#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৪৯|
লোকমুখে একটি কথা প্রায়শই শুনত সুহাস৷ আজ মরলে কাল দু’দিন। নিঃসন্দেহে কথিত সেই বাক্যটি চিরন্তন সত্য। উদয়িনী নেই আজ একমাস দশদিন। এত গুলো দিন চলে গেল। মা নেই। বাড়ি ফিরে বোনের রুগ্ন দেহ আর শুষ্ক মুখ দেখে বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠল সুহাসের। দু’দিনের ছুটি। তাই ছুটে চলে এসেছে মায়ের স্বপ্নের বাড়িতে। আফসোস মা নেই। দীর্ঘশ্বাস মা আর কোনোদিন আসবে না৷ গম্ভীর রূপে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এ বাড়িময় আর বিচরণ করবে না। সে এসেছে বাবা আর বোনের কাছে। বোনটা যে তার চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করে। সুহাস আসার আধাঘন্টা পরেই নামীর উপস্থিতি ঘটল। ড্রয়িং রুমে ঢুকে সুহাসকে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলল নামী।
মা মারা যাওয়ার পর থেকে বেশ পরিবর্তন এসেছে সুহাসের মাঝে। এই পরিবর্তনে দৃষ্টিকটু ব্যাপারটা হচ্ছে নামীর সঙ্গে তার দূরত্ব। যত সময় গড়াচ্ছে দূরত্ব বাড়ছে বৈ কমছে না৷ নামী ঠিকই তার খেয়াল রাখার চেষ্টা কারে৷ কাজের সূত্রে দূরে থাকলেও নিয়ম করে খোঁজ নেয়৷ ফোন করে রোজই৷ কিন্তু সুহাস ফোন ধরতে চায় না। বার বার ফোন করার পর এক প্রকার বিরক্ত হয়ে রিসিভ করে। কথা বলে প্রচণ্ড উদাসীনতা নিয়ে। যা টের পায় নামী। খারাপ লাগে ওর। কষ্টও হয়। তবু ধৈর্য্য ধরে থাকে। সদ্য মা হারিয়েছে। ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। এই আশায় অপেক্ষা করে। পুরোনো সুহাসকে ফিরে পাবার৷ এই যে আজ সে বাড়িতে আসবে। গতকাল বলেছিল সুহাসকে। জিজ্ঞেস করেছিল, সুহাস আসবে কিনা। উত্তর দেয়নি সুহাস। নিরুত্তর ছিল। সুহাস আসবে না। নামীর আসারও বাধ্যবাধকতা নেই। তবু এসেছে। শশুর আর ননদের সঙ্গে সময় কাটাতে। ফাঁকা বাড়িতে সিমরান সারাদিন একাই থাকে। ভাবি হিসেবে তার কিছু দায়িত্ব, কর্তব্য আছে। তাই এসেছে। তাছাড়া এই সংসারের ভাড় এখন তার ওপরই। যতই চাকরি করুক, ব্যস্ত থাকুক৷ দিনশেষে সংসার নামক জীবনটাকেও আগলে রাখতে হবে। নামীকে দেখে সিমরান অবাক হওয়ার পাশাপাশি খুশি হলো। সুহাস দেখেও না দেখার ভাণ ধরে বসে রইল৷ নামী এগিয়ে এসে দৃঢ় গলায় বলল,
‘ গতকাল জিজ্ঞেস করেছিলাম আসবে কিনা। কেন বলোনি? ‘
বোনের সঙ্গে বসে ফোনে কী যেন দেখছিল সুহাস। সেলিনা আপা দু কাপ কফি দিয়ে গেল। নামীকে দেখে খুশি হলো সেলিনা আপাও। বলল,
‘ ভাবি আসছেন! কেমন আছেন? ‘
‘ ভালো। তুমি ভালো আছো? এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দাও তো। ‘
বলতে বলতে সুহাসের পাশে গিয়ে বসল নামী। চুল গুলো ঠিক করতে করতে সিমরানের দিকে তাকাল। সিমরান মৃদু হেসে বলল,
‘ কেমন আছো ভাবিপু? ‘
সিমরানের মুখ পানে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ হাসল নামী।
মেয়েটা এখন তাকে নামীপু না বলে ভাবিপু ডাকে।
***
ছুটি শেষ। তাই উদয়িনী মারা যাওয়ার সাতদিনের মাথায় সুহাস, নামী দু’জনকেই চলে যেতে হলো। যাওয়ার সময় নামীকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদে সিমরান। বলে,
‘ আমার আম্মু খারাপ মানুষ নয় নামীপু৷ জানো আম্মু চেয়েছিল পুরোনো সব তিক্ততা ভুলে তোমাকে আপন করে নিতে। অনেক ধুমধাম করে এ বাড়িতে তোমাকে নিয়ে আসতে চেয়েছিল। আমি আর আম্মু মিলে কত প্ল্যান করেছিলাম। ভেবেছিলাম যেদিন এ বাড়িতে আবার আসবে সেদিন থেকে তোমাকে ভাবিপু বলে ডাকব। তুমি তো আমার ভাইয়ের বউ। আমরা সবাই তোমাকে মেনে নিয়েছি। সবাই ভালোবাসি তোমাকে। ‘
***
সিমরানের প্রশ্নে নামী উত্তর দিল,
‘ ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? মুখটা শুঁকিয়ে গেছে। ঠিকভাবে খাওয়াদাওয়া করো না নিশ্চিত? বাবা কোথায়? ‘
সিমরান হাসল কিঞ্চিৎ। অনেকদিন পর ভাই, ভাবিকে কাছে পেয়ে ভালো লাগছে তার। সিমরানের সাথে কথা বলার ফাঁকে সুহাসের দিকে তাকাল নামী। মৃদুস্বরে বলল,
‘ কিছু বলেছি তোমায়। ‘
সুহাসের মাঝে ভাবান্তর হলো না। সিমরান সুহাসের কাঁধে হাত রেখে বলল,
‘ কী ব্যাপার ব্রো? ভাবিপুর সাথে অভিমান করেছ নাকি? ‘
উত্তর দিল না সুহাস। নামীর মেজাজ খারাপ হলো। রাগান্বিত হয়ে সুহাসের হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে বলল,
‘ সুহাস কিছু বলেছি তোমায়। ‘
নিমেষে রক্তিম দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সুহাস। সিমরান, নামী দু’জনই চমকে ওঠল ওই দৃষ্টি দেখে। ভয়াবহ ক্রোধে জর্জরিত সুহাস৷ সে আর এক মুহুর্ত ওখানে বসল না। ফোনটা নিয়ে তড়াক করে ওঠে উপরে চলে গেল৷ নামী হতভম্ব হয়ে ঠাঁই বসে। সিমরান ভয়ে ভয়ে ঢোক গিলে বলল,
‘ কী হয়েছে ভাইয়ার? ‘
নামীর চোখ বেয়ে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। অজান্তেই বেরুলো। নিমেষে তা আবার তর্জনী দিয়ে মুছে মৃদু হেসে বলল,
‘ মা চলে যাওয়ার পর থেকে একটা দিনও আমরা এক বিছানায় ঘুমাইনি সিনু। আর না একসঙ্গে বসে ভালো মন্দ দু’টো কথা বলেছি। আমি চেষ্টা করেছি কাছে যাওয়ার কথা বলার। ও মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। ফোন দিলে ফোন রিসিভ করে না। বার বার দেয়ার পর যদিও বা একবার রিসিভ করে যা বলি তার উত্তর দিয়েই কেটে দেয়। আমার ওখানে যেতে বললে যায় না৷ আজ বাড়ি আসবে কিনা কতবার জিজ্ঞেস করলাম বলল না। অথচ এসেই ওকে দেখলাম। জানালে কী হতো? একসঙ্গে আসতে পারতাম না বলো? ‘
উদয়িনী বেঁচে থাকাকালীন নামী কখনো তাকে মা বলেনি। এই প্রথম আজই বলল। সিমরাম খুশি হলো এতে। কিন্তু সুহাসের ব্যাপারে বলা কথা গুলো শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেল। তার ভাই এমন করছে! এত রাগ কেন ভাবিপুর প্রতি? কীসের এত্ত অভিমান? গা শিউরে ওঠল আচমকা। জিজ্ঞেস করল,
‘ কারণ? ‘
নামী বলল,
‘ প্রথমে ভেবেছিলাম সদ্য মা হারিয়েছে তাই। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সুহাস আমাকে ভুল বুঝছে। ‘
‘ কেন? ‘
‘ মা চেয়েছিলেন ধুমধাম করে আমাকে এ বাড়িতে নিয়ে আসতে। আমি সময় নিচ্ছিলাম। এত বেশি নিলাম যে উনি আর পৃথিবীতেই রইলেন না। ‘
দীর্ঘশ্বাস ফেলল নামী। নিঃশ্বাস আঁটকে এলো সিমরানের। সত্যি বলতে এ বিষয়টা নিয়ে তারও আফসোস আছে। মায়ের শেষ ইচ্ছে এটাই ছিল। যা পূরণ হয়নি। ভাবিপু সময় নিয়েছে এটা কি দোষ হতে পারে? সে তো জানত না মা এক্ষুনি আমাদের ছেড়ে চলে যাবে৷ কিয়ৎক্ষণ নিশ্চুপ থেকে সিমরান বলল,
‘ তুমি মন খারাপ করো না ভাবিপু৷ সব ঠিক হয়ে যাবে। না হলে আমি, আব্বু মিলে বুঝাব ভাইকে। ‘
স্মিত হাসল নামী৷ সিমরানের মাথায় হাত বুলিয়ে ওঠে দাঁড়াল। বলল,
‘ ফ্রেশ হয়ে আসছি আমি। রাতে কী খাবে বলো। ‘
সিমরান মৃদু হেসে কী খাবে জানালো। নামীও ত্বরিত পা বাড়াল উপরে। গোসল করে বাইরের পোশাক বদলে তারপর নিচে আসবে৷ নিজহাতে রান্না করবে শশুর, স্বামী আর ননদের জন্য।
.
.
অনেকদিন পর বাড়িটা প্রাণ ফিরে পেয়েছে। একসঙ্গে খেতে বসে এটাই ভাবল সোহান খন্দকার। ছেলে, ছেলে বউ আসাতে ভীষণ খুশি সে। নামী আজ একা হাতে তাদের জন্য রান্না করেছে। সব সুহাস, সিমরানের পছন্দের খাবার৷ এসব খাবার পছন্দ সোহান খন্দকারেরও। খাওয়ার ফাঁকে টুকটাক গল্প করছিল সোহান। গল্পের ফাঁকে খেয়াল করল, সুহাস খাচ্ছে না৷ আঙুল দ্বারা নাড়াচাড়া করছে শুধু৷ তাই শুধাল,
‘ সুহাস খাচ্ছিস না কেন? খাবার ভালো হয়নি? ‘
নামীও খেয়াল করেছিল। সুহাস খাচ্ছে না৷ কিছু বলার সাহস করে ওঠতে পারছিল না। বাবা বলায় ভরসা পেল। কিছু না ভেবেই বলে ফেলল,
‘ আমার ওপর রাগ থাকতেই পারে। খাবারের ওপর তো নেই। ভণিতা না করে খেয়ে নাও সুহাস। ‘
নামী কথাটা বলেছে মাত্র। অমনি ক্রোধে ফুঁসতে ফুঁসতে ওঠে দাঁড়িয়েছে সুহাস। তার কাণ্ড দেখে কয়েক পল হতবাক ছিল সোহান খন্দকার। সুহাস যখন খাবার ঠেলে চলে যেতে উদ্যত হলো তখন চমকাল সে৷ আকস্মিক সুহাসের হাত টেনে ধরে মৃদু ধমক দিল,
‘ এটা কী ধরনের আচরণ সুহাস! বসো, বসো বলছি। খাবার ফেলে এভাবে যাবে না৷ ‘
বাবার মুখের ওপর কথা বলতে পারল না সুহাস। নামীর দিকে ক্রোধান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল একবার। এরপর চুপচাপ বসে খেতে শুরু করল৷ বাবা, মা যে জীবনের কতবড়ো সম্পদ। মা চলে যাবার পর থেকে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। মায়ের অভাব বাবা পূরণ করতে পারে না। কিন্তু সোহান খন্দকার নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করছে ছেলেমেয়েদের আগলে রাখতে। যতই সুহাস প্রতিষ্ঠিত হোক। বিবাহিত হোক। দিনশেষে তারও মাথার ওপর ছায়ার প্রয়োজন পড়ে। যা সোহান খন্দকার দিচ্ছে পরিপূর্ণ ভাবে। তাই তো এখন বাবার প্রতি অনেক বেশি দুর্বল হয়ে পড়েছে ছেলেমেয়ে দু’টো। খাওয়া শেষে সুহাস চলে গেলে সোহান খন্দকার নামীকে জিজ্ঞেস করল,
‘ সুহাস তোমার ওপর রেগে আছে মা? ‘
নামী জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করল। গ্লাসে পানি ভরতে ভরতে বলল,
‘ তেমন কিছু না বাবা৷ জানেনই তো আপনার ছেলে কেমন রগচটা। অল্পতেই রেগে যায়। ঠিক হয়ে যাবে চিন্তা করবেন না। ‘
সোহান খন্দকারের পৃথিবী বলতেই সুহাস, নামী আর সিমরান৷ তিনজনকে নিয়ে ভাবে মানুষটা। চিন্তা করে খুব৷ নামী বুঝে সবটা। তাই তাকে চিন্তায় ফেলতে চায় না বলে সবটা চেপে গেল। মিথ্যে হাসির আড়ালে লুকিয়ে ফেলল নিজের যন্ত্রণা গুলো।
.
.
সিমরানের সাথে অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করে নিজেদের ঘরে ফিরল নামী। তার আর সুহাসের ঘর। সুহাস অবশ্য এখন ঘরে নেই৷ বাইরে গেছে হয়তো। ভেবেই লম্বা একটি নিঃশ্বাস ছাড়ল। মৃদু পায়ে এগিয়ে গেল ড্রেসিং টেবিলের সামনে। সময় নিয়ে চুল গুলো আঁচড়ে বিনুনি গাঁথল। নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল কিয়ৎক্ষণ। হৃদয় পুলকিত হলো৷ আগের চেয়ে মুখে গ্ল্যামার বেড়েছে তার। শুধুই কি মুখে? দু পা পিছিয়ে গিয়ে আপাদমস্তক দেখল নিজেকে। শারীরিক গঠন আগের চেয়েও আকর্ষণীয় লাগছে। বডিশেপটাও মারাত্মক আকর্ষণীয়। আপনমনে নিজেকে নিয়ে এসব ভেবেই তীব্র লজ্জায় আরক্ত হলো মুখশ্রী। বুকের ভেতর অদ্ভুত এক শিহরণ জেগে ওঠল হঠাৎ। পুলকিত চিত্তে ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার পানে তাকাল একবার। সুহাস কখন আসবে? সুহাসের অপেক্ষায় বিছানায় গিয়ে বসে রইল। সহসা কেঁপে ওঠল হোয়াটসঅ্যাপের ম্যাসেজ টোনে৷ ত্বরিত ফোনটা হাতে নিতেই দেখল, ফারাহ ম্যাসেজ করেছে।
‘ কেমন আছিস দোস্ত? জানিস গতকাল নিধি আপুর সাথে দেখা করতে গিয়েছিল আয়াজ। আপুর ছেলেটা দেখতে মাশাআল্লাহ। কী কিউটরে! দাঁড়া তোকে ছবি পাঠাচ্ছি। ‘
হেসে ফেলল নামী। নিধি আপুর ছেলে! উদিয়িনীর মৃত্যুর ছয়দিন পর নিধির ডেলিভারি হয়। ছেলে সন্তানের জন্ম দেয় সে। সে সময় তাদের মানসিক অবস্থা এতটাই বিধ্বস্ত ছিল যে তারা কেউ দেখতে যেতে পারেনি৷ স্বাগতম জানাতে পারেনি বাচ্চাটাকে।
পরে অবশ্য সুহাস, আইয়াজ, প্রাচী আপু গিয়েছিল। কিন্তু সে যেতে পারেনি। তাই তরান্বিত হয়ে রিপ্লাই করল,
‘ ভালো আছি। তুই কেমন আছিস? ‘
ফারাহ উত্তর দিয়ে গোটা দশেক ছবি পাঠাল। নামী খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল প্রতিটা ছবি। চোখ দু’টো তার প্রশান্তিতে ভরে ওঠল যেন৷ ত্বরিত লিখল,
‘ হাউ কিউট! মাশাআল্লাহ। নিধি আপুর মতোই হয়েছে রে। নাম কী বাবুর?’
‘ অনিরূপ শিকদার। অর্পণ স্যারের অ আর নিধি আপুর নি নিয়ে ছোট্ট করে সবাই নাকি অনি ডাকে। জানিস, বাবুটাকে দেখে এসে আয়াজ সারারাত ঘুমাতে পারেনি। এত্ত বাবু পাগল ছেলেটা। ভুলতেই পারছিল না অনিকে। তাছাড়া নিজের বান্ধবীর মেয়ে তো। ওদের বন্ধু মহলের ফার্স্ট বেবি। টানটা একটু বেশিই৷ আর জানিস কী করেছে? সে আবদার করেছে। তারও অনির মতো কাউকে চাই। বাবা হতে চায় সে। ‘
ম্যাসেজটা দিয়েই লজ্জা পাওয়ার ইমোজি দিল ফারাহ। নামী শিউরে ওঠল সহসা৷ ফারাহকে বলল,
‘ আয়াজ ভাইয়ের আবদার পূরণ কর ফারাহ। মা হওয়ার বয়স হয়েছেই আমাদের। এবার মা ডাক শোনা উচিত। ‘
ফারাহকে ম্যাসেজটা দিয়েই মন খারাপ হয়ে গেল নামীর। তার বয়স কত হলো? ছাব্বিশ চলছে। এবার তো একটা বেবি নিতে পারে৷ মুহুর্তেই চমকে ওঠল সে। গত মাসে পিরিয়ড মিস গেছে তার। এ কথা বেমালুম ভুলে গেছিল। আচমকা মনে পড়ায় হাত, পা কাঁপতে শুরু করল অনবরত। মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগল। আকস্মিক শাশুড়ির মৃত্যু, কর্ম জীবনে ব্যস্ততা, সুহাসের দূরত্ব সব মিলিয়ে সে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টাকে হেলাফেলা করেছে!
সুহাস কোথায়? চিত্ত চঞ্চল হয়ে ওঠল নামীর। তর আর সইল না যেন। মন বলল এক্ষুণি টেস্ট করতে। কিন্তু কিন্তু…কীভাবে? সুহাসকে ফোন দিয়ে বলবে, প্র্যাগ্নেসি কীট নিয়ে আসতে? না থাক। আগে নিজে একা একা পরীক্ষা করবে। রেজাল্ট পজেটিভ হলে তারপর জানাবে সুহাসকে। একদম চমকে দেবে। স্ত্রীর থেকে পাওয়া একজন পুরুষের জীবনের বেস্ট গিফট তো এটাই৷
নামী যখন এসব ভাবনায় মশগুল। তখন ঘরে ফিরল সুহাস। নামীকে দেখেই কপাল কুঁচকে ফেলল। নামী সুহাস এসেছে দেখেই বিগলিত চিত্তে বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়াল। সুহাস তাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বেলকনিতে চলে গেল। কিয়ৎক্ষণ পর নামীর নাকে এলো সিগারেটের গন্ধ। সুহাস সিগারেট খাচ্ছে? বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো! ক্রোধে জর্জরিত হলো মন। এতটা অধঃপতন! মেনে নিতে পারল না৷ সিগারেটের গন্ধ একদম সহ্য করতে পারে না নামী। তাই আচমকা কড়া গন্ধে নাক চেপে ধরে কেশে ওঠল।কাশতে কাশতে এক পর্যায় পেটে মোচড় খেয়ে গা গুলিয়ে ওঠল তার। ছুটে চলে গেল বাথরুমে। বেলকনিতে দাঁড়িয়েই সুহাস শুনতে পেল, নামীর কাশির শব্দ। গলগল করে বমি করছে এটাও টের পেল৷ নিমেষে বিরক্ত হয়ে সিগারেট ফেলে দিল বেলকনির গ্রিলের ফাঁক দিয়ে একদম নিচে। এদিকে বমি করে মাথা ধরে গেল নামীর। চোখ, মুখে পানি দিয়ে রুমে এসে বিছানায় বসতে বসতে হাঁপিয়ে ওঠা স্বরে ডাকল সুহাসকে,
‘ সুহাস, এই সুহাস এদিকে এসো না…। ‘
সুহাস শুনল তবু এগিয়ে এলো না। এবার কান্না করে দিল নামী। ক্রন্দনরত কণ্ঠে ফের ডাকলে বিরক্ত মুখে সুহাস এলো। তাকে দেখে শান্ত হলো নামী। বলল,
‘ আমার শরীরটা খুব খারাপ লাগছে সুহাস। ‘
সুহাস ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ বমি হলো তাই৷ শুয়ে থাকলেই ঠিক হয়ে যাবে। ‘
‘ তুমি সিগারেট খাচ্ছিলে বলে! ‘
আর জবাব দিল না সুহাস৷ চুপচাপ বাতি নিভিয়ে বিছানার অপর পাশে শুয়ে পড়ল। নামীর এত্ত খারাপ লাগল যে আর একটিও কথাও বলতে পারল না। সেও নিশ্চুপ শুয়ে রইল এক কোণে৷ অন্ধকার ঘরে নিশ্চুপ তারা দু’জন। দু’জনার মাঝে দূরত্ব একহাত সমান৷ হঠাৎ নামীর কেমন ভয় ভয় লাগল। এর আগে কখনো এত ভয় করেনি৷ আজ ভয় পাচ্ছে কেন? অজান্তেই নিজের একটা হাত পেটে রাখল। বুলাতে বুলাতে বলল, কোনো ভয় নেই। এরপর জড়োসড়ো হয়ে সুহাসের পিঠ ঘেঁষে শুয়ে রইল।
সুহাস অনুভব করল নামীর স্পর্শ। কিন্তু ফিরে তাকাল না। ঠিক যেন রোবট সে। এভাবে শুয়ে রইল। বুকের ভেতর চলল তীব্র অশান্তি। এক ঘন্টা, দু’ঘন্টা এভাবে তিনঘন্টা অতিক্রম হলো। নামীর শরীর দুর্বল ছিল। তাই সে ঘুমিয়ে গেছে৷ কিন্তু সুহাসের ঘুম হলো না। সে ফোন হাতে নিয়ে সৌধকে ফোন করল। সৌধ ফোন ধরল না। আর কাকে ফোন করবে? এ সময় কে জেগে আছে তাকে সঙ্গ দিতে? রাত গভীর। পাশে স্ত্রী। তবু তীব্র একাকীত্বে ভুগতে লাগল সুহাস। যে একাকীত্বের সুযোগ পেয়ে শয়তান তার মস্তিষ্ক বিগড়ে দিল। পুরোনো নাম্বার ঘেঁটে ঘেঁটে সে ফোন করল তার পুরোনো গার্লফ্রেন্ডদের মধ্যে ইসমা নামের একটি মেয়েকে। আশ্চর্য হলো দুবার রিং হতেই ফোনটা রিসিভ হওয়ায়। এরপর কথা বলতে বলতে আশ্চর্যের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেল তখন যখন ইসমার সাথে কথা বলে নিজের মাঝে ভালো লাগা অনুভব করতে শুরু করল। এতক্ষণ যে অশান্তিতে পাগল হয়ে যাচ্ছিল, সে অশান্তি এক নিমেষে দূর হয়ে গেছে বুঝতে পেরেই ইসমার প্রতি কৃতজ্ঞবোধ করল। এক ঘন্টা, দু’ঘন্টা এভাবে ভোর পর্যন্ত কথা বলল ওরা।
ফজরের আজান দিতেই নামীর ঘুম ছুটে গেল। সে শুনতে পেল মৃদু স্বরে সুহাস কথা বলছে কারো সাথে। কী বিনয়ের সুর৷ সে সুর শুনতে শুনতে আকস্মিক মস্তিষ্ক সচল হলো তার। তড়াক করে ওঠে বসেই শুধাল,
‘ কার সঙ্গে কথা বলছ সুহাস! ‘
|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা
নেক্সট পর্বে উপন্যাসটি হাফ সেঞ্চুরি হয়ে যাবে। আলহামদুলিল্লাহ। যারা সাথে আছেন তাদের কৃতজ্ঞতা।