প্রিয়াঙ্গন #পার্ট_১৬ জাওয়াদ জামী জামী

0
334

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_১৬
জাওয়াদ জামী জামী

রাত এগারোটা। জয় কানে হেডফোন গুঁজে, গান শুনতে শুনতে বাসায় ফিরছিল। বাসা থেকে কিছুটা দূরে ফাঁকা একটা জায়গায় হঠাৎই একজনের সাথে ধাক্কা লাগল।

” কি রে মামুর ব্যাটা, ধাক্কা দিলি কেন বে? ”

” সরি ব্রো, আমি বুঝতে পারিনি। ” কান থেকে হেডফোন খুলে বলল জয়।

” চুপ শা’লা। আগে বল ধাক্কা দিলি কেন? ” ছেলেটা তেড়ে আসল জয়ের দিকে।

জয় কিছু বুঝে উঠার আগেই আরও চারজন ছেলে সেখানে হাজির হয়। তারা একজোট হয়ে জয়ের সাথে ঝগড়া শুরু করে। একপর্যায়ে একটা ছেলে জয়কে থা’প্প’ড় দেয়। জয়ও তেড়ে গিয়ে সেই ছেলেকে থা’প্প’ড় দেয়। সেই সাথে আজেবাজে গালিও দেয়। এতে ছেলেরা রে’গে গিয়ে জয়কে থা’প্প’ড় মা’র’তে থাকে।

পাঁচজনের সাথে একা পেরে উঠলনা জয়। ও নেতিয়ে গেছে। হঠাৎই পেছন থেকে একটা শক্তপোক্ত হাত ওকে পেঁচিয়ে ধরল। পিঠমোড়া করে বাঁধল ওকে। এরপর চোখও বেঁধে দেয়। হঠাৎই জয় অনুভব করল ও রাস্তায় হুটোপুটি খাচ্ছে। ওর বাম গাল, কান অসার হয়ে গেছে। এবার জয় ভয় পেয়ে গেছে। ও কোন অনুভূতি ব্যক্ত করার আগেই কেউ ওর পায়ে হকিস্টিক দিয়ে উপর্যুপরি আঘাত করতে থাকে। পাঁচজন ছেলে তখন নির্বিকার হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে রাস্তায় অসহায়ের মত পরে থাকা জয়কে। ওর মস্তিষ্ক ভোঁতা হয়ে আসছে। মা’রে’র কারনে ওর জ্ঞান প্রায় লুপ্ত হয়েছে। তবে পুরোপুরি জ্ঞান হারানোর আগে কারও কয়েকটা তেজদ্বীপ্ত বাক্য ওর কুর্নকুহরে প্রবেশ করল। ওর কানে কথাগুলো পৌঁছালেও মস্তিষ্ক ধরতে পারলনা গলাটা কার। সেই ব্যক্তি বেদম পেটাচ্ছে আর বলছে,

” তুই কার সম্পদে হাত দিয়েছিস, একবারও ভেবে দেখেছিস? আমার সম্পদে হাত বাড়ানো দূরের কথা, কেউ চোখ তুলে তাকালে আমি সেই চোখ উপড়ে ফেলব। আমার জিনিস দেখার অধিকার শুধু আমারই আছে। তুই নরকের কীট নরকেই থাকবি। সেটা না করে, আমার সম্পর্কের মাঝে থার্ড পারসন হতে এসেই অকালে হাত-পা ভাঙতে হচ্ছে। এটা ফার্ষ্ট এ্যান্ড লাস্ট ওয়ার্নিং। এরপর তোর ছোঁকছোঁক স্বভাব দেখলেই মাটিতে পুঁতে দেব। কেউ কিচ্ছুটি টের পাবেনা। ”

পুরো কথা শোনার আগেই জয় জ্ঞান হারায়।

রাত একটা পঁচিশে শায়লা হাসান তাহমিদের রুমের দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে।

তাহমিদ দরজা খুলে চোখ কচলে তাকায়।

” তাহমিদ, আমাকে নিজেকে মেডিকেলে চল। তারাতারি রেডি হয়ে নাও। ” শায়লা হাসানের ব্যাকুল গলায় বলল।

” কেন খালামনি! এই রাতে মেডিকেলে যাবে কেন? কি হয়েছে তোমার? ”

” আমি ঠিক আছি। জয়ের নাকি কিছু হয়েছে। ওর ফোন থেকে একজন আমাকে ফোন দিয়ে জানাল, জয়কে নাকি মেডিকেলে এডমিট করা হয়েছে। এখন কথা বলার সময় নেই। তুমি রেডি হয়ে এস। আমি ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলেছি। ”

তাহমিদ একটা হাই তুলে হেলতে দুলতে ওয়াশরুমে ঢুকে, চোখমুখে পানি ছিটিয়ে বেরিয়ে আসল।

শায়লা হাসান ছেলেকে দেখা মাত্রই কেঁদে উঠল। ভাঙ্গা ডান হাত আর বাম পা নিয়ে বেডে শুয়ে ব্যথায় কাতরাচ্ছে জয়। ওর পুরো শরীরে মা’রে’র কালসিটে দাগ দেখে শিউরে উঠেছে শায়লা হাসান ও নায়লা আঞ্জুম।

বেডের একপাশে নির্বিকারচিত্তে দাঁড়িয়ে আছে তাহমিদ। ওর পাশে রায়হান আহমেদ দাঁড়িয়ে ঘন ঘন হাই তুলছেন।

শায়লা হাসান তোড়জোড় করছে জয়কে এখান থেকে নিয়ে যেতে। সে তার ছেলেকে ভালো কোন ক্লিনিকে এডমিট করতে চায়। সে ইতোমধ্যে ফোনে বেশ কয়েক জায়গায় কথা বলেছে।

” তাহমিদ, এসব কি! মেডিকেলে কি মানুষের চিকিৎসা হয়না? জয়কে একটা রাত এখানে রাখলে কি হবে। কাল সকালেই না-হয় কোন ক্লিনিকে নিত। আমি এখানে আসতেই চাইনি। শুধু তোমার খালার খ্যাঁচখ্যাঁচানির জন্য আসলাম। এমনিতেই এই জয়কে আমার পছন্দ হয়না। কেমন একটা লাফাঙ্গা টাইপের ছেলে। ”

” আপনাকে চাচাশ্বশুর বানাতে সে তৎপর হয়ে গেছে। এটা আপনি জানার পর কি প্রতিক্রিয়া দেখান, সেটা দেখার বড় সাধ হচ্ছে। ” বিরবিরিয়ে বলল তাহমিদ।

” কিছু বললে? ”

” হুম? বললাম, সবই কর্মফল। ”

রায়হান আহমেদ এই বিষয়ে কথা বলার আগ্রহবোধ করলেননা। তিনি বাহিরে গিয়ে সিগারেট ধরালেন।

রাত তিনটা নাগাদ কলিংবেলের আওয়াজ শুনে দরজা খুলে দেন রাজিয়া খালা। তিনি জয়কে দেখে আৎকে উঠেছেন। ওকে স্ট্রেচারে করে বাসায় নিয়ে এসেছে! কুহু একপাশ থেকে দাঁড়িয়ে সবটা দেখল। জয়ের এই অবস্থা দেখে ওর খারাপ লাগলেও, ওর ইচ্ছে করছেনা জয়ের কাছে যেতে। তাই ও নিজের রুমে চলে যায়। তাহমিদ আঁড়চোখে কুহুকে দেখে মৃদু হাসল।

সকাল থেকে শায়লা হাসান ব্যতিব্যস্ত হয়ে ছেলের দেখাশোনা করছে। দুইজন ডক্টর এসেছে জয়ের চেক-আপ করেছে। শায়লা হাসান চাচ্ছে ছেলেকে নিয়ে যত তারাতারি সম্ভব খুলনা ফিরে যেতে। জয়ের বাবা খালেদ হাসান ছেলেকে চিকিৎসা করাতে সিঙ্গাপুর নিয়ে যাবেন। তিনি ইতোমধ্যেই সব ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছেন। এটা তিনি খুলনা থেকে ফোনেই জানিয়েছেন।
কুহু অবাক হয়ে এদের কাজকর্ম দেখছে। তবে এখন পর্যন্ত ও জয়ের আশেপাশে যায়নি। আর ওর সেখানে যাওয়ার মোটেও ইচ্ছে সেই।

সেদিন শায়লা হাসানের খুলনা যাওয়া হলোনা। ডক্টর তিন-চার দিন জয়কে কোথাও নিতে বারণ করেছেন। তাই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আগামী পাঁচদিন তারা রাজশাহীতেই থাকবে।

কুহু সকালে খালাকে যতটা সম্ভব কাজে সাহায্য করেছে। নানিমাকে খাইয়ে দিয়েছে। তারপর টুকিটাকি কাজ সেড়ে ও বেরিয়ে পরে কোচিং-এর উদ্দেশ্যে। একসাথে দুইটা কোচিং করে বাসাটা আসবে।
আজকে বাসা থেকে বেরিয়ে কুহু একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আজকে জয়ের ভয় ওকে তাড়া করছেনা। কিন্তু ছেলেটার জন্য ওর সত্যিই খারাপ লাগছে। কুহু একটা মানুষকে যতই অপছন্দ করুক, তাই বলে তার খারাপ চাইতে ও কখনোই পারেনা। সেই শিক্ষা ও পায়নি।
আজ আশেপাশে তাহমিদকেও দেখলনা। কুহু জানতেই পারেনি, তাহমিদ আরও আগে বাসা থেকে বেরিয়েছে।

কোচিং শেষ করে রাস্তায় এসে দাঁড়াতেই কোথায় থেকে তাহমিদ এসে হাজির। আজও সে রিক্সা নিয়ে এসেছে। কুহু তাহমিদকে দেখে চোখ ছোট করে তাকায়।

” এভাবে তাকিয়ে না থেকে রিক্সায় উঠো। তোমার জন্য মামার সময় বসে থাকবেনা। ” বরাবরের মতোই খোঁ’চা দিল তাহমিদ।

কুহুর খুব করে ইচ্ছে করলো লোকটাকে বলতে, ও তার সাথে যাবেনা। সেই সাথে কয়েকটা কথাও শুনিয়ে দিতে ইচ্ছে করল। কিন্তু ওর সব কথা কন্ঠায় এসে আটকে গেল। কুহু ভেবে পায়না জয়কে কিছু বলার সময় ওর তো এমন হয়না! কিন্তু এই লোকের সামনে আসলেই কথারা কেন এভাবে বেইমানী করে?

” চিন্তাবতী, রিক্সায় উঠেও তো চিন্তা করা যায়? তুমি রিক্সায় উঠে যত খুশি চিন্তা কর। ”

কুহু কিছু না বলে রিক্সায় চড়ে বসে। ও গতদিনের মতই জড়োসড়ো হয়ে বসেছে। তাহমিদও ওর থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছে। কিন্তু ওর হাত ঠিকই পেছনে রেখেছে, যাতে কুহু ব্যথা না পায়।

আজও উল্টোদিকে রিক্সা যেতে দেখে কুহু কিছু একটা ভেবে তাহমিদের দিকে তাকায়।

” আজও কি আমাকে বিক্রি করতে নিয়ে যাবেন? ”

হঠাৎ কুহুর এমন কথা শুনে তাহমিদ ভড়কে যায়। পরক্ষনেই ওর গতকালের বলা কথাগুলো মনে হয়। সে-ও কম যায়না। কুহুকে খোঁ’চা দেয়ার সুযোগ পেয়ে যায়।

” হুম। কালকের মত তিড়িংতিড়িং করছনা যে? ভয় কি তবে কেটে গেছে! ”

” যা পাবেন তার আধান ভাগ হবে কিন্তু। অর্ধেক আপনার, অর্ধেক আমার। ”

তাহমিদ এবার ভ্যাবাচ্যাকা খায়। ও কুহুর কথার মানে বুঝতে পারেনি। তাই সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চায় কুহুর দিকে।

কুহু সেটা বুঝতে পেরে অনেক কষ্টে হাসি চাপিয়ে রেখে বলে,

” ঐ যে আমাকে বিক্রির টাকার আধাআধি ভাগের কথা বললাম। ”

তাহমিদ কুহুর এমন কথা শুনে রে’গে উঠল।

” ফাজিল মেয়ে, কতবড় সাহস আমার কাছ থেকে টাকার ভাগ চায়। আগে বুঝতে শিখ, আমার টাকা মানেই তোমার টাকা। তারপর ভাগ চাইবে। না বুঝেই অযথা লাফালাফি আমি পছন্দ করিনা। চুপচাপ বসে থাক। নইলে এক ধাক্কা দিয়ে রিক্সা থেকে ফেলে দেব। ”

তাহমিদের প্রচ্ছন্ন হুমকি শুনে কুহু সত্যিই ভয় পায়। ও আর কোন কথা না বলে বসে থাকে। রিক্সা গিয়ে থামল একটা মার্কেটের সামনে। কুহু ভাবছে, তাহমিদ ওকে এখানে কেন নিয়ে আসল!
কিন্তু ও তাহমিদকে প্রশ্ন করার সাহস পায়না। বাধ্য হয়ে ওকে তাহমিদের পিছুপিছু যেতে হয়।

” তোমার চাচাতো ভাই-বোনের জন্য ড্রেস সিলেক্ট কর। বিশেষ করে রিশার জন্য। ও কিসব জামাকাপড় পড়ে, সেসবের নাম আমার জানা নেই। ওর সাইজ অনুযায়ী দুইটা ড্রেস সিলেক্ট কর। এরপর নিশোর জন্য দেখবে। ”

কুহু তাহমিদের কথামত দুইটা ড্রেস সিলেক্ট করল। নিশোর জন্যও করল। এরপর তাহমিদের ধমক হজম করে সৃজনের জন্য টি-শার্ট আর জিন্সের প্যান্ট পছন্দ করল। এরপর ওকে নিয়ে তাহমিদ মার্কেটের বাহিরে একটা রেস্টুরেন্টে বসল।

” কি খাবে, অর্ডার দাও। ”

” আমি কিছু খাবোনা। বাসায় যাব। ”

” তুমি না খেলেও আমি খাব। আর তুমি চুপচাপ বসে থেকে দেখবে। আমার খাওয়া শেষ হলেই তবে তুমি বাসায় যেতে পারবে। ”

কুহু আর কিছু না বলে মুখ গোমড়া করে বসে থাকল।

তাহমিদ খাবার অর্ডার দিয়ে, কুহুকে রেস্টুরেন্টে রেখে কোথাও বেরিয়ে যায়। কুহু বিরসবদনে বসে বসে চারপাশ পর্যবেক্ষন করতে থাকল।

প্রায় বিশ মিনিট পর তাহমিদ হাতে একটা প্যাকেট নিয়ে রেস্টুরেন্টে আসল। এরইমধ্যে খাবার আসলে নীরবে দুইজন খেয়ে নেয়। কুহু একটু আঁইগুঁই করলে, তাহমিদের ধমক খেয়ে চুপসে যায়।

কুহুর আজ ভিষণ ভয় করছে। আজকে বাসায় আসতে একটু বেশিই দেরি হয়েছে। চাচি ওকে কি বলবে সেটা ভেবেই ওর হাত-পা কাঁপছে। তাহমিদ ওকে বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে কোথাও চলে গেছে। যাবার আগে ওর কাছ থেকে সব প্যাকেট নিজের কাছে নিয়ে, শুধু দুইটা প্যাকেট কুহুকে দেয়। কুহু দেখল একটাতে সৃজনের জন্য কেনা পোশাক। অপরটাতে কি আছে তা সে জানেনা। তাহমিদকে প্রশ্ন করেও লাভ হলোনা। ও শুধু বলল, এটা কাউকে না দেখাতে। রুমে গিয়ে যেন প্যাকেট খোলে। কুহু আল্লাহকে ডাকতে ডাকতে বাসায় প্রবেশ করল।

ড্রয়িংরুমে ঢুকে নায়লা আঞ্জুমকে আঁড়চোখে খুঁজল কুহু। কিন্তু তাকে কোথাও দেখতে পেলনা। ও হাঁফ ছাড়ল। এক দৌড়ে চলে যায় নিজের রুমে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here