এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায় #পর্বসংখ্যা_০১ #মৌরিন_আহমেদ

0
497

— “বেশি রূপবতী হইলে এইরকমই হয় কপালে স্বামীর ঘর জোটে না!”

ছোট বোনের মুখে এরকম বাঁকা কথা শুনে মুখের হাসি বিলীন হয় চারুলতার। চোখ ঘুরিয়ে বোনের দিকে তাকাতেই দেখে, অনুলেখা মুখ কুঁচকে তারই পানে চেয়ে। ওর বধূবেশে সেজে থাকা অঙ্গে ঝলমল করতে থাকা দামী বেনারসি আর চকচক করতে থাকা গয়নাগুলো যেন একসঙ্গে কটাক্ষ করছে চারুকে!
বিয়ে বাড়ির কল-হাস্যে মুখর এই ঘরের আর সবার নজর এখন চারুর উপর ন্যস্ত। অনুর বাঁকা কথার খোঁচা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কক্ষে উপস্থিত কাজিনরা একজন – আরেকজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। একটু আগের হৈচৈ হল্লা হারিয়ে গেছে নিমিষে, সকলের চাউনি থমথমে। চারু অপ্রস্তুত হলো খুব। ফেলে আসা তিক্ত অতীত নিয়ে খোঁচাটা সামলে কিছু বলবে তার আগেই মধ্যস্থতা করলো ইমা; ওদের বড় ফুপুর মেয়ে। অনুকে উদ্দেশ্য করে ধমকে ওঠে,
— “এমন করে কথা বলছিস কেন, অনু? বড়দের নিয়ে এভাবে কথা বলতে হয়?”
— “তো কীভাবে কথা বলতে হয়?”
অনু সরাসরি ইমার চোখে চোখ রাখলো। ইমা কঠিন স্বরে বললো,
— “অসভ্যের মতো করবি না। চারু আপা আমাদের সবার বড় বোন। তার সঙ্গে এরকম ঠেস দিয়ে কথা বলা তোর সাজে না।”
— “সাজে না? হাহ্! কেউ দোষ করলে তাকে দোষ দেয়া যাবে না?”
কটাক্ষ করলো অনু। ইমা পুনরায় ধমকে উঠলো,
— “না দেয়া যাবে না। কারণ চারু আপা কোনো দোষ করে নি। স্বামীর সাথে বনিবনা না হলে কেউ ছাড়াছাড়ি করতেই পারে। এটা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। সেখানে তোর কথা বলার কিছু নেই।”
— “অবশ্যই আছে। কারণ মাহতাব ভাই এ-বাড়ির প্রাক্তন জামাই হলেও নতুন আরেকটা সম্পর্ক শুরু হতে যাচ্ছে তার সঙ্গে। উনি মাহাদের বড় ভাই! সেই হিসেবে..”
— “তোর ভাসুর। জানি আমরা সেটা। নতুন করে বলবার কিছু নেই।”
ভাগ্যিস এখানে বড়রা কেউ নেই। সব কচি-কাঁচার আসর বসেছিল বৌয়ের সাজের ঘরে, তাই রক্ষে! ওদের বোনদের এই কথা কাটাকাটি কেউ শুনলো না।
ইমা থামলো না, কঠিন হুঁশিয়ারি দিলো অনুর প্রতি,
— “শোন, আজ তোর বিয়ে বলে কিছু বলছি না। শুধু বলবো তোর এই উড়নচণ্ডী চালচলন আর অকারণে অন্যকে হেয় করার অভ্যাসটা ছাড়।পরের বাড়ি যাচ্ছিসই, স্বভাব না বদলালে পস্তাতে হতে পারে!”
কথা শেষ করে দাড়ালো না ইমা। ‘চলো তো আপা। মা ডাকছে!’ — বলে চারুর হাত ধরে নিয়ে গেল ঘর থেকে। পেছনে পড়ে থাকলো অপমানে মুখ লাল হওয়া অনুলেখা। ঘর ভর্তি মানুষ, যারা সবাই কি-না ওর চেয়ে বয়সে অনেক অনেক ছোট — তাদের সামনে ইমা ওকে এভাবে কথা শুনিয়ে দিয়ে গেল?

অরুণা ম্যানসন।
আহাদ রাজা তার প্রাণাধিক প্রিয় জীবনসাথী অরুণার জন্য তৈরি করেছেন এই বাড়ি। আজ থেকে প্রায় বিশ বছর আগে। সেই থেকে চলছে এই পরিবারের গল্প।
পরিবারটির গোড়াপত্তন করেছিলেন আহাদ রাজা। হাল আমলের বেশ বড় গ্রামের হাভাতে চাষার ছেলে থেকে আহাদ রাজা শুধুমাত্র নিজের চেষ্টা আর পরিশ্রমের জোরেই হয়ে উঠেছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী। শুরু করেছিলেন খুব ছোট্ট কিছু দিয়ে। উপশহরে একটা ছাট কাপড়ের দোকান ছিল। সেই দোকানের বেচা-বিক্রি করতেন নিয়মিত। তারপর আস্তে আস্তে প্রসার হলো। ছাট কাপড় থেকে শাড়ি, থ্রি-পিস সবকিছু চলে এলো। হাতে কাচা পয়সাও আসতে লাগলো প্রচুর। সেসব নিজের জন্য খরচা না করে জমাতে লাগলেন। কিছু টাকা জমে গেলে, লোন নিলেন ব্যাংক থেকে। সবমিলিয়ে মূল শহরে একটা দোকান ঘর ভাড়া নিলেন। নতুন দোকানের সঙ্গেই রইলো টেইলার্স। নিত্যনতুন কাপড়ের চালান আনা শুরু হলো। কর্মচারী বাড়লো। ধীরে ধীরে রমরমা হয়ে উঠলো দোকান। এখন গোটা শহরে তার ”আহাদ এম্পোরিয়াম”–এর বেশ নামডাক!

ব্যক্তিগত জীবনে তিন কন্যা এবং তিন পুত্রের জনক আহাদ রাজা। স্ত্রী অরুণা গত হয়েছেন বছর সাতেক হলো। সন্তানদের সকলেই বিবাহিত, (এমনকি তাদের কারো কারো ছেলেমেয়ের বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়েছে, কিংবা বিবাহ ভারগ্রস্থ!) নিজেদের পরিবার নিয়ে পিতার সঙ্গেই থাকেন। এবং তিন পুত্রই পারিবারিক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। পিতার অবসর নেয়ার পর সবকিছু শক্ত হাতে সামলাচ্ছেন তারা। ইতোমধ্যে বেশ উন্নতি সাধন করেছেন। নতুন দোকান হয়েছে বেশ কয়েকটা। একথা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করবেন যে, আহাদ রাজার তিন পুত্রই বাপের চেয়েও বেশি বিজ্ঞ এবং দক্ষ হয়ে উঠেছেন!
ছেলেদের মধ্যে আজমীর রাজা বড়। দুই কন্যার জনক। চারুলতা এবং অনুলেখা। চারুর বিয়ে হয়েছিল দু’ বছর আগে। কিন্তু কোনো কারণে সংসারটি টেকে নি। ছোটোজন অনুলেখা, তার বিয়ে উপলক্ষেই বাড়িতে আজ এতো আয়োজন!
আহসান রাজা দ্বিতীয়। তিন পুত্র তার। কবির, কাব্য এবং সৌভিক — সকলেই পড়ালেখার পাট চুকিয়ে নিজ নিজ কর্মসংস্থান করে নিয়েছে। তবে কেউই পরিবারিক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয় নি। বৈবাহিক অবস্থার হিসেবে বড় দু’জনই বিবাহিত। এখনো বাকি রয়েছে সৌভিক।
আসাদ রাজা। একটি নম্র-ভদ্র মেয়ে এবং দুটি হাড়ে বজ্জাত জমজ ছেলের বাপ। মেয়েটি ঋতু। সাস্টের পলিটিক্যাল স্টাডিজের ছাত্রী। আর দুই রিংকু – টিংকু; অষ্টম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত। পড়ালেখা ছাড়া তাবৎ দুনিয়ার সমস্ত কাজ যাদের ভীষণ প্রিয়! তাদের অন্যতম দায়িত্ব হলো বড় ভাইবোন গুলির পিছনে জাসুসি করে বেড়ানো, তাদের প্রতিটি দোষ বড়দের কাছে বলে দেয়ার হুমকি দিয়ে ফায়দা লোটা!

তিন কন্যার বড়জন আলেয়া। প্রাইমারি স্কুলের টিচার, সিলেটে নিজের স্বামী এবং দু’ কন্যার সঙ্গে শ্বশুর বাড়িতেই থাকেন। মেজোজন আয়েশা। অস্ট্রেলিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরিরত, পরিবার নিয়ে সেখানেই থাকেন। দুই পুত্র-কন্যার জননী। এবং সবশেষে ছোটটি আমেনা। গৃহিণী; স্বামী এবং একমাত্র পুত্র সন্তান নিয়ে কানাডা প্রবাসী হয়েছেন আজ বছর পাঁচেক হলো।

নিচতলার সবচে’ যে বড় ঘরটি তাতেই আহাদ রাজার বাস। যেহেতু তিনিই বাড়ির কর্তা, স্বভাবতই তার কক্ষের আলাদা আভিজাত্য আছে। আকারে বেশ বড়-সড় হলেও এখানে আসবাবের আতিশয্য নেই। ছিমছাম পরিবেশ। কিন্তু গাম্ভীর্যে পূর্ণ!
সাধারণত এখানেই যতো গুরুত্বপূর্ণ পারিবারিক আলাপ – আলোচনা, পুত্রদের সঙ্গে বসে ব্যবসা সংক্রান্ত গোপন বৈঠক সেরে থাকেন আহাদ রাজা। তাই অন্যরা এই ঘরের ব্যাপারে সমঝেই চলে, যেমন চলে ঘরের মালিককেও। কিন্তু অনুর বিয়ে উপলক্ষ্যে পুরো বাড়িই যখন নতুন আমেজে সেজেছে, তখন কি ভেবে যেন বৃদ্ধ আহাদ রাজা তার এই ঘরটি ছেড়ে দিয়েছেন নাতি – নাতনীদের জন্য। করুক ওরা হৈ-হুল্লোড়, আমোদ – উল্লাস! কিন্তু বর্তমানে ঘরটার দখল আছে আলেয়ার হাতে। পরশু কানাডা থেকে এসেই বাপের ঘরটা কব্জায় নিয়েছেন তিনি। তার বদৌলতেই মহিলামহলের যত প্রকার আড্ডা, ঠাট্টা – মশকরা এমনকি পরচর্চা – পরনিন্দারও আসর হয়ে উঠেছে এই জায়গা!
ইমার সঙ্গে চারু এসে দাড়ালো ঘরের দোরগোড়ায়। আধখোলা দরজার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে ভেতরের কিছু অংশ। আলেয়া ফুপু, আয়েশা ফুপু দুজনেই বিছানায় বসে, হাসছেন। ওরা যেহেতু আছে তারমানে অন্যদেরও থাকবার সম্ভবনা প্রবল, ভাবলো চারু। গুরুত্বপূর্ণ কিছু নিয়ে আলোচনা হতে পারে। একটু কেশে দৃষ্টি আকর্ষণের উদ্দেশ্যে বললো,
— “বড়ফুপু ডেকেছ?”
হাসির কলকলানি থামলো মুহূর্তের জন্য। সবার দৃষ্টি গিয়ে পড়লো দরজায় দাড়ানো চারুলতার পানে। গলা উঁচিয়ে ডাক দিলেন আলেয়া,
— “হ্যাঁ, আয় তো চারু।”
অনুমতি পেয়ে নম্র পায়ে ভেতরে প্রবেশ করলো চারুলতা। ইমা ঠিক ঢুকলো না, দরজার ফাঁকটুকু দিয়ে মাথা গলিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— “আমাকেও কি থাকতে হবে, আম্মা? না, চলে যেতে পারি?”
— “তুমি যাও।”
আদেশের সুর ভেসে এলো। মাথা দুলিয়ে সায় দিলো ইমা,
— “আচ্ছা।”
ইমা চলে গেল। হাত বাড়িয়ে সস্নেহে ভাতিজিকে কাছে ডাকলেন আয়েশা,
— “এদিকে বোস তো, মা।”
চিরকালের ধীর – স্থিরমতি চারু এগিয়ে গিয়ে বসলো তার মেজোফুপুর কাছে। বসবার আগে একপল্ চেয়ে নিলো কক্ষে উপস্থিত সকলের দিকে। মা – চাচী – ফুপু এরাই আছেন। তারা কথা বলতে শুরু করেছেন আবার। যার অধিকাংশই অনুর বিয়ে সংক্রান্ত আলাপ। বড় ফুপুও এতে শামিল আছেন। ওদের এই সাংসারিক আলাপ ওকে কেন ডাকা হলো? আলেয়া কি খামোখাই ওকে টেনে আনলেন দোতলার আসর থেকে? চারু বুদ্ধিমতী মেয়ে, তাই বুঝতে অসুবিধে হলো না বড় ফুপুর উদ্দেশ্য। উনি অবশ্যই ওকে জরুরি কিছু বলতে ডেকেছেন। শুধু শুধু কিছু করবার পাত্রী তো তিনি নন। আর সেই জরুরি কিছু যে এতো মানুষের মাঝে উনি বলবেন না তাও বুঝলো বেশ। তাই অধৈর্য না হয়ে চুপটি করে বসে ওদের কথা শুনতে লাগলো চারুলতা।
একটু পরেই সাঙ্গ হলো ওদের কথা। আসাদ রাজা এসে ডেকে গেলেন তার বড় ভাবীকে। কি এক রান্না নিয়ে যেন বাবুর্চির সঙ্গে তার তর্ক লেগেছে। এখন মীমাংসা করতে বড় ভাবীকেই লাগবে। উনি রান্নায় সিদ্ধহস্ত কি-না!
চারুর মায়ের প্রস্থানের পরই আসর ভাঙলো। একে একে চলে গেলেন সবাই। ঘরে একা রয়ে গেল চারু আর আলেয়া বেগম। ফাঁকা পেয়ে চারু বিনীত হয়ে শুধালো,
— “আমায় কি জন্য ডেকেছিলে, বড় ফুপু?”
ওর কথায় ফিরে তাকালেন আলেয়া। হাত ধরে কাছে টেনে নিলেন ওকে। চিবুক ছুঁয়ে আদর করে বললেন,
— “কেমন আছিস, মা? মুখটা অমন শুকনো লাগছে কেন?”
পাংশুটে ভাবটা লুকোবার প্রচেষ্টায় হাসলো খানিক চারু,
— “কই, না তো!”
— “দুঃখ লুকাস না, চারু। তোর কষ্টটা আমি বুঝি। আমি জানি, এটা তুই মানতে পারছিস না। মন ছোট করছিস। যে বাড়ি থেকে তোর সংসার নষ্ট হলো সেখানে — কিন্তু কি করবি বল, অনু যে একেবারে জেদ — ”
বলতে বলতেই ওর চোখের দিকে তাকালেন আলেয়া। সেই দৃষ্টির সু-গভীর ভাষা আর চেহারার নিদারুণ অসহায়ত্ব দেখে না চাইতেও মনটা খারাপ হয়ে এলো ওর। মুখ নামিয়ে স্তিমিত সুরে বললো,
— “তুমি খামোখাই ভাবছ। আমি মোটেও মন ছোট করি নি। আজকে অনুর বিয়ে, আমার ছোট বোনের বিয়ে! এই নিয়ে কি আমার মন খারাপ করা সাজে? হতে পারে, অনুর যে পরিবারে বিয়ে হচ্ছে সে পরিবারের সঙ্গে একসময় আমার নিজস্ব একটা সম্পর্ক ছিল। কিন্তু সেটা তো অতীত। এর আগে মাহাদ আমার দেবর থাকলেও এখন তো আমার হবু ভগ্নিপতি। আর ওই.. ওই লোকটা, সে তো শুধুই একজন পরপুরুষ। তাকে কিংবা তার সঙ্গে থাকা আমার অতীত নিয়ে কোনো ভাবনা আমার নেই। তুমি চিন্তা করো না, প্লিজ।”
আলেয়ার হাতের উপর নিজের ডান হাতটা রাখলো। আশ্বস্ত করে চাপ দিলো সামান্য। আলেয়া বুঝেও যেন বুঝতে চাইলেন না। অবিশ্বাসী কণ্ঠে বললেন,
— “তুই সত্যিই ওসব নিয়ে ভাবছিস না তো? মাহতাব কে নিয়ে –”
ফুপুর কথা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে চারু বললো,
— “না। বিশ্বাস করো। তাকে নিয়ে আমার আর কোনো ভাবনাই নেই। আমি সব ভুলে গেছি। যদিও এটা ভোলার মতো নয় কিন্তু তবুও — অনুর বিয়ে নিয়ে আমার কোনো দুঃখ নেই। ও ওর পছন্দের মানুষকে বিয়ে করবে এতে আমি বাঁধা দেওয়ার কে? আমি চাই ও সুখী হোক।”
— “আমিও চাই তুই সুখী হ। অনেক অনেক সুখী হ। পুরোন সবকিছু ভুলে যা!”
ভাতিজিকে কাছে টেনে গালে চুমো দিলেন আলেয়া। পরম মমতায় আগলে নিলেন বুকের মাঝে। এই মেয়েটা যে তার কতো আদরের, কতো ভালোবাসার তা কি কেউ জানে?
তখনও তিনি সংসার জীবনে প্রবেশ করেন নি। অনার্সে ভর্তি হয়েছেন সদ্য। বড় ভাই আজমীর রাজার বিয়ের দীর্ঘদিন পরেও কোনো বাচ্চা – কাচ্চা হচ্ছিল না। আত্মীয় – স্বজনেরা তো অনেকে নানান বাজে কথা বলা শুরু করেছিল আড়ালে। চমক ভাবীকে বাঁজা, আজমীর ভাইকে আঁটকুড়ে ইত্যাদি ইত্যাদি উপাধিতেও ভূষিত করেছিল। তারপর মেজ ভাইয়ের যেদিন তৃতীয় ছেলে সৌভিকের জন্ম হলো সেদিনই শোনা গেল, বাড়িতে নতুন সদস্যের আগমনের সংবাদ! হাসপাতালে মাথা ঘুরে পরে গিয়েছিলেন চমক ভাবী, তখনই টেস্ট করে জানা গেল চমকে যাওয়ার খবর! চারুলতার খবর!
কতগুলো দিনের অপেক্ষার পর সবার মুখে হাসি ফুটিয়ে, চমক ভাবীর কোল আলো করে এলো এই মেয়ে। প্রিয় ভাতিজির সুন্দর পানপাতার মতো ছোট্ট মুখ, আর নমনীয় কোমল শরীর দেখে বড় শখ করে আলেয়াই নাম রেখেছিলেন “চারুলতা জাফরিন”!
প্রথম কন্যা সন্তান হিসেবে সকলেরই বড় আদরের, বড় যত্নের হলেও তার কাছে ওর বিশেষ কদর। তার জীবনে প্রথম মাতৃত্বের স্নেহ জাগিয়ে দিয়েছিল চারু। প্রথম কোনো ছোট প্রাণ তার উষ্ণ কোলে বসে ছোট ছোট হাত দিয়ে জড়িয়েছিল তার গলা, আধো – আধো বুলিতে তাকে ডেকেছিল বুবু! ফুপু যে তখনো ডাকতে শেখে নি বাচ্চাটা। ওই পুচকু মেয়েটার মুখে সারাক্ষণ ‘বু-বু’ ডাক শুনেই তো ওর প্রতি মায়ার বন্ধনে জড়িয়ে গেলেন আলেয়া। যে বন্ধন এ জন্মে আর কাটবার নয়!
চারুর বয়স যখন দুই তখন চমক ভাবীর পেটে অনুলেখা। ভাবী তখন অসুস্থ। ঠিকঠাক যত্ন নিতে পারেন না ওর। তখন ছোট্ট চারুর সর্বক্ষণের খেলার সঙ্গী, আবদারের ঝুলি হয়ে উঠেছিল আলেয়া। মা অসুস্থ তাই তার কাছেও ভিড়ে না। কিন্তু একমুহূর্ত বড়ফুপুকে না দেখে ওর চলে? কতো যত্নের এই পুতুলটা!
সেই চারু আজ কতো বড় হয়েছে! জীবনের কতো চড়াই-উৎরাই এসে হাজির হয়েছে ওর সামনে। ও কি সেসব পাড়ি দিতে পারবে? ভাবতে ভাবতেই চোখ ভিজে আসে আলেয়ার। চারুকে আরেকটু নিবিড়ভাবে টেনে নেন নিজের সঙ্গে। পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আশীর্বাদ করেন ওকে। সুখী হ!

অনেকটা সময় ফুপুর সঙ্গে কাটিয়ে ঘর থেকে বেরোলো চারু। লন এরিয়ায় প্যান্ডেল সাজানো হয়েছে বিয়ের। ইমার কাছে শোনা, ওদিকটাতেই নাকি সব পুচকুগুলো জড়ো হয়েছে। গান বাজাচ্ছে, নাচানাচি করছে। আনন্দ করছে নিজেদের মতো করে! অনুর কাছে গিয়ে নতুন করে ঝামেলা বাঁধানোর চেয়ে এই ছোটদের মেলায় যাওয়া যেতে পারে। ভেবেই এগুলো চারু।
বাইরে পা দিতে না দিতেই কানে এসে বাজলো সাউন্ড বক্সের কান ফাটানো শব্দ। হাইবিটে বেজে চলেছে সেখানে হিন্দি গান,
“Kabhi Lage Monalisa
Kabhi Kabhi Lage Lolita
Aur Kabhi Jaise Kadambri
Haaye Meri Param Param Param Param
Param Sundari”
সেই সঙ্গে ওর কাজিনমহলের ছোট-ছোট ভাইবোনের সোল্লাসে চিৎকার! সবচে বেশি শোনা যাচ্ছে রিংকু – টিংকুর ফাটা বাঁশের মতো গলা। দু’ মিনিটের মধ্যেই মাথা ধরে গেল চারুর। এই অবিরাম হৈ-হৈ গান-বাজনা যে ওর জন্য মোটেও উপযোগী নয় সেটা বুঝেই সটকে পড়লো। ঝিম ধরানো মাথায় একহাত চেপে ফিরে এলো বাড়ির ভেতর। গন্তব্য দোতলার শেষ প্রান্তের নিরালা ঘরখানি, তার শান্তিনিবাস!

ওদের বাবা-চাচা-জ্যাঠা সবার ঘর নিচে। পুরোটাই মুরব্বীরা দখল করে আছেন। আর ওরা ভাই-বোনগুলি সব ঠাঁই পেয়েছে বাপেদের একদম মাথার উপরে, অর্থাৎ দোতলায়। চারু একহাতে মাথা চেপে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠছিল। উপরে উঠেই হাতের বাঁ পাশে কবির ভাইয়ের ঘর। পাশ দিয়ে যাবার সময় ভেতর থেকে চুড়ির রিনিঝিনি আওয়াজ শুনতে পেয়ে নক করলো চারু,
— “ভাবী, আসবো?”
— “কে? চারু? হ্যাঁ, হ্যাঁ। আসো! দরজা খোলা।”
দোর ঠেলে ভেতরে ঢোকে চারু। ওকে দেখেই আহ্লাদী হেসে বলে জাবিন,
— “ভালো হয়েছে তুমি এসেছ। আমি যে কী বিপদে পড়েছিলাম!”
— “কেন? হয়েছে কি?”
মুচকি হাসলো চারু। জাবিন মুখটা পেঁচার মতো করে বললো,
— “হেসো না, মেয়ে। কি জ্বালায় পড়েছি আমি, সেটা আমিই বুঝছি। তুমি এসে একটু কুচি ধরে দাও তো!”
— “আচ্ছা। দেখছি!”
চারু এগিয়ে এসে ভাবীর আদেশ মানলো। সুন্দর করে শাড়ির কুচি ধরে দিতে লাগলো জাবিনকে। আঁচল টেনে ঠিক করে দিলো। শাড়িতে অনভ্যস্ত জাবিনের যেন সমস্যা যেন না হয় তাই ভালো করে পিন গুঁজে দিতে দিতে বললো,
— “তুমি তো শাড়ি পরো না, আজ হঠাৎ? পরলেই যখন তখন কাউকে ডাকলে না কেন?”
জাবিনের ভোঁতা মুখ সোজা হলো না। মুখ লটকে জানালো,
— “তুমি তো জানোই, আমি শাড়ি পরতে পারি না। অনুর বিয়ে উপলক্ষ্যে সবাই পরছে দেখে শাড়ি কিনেছি। কিন্তু দেখো তো, একঘণ্টা ধরে পরছি কিন্তু এখনও কুচিটাই গোছাতে পারলাম না! কাউকে যে ডাকবো তারও উপায় নেই। দোতলায় কেউ নেই! ওদিকে তোমার ভাই গেছে নিচে। গান-বাজনা করছে সবকয়টা মিলে। বারবার কল করে আমাকে তাড়া দিচ্ছে, রাগ হচ্ছে, আমি যাচ্ছি না কেন! ও কি জানে আমার অবস্থা?”
শেষের কথাটা একটু রাগ করেই বললো। বেচারীর করুণ কাহিনী শুনে ফিক করে হেসে ফেললো চারু। হাসতে হাসতে ভাবীর দিকে চেয়ে দেখলো তার মুখখানা। কেমন ছোট বাচ্চাদের মত গাল ফুলিয়ে চেয়ে আছে, দেখো? চারু হাসতে হাসতে জাবিনের গালে একটু চিমটি কাটলো,
— “ইসস! এখানে খুব রাগ দেখানো হচ্ছে, না? নিচে ভাইয়ার সামনে গেলে, ঠিকই তো ভুলে যাবে সব! গদগদ হয়ে পোজ দিয়ে ছবি তুলবে!”
গোপন কথা ফাঁস হওয়ায় বেশ লজ্জায় পড়তে হলো ওকে। রক্তিমাভা গাল দুটো লুকিয়ে কপট রাগ দেখালো ননদিনীকে,
— “বলেছে তোমাকে!”
— “বলেছেই তো!”
দ্বিগুণ লজ্জায় মিইয়ে যায় জাবিন। চারু আরেকটু জোরেই হেসে উঠে এবার। প্রসঙ্গ পাল্টাতে জাবিন হঠাৎ বলে,
— “এই তুমি তখন কি কারণে এসেছিলে বলো তো? এসময়ে এখানে তো কেউ নেই! তুমি একা একা দোতলায় কি করছো?”
হঠাৎ কিছু মনে পড়ে যাওয়ায় চারু জানায়,
— “ওহ্। আমি এসেছিলাম একটা ঔষধ নিতে। বাইরের এতো শব্দে মাথাব্যথা শুরু হয়েছে রীতিমত। তাই ভাবছিলাম, ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমিয়ে নেব।”
— “সেকি ঘুমোবে কেন? বিয়ে দেখবে না? অনু তো তোমারই বোন!”
আঁতকে উঠলো যেন। ওর বিভ্রান্তি কাটিয়ে দিলো চারু,
— “বিয়ের এখনও অনেক দেরি, ভাবী। ন’টায় বিয়ে, এখন সবে সন্ধ্যে ছ’টা! দু’ আড়াই ঘণ্টা ঘুমিয়ে নেয়া যাবে। তুমি পেইন-কিলার দাও তো। খেয়ে একটু আরাম পাই। ভারী যন্ত্রণা করছে মাথাটা!”
বলতে বলতেই কপালের কোণায় হাত ঠেকালো। জাবিন কয়েকটা ড্রয়ারে খুঁজে নিরস হয়ে বললো,
— “আমার ঘরে তো ট্যাবলেট নেই, চারু।”
— “তবে? মাথা তো যন্ত্রণায় ছিঁড়ে পড়ে যাচ্ছে আমার!”
অসহায় শোনালো কণ্ঠ। জাবিন একটু ভেবে নিয়ে বললো,
— “তুমি ঋতু বা অন্য কারো কাছে চাও। কিন্তু পাবে কি-না, ঋতুটা যা ভুলোমনা! কোথায় কি রাখে! তুমি বরং সৌভিকের কাছে যাও। ওর কাছে সবকিছুই পাওয়া যায়। দারুণ গোছালো ছেলে!”
সৌভিক ভাইয়ার কথা উঠতেই চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো চারুর। তাই তো, সৌভিক ভাইয়ার কথাটা তো মাথায় আসে নি। ওর কাছে চাইলেই তো হয়! ভাবীকে ধন্যবাদ জানিয়ে তৎক্ষণাৎ পা বাড়িয়ে ছুটলো সৌভিকের কক্ষের দিকে।
ইংরেজিতে যাকে জেন্টলম্যান বলে তারই যোগ্য উদাহরণ হলো এই সৌভিক। যার সবকাজ গোছালো, নিখাদ-নির্মল-নিখুঁত। প্রতিটি কাজ যে করে পরিচ্ছন্ন হয়ে, সাজিয়ে-গুছিয়ে! তার কাছে এখন একটা পেইন-কিলার পাওয়া কি এতই অসম্ভব?

সৌভিকের ঘর ভেতর থেকে বন্ধ। মানে ভাইয়া ঘরেই আছে। দরজায় করাঘাত করলো চারুলতা,
— “এ্যাই, ভাইয়া? দরজা খোলো তো! এ্যাই!”
— “কে?”
আওয়াজ এলো প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। ঘুম মেশানো কেমন জড়ানো গলা। সৌভিক ভাইয়া এখনো ঘুম থেকে ওঠে নি? স্বর উঁচিয়ে জবাব দিলো চারু,
— “আমি চারু। দরজা খোলো। জলদিই!”
— “হুঁ।”
আজ দুপুরেই বরিশাল থেকে বাড়ি ফিরেছে সৌভিক। লম্বা সফরের ধকল সইতে পারে নি হয় তো। তাই ঘুমিয়েছে। বুঝতে পেরে আর জোরাজোরি করলো না চারু। কিছুক্ষণ চুপ করে অপেক্ষা করলো সৌভিকের দোর খোলার। একটু পর ভেতর থেকে সৌভিকের কণ্ঠ ভেসে এলো,
— “কি হয়েছে?”
সঙ্গে কপাট খুলবার আওয়াজ। চারু বলতে শুরু করলো,
— “আর বলো না, মাথা ব্যথায় তো মlরে যাচ্ছি একেবারে। বাড়িতে সবাই ব্যস্ত। কেউ নেই আমাকে সাহায্য করতে। একমাত্র বড় ভাবীর কাছে গেলাম কিন্তু তার কাছে ঔষধ নেই। এখন তোমার কাছে কি পেইন-কিলার—”
বলতে বলতেই সামনে চেয়ে হঠাৎ থেমে গেল চারুলতা। দরজা হাঁট হয়ে খুলে গেছে ততক্ষণে। সেখানে সৌভিক নয়, বরং উপস্থিত হয়েছে অন্য কেউ! সেই অন্য কেউটা একজন অপরিচিত ব্যক্তি বুঝেই চোখ বড় বড় করে তাকালো চারু। প্রবল বিস্ময়ে দুটি শব্দ ছিটকে বেরোলো মুখ থেকে,
— “আপনি কে?”

চলবে___

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_০১
#মৌরিন_আহমেদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here