#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৪০
জাওয়াদ জামী জামী
” ছেলে আর ছেলের বউকে সাথে নিয়ে ডিনার করে খুব শান্তি পেয়েছ তাই না? এখন কি মনে হচ্ছে, এতদিন এত সুখ থেকে নিজেকে বঞ্চিত রেখেছিলাম কেন? যতসব লো ক্লাস মেন্টালিটি। এক দেখাতেই ছেলের বউ তার আপন হয়ে গেছে। এখন আমি যেন আর কেউনা। ড্যাং ড্যাং করতে করতে ছেলে আর ছেলের বউকে নিয়ে ডিনার করল। ঐ থার্ড ক্লাস মেয়ের সামনে নিজেকে দ্বায়িত্বশীল শ্বশুর হিসেবে পরিচিত করল। ” ডেইজি কুরাইশি রা’গে গজগজ করতে করতে কথাগুলো বলল।
স্ত্রী ‘র কথা শুনে রাশেদ কুরাইশি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন। তিনি বলার জন্য কোন শব্দ খুঁজে পাচ্ছেননা। কি অবলীলায় তার স্ত্রী এসব বলছে, ভেবেই তিনি বিস্মিত হচ্ছেন। অথচ ডিনার করতে যাওয়ার আগে তিনি ডেইজি কুরাইশিকে তার সাথে যাওয়ার জন্য অনেক জোর করেছেন। কিন্তু সে তার কোন কথাই শোনেনি।
” কয়দিন পর দেখব আমার ছেলেমেয়েদের ফাঁকি দিয়ে সব প্রপার্টি ঐ অসভ্য, ছোটলোক ছেলেকে দিয়ে বসে আছে। এখন ছেলেই সব। আমার রায়ান আর জাহিয়া কিছুই নয়। সব ঐ অসভ্যটার অবদান। ” রাশেদ কুরাইশিকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে ডেইজি কুরাইশি তার কথা চালিয়ে যেতে থাকে।
এবার আর রাশেদ কুরাইশি চুপ করে থাকলেননা। তিনি রে’গে উঠলেন।
” তুমি চুপ করবে? আমার কাছে আমার তিন সন্তানই সমান। তাহমিদ রায়ান, জাহিয়ার থেকে আমার কাছে কোনও অংশেই কম নয়। আমার সব প্রপার্টি ওদেরকে সমান ভাগে ভাগ করে দেব। এই নিয়ে আর একটা কথাও শুনতে চাইনা। ” রাশেদ কুরাইশি আর কথা না বাড়িয়ে একটা বই হাতে নিয়ে রকিং চেয়ারে বসলেন।
রুমে এসে কুহু মাথার ঘোমটা ফেলে দেয়। এতক্ষণ ঘোমটার আড়ালে থেকে ওর হাঁসফাঁস শুরু হয়েছে। তাহমিদ রুমে এসে বেলকনির দরজার খুলে পর্দা সরিয়ে দেয়। পর্দা সরিয়ে দিতেই হু হু করে বাতাস রুমে ঢুকল। হঠাৎই ঠান্ডা বাতাসের পরশ পেতেই কুহু বাহিরে তাকায়। রাতের কৃত্রিম আলোয় উদ্ভাসিত এই বাড়ির এরিয়া। কৃত্রিম আলোরছটায় চাঁদের আলোর দেখা পাওয়া মুশকিল। তবুও ধীর পায়ে বেলকনির দিকে এগিয়ে যায়। একটু যদি চাঁদের আলোর পরশ শরীরে নেয়া যায়। কুহুকে বেলকনির দিকে যেতে দেখে তাহমিদও ওর পিছু পিছু যায়।
মেয়েটা রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। ওর দৃষ্টি দূর ছায়ালোকের দিকে। যেখানে ভেসে বেড়াচ্ছে হাজারো তারকারাজি। গায়ে মেখেছে চাঁদের আলোর রূপালী ঝর্ণা।
তাহমিদ পেছনে দাঁড়িয়ে আচমকা জড়িয়ে ধরল কুহুর কোমড়। তাহমিদের স্পর্শে কুহু কেঁপে উঠল। তাহমিদ ধীরে ধীরে ওর হাত কুহুর উন্মুক্ত পেটের দিকে নিয়ে যায়। থুতুনি রাখে কুহুর খোলা কাঁধে। তাহমিদের দাড়ির ঘষাষ শিরশিরিয়ে উঠল কুহুর তনু। অসার হয়ে আসে ওর সর্বাঙ্গ। এদিকে পেট জুড়ে তাহমিদের ছোঁয়া ধীরে ধীরে গাঢ় হচ্ছে। কুহু ঠোঁট কামড়ে সহ্য করছে তার একান্ত পুরুষের ভালোবাসার অত্যাচার। যে অত্যাচারে নেই কোনও দুঃখ, কষ্ট। তাহমিদের হাত এতক্ষণ কুহুর পেটে বিচরণ করছিল, এবার সে কুহুর খোলা কাঁধে ছোট ছোট চুমুতে ভরিয়ে দিচ্ছে।
অনেকক্ষণ পর কুহুর হুঁশ হয় ওদেরকে এই অবস্থায় কেউ যদি দেখে! ও হুট করেই তাহমিদকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দেয়। কুহুর ধাক্কায় তাহমিদ ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকায়।
” এভাবে রোমাঞ্চের চৌদ্দটা না বাজালেই কি হচ্ছিলনা! নিষ্ঠুর রমনী। নিজেও ভালোবাসবেনা, আবার আমি ভালোবাসতে গেলেই দূরে সরিয়ে দেয়। আমার কপালে বউয়ের আদর নেই। ”
” ছিহ্ এসব কি বলছেন! আপনার দেখছি লজ্জা শরমের বালাই নেই। আশেপাশে কত বিল্ডিং। কেউ আমাদের এই অবস্থায় দেখলে কি ভাববে বলুনতো? ”
তাহমিদ কুহুর কথা পাত্তা না দিয়ে ওকে কোলে তুলে নেয়। এরপর বেলকনির মেঝেতে পাতা বিছানায় ওকে নিয়ে বসল। তাহমিদ কুহুকে কোলে নিয়েই বসেছে। ওর নড়াচড়ার কোন উপায় রাখেনি।
” কেউ দেখলে দেখবে। আই ডোন্ট কেয়ার। আমি আমার বউকে আদর করছি। এতে লজ্জার কিছুই নেই। এত কম কম আদর করলে দুই ডজন ছানাপোনা কেমন করে আসবে! ”
” কিহ্, দুই ডজন! আপনার মাথা ঠিক আছে? নাকি মেয়াদোত্তীর্ণ কিছু খেয়েছেন? ”
” বউ, তুমি ভালো করেই জানো আমি আজেবাজে কিছু খাইনা। তোমার বর একদম বিশুদ্ধ, নিষ্পাপ আর অসহায়। ”
” জানিনা আবার। ”
” কি জানো? ” তাহমিদ কুহুর গলায়, কাঁধে গাল ঘষে বলল।
” আপনি একদম খাঁটি মানুষ। ”
” গুড। একমাত্র জামাইয়ের জন্য সব সময়ই এমন ভালো ধারনা পোষণ করবে। এতে আমার ছানাপোনারাও তাদের বাবাকে বেশি বেশি ভালোবাসবে এবং বাবার ভক্ত হবে। তাদের সামনে বেশি বেশি আমার সুনাম করবে। ”
” হুম করব সুনাম। ”
” গুড। ”
” শুনুন। ”
” বলুন। ”
” বাবাকে আমার বেশ লেগেছে। তিনি আমাকে কত যত্ন করে খাওয়ালেন। আবার আপনারও খেয়াল রাখলেন। এতদিন আপনি শুধু শুধু তার ওপর রা’গ করেছেন। ”
” এক বেলাতেই পটে গেছ! কয়েকদিন এখানে থাক। তার স্বরূপ তোমার সামনে উন্মোচিত হোক। তারপর বল তিনি কেমন। আগে পটে গেলে মানুষ চেনার পর কষ্ট পাবেতো। আর আমি চাইনা তুমি কষ্ট পাও। ”
” আবারও? আপনি এমন কেন! কি হয় বাবার সাথে ভালো করে কথা বললে? ”
” কিছুই হয়না। তার সাথে ভালো করে কথা বললে আমি কি একটা সুস্থ শৈশব, কৈশোর কিংবা স্বাভাবিক যৌবন ফিরে পাব? ”
” জানি, সেসবের কিছুই পাবেননা। কিন্তু আপনার স্বাভাবিক কথাবার্তায় যে বাবা খুশি হবেন। আমি লক্ষ্য করেছি, বাবা আপনার সাথে কথা বলার জন্য সুযোগ খুঁজে বেড়ান। একজন বাবাকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করবেননা। আমি জানি আপনার কাছে বিষয়টা অনেক কঠিন। তবুও একজন বাবাকে খুশি রাখতে এতটুকু করাইতো যায়। ”
” সারাজীবন শুধু অন্যকে খুশ করে যাব? তবে আমি কেন একটু খুশির স্বপ্ন দেখতে পারিনা? আমার চারপাশ কেন আঁধারে ছাওয়া? কি দোষ ছিল আমার? ”
” আপনার কোনই দোষ ছিলনা। আপনি দু’জনের মাঝে সম্পর্কের টানাপোড়েনে পিষ্ট হয়েছেন। যার প্রভাবে আপনার অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যত পথও কণ্টকাকীর্ণ হয়েছে। আপনার চারপাশ আঁধারে ছাওয়া ঠিকই। কিন্তু আপনি নিজে একজন আলোর দিশারি। যার আপাদমস্তক আলোয় ঝলমল করে, ঝলমলে রোদ্দুরের ন্যায়। থাকুকনা তার চারপাশে আঁধার। সেই আঁধার কভু আপনাকে ছুঁতে পারবেনা। ঝলমলে রোদ্দুরের তেজোদ্দীপ্ত বর্ণচ্ছ্বটায় আঁধার কি তার পাখনা মেলতে পারে? ”
” তুমি সবটা জানোনা তাই এভাবে বলতে পারছ। ” তাহমিদ বিষাদ মাখা গলায় বলল।
” আমি সবই জানি। খালা একদিন আমাকে অনেককিছুই বলেছেন। আপনি জীবনে যা যা সহ্য করেছেন, তারপরও যে আপনি নিজেকে এভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন, তা কয়জন পারে? আপনি অনেকের অনুপ্রেরণা হওয়ার ক্ষমতা রাখেন। ”
” কি ব্যাপার বউ, আজ আমার এত প্রশংসা করছ কেন? আমিতো দেখছি খুশিতে পা’গ’ল হয়ে যাব। বউয়ের প্রশংসা পেতে ভাগ্য লাগে। আজকে আমার ভাগ্য দেখছি সুপ্রসন্ন! ” তাহমিদ একটু হেসে ভরাট কন্ঠে বলল।
” চুপ করবেন? টিটকারি মা’র’ছেন কেন! আমি যা কিছু বলেছি, সবটাই সত্য। ” কুহু অভিমানে মুখ ফোলায়।
” আমি কখন বললাম, তুমি মিথ্যা বললে! আমিতো নিজের প্রশংসা শুনে হাওয়ায় ভাসতে শুরু করেছি। আরেকটু প্রশংসা করলে প্লেন ছাড়াই অন্য মহাদেশে উড়াল দেব। ”
” আবার? আপনি সত্যিই একটা বদ লোক। ”
” এইতো সত্যি কথা বের হয়েছে। আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেই আরও কিছু শুনতে পাব। তাইতো বলি, বউ করবে জামাইকা প্রশংসা! বউ জাতির সৃষ্টিই হয়েছে জামাইয়ের পেছনে কাঠি নাড়তে। ”
” এই আপনি আমাকে এখনই ছাড়ুন। আপনার সাথে কোন কথা নেই। জীবনেও আপনার প্রশংসা করবনা। আপনি একটা যাচ্ছেতাই। আমি তার সাথে একটু সুখ-দুঃখের গল্প করতে চাইলাম, আর সে আমার সাথে মজা করে। আসলে সে চায়না, তার জীবনের গল্প আমার সাথে শেয়ার করতে। ” কুহু তাহমিদের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়াতে চাইলেও তাহমিদের শক্তির সাথে পেরে উঠেনা। বাধ্য হয়ে ওকে তাহমিদের কোলেই থাকতে হয়।
” যে ছেলে ছোট থেকেই বাবা-মা ‘র মনোমালিন্য দেখতে দেখতে বড় হয়েছে। নয় বছর বয়সে যাকে তার মা ফেলে রেখে অন্য কারও হাত ধরে চলে যায়, যার বাবা অন্য নারীতে মত্ত সেই ছেলের জীবন কি এতই সহজ? প্রতিনিয়ত তাকে মানুষের কটুকথা শুনতে হয়েছে। এভাবেই চলতে থাকে বছরের পর বছর। ভ্যাগাবন্ডের ন্যায় এদিকওদিক ঘুরে বেড়ায়। যার জীবন নানিমা আর রাজিয়া খালা নামক মানুষ দুটো ছাড়া আর কারও অস্তিত্ব ছিলনা। তবে মাঝেমধ্যে শাহানা ফুপু এসে আদরে ভরিয়ে দিত। একটা সময় সে সংসার না করার পণ করে। কিন্তু একদিন হঠাৎই এক কান্নাভেজা চোখে সে আটকে যায়। আটকে যায় শ্যামাঙ্গীনি এক কিশোরীর মায়াময় মুখে। তার হৃদয়মাঝে আটকে থাকা ভালোবাসা উছলে পরে। সে বহু বছর পর জানতে পারল, তার ভেতরও ভালোবাসা বাস করছে। যে ভালোবাসার জোয়ারে সে সবকিছু ভাসাতে প্রস্তুত। সেইদিনই তার সকল পণ জলাঞ্জলি দিয়ে সেই কিশোরী কন্যাকে নিজের করে পেতে চায়। একটা সময় সে পেয়েও যায় তার কিশোরী কন্যাকে যতটা আপন করে পেলে দু’জনের মাঝে কোন লজ্জার বালাই থাকেনা, যতটা আপন করে পেলে দুনিয়াকে তুচ্ছ করতে ইচ্ছে করে। সেভাবেই সে পেয়েছে তাকে। আজ এই মধুর রজনীতে সেই কিশোরী কন্যা তার নিজস্ব পুরুষের কোলে বসে সেই কথাই শুনছে। আর কিছু শুনতে চাও আমার শ্যামাঙ্গীনি? ” তাহমিদের দরদ মাখানো কথা শুনে কুহু বিমোহিত নয়নে তাকায়।
তার কথাগুলো কুহুর বুকে আছড়ে পরল বাঁধভাঙা ঢেউয়ের ন্যায়। যে ঢেউয়ের তোড়ে কুহু যেকোন পরিস্থিতিতে ভাসতে রাজি। হারাতে রাজি মধুমাখা প্রেমহিল্লোলে। কোথায় থেকে একরাশ আবেগ এসে কুহুকে জড়িয়ে নেয়। সে-ও স্থান কাল ভুলে তাহমিদের গলা জড়িয়ে ধরে, তার পানে চায় নেশাক্ত চোখে। ওর ঠোঁট তিরতির করে কাঁপছে।
তাহমিদ হেসে তার রমনীর ঠোঁট ঠোঁট ডুবায়।
চলবে…