবারও তুইই খাস। এতে তোর বউয়ের কষ্ট একটু লাঘব হবে। ”
সজল কিছু বলতে চাইলেই চারপাশে মাগরিবের আজানের সুমধুর ধ্বনি শুনতেই চুপ করে যায়। দুই বন্ধু মনযোগ দিয়ে আজান শুনছে।
” বাপজান, তুমি এত দেরি কইরা আসলা? এদিকে চিংড়ির মালাইকারি ঠান্ডা হইয়া গেছে। বাজার করবা ঠিকই কিন্তু একবারও গরম গরম খাইবানা। ”
” আরিব্বাহ খালা, তুমি আজকেই মালাইকারি করে ফেলেছ! খালা, তুমি গ্রেট। ” চেয়ার টেনে বসে গ্লাসে পানি ঢালছে তাহমিদ। তিন ঢোকে পুরো গ্লাসের পানি শেষ করল।
” বাপজান, আমি আইজকা রান্ধিনাই। আইজকা কুহু মা’য়ে রান্ধছে। ”
খালার কথা শুনে তাহমিদ বাম ভ্রু উচু করে কুহুর দিকে তাকায়। মেয়েটা তখন ডালে ফোড়ন দিতে ব্যস্ত। ওর অন্য দিকে তাকানোর সময় নেই। ড্রয়িংরুমে রিশা, নিশো, সৃজন হৈ-হুল্লোড় করেছে। তাহমিদ ওদেরকে দেখে মৃদু হেসে খালার সাথে কথা বলতে শুরু করল,
” খালা, আমাকে দিবা? মানে চিংড়ির মালাইকারি। একটু টেস্ট করে দেখতাম কেমন রান্না করে তোমার গা’ধী মা। ”
তাহমিদের কথা শুনে কুহুর রা’গ হয়। লোকটা বিকেলেও একবার ওকে গা’ধা বলেছে। কুহু ভেবে পায়না লোকটা কেন ওকে কারনে-অকারনে খোঁ’চা দেয়। ওপরে ওপরে লোকটাকে যতটা ভালো মনে হয়, ততটা ভালো সে নয়।
” এই নেও বাপজান, তোমার মালাইকারি। খাইয়া কও কুহু মা’য়ে কেমন রান্ধছে। ” রাজিয়া খালা তাহমিদের দিকে একটা বাটি এগিয়ে দেন।
তাহমিদ বাটি থেকে একটা চিংড়ি নিয়ে মুখে তুলতে গিয়েই থেমে যায়। কিছু একটা ভেবে খালার দিকে তাকায়
” খালা, তোমার মা’কে আগে খেতে বল। সে যদি হিংসা করে এতে কিছু মিশিয়ে দেয়? কিংবা দেখা গেল লবন দিয়ে তিতা করে রেখেছে। আমি বাপু আমার জিহ্বার স্বাদ নষ্ট করতে চাইনা। বরং সে-ই আগে খেয়ে এটার টেস্ট ঠিক আছে কিনা বলে দিক। তারপর নাহয় আমি খাব। ”
তাহমিদের কথা শুনে কুহু চরমমাত্রায় অবাক হয়ে খালার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। ও মনে মনে তাহমিকদে হাজারটা গালি দিচ্ছে।
” কতবড় বদ হলে একটা মানুষ এভাবে কথা বলতে পারে! তার সাথে আমার কোন জন্মের শত্রুতা আছে, যে সে আমাকে এভাবে খোঁ’চা দিচ্ছে? অসহ্য লোক একটা। শাখামৃগ, মুখপোড়া হনুমান। ” কুহু বিরবিরিয়ে তাহমিদের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করছে।
” খালা, তাকে ওয়াজ করা বাদ দিয়ে এখানে আসতে বল। সে ওয়াজ পরেও করতে পারবে। মুখের সামনে লোভনীয় খাবার রেখে বসে থাকা কত যে কষ্টের সেটা শুধু আমিই জানি। ”
” খালা, উনাকে বলে দিন আমি এখন কিছুই খাবনা। প্রয়োজনে আপনি খেয়ে তাকে বলুন সব ঠিক আছে কিনা। ” কুহু গলা চড়িয়ে বলল।
” পা’গ’ল নাকি! খালা, যে রান্না করেছে, সে-ই আগে টেস্ট করবে। কেউ যদি আমার কথা না শোনে, তবে কিন্তু আমি তাকে জোড় করে খাওয়াব। এটাই ফাইনাল। ”
” ও মা কুহু, একটা খাইয়া দেখনা। বাপজানের কথা শুন। ”
রাজিয়া খালার জোড়াজুড়িতে কুহু গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসল ডাইনিং টেবিলের কাছে। তাহমিদের সামনে থেকে বাটি নিজের দিকে এগিয়ে নিয়ে একটা চিংড়ি হাতে তুলে নেয়। চিংড়িটা মুখে দেয়ার আগে একবার তাকালো ড্রয়িংরুমে বসে থাকা সৃজনের দিকে।
কোনরকম চিংড়িটা খেয়ে রান্নাঘরে যায় কুহু।
” খালা, উনাকে বলুন তরকারিতে লবন পরিমান মতই হয়েছে। তিনি নির্দিধায় খেতে পারবেন। ”
কুহুর কথা শুনে তাহমিদ স্মিথ হেসে ডাক দেয় রিশা, নিশো আর সৃজনকে।
” খালা, বাটিতে আরও কয়েকটা চিংড়ি দাও। আমার ব্যাটেলিয়নরা টেস্ট করলেই তবে আমি খাব। ”
ওরা তিনজন ডাইনিং টেবিলের কাছে আসতেই খালা ওদের সামনে মালাইকারির বাটি রাখল।
কুহু আরও একবার অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সামনের সুদর্শন মানুষটার দিকে। এই মানুষটাকে চেনা বড় দায়। এই মনে হয় সে চুড়ান্তমাত্রার অসভ্য, তো পরক্ষণেই মনে হয় এটা তার আসল রূপ নয়। সে আসলে নিজেকে যেমনভাবে উপস্থাপন করে তেমনটা সে মোটেও নয়।
চলবে…..