প্রিয়াঙ্গন #সূচনা_পর্ব জাওয়াদ জামী জামী

0
645

” ভাই কি আর কারও ম’রে’না? দুনিয়ায় কি একমাত্র তোমার ভাই-ই ম’রে’ছে? কাল থেকে এই বাড়িতে ধর্না দিয়ে পরে আছ! তোমার কি নিজের সংসার নাই? বউ-বাচ্চা নাই? বিয়ের এত বছর পরও ভাবির আঁচলের তলায় বসে থাকা লাগবে! ”

ছোট জা’য়ের এরূপ আ’ক্র’ম’ণা’ত্ব’ক কথা শুনে সদ্য বিধবা নারীটির দু-চোখ বেয়ে অনর্গল অশ্রু ঝরতে থাকে। এত অপমানও তার ভাগ্যে ছিল! অথচ বিয়ের পর থেকে সব সময়ই ছোট দেবরদের ভাইয়ের নজরে দেখেছেন তিনি। আজ সেই পবিত্র সম্পর্কের মাঝে এ কোন কালো দাগ কে’টে দিল তার ছোট জা!

দরজায় দাঁড়িয়ে স্তব্ধ হয়ে কুহু শুনছে ওর ছোট চাচির কথা। কালকেই ও তার বাবাকে হারিয়েছে কিন্তু ছোট চাচি এসব কি বলছে! চাচির মনে কি একটুও সহানুভূতি নেই বাবা-মা ‘ র জন্য! অথচ মা’তো কখনোই চাচির সাথে দূর্বব্যহার করেনি! আপনজনদের আচরণও এত নি’ষ্ঠু’র হতে পারে!
কুহুর ইচ্ছে করছে চাচিকে কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিতে। কিন্তু অনেক কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করল সে। কালকে বাবা মা’রা গেছে, অথচ আজকে মেয়ে কাউকে কথা শোনাচ্ছে, এটা গ্রামাঞ্চলে মুহূর্তের মধ্যেই রটে যাবে। ধীর পায়ে মা’য়ের পাশে এসে বসল কুহু। তখনো ওর মা কেঁদেই চলেছে। আর ছোট চাচা বারান্দায় নতমুখে বসে আছে।

” এখনও ঐখানেই সংয়ের মত বসে থাকবে? তোমার ভাবির না হয় লজ্জা নেই, তাই বলে তুমিও কি লজ্জা বেঁচে খেয়েছ? ” আবার মুখ ঝামটা দিল কুহুর ছোট চাচি শিরিন আক্তার।

” কার যে লজ্জা নেই, সেইটা আমরা ভালো করেই জানি, শিরিন। তোকে আর নতুন করে বলে দেয়া লাগবেনা। তোর বিবেক বলে কি কিছু আছে? কালকে আমার ভাই মা’রা গেছে, আর তুই আজকে এসব কি জঘন্য কথাবার্তা বলছিস? যে ভাবি তার দেবর-ননদদের ভাই-বোনের নজরে দেখেছে সব সময়ই, আজ তার এই কঠিন সময়ে তাকে এভাবে বলতে তোর একটুও বাঁধছেনা? ” নিজের মাতৃসমা বড় ভাবির অপমান সইতে না পেরে কথাগুলো বললেন কুহুর বড় ফুপু শাকিলা সুলতানা।

ননদের মুখে এহেন কথা শুনে ফোঁস করে উঠল শিরিন আক্তার। সে বোধহয় বাড়ি থেকে পণ করেই এসেছিল, আজ কাউকে ছেড়ে কথা বলবেনা।

” আমার বিবেক, আবেগ, লজ্জা সবই আছে। এবং আপনার থেকে বেশিই আছে। আপনার যদি লজ্জা, বিবেক বলে কিছু থাকত, তবে যে ভাইয়ের খেয়েপড়ে বেঁচে আছেন, তার বউকে সমীহ করে কথা বলতেন। যার স্বামী মাতাল, নুন আনতে যার পান্তা ফুরায়, তার মুখে এসব কথা সাজেনা। ”

শিরিন আক্তারের কথা শুনে মিইয়ে যায় শাকিলা সুলতানা। চোখে জমা হয় অপমানের অশ্রু। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে মুখ খুলে,

” আমার স্বামী মাতাল, আমার নুন আনতে পান্তা ফুরায় এটা পুরাতন খবর। নতুন কিছু বল। মনে রাখিস আমি যদি কারও খেয়েপড়ে বেঁচে থাকি, সেটা বড় ভাইয়ের পয়সায় ছিলাম। তুই কিংবা তোর স্বামী আমার জন্য কিছুই করিসনি। বরং তোর জন্য আমরা সবাই অনেক কিছু করেছি। তুই যে শিক্ষিকা বলে নিজেকে নিয়ে গর্ব করিস, সেটাও আমার বড় ভাইয়েরই দান। তুই যে এই এই বাড়ির বউ হয়ে এসেছিস, সেটা আমি চেয়েছি বলেই হয়েছে। তাছাড়া তোর মত ছোট ঘরের মেয়েকে আমার আব্বা ছেলের বউ করতে ইচ্ছুক ছিলনা। সুতরাং নিজেকে নিয়ে বাহাদুরি না করে ভেতরে হাত দিয়ে দেখ, কি ছিলি আর কি হয়েছিস। তোর মত…..

শাকিলা সুলতানা কথা শেষ করতে পারেনা। তার কথার মাঝেই কথা বলে উঠল কুহুর মা আইরিন পারভিন।

” শাকিলা, আজকের দিনেও এসব কথা না বললেই কি নয়? আমার এসব শুনতে ভালো লাগছেনা। সাইদ তুমি তোমার বউকে নিয়ে বাড়ি যাও। আর কখনোই এদিকে এসোনা। মনে কর তোমার ভাইয়ের সাথে সাথে আমরাও ম’রে গেছি। ”

আর কিছু বলতে পারেননা আইরিন পারভিন। কান্নায় ভেঙে পরলেন। কুহুও কাঁদছে হাউমাউ করে। এতটা অপমানও ওদের ভাগ্যে ছিল!

উঠানে আম গাছের নিচে বসে এতক্ষণ সব শুনছিল কুহুর ছোট ভাই সৃজন। ছোট চাচির কথা শুনে ওর ছোট্ট বুকে জন্ম নেয় ক্ষোভ, অভিমান, রা’গ।

সাইদ আহমেদ মাথা নিচু করে বেরিয়ে যায় বড় ভাইয়ের বাড়ি থেকে। তার পিছু পিছু শিরিন আক্তারও বেরিয়ে যায়।

কুহুর ছোট ফুপু সোহানী পারভীন রান্না চাপিয়ে দিয়েছে। উঠানের একপাশে রান্নাঘরে বসে সে কাজ করছিল। ছোট ভাইয়ের বউয়ের সব কথাই তার কানে গেছে। কিন্তু এতে তার কোন হেলদোল নেই। ওদের যা ইচ্ছে হয় করুক।

কুহু জানালার কপাটে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিছানায় ওর মা ঘুমাচ্ছে। অবশ্য কাল থেকে তাকে ঘুমের ঔষধ দিয়ে ঘুম পারিয়ে রাখা হচ্ছে। পুরো বাড়ি নিস্তব্ধ। কোথাও কোন সাড়া নেই। এই নিস্তব্ধতাকে গ্রাস করে একটু পর পর ফুঁপিয়ে উঠছে কুহু। চিন্তা করছে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। কি হবে এরপর? কিভাবে চলবে ওদের সংসার? বাবা স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়ার পর যে টাকাগুলো পেয়েছিল, তার প্রায় সব টাকাই বাবার চিকিৎসায় খরচ করতে হয়েছে। জমজমাও যা আছে তার সবই বন্ধক রাখা হয়েছে। সেই জমিগুলো ছাড়াতেও পাঁচ-ছয় লাখ টাকা লাগবে। হাতে আর সামান্য কিছু টাকা আছে। এই টাকা দিয়ে কিভাবে ওরা দুই ভাইবোন পড়াশোনা করবে, সংসার চালাবে, জমিজমা ছাড়াবে ! এসব কথা ভাবতে গিয়ে কুহুর মাথা ঘুরে উঠল। এমনিতেই দুর্বল শরীর। তারউপর গতকাল থেকে না খেয়ে আছে। আর কিছু ভাবতে পারছেনা মেয়েটা। ধীরে ধীরে বিছানায় আসে। শুয়ে পরে মা’য়ের পাশে।

” তাহমিদ বাবা, ও তাহমিদ বাবা, এইবার উইঠ্যা পর। অনেক বেলা হইছে। তুমি খাইবা কখন? ”

কারও গলার আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গলো তাহমিদের। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল। প্রথমেই ফোন হাতে নিয়ে সময় দেখল। এরপর তাকালো সামনের দিকে। চোখের সামনে দাঁড়ানো বৃদ্ধাকে দেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,

” রাজিয়া খালা, এখন সবেমাত্র আটটা বাজে। আজকে অন্তত এই সময় আমাকে না ডাকলেও পারতে। তুমি ভালো করেই জানো, সপ্তাহের এই দুইটা দিন আমি রাজশাহীতে আসি একটু বিশ্রাম নিতে। কিন্তু তুমি বরাবরের মতই আমার আরামকে হারাম করতে সদা তৎপর। কি শান্তি পাও বলতো ”

” তুমি নিয়ম কইরা খাইলেই আমার শান্তি। সূর্যরে মাথার উপরে নিয়া উঠলে কি টাটকা খাওন খাইতে পারবা? এবার বিছানা থাইকা নামো। আমি বিছানা গোছাইয়া দিই। তুমি মুখহাত ধুইয়া নিচে যাও। আমি তোমার জন্য ভুনা খিচুড়ি আর শুটকি ভুনা করছি। ” রাজিয়া খালা তাহমিদকে একপ্রকার বিছানা থেকে টেনে নামিয়ে, ঠেলে ওয়াশরুমে পাঠায়।

তাহমিদ ডাইনিং টেবিলের কাছে এসে দেখল ওর ছোট খালু মনমরা হয়ে বসে আছেন। খাবার মুখে না তুলে প্লেটে আঁকিবুঁকি করছেন। পাশেই ওর খালা মনযোগ দিয়ে খাচ্ছে। তার তৃপ্তি করে খাওয়া দেখেই বোঝা যাচ্ছে খাবার খুব টেস্টি হয়েছে।

” তালুকদার মুহাম্মদ রায়হান আহমেদের মনটা খারাপ নাকি? ঘটনা কি গুরুতর? আমার জানামতে আপনি সরকারি কমকর্তা এবং মাস শেষে মোটা টাকা আয় করেন। এবং স্ত্রী’র বাধ্য স্বামী। আর যেসব স্বামীরা স্ত্রী’র বাধ্য হয়, তাদের সংসারে সুখের কোন কমতি থাকেনা। আপনার কি এই তিনটার মধ্যে কোন একটা উৎসে ঘাটতি পরেছে? ”
তাহমিদের সাথে বরাবরই রায়হান আহমেদের সম্পর্ক ভালো। তাদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে হাসিঠাট্টা হয়েই থাকে। সম্পর্কে খালু হলেও ওদের মধ্যের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণই বলা যায়। তাই তাহমিদ হাসতে হাসতে খালুর সাথে মজা নেয়ার সুযোগ হাতছাড়া করেনা।

তাহমিদের কথা শুনে ওর খালার ভ্রু কুঁচকে আসে। বিরক্তিতে ছেয়ে যায় তার মন। কিন্তু বোনের ছেলেকে কিছু বলার সাহস করে উঠতে পারেনা। কারন সে ভালোভাবেই চেনে তাহমিদকে। তার বোনের ছেলে যে বদ রাগী সেটা ভালো করেই জানে নায়লা আন্জুম। তাই সে পারতপক্ষে বড় বোনের ছেলেকে ঘাটায়না। তাই খোঁ’চা কষ্ট করে হলেও হজম করল।

তাহমিদের কথা শুনে রায়হান আহমেদের চোখে পানি এসে জমা হয়েছে। কিন্তু তিনি স্ত্রী’র সামনে কাঁদতে পারছেননা। তিনি তাহমিদের কথার উত্তর না দিয়ে চুপ থাকলেন।

এদিকে তাহমিদও ওর ছোট খালুর নিরবতা দেখে কিছু আঁচ করতে পেরেছে। ও বুঝতে পারছে ছোট খালুর কিছু হয়েছে। নয়তো চুপ করে থাকার মানুষ তিনি নন। তাহমিদ আর কিছু না বলে খাওয়ায় মনযোগ দেয়।

আইরিন পারভিন বিছানায় বসে কাঁদছেন। তিনি সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। একসময় তার স্বামী ছিল এই পরিবারের মাথা। নিজে স্কুলে মাস্টারি করে ভাইবোনদের পড়াশোনা শিখিয়েছে। ভাইদের স্বপ্ন পূরন করতে নিজের স্বপ্নকে বিসর্জন দিয়েছে। ছোট ভাইয়ের বউকে চাকরি নিয়ে দিয়েছে। বোনদের ভালো ঘরে বিয়ে দিয়েছে। আজ সেই মানুষের অবর্তমানে তারই ছোট ভাইয়ের বউ আজেবাজে কথা শুনিয়ে গেছে! আইরিন পারভিন উপলব্ধি করতে পারছেন, তার সামনে কঠিন দিন আসতে চলেছে। এবং তিনি হয়তো কাউকেই পাশে পাবেননা। আবারও কান্নায় ভেঙে পরলেন আইরিন পারভিন। দরজায় দাঁড়িয়ে কুহু অসহায়ের মত মা’য়ের কান্না দেখছে। ও ভেবে পাচ্ছেনা কি করে মা’কে শান্তনা দেবে।

বিঃদ্রঃ আবারও চলে এলাম নতুন গল্প নিয়ে। আমার বেশ কয়েকজন পাঠক অনুরোধ করেছেন আবারও তাহমিদ-কুহুকে নিয়ে আসতে। তাদের চাওয়াকে সম্মান জানিয়ে আমি তাহমিদ-কুহুকে নিয়ে আসলাম। আপনারা আর একবার উপভোগ করতে থাকুন তাহমিদ-কুহুর প্রনয়, চড়াই-উৎরাই, ঘাত-প্রতিঘাত।

চলবে…

#প্রিয়াঙ্গন
#সূচনা_পর্ব
জাওয়াদ জামী জামী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here