এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায় #পর্বসংখ্যা_১৮

0
370

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_১৮

লম্বা ছুটির পর কর্ম জীবনে প্রবেশ করতেই বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়লো নিখিল। অফিসে এখন চাপ আছে। ছুটিতে তার ডেস্কে ফাইল জমা পড়েছে বেশ কিছু। সেগুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতেই কখন যে অফিস আওয়ার পার হলো টের পেল না।

ব্যাগ গুছিয়ে বাড়ি ফিরবার পথে ওর মনে হলো চারুর কথা। সৌভিকের কথা। সৌভিকের কাছে চারুর নাম্বারটা চেয়ে নেয়া যায় অনায়াসেই। কিন্তু সেটা করতে ওর বিবেকে বাঁধছে খুব। হয় তো, চারুর প্রতি ওর দুর্বলতা জেনেই!

সেই প্রথমদিন থেকেই লক্ষ্য করে এসেছে নিখিল, চারুর প্রতি অদ্ভুত একটা দুর্বলতা আছে সৌভিকের। ছেলে হিসেবে সে যথেষ্ট অমায়িক এবং আন্তরিক। ভাইবোনদের প্রতি দারুণ স্নেহশীল। তাদের মন রক্ষার্থে, তাদের খুশির জন্য অনেক কিছুই করে। কিন্তু এই স্নেহময়তা, ভালোবাসা যেন চারুর প্রতি একটু বেশিই! নিখিল প্রথম যেদিন বন্ধুর নিকট মনের কথা কইলো, সেদিনও বেশ অদ্ভুত আচরণ করেছিল সৌভিক। শান্ত ছেলেটা হুট করে তেঁতে উঠেছিল। ধুমধাম কিল-ঘুষি মেরে রীতিমত উন্মাদ হয়ে উঠেছিল যেন! নিখিল অবাক হয়েছিল, বুঝতে পারে নি ওর এমন মারমুখো ব্যবহারের কারণ!

কিন্তু দিন যতোই গিয়েছে, ও বেশ বুঝতে পেরেছে। চারুর সঙ্গে নিখিলের দেখা – সাক্ষাৎ, কথাবার্তা ঠিক ভালো চোখে দেখত না সৌভিক। অথচ ও নিশ্চিত জানে, নিখিলের মনের কথা। নিখিলকে দীর্ঘদিন ধরে সে চেনে, তার পরিবারিক অবস্থা জানে। সে যে পাত্র হিসেবে চারুর অযোগ্য নয় তাও জানে!

তবুও প্রিয় বন্ধুর ওর প্রতি বিদ্বেষী মনোভাব খেয়াল করেছে নিখিল। শুরুতে তেমন পাত্তা না দিলেও, ঢাকায় ফিরবার দিন সন্ধ্যায়, সৌভিকের ওই বিধ্বস্ত চেহারা দেখে আর কিছু বুঝতে বাকি নেই ওর! ওরই প্রিয় বন্ধু যে ওর ভালোবাসার মানুষটিকে বহু আগে থেকে ভালোবাসে এই চরম সত্য জানবার পর ওর অনুভূতিটা কেমন হয়েছিল সেটা ঠিক ভাষায় প্রকাশ করবার মতো নয়। নিজের প্রতি ধিক্কার জন্মেছিল খুব। খারাপ লেগেছে বন্ধুর জন্য। কিন্তু তখন তার আর ফিরে যাওয়ার পথ নেই। চারুকে যে সে মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে! তাকে কি ভোলা সম্ভব?

সৌভিকের ব্যাপারটাও সে ভেবে দেখেছে। সে চারুর বিষয়ে সব জানে, তাকে ভালোবাসে। অথচ সে ওর বিয়ের সময়ে কিছু বলে নি, কেন? এখন চারুর অক্ষমতার কথা সবাই জানে, এবং এটা সত্যি যে সবটা জেনে-শুনে এরকম ত্যাগ করতে রাজি হওয়াটা কঠিনই! একজনকে যতই ভালবাসি জীবন সঙ্গী হিসেবে, কিন্তু দিন শেষে নিজের সন্তান তো একজন চাইতেই পারে! পিতৃত্বের স্বাদ নিতে চাওয়া অন্যায় নয়। বাচ্চারা যখন ছুটে এসে কোলে চড়ে ছোট ছোট হাতে গলা আঁকড়ে ধরবে, আধো আধো গলায় ডাকবে ‘বাবা’— সেই অনুভূতি কেমন সেটা জানবার আকাঙ্ক্ষা থাকে তো সবারই!

তবে কি এমন যে, সৌভিক ভালোবেসেও তার পরিবারের কাছে বাঁধা পড়ে আছে? সমাজ – সংস্কারকে ভেঙে এগোতে পারছে না বলেই চারুকে কখনোই জানায় নি তার অব্যক্ত ভালোবাসার কথা? নিখিল ভাবতে থাকে। খোলা জানালায় চোখ রেখে রাতের ব্যস্ত নগরী দেখতে দেখতে আনমনে ভাবতে থাকে সে!
___

কয়েকদিন পেরোলো। চারুলতার জীবন আগের মত নিস্পন্দ, ছন্দহীন। সময়ের স্বাভাবিক গতিতে ওর জীবন স্রোতের মত বয়ে গেল। একেবারে নির্বিকারে। কোনো উত্তালতা নেই, উচাটন নেই। শুধু হঠাৎ হঠাৎ নিরিবিলি শ্রান্ত মধ্যাহ্নে একলা ঘরে বসলে নিখিলের কথা ওর মনে আসত। মনে আসত, অনুর বিয়ের দিন ওকে প্রথম দেখার কথা। সেইরাতে কান্নারত অবস্থায় নিখিলের সান্ত্বনা বাণী, তিস্তা পাড়ে বেড়াতে গিয়ে লোকটার সঙ্গে গল্প আর সবশেষে সেদিনের সেই মনোমুগ্ধকর হৃদয়হরিণী প্রেমত্তাপী কথামালা!
লোকটা চারুকে তাকে ভালোবাসতে বলে নি। কোনো জোর করে নি। আকুল আবেদনে শুধু তার হাত ধরতে অনুরুদ্ধ করেছে। চারু শুধু তার অনুরোধে সাড়া দিয়ে হাত ধরেছিল। লোকটা তাতেই খুশি হয়েছে। শুধু সেই হাত ধরা থেকেই সে ওকে ভালোবাসবে বলে অঙ্গীকার করেছে। ওর দুঃখের সময়ে পাশে থাকবে বলেছে। ওর সুখ-দুঃখের সাথী হতে চেয়েছে। কিন্তু কই?
এখান থেকে ফিরবার পর তো একটিবারও লোকটা ওর খোঁজ নিলো না! না ওকে দিলো কোনো খবর!
একটা ফোনকলের আশায় আশায় চারু কতো গুমড়ে মরলো। চিরকাল নিজের ফোন সম্পর্কে উদাসীন মানুষটা, এক মুহূর্তের জন্য মুঠোফোনকে কাছছাড়া করলো না। পাছে নিখিল কল দিয়ে তার ধরা না পায়?
অথচ নিষ্ঠুর লোকটা? মনেই করলো না ওকে!
সব প্রেম, সান্ত্বনা বাণী, পাশে থাকবার অঙ্গীকার অবলীলায় ভুলে গেল!
লোকটাকে সে ভালোবাসে নি। কিন্তু বিশ্বাস তো করেছিল। তার কথায় বিবর্ণ-মলিন মনের দুয়ারে স্বপ্নের প্রজাপতিরা তো ডানা মেলেছিল? ক্ষণিকের জন্য হলেও তার মনে হয়েছিল, শীতের নিশ্চুপ শুষ্কতা শেষে তার জীবন রাঙিয়ে দিতে বসন্তের আগমন হয়েছে!
কিন্তু কোথায়! সবই যে মিথ্যে! আগের মত বিবর্ণ!
___

পৃথিবীতে দু’ ধরণের মানুষ আছে। একধরণের, যারা ব্রাশে পেস্ট নিয়ে বেসিনের সামনে দাড়িয়েই ব্রাশ করে। অন্যটা যারা ব্রাশে পেস্ট লাগানোর পর পুরো বাড়ি (পারলে এলাকার) চারধারে একপাক চক্কর লাগিয়ে আসে। আমাদের রিংকু – টিংকু ঠিক সেই ধরণের মানুষ। সকাল সকাল ব্রাশ হাতে নিয়ে বাড়ির এ-কোণা থেকে ও-কোণা চক্কর দিয়ে বেড়ানো যাদের কাজ।

স্কুল যেতে হবে আটটায়। মায়ের ঠেলাঠেলিতে আগে আগেই ঘুম থেকে উঠেছে বটে, কিন্তু দু’ ভাইয়ের তাতে মন নেই। ঘুম ভাঙবার পরই তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে আজ স্কুলমুখো হবে না। তাই রোজকার চেয়ে আজকে যেন ব্রাশ করতে সময় লাগাচ্ছে দ্বিগুণ বেশি! লন এরিয়ায় হেঁটে বেড়াচ্ছে দুই ভাই। হেমন্তের সকালের মিঠে রোদ গায়ে মাখছে। আর গুটুর-গুটুর করে গল্প সারছে। হাঁটতে-হাঁটতে বাড়ির মূল ফটকের কাছে গিয়ে পৌঁছলো টিংকু। ব্রাশ মুখে দিয়ে এদিক – ওদিক তাকাতে তাকাতেই একটা লোককে দেখলো এদিকেই আসতে। সাইকেলে চড়ে আসছে লোকটা। সোজা বাড়ির ভেতরেই হয় তো ঢুকতো, কিন্তু ওর প্রশ্নে দাড়িয়ে গেল,
— “কি চাই?”
— “অরুণা ম্যানশন? বাড়ি নং ৩৪, রোড নং ৩/৪, ওয়ার্ড আঠারো?”

টিংকু কিছু না বলে গেটের পাশের নামফলকে হাত রাখলো। মুখটা অসম্ভব গম্ভীর করে ফলকে লেখা ঠিকানাটার প্রতিটি শব্দের নিচে আঙুল ঠেকিয়ে বুঝালো, ঠিকানা ঠিক না ভুল। লোকটা ওর ইশারা বুঝলো। মাথা নাড়তে নাড়তে বললো,
— “এই বাড়ির একটা চিঠি আছে।”

বলতে বলতেই লোকটা তার ব্যাগে হাত ঢুকালো। এতক্ষণে তার দিকে জহুরি চোখে চেয়ে ছিল টিংকু। পোশাক-আশাক, হাবভাব দেখে চিনতে পারলো। ছোটবেলায় বইয়ের ছবিতে দেখেছে ডাকপিয়ন। কিন্তু বাস্তবে কখনো দেখে নি বলে চিনতে একটু কষ্টই হচ্ছিল।

মুখটাকে যথাসম্ভব গম্ভীর শুধালো,
— “কার চিঠি?”

রিংকু ছুটে এসে উপস্থিত হলো সেখানে। কোনো কারণে সে একটু বাগানের দিকটায় ঢুকেছিল। ভাইকে অপরিচিত লোকের সঙ্গে কথা বলতে দেখে ছুটে এসেছে। লোকটা ওর দিকে একপল তাকালো। মাথা নেড়ে বললো,

— “চারুলতা জাফরিন। প্রযত্নে আজমীর রাজা।”
— “চিঠিটা দিন। চারুলতা আমার আপার নাম।”

কিশোরের চিকন গলায় রাশভারী আওয়াজটা ঠিকঠাক এলো না, বরং হাস্যকর শোনালো ওর এই ঢং করে কথা বলা। লোকটা একটু হেসে বললো,
— “তোমাকে তো দেয়া যাবে না, বাবু। প্রাপক যে, তাকে ডাকো। তাকেই লাগবে।”

বাবু? তাদের দেখে এই লোকের ছোট বাবু মনে হয়? দু’ ভাই মহাবিরক্ত হলো। মুখ থেকে ব্রাশ বের করে। থু করে একদলা পেস্টের ফেনা ভর্তি থুথু মাটিতে ছুঁড়ে রিংকু বললো,
— “আপা বাড়িতে নেই। চিঠি নিতে পারবেন না।”

স্বভাব সুলভ পেশাদার ভঙ্গিতে জানালো,
— “রেজিষ্টার করা চিঠি। সাক্ষর লাগবে। প্রাপক না থাকলে আজমীর রাজাকে ডাকুন। ওনাকে দিচ্ছি।”

দু’ ভাই চোখাচোখি করলো। রাগে দু’ জনেরই গা জ্বলছে। আরে ভাই, আমরা থাকতে বড় আব্বাকে লাগবে ক্যান? আমরা কি যথেষ্ট না?
টিংকুর ত্যক্ত কণ্ঠ,

— “বড় আব্বা বাড়িতে নেই। শুধু সে কেন কোনো বড় মানুষই বাড়িতে নেই। দাওয়াতে গেছে সবাই। চিঠি দিলে আমাদের দ্যান, নাহলে চলে যান।”

কথাগুলো ডাহা মিথ্যা। তবুও কি নির্দ্বিধায় বলে দিলো দু’জন!

চিঠি ওয়ালা তবুও ইতস্তত করতে লাগলো। যমজ দ্বয় পাত্তা দিলো না আর। লোকটার মুখের উপর দরজা আটকে দিতে উদ্যত হলো। ভাবখানা এই —‘আমাদের চিঠি দিবি না তো? আপাকেও দিতে হবে? দরজা আটকালে তখন দিতে পারবি? ব্যাটা উজবুক!’

অগত্যা চিঠিওয়ালা হার মানলো। টিংকুর সাক্ষর সম্বলিত কাগজখানা রেজিস্ট্রি খাতায় রেখে, খামভরা চিঠি দিয়ে বিদায় হলো!

আপাকে কে চিঠি দিতে পারে সে নিয়ে আগ্রহের সীমা ছিল না ওদের। বহুত ঝুট – ঝামেলার পর কাঙ্ক্ষিত চিঠিখানা হাতে পেয়ে উল্লসিত হলো। লাফিয়ে উঠে খামটা নেড়েচেড়ে দেখতেই আবিষ্কার করলো, প্রেরক নিখিল নওশাদ!

বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠলো রিংকু,
— “নিখিল ভাই চিঠি লিখেছে? ওরেম্মা! কি রোমান্টিক ভাই!”

বলেই চাপড় লাগাল সহোদরের পিঠে। খাম হাতে নিয়ে গম্ভীর হলো টিংকু। কিয়ৎক্ষণ উল্টেপাল্টে দেখে বললো,

— “ফেসবুক – হোয়াটস অ্যাপের যুগে চিঠি? আশ্চর্য!”

রিংকু মুখ কুঁচকে তাকালো,

— “আশ্চর্যের কি আছে? নিখিল ভাই বাকি সবার মত না। আলাদা অনেক। তাই হয় তো, চিঠি দিয়েছে। নব্বই দশকের চিঠি যুগের প্রেম দেখিস নি? কি সুইট আর প্রীটি শুনতে লাগে ওদের লাভ স্টোরিগুলো!”
সহসা জবাব দেয় না টিংকু। খানিক চুপ থেকে কি যেন ভেবে নেয়।

তারপর গম্ভীর মুখটাতে কুটিল হাসি ফুটিয়ে বলে,

— “তাহলে তো চিঠি পড়ে দেখতে হচ্ছে! দেখি, নিখিল ভাই কি লিখেছে!”
— “কীহ্?”

রিংকু ভীষণ অবাক হয়। দু’ জনেই দুষ্টের শিরোমণি বটে, কিন্তু এই প্রথমবার বড়’পার চিঠি নিয়ে দুষ্টুমি করতে ইচ্ছে করে না রিংকুর। এরমধ্যে বাড়ির কাজের মহিলাটাকে দেখা গেল। হলরুমের দরজায় দাড়িয়ে উনি ডেকে গেলেন,

— “ভাইজানেরা তাড়াতাড়ি আয়েন। ইস্কুল যাওয়ার সময় পার হইয়া যাইতেছে!”

সেদিকে একঝলক চেয়ে হাত নাড়িয়ে রিংকুর জবাব,
— “যাচ্ছি। যাও!”

তারপর ভাইয়ের দিকে ফিরে বলে,
— “মানে এই চিঠি আমরা আগে পড়বো। দেখবো, নিখিল ভাই কি কি লিখেছ। তারপর আপাকে দেব! ঘরে চল এখন—”

খামটা পকেটে লুকিয়ে সহোদরকে টানতে টানতে ভেতরে চলে গেল। অনেক হয়েছে দাঁত ঘষাঘষি। কোনোমতে মুখটা ধুয়েই ঘরে গিয়ে দোর দিয়ে চিঠি পড়তে বসবে! আহা, নিখিল ভাইয়ের প্রেমময় চিঠি পড়বার জন্য তর সইছে না পরাণে—

চলবে___

#মৌরিন_আহমেদ

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
সকল পর্বের লিংক
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=122111588804106938&id=61553208165829&mibextid=2JQ9oc

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here