ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা |৪৮|

0
215

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৪৮|
মিসেস উদয়িনী ইজ নো মোড়! ডক্টর উদয়িনী আর নেই৷ দু’টো সন্তান আজ মাতৃহারা। সোহান খন্দকার বিপত্নীক হলেন৷ দুনিয়াতে নতুন প্রাণের আগমনে চারপাশ ঝলমলে হয়ে ওঠে৷ আপনজনেরা ছড়িয়ে দেয় উল্লাস। আনন্দে উদ্ভাসিত হয় সকলের মুখ।
আর পুরোনো প্রাণ বিদায় নিলে চারপাশ মলিনতায় ছেয়ে যায়। আপনজনেরা হয় শোকাবহে স্তব্ধ। মুখাবয়বে ফুটে ওঠে বিষণ্ণতা। মানুষের জীবন যেন প্রদীপের আলো। যতদিন বাঁচে ততদিন কাছের মানুষদের আলোকিত করে রাখে। যখন মৃত্যু ঘটে জ্বলন্ত প্রদীপটা ধুপ করেই নিভে যায়। অন্ধকারে নিমজ্জিত হয় তার সঙ্গে সম্পর্কিত প্রতিটি মানুষ।

সকালবেলা ডিউটির জন্য তৈরি হচ্ছিল সৌধ। আচমকা বাড়ি থেকে কল আসে। খবর পায়, সুহাসের মা উদয়িনী আন্টি আর নেই৷ নিমেষে মস্তিষ্ক নিশ্চল হয়। পা দু’টো হয় অবশ। বুকের ভেতর তীরের ফলার মতো এসে বিঁধে সিমরানের মলিনত্বে ঘেরা শুভ্র মুখশ্রী। ঝাপসা সেই অক্ষিযুগল স্মরণ হতেই শ্বাস-প্রশ্বাসে অস্থিরতা বাড়ে। ফোন রেখে থমকানো দৃষ্টিতে স্ক্রিনে আঙুল চালায়। সুহাস! সুহাস, নামী জানে? কোথায় ওরা? ভেবেই ত্বরিত সুহাসের ফোনে কল দেয়। ওপাশ থেকে নামী রিসিভ করে। কান্নারত গলায় বলে,

‘ সৌধ ভাই, আমরা রওনা হয়েছি। কখন পৌঁছাব জানি না৷ আপনি এখন কোথায়? ‘

‘ আমি এক্ষুনি বেরুচ্ছি নামী। তুমি জাস্ট সুহাসকে সামলে নিয়ে এসো। আয়াজ! আয়াজ, ফারাহ আছে তো? ‘

‘ হ্যাঁ, ওরা আছে৷ ‘

বলেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল নামী। সৌধ ফোন রেখে নিজের কিছু জিনিসপত্র গুছিয়ে তৎক্ষনাৎ বেরিয়ে পড়ল। ওরা পৌঁছাল সন্ধ্যাবেলা। সুহাসদের বাড়িটা নিরিবিলি হলেও আলাদা প্রাণ ছিল৷ আজ যেন জাঁকজমকপূর্ণ বাড়িটা প্রাণশূন্য। যে বাড়িতে এতদিন মানুষের দেখা মেলাই কঠিন ছিল। আজ সে বাড়িতে গিজগিজে মানুষ। সদর দরজা অব্দি পৌঁছাতে বেশ বেগ পেতে হলো সুহাস, নামীকে। আইয়াজ ভীড় ঢেলে আগে যাচ্ছিল। সুহাস, নামী এসেছে দেখেই জড়বস্তুর ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ দু’দিকে ভাগ হয়ে গেল। সুহাসের পা দু’টো নড়ছে না। শরীর টলছে। নামী শক্ত করে তার হাত ধরে আছে। এগুচ্ছে একটু একটু করে। সুহাস শোকে স্তব্ধ। তার ধূসর দৃষ্টিজোড়া আজ ভয়াবহ রক্তিম। নিথর দেহে মাকে দেখলেই বোধহয় রক্ত বেরুবে ওই দৃষ্টিদ্বয় বেয়ে। নামীর গলা শুঁকিয়ে কষ্ঠে রূপান্তরিত। বুকের ভেতরটা ক্ষতবিক্ষত। মা হারার যন্ত্রণা জানে সে। তাই সুহাস আর সিমরানের মনের অবস্থা টের পেল। বুকের ভেতর ধকধক করছে৷ কীভাবে সামলাবে সুহাসকে? সিমরানকেই বা কী বলে সান্ত্বনা দেবে আজ? সান্ত্বনা দেয়ার মতো কোনো ভাষাই যে জানা নেই তার কাছে।

সুহাস সদর দরজায় পা রাখতেই হৃদয়ে রক্ত ক্ষরণ ঘটল। তাদের সাজানো, গোছানো বিশাল বড়ো ড্রয়িং রুমের সব আসবাবপত্র একপাশে রাখা। ফ্লোরের মধ্যিখানে সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে মাকে। তার পায়ের কাছে হাত, পা ছেড়ে বসে আছে সোহান খন্দকার। তার পাশে সুহাসের দুই মামা। মাথার কাছটায় বিধ্বস্ত রূপে সিমরানকে দেখতে পেল। চোখের জল শুঁকিয়ে আবারো গাল দুটো ভিজে ওঠেছে মেয়েটার৷ সারাদিনে কতবার জ্ঞান হারিয়েছে হিসেব নেই। এলোমেলো ভেজা চুল দেখে বোঝা গেল মাথায় পানি ঢালা হয়েছে বেশ কয়েকবার। চিৎকার করে কান্নাকাটি আর মাকে ডাকাডাকির ফলে গলা ভেঙে গেছে। এখন আর শব্দ করে কাঁদতে পারছে না মেয়েটা। আশপাশে পরিচিত, অপরিচিত অনেক আত্মীয়কে দেখতে পেল সুহাস৷ সিমরানের পাশে একজন সুদর্শনীয় বৃদ্ধা বসে আছেন। তীক্ষ্ণ চোখে তাকালে বোঝা যাবে, তার চোখ দু’টি কাঁদছে না। কেঁপে কেঁপে ঠোঁটজোড়া নড়ছে শুধু। দোয়া পড়ছে। বুঝল সুহাস। কারণ বৃদ্ধাটি তার নানুমনি। যার চোখ না কাঁদলেও মনটা হুহু করে কাঁদছে। সন্তানের মরা মুখ কোন মায়ের সহ্য হয়? শেষ বয়সে এসে সন্তানের মৃত্যু দেখা একজন বৃদ্ধার জন্য নির্মমই বটে। নিশ্চল দেহে স্তব্ধ চোখে সমস্তই অবলোকন করল সুহাস। এরপর বা’পাশে ঘাড় ঘুরাল। শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করল স্ত্রী নামীর দিকে। নামীর বুক ধক করে ওঠল। সুহাস সন্তর্পণে নামীর হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিল। টলানো শরীরে এগিয়ে গেল মায়ের প্রাণহীন দেহের কাছে। ভাই এসেছে! আচমকা ভাঙা গলায় ভাইয়া ডেকে এক চিৎকার দিল সিমরান। যে চিৎকার সুহাসের হৃদয় নাড়িয়ে দিল। পুরুষ মানুষ। তবু নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। ছুটে গিয়ে বোনকে জড়িয়ে ধরে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। দুই ভাইবোনের গগনবিদারী সে চিৎকারে পুরো বাড়ি কেঁপে ওঠল। কেঁপে ওঠল সোহান খন্দকারের স্বামী সত্তা, পিতৃ সত্ত। পাশ থেকে সুহাসের মামা কান্না করতে করতে বলল,

‘ দুলাভাই ওদের কাছে যান। ছেলেমেয়ে দু’টোকে ভরসা দিন। ‘

নামী ছুটে এসে ততক্ষণে সুহাসকে ধরেছে। সিমরান ভাইয়ের বুকে সমানতালে কিল বসাতে বসাতে বিলাপ করছে,

‘ আম্মুকে ফিরিয়ে দাও ভাইয়া, ফিরিয়ে দাও আমার আম্মুকে। তুমি তো ডাক্তার ফিরিয়ে দাও আমার আম্মুকে প্লিজ। এমন কোনো ইনজেকশন দাও যাতে আম্মু জেগে ওঠে। ‘

‘ মা আর ফিরবে না সিনু। মা আর ফিরবে না। ‘

রেগে গেল সিমরান। চিৎকার করে বলল,

‘ কেমন ডাক্তার তুমি? নিজের মাকে বাঁচাতে পারবে না? ‘

বলেই ফোপাঁতে শুরু করল। সোহান এসে ছেলেমেয়েকে জড়িয়ে ধরল। কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হতেই সুহাস বাবার আলিঙ্গন ছেড়ে মায়ের কাছে গিয়ে বসল। দু’হাতে চোখের পানি মুছতে মুছতে নাক টেনে বলল,

‘ ও মা, আমি এসেছি৷ তোমার সুহাস। ‘

নামী এসে সুহাসের কাঁধ জড়িয়ে ধরে ডুকরে ওঠল। সুহাস সেদিকে ভ্রুক্ষেপও করল না। বাবার বুকে মাথা রেখে কতক্ষণ নিশ্চুপ রইল সিমরান৷ সহসা তার দুই মামি এসে বলল,

‘ দুলাভাই আপাকে গোসল করাতে হবে। সময় বেশি নেই। ‘

এশার নামাজের পর জানাজা পড়ানো হবে। কবর হবে, সোহানদের গ্রামের বাড়ির গোরস্তানে। মামির কথা শুনে তড়াক করে বাবার বুক থেকে মাথা তুলল সিমরান। হাঁটু ভর দিয়ে চলে গেল মায়ের মাথার কাছে। মাথায় কাঁপা কাঁপা হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মৃদু কণ্ঠে ডাকল,

‘ আম্মু, আম্মু ও আম্মু। ‘

সুহাসও ডাকল,

‘ মা ও মা, মা। ‘

সোহান খন্দকার ওদের কাছে আসতে নিলে নানুমনি বাঁধা দিলেন। বললেন,

‘ কিছুক্ষণ চোখ ভরে দেখুক ওরা। মন ভরে মাকে ডাকুক। বাঁধা দিও না বাবা। আর তো দেখতে পারবে না। আর তো ডাকতে পারবে না। ‘

বলতে বলতেই ফুঁপিয়ে ওঠলেন বৃদ্ধা। মায়া দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন মৃত মেয়ে আর তার জীবন্ত দুই নাতি নাতনিকে। এরপর ছেলেদের দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘ আমাকে ঘরে দিয়ে আয় কেউ। নামাজে বসব আমি। ‘
.
.
সুহাসের বন্ধু, বান্ধব সকলেই উপস্থিত। উপস্থিত সৌধদের বাড়ির সদস্যরাও। সৌধ এখন পর্যন্ত ভেতরে আসেনি৷ সে বাড়ির সামনেই নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে ঢুকলেই বন্ধুর করুণ দশা দেখতে হবে। দেখতে হবে বিধ্বস্ত রূপী সিমরানকেও। কেন যেন সাহস পেল না ভেতরে ঢুকবার। অপেক্ষা করতে লাগল শুধু। সুহাসদের গ্রামের বাড়ি যেতে হবে। গাড়ি সব রেডি। উদয়িনী আন্টির দেহ বিদায় পর্ব শেষেই বেরুবে। উদয়িনীকে কাফনের কাপড়ে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে। সিমরান, সুহাস নির্বাক চোখে তাকিয়ে আছে। তাদের মা যেন হাসছে৷ সিমরান অভিমানে ভেঙে পড়ল। থমথমে কণ্ঠে সুহাসকে বলল,

‘ দেখো ভাইয়া, আম্মু হাসছে। ‘

এটুকু বলতেই গলা জড়িয়ে এলো। নিজেকে সামলে নিল মুহুর্তেই সময় বেশি নেই। ভেবেই ভেতরটা কাঁপতে লাগল। নিঃশ্বাস রোধ। মায়ের মুখে নিষ্পলক তাকিয়ে হঠাৎ সিমরান বলল,

‘ আম্মু, অ্যাঁই আম্মু। এত অল্প সময় ছিল তোমার আমার জন্য? ‘

একটু থামল। পরোক্ষণেই হাঁপানো সুরে বলল,

‘ কেমন ঘুম ঘুমালে আম্মু? এত ডাকলাম তবু ওঠলে না? ‘

সুহাস মায়ের দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে। সিমরান ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রাগান্বিত হয়ে বলল,

‘ তোমার ছেলে কেমন ডাক্তার হলো যে মায়ের ঘুম ভাঙাতে পারছে না? লাখ লাখ টাকা খরচ করে ছেলেকে ডাক্তার করলে এত তাড়াতাড়ি আমাদের মা হারা করার জন্য? ‘

নামী এসে মাথায় হাত রাখল সিমরানের। সিমরান নামীকে দেখে ছোটো ছোটো করে তাকাল। বলল,

‘ এই যে আরেক ডাক্তারনি। তোমরা আমার আম্মুর ঘুম ভাঙাতে পারছ না কেন? কোনো মেডিসিন কি নেই ঘুম ভাঙানোর? ‘

নামী কেঁদে ফেলল আবার। সিমরানকে জড়িয়ে ধরে বলল,

‘ চিরনিদ্রা ভাঙানোর ক্ষমতা পৃথিবীর কোনো ডাক্তারেরই নেই সিনু। ‘
.
.
রাত প্রায় এগারোটা। সুহাসকে নিয়ে বন্ধুরা বাড়ি ফিরে এলো। সোহান খন্দকার আজ আর ফিরবেন না৷ সৌধ, আইয়াজ, প্রাচী সহ অনেক বন্ধুরাই আছে। সুহাসের পাশে রয়েছে তারা। নেই শুধু নিধি। তার গর্ভাবস্থার শেষ ধাপ। নয়তো ঠিকই আসত। জানে সবাই। সৌধদের বাড়ি থেকে খাবার এসেছে। সৌধ আইয়াজ মিলে নামীকে দিয়ে সুহাসের রুমে খাবার আনালো। নামী খাইয়ে দিতে চাইল৷ সুহাস খেলো না৷ সৌধ জোর করল৷ বোঝাল তাকে এখন শক্ত থাকতে হবে। বাবা, বোন সবাইকে সামলাতে হবে। বোনের প্রসঙ্গ আসামাত্র সম্বিৎ ফিরল সুহাসের। থমকানো গলায় বলল,

‘ সিনু! সিনু কোথায়? সারাদিন কিছু খায়নি ও। আমার বোনটাও মরে যাবে। ‘

নামী কম্পিত কণ্ঠে বলল,

‘ তানজিম আন্টি আছে সিনুর কাছে। নানুমনিও আছে। আন্টি খাওয়ানোর চেষ্টা করছে ওকে৷ তুমি প্লিজ খেয়ে নাও। ‘

শান্ত হলো সুহাস। ভাতের থালা ঠেলে দূরে সরিয়ে বলল,

‘ একদিন না খেলে কিছু হবে না। জাস্ট এক গ্লাস ঠান্ডা পানি খাব। ‘

তৎক্ষনাৎ নিচে গিয়ে ঠান্ডা পানি আনল নামী। অনেক জোরাজোরি করেও খাওয়াতে পারল না সুহাসকে৷ যত সময় বাড়ল ছেলেটা ততই ভেঙে পড়ল। মুখ দিয়ে শুধু একটা কথাই বেরুলো,

‘ ওই অন্ধকারে কীভাবে মাকে মাটিচাপা দিয়ে এলাম আমি! ‘

সুহাসের অবস্থা দেখে দুঃশ্চিতায় পড়ে গেল সৌধ। সারাদিন অনেক ধকল গেছে। মানসিক অবস্থাও বিধ্বস্ত। একটু ঘুমাতে পারলে কাজ হতো৷ কিন্তু আজ কি ঘুম আসবে ওর? অনেক ভেবে নামীকে ইশারায় বাইরে যেতে বলল। এরপর দু’জন পরামর্শ করে ঘুমের ইনজেকশন আনিয়ে সুহাসকে বুঝতে না দিয়ে কৌশলে পুশ করে দিল। সুহাস টের পেল যখন তখন সৌধর হাত চেপে ধরল। সৌধ স্মিত হেসে বলল,

‘ তোর ঘুম প্রয়োজন। ‘

এরপর সুহাসের দায়িত্ব নামীকে দিয়ে বন্ধুরা ওদের বেডরুম থেকে বেরিয়ে এলো। তখন নিচে যেতেই প্রাচী বলল,

‘ সুহাসের মামিরা খেতে ডাকছে চল খেয়ে নিই। ‘

এমন সময় পাঁচ বছরের তাহানী নিচে নেমে এলো। গুটিগুটি পায়ে সৌধর কাছে এসে বলল,

‘ সিনুপু খাচ্ছেই না। বড়ো মা আমাকে জোর করে খাওয়াতে পারে। সিনুপুকে পারেই না। ছোটো ভাইয়া? আমার আম্মুও তো আল্লাহ তায়ালার কাছে চলে গেছে। আমিত অভিমান করে না খেয়ে থাকি না৷ সিনুপুকে কতবার বললাম। কেয়ারই করল না। আজ তাহানী বেবিকে পাত্তাই দিচ্ছে না। ‘

হাত নেড়ে নেড়ে কথাগুলো বলে হাঁপিয়ে ওঠল তাহানী৷ সৌধ ভ্রু কুঁচকে মনোযোগ দিয়ে শুনল কথা গুলো। এরপর আচমকা প্রাচীর দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ তোরা খেয়ে নে। আমি সিনুর কাছে যাচ্ছি। ‘

কথাটা বলেই দেরি করল না সৌধ। তাহানীকে কোলে তুলে উপরে চলে গেল। উদয়িনী আন্টির রুমে।কারণ সিমরান ওখানেই আছে। নানুমনিকে মাত্রই সুহাসের বড়ো মামি এসে নিয়ে গেল। ঘরে এখন তানজিম চৌধুরী আর সিমরান। সুজা এমপির পত্নী সিমরানের কাছে রয়েছে। এতেই সকলে বেশ নিশ্চিন্ত। আর কাউকে প্রয়োজন নেই সিমরানের জন্য৷ সকলে এটা ভাবলেও সৌধর মন বলল সিমরানের পাশে তাকে ভীষণ প্রয়োজন। সৌধ ঘরে এলো। দেখল, ভাতের থালা হাতে মন খারাপ করে বসে আছে তার আম্মা। আর সিমরান বিষণ্ন মুখে নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে আছে দেয়ালের দিকে। তাহানীকে কোল থেকে সযত্নে নামাল সৌধ। মাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘ আম্মা, খাচ্ছে না সিনু? ‘

‘ না বাবা। এত বুঝাচ্ছি। কেমন থম ধরে আছে। এভাবে তো সমস্যা হবে। সুহাস খেয়েছে? ‘

‘ না। এক গ্লাস পানি খেয়েছে শুধু। ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে এলাম। ‘

হতাশা ভরে নিঃশ্বাস ছাড়লেন তানজিম। সৌধ এগিয়ে এলো। আচমকা বলল,

‘ যদি কিছু মনে না করেন আমি সিনুর সঙ্গে একা কথা বলতে চাই। ‘

সহসা ছেলের কথায় চমকে ওঠল তানজিম। বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কয়েক পল। এরপর ধাতস্থ হয়ে নেমে দাঁড়াল। সৌধ মায়ের হাত থেকে ভাতের থালা নিজ হাতে নিয়ে বলল,

‘ আমি চেষ্টা করি? ‘

শোকের মাঝেও এক টুকরো সুখ ফুটে ওঠল তানজিম চৌধুরীর চোখে। ত্বরিত ছেলেকে অনুমতি দিয়ে তাহানীকে নিয়ে চলে গেল সে। দরজা খোলাই রাখল। আম্মা বেরিয়ে যেতেই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সিমরানের পাশে বসল সৌধ৷ খেয়াল করল সিনুর মনে কোনো ভাবান্তর নেই। একই ভাবে বসে একই দৃষ্টিতে তাকিয়ে। হাত পরিষ্কারই ছিল। তাই ডাল আর আলুভাজি দিয়ে ভাত মেখে সিমরানের মুখের সামনে ধরল। শীতল গলায় বলল,

‘ না খেয়ে থাকলে আন্টি ফিরে আসবে না সিনু৷ হা কর। আন্টি চলে গেছে। তার জায়গা কেউ পূরণ করতে পারবে না জানি। কিন্তু আমরা সবাই তোর পাশে আছি। আমি তোর পাশে আছি সিনু। ‘

শেষ বাক্যে কী যেন মিশে ছিল। যা সহসা বুকে কম্পম সৃষ্টি করল সিমরানের। অদৃশ্য একটি ঘোর থেকে বেরিয়ে এসে বিস্মিত চোখে সৌধর পানে তাকাল সে৷ দৃঢ় চোয়াল বিশিষ্ট সুগভীর চোখ দু’টোয় মলিনত্বের ছাপ স্পষ্ট। তবু অদ্ভুত এক শীতলতা খুঁজে পেল। যা প্রগাঢ় হলো তার মুখের সামনে ধরে রাখা পুরুষালি বলিষ্ঠ হাতটি দেখে৷ নিমেষে ভেতর থেকে কান্না উপচে এলো সিমরানের। কিন্তু কাঁদল না সে। হতভম্ব মুখে একবার সৌধর হাত আরেকবার চোখে তাকাতে লাগল শুধু৷ সৌধ একই সুরে পুনরায় বলল,

‘ ছোটো থেকেই নিজহাতে খেতে ভালোবাসি৷ কারো হাতে খাই না৷ কাউকে খাইয়েও দিই না। আজ তোকে দিচ্ছি, নে হা কর। ‘

ভাগ্যের কী লীলা! ভারিক্কি ব্যক্তিত্বের সৌধ চৌধুরী। নিধিতে ভয়ংকর মাত্রায় আসক্ত ছিল মানুষটা। কী নির্মমভাবেই না প্রত্যাখ্যান করেছে সেদিন সিমরানকে৷ আজ সেই সৌধ কিনা সিমরানের দুর্দিনে এভাবে পাশে থাকছে৷ অবিশ্বাস্য দৃশ্যে সিমরানের চিত্ত বিচলিত হলো কিঞ্চিৎ। মনের অস্থিরতা মুখে প্রকাশ করল না। সৌধ তৃতীয়বারের মতো তাকে খাবার মুখে নিতে বলল,

‘ সিনু হা কর। ‘

সৌধের কণ্ঠে দৃঢ়তা স্পষ্ট। সিমরান লম্বা একটি শ্বাস টানল। পলকহীন দৃষ্টিতে পলক ফেলল বারকয়েক। এরপর নির্লিপ্ত ভাবে সৌধর হাতটা দূরে ঠেলে দিল। ভাতের থালা নিজহাতে কোলের ওপর তুলে নিয়ে ঝাপসা হয়ে আসা চোখ দু’টি দিয়ে ফের তাকাল সৌধর পানে। কণ্ঠ ভাঙা ভাঙা৷ তবু বলল,

‘ আমি কি একেবারে নিঃশেষ হয়ে গেছি সৌধ ভাই?’

আকস্মিক কথায় সৌধর দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল। কেন জানি স্বাভাবিক লাগছে না সিমরানকে। সে কিছু বলতে উদ্যত হবে তক্ষুনি আবারো সিমরান বলল,

‘ আমি তোমার ভালোবাসা চেয়েছিলাম সত্যি। কিন্তু দয়া চাইনি একটুও। আমি জানি এমন সময় সহমর্মিতা দেখানো প্রয়োজন। কিন্তু তোমার থেকে এটা নিতে আমার কষ্ট বাড়বে।

‘ সিনু! ‘

সৌধর কণ্ঠে বিস্ময়। সিমরান থামিয়ে দিয়ে বলল,

‘ আমি নিজ হাতেই খাব। তুমি আমার কথা ভেবে এটুকু সহায়তা করতে এসেছ। এজন্য থ্যাংকিউ। ‘

গলায় কান্না আঁটকে কথাটা বলেই নিজহাতে ভাত তুলে মুখে দিল। না চিবিয়ে গিলে ফেলল নিমেষে। বলল,

‘ আমি বিজনেসম্যান সোহান খন্দকারের মেয়ে। ডক্টর উদয়িনীর মেয়ে আমি। ডক্টর সুহাসের বোন আমি। আর ডক্টর নামীর ননদ। আমার জন্য এদের ভালোবাসা আর সাপোর্টই যথেষ্ট। তোমার ভালোবাসা পাইনি৷ দায়টুকুরও প্রয়োজন নেই। এই দেখো একাই খেতে পারি। যাদের মা নেই তাদের তো একা একাই খেতে হয়। ‘

বলেই আবারো একনাগাড়ে ভাত তুলে মুখে দিতে লাগল। না ঠিকভাবে ডাল, আলুভাজির সঙ্গে মাখালো আর না চিবালো। সৌধ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল,

‘ সিনু আস্তে, আস্তে গলায় আঁটকে যাবে। ‘

শুনল না সিমরান। ওর অবস্থা দেখে হতভম্ব হয়ে গেল সৌধ। আজকের মতো একটি দিনে হয়তো ধমক দেয়া ঠিক হবে না। তবু কঠিন চোখে তাকাল।
ওর ভালোর জন্যই দৃঢ় কিন্তু নিচু গলায় ধমকও দিয়ে ফেলল। যে ধমকে কেঁপে ওঠল সিমরান। এতক্ষণ যা গিলেছিল সব বেরিয়ে এলো সহসা। সে মুখে হাত চেপে ধরলেও লাভ হলো না। হাতের দু’পাশ দিয়ে সব বেরিয়ে বিছানা নষ্ট হলো। চোখের সামনে এমন অবস্থা দেখে সৌধ উঁচু গলায় তার আম্মাকে ডাকতে লাগল। পাশাপাশি পানির গ্লাস নিয়ে এগিয়ে এলো সিমরানের কাছে। মুখের কাছে গ্লাস ধরে কঠিন গলায় রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল,

‘ পানি খা। ‘

পানি খেল সিমরান। সৌধর শরীরটা রাগে তখনো কাঁপছে। সিমরান শান্ত হয়ে এলে রাগটুকু আর প্রকাশ করল না। শুধু বলল,

‘ মেয়েদের জেদ থাকা ভালো, তেজও ঠিক আছে। কিন্তু ভুল স্থানে, ভুল মানুষে, ভুল বুঝে জেদ, তেজ কোনোটাই ভালো না। ‘

এ পর্যন্ত বলেই থেমে গেল। চোখ বুজে একটুক্ষণ কী যেন ভেবে চোখ মেলল আবার। সাদা পোশাকে, বিষণ্ন মুখশ্রীর সিমরানের দিকে গাঢ় চোখে তাকিয়ে বলল,

‘ ডক্টর উদয়িনীর মেয়ে, ডক্টর সুহাসের বোন তাই তো? ‘

কথা আঁটকে এলো তবু সিমরান জবাব দিল,

‘ বিশ্বাস হয় না? ‘

তীক্ষ্ণ রাগ ঝড়ে পড়ল যেন। সৌধ গম্ভীর হয়ে গেল। বলল,

‘ ডক্টর নামীর ননদ?’

দু-চোখে এবার অশ্রু ঝড়ে পড়ল সিমরানের। সৌধ দৃষ্টি সরিয়ে নিল মুহুর্তেই বলল,

‘ নিজেকে একা সামলে প্রমাণ করে দে তোর কাউকে প্রয়োজন নেই। পারবি? ‘

চোখের পানির মাত্রা বাড়ল। নিঃশ্বাসে বাড়ল অস্থিরতা। তবু চোখ বুজে ঠোঁট কামড়ে কান্নারত গলায় দৃঢ় শব্দে সিমরান বলল,

‘ পারব। ‘

সহসা একপেশে হাসল সৌধ। অতি সন্তর্পণে ওঠে দু’হাত পকেটে গুঁজে দিয়ে কয়েক কদম হেঁটে গেল দরজার দিকে। নিমেষে ঘাড় বাঁকিয়ে ফিরে তাকাল একবার। নিচু কণ্ঠে সিমরান শুনতে পাবে এমন করে বলল,

‘ বেস্ট উইশেষ। ‘

তানজিম চৌধুরী এলেন সেই মুহুর্তে। বললেন,

‘ খেয়েছে? ‘

সৌধ রুম ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পূর্বে মৃদু স্বরে আম্মাকে বলে গেল,

‘ খাবে। খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি। আপনি থাকুন ওর কাছে। ‘

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা
আজকে লেখার সময় এতবেশি বিরতি নিতে হয়েছে। বার বার ডাকাডাকি করা হয়েছে। কেমন যে হলো পর্বটা বুঝতে পারছি না৷ আপনারা পড়ে জানান কেমন?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here