#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী
অন্তিম পর্ব (শেষাংশ)
ইমতিয়াজ ও শরীফ দুজনকেই গ্রে°ফ°তার করেছে পিবিআই। যদিও গ্রে°ফ°তার কথাটা এখানে ভুল, ওরা নিজে থেকেই ধরা দিয়েছে।
ঢাকায় নিয়ে আসার পর মৃত্তিকা খোঁজ পায় ওদের। সারারাত পাগলের মতো ছটফট করছিল সে, বিশেষ করে ইমতিয়াজকে ফোনে না পেয়ে সে আরো চিন্তিত ছিল। দুপুরে খবরটা পেয়েই ছুটে এসেছে।
ইমতিয়াজ একটু দূর থেকে ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। দুহাতে হাত°কড়া লাগানো অবস্থায় একটা মানুষ কিভাবে হাসতে পারে? শরীফ পাশে নির্বিক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আশেপাশে ওদেরকে ঘিরে রেখে সাংবাদিক আর টিভি ক্যামেরা, একের পর এক ছবি তুলছে আর ব্রেকিং নিউজ প্রকাশ করছে।
পাশের লা°শবাহী গাড়িতে শাফিন, রিজভিসহ তাদের লোকজনের দেহ। শাফিনের লা°শ যে দেখেছে সেই ভ°য় পেয়েছে।
ভীড় ঠেলে এগিয়ে যায় মৃত্তিকা। পুলিশ সদস্যদের বাধা কা°টিয়ে ইমতিয়াজের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
“আপনি না বলেছিলেন নিজের সন্তানকে খু°নির সন্তান হতে দিবেন না? তবে এটা কেন করলেন ইমতিয়াজ?”
ইমতিয়াজ ওর চোখে চোখ রাখে না। অন্যদিকে তাকিয়ে বেশ শান্তভাবে জবাব দেয়,
“তার মা তাকে ভালো রাখবে।”
মৃত্তিকার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। ঠিক যে কারণে সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছিল, আজ ইমতিয়াজই তাই করে বসেছে।
শরীফের দিকে তাকিয়ে বলে,
“বাবা, আমার সাথে থাকতে তোমার কখনোই ইচ্ছা হয়নি?”
শরীফ উত্তর দেয় না। মৃত্তিকা অস্ফুটস্বরে বলল,
“বাবা?”
আবারো ইমতিয়াজের দিকে তাকায় সে। ইমতিয়াজ সামনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“চলে যাও এখান থেকে। সাংবাদিকদের তো°পে তুমি পড়ো না।”
“আমাকে ভালোবাসলে কি খুব অপ°রাধ হতো ইমতিয়াজ?”
ইমতিয়াজ তাকায় ওর দিকে, এবারে দুজনে চোখে চোখ রাখে। মৃত্তিকার লাল দুইচোখ দেখে ইমতিয়াজের কষ্টের পাল্লা ভারি হয়।
কিছু বলতে নিলে মৃত্তিকা ওকে ঝাপটে ধরে হাউমাউ করে কান্না করে দেয়। ইমতিয়াজ চমকে উঠে, আশেপাশের ক্যামেরায় ছবি তোলার গতি বাড়ে।
দুজন মহিলা কন্সটেবল কাছে আসতে নিলে ইমতিয়াজ বলে,
“প্লিজ, একটু সময় দিন।”
অনুরোধ রাখে, কিন্তু মৃত্তিকাকে সরানো যায় না। ওর চোখের জলে ইমতিয়াজের শার্টের বুকের ডানপাশের অংশটা ভিজে গেছে, বারে বারে হিঁ°চকি দিচ্ছে মৃত্তিকা। ইমতিয়াজ চুপ করে আছে, শান্ত তার দৃষ্টি।
কাঁদতে কাঁদতে একসময় ক্লান্ত মৃত্তিকা জ্ঞান হারায়। ইমতিয়াজের দুহাত সামনের দিকে এনে আটকে রাখা ছিল, সে দুহাত একসাথে মৃত্তিকার মাথা উপর দিয়ে নিয়ে ওর পিঠের দিকে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলল,
“মৃত্তিকা আমার, মৃত্তিকা।”
ওই দুজন কন্সটেবল আসলে ইমতিয়াজ অসহায় কন্ঠে বলল,
“ও প্রেগন্যান্ট, প্লিজ ওকে ডাক্তারের কাছে নেয়ার ব্যবস্থা করুন। প্লিজ।”
আবারো সে মৃত্তিকার দিকে তাকায়। ওর শরীরের সাথে মিশে আছে মেয়েটা। ইমতিয়াজের গালের সাথে ওর কপাল লেগে আছে।
ইমতিয়াজ ওর কপালে চুম্বন করে, একটু নিচু হয়ে ওর ওষ্ঠপুটেও চুম্বন করে। নিজের গাল ওর ঠোঁটে ছুঁইয়ে বলে,
“মৃত্তিকা, কেন এতো করে চাইছো আমাকে? নিজেকে কেন শেষ করছো?”
জোরপূর্বক ইমতিয়াজের থেকে মৃত্তিকাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। ইমতিয়াজের চেহারায় অসহায়ত্ব প্রকাশ পাচ্ছে। এই লোকগুলোর মধ্যে আবারো যদি কোনো পশুর উদয় হয়, কিভাবে মৃত্তিকাকে রক্ষা করবে ইমতিয়াজ?
ভীড়ের মাঝে মৃত্তিকার সাথে একটা পরিচিত চেহারা দেখে ইমতিয়াজ। মানুষটা তানজিম। মৃত্তিকাকে নিয়ে সিএনজিতে উঠে হাত নাড়ে সে।
“অপ°রাধ হতো বলেই হয়তো তুমি আমি এক হইনি।”
ইমতিয়াজের বুক চি°ড়ে দীর্ঘশ্বাসের সাথে কথা বের হয়।
______________________________________
আব্বাস সাহেব ঢাকায় এসেছেন। সাথে এনেছেন নাতির জন্য অনেক রকমের খেলনা। আহনাফ তো একটা দৌড়াদৌড়ির মধ্যে আছে। হাসপাতালের এ কাগজ, ও কাগজ নিয়ে তাড়াহুড়ো করছে সে।
টাকা জমা দিতে গিয়ে পাশে চলতে থাকা টিভিতে সে ইমতিয়াজ-মৃত্তিকাকে দেখে। সাথে চলছে রঙঢঙ মেশানো এক হেডলাইন।
টাকা জমা দিয়ে রিসিট জাহাঙ্গীর সাহেবের হাতে দিয়েই সে ছুটেছে থানার উদ্দেশ্যে৷ কাল থেকে ওর অগোচরে এতো ঘটনা ঘটে গেছে, অথচ সে টেরই পেল না।
থানায় সে কারো সাথে কথা বলতে পারে না। তাই তানজিমের সাথে যোগাযোগ করে মৃত্তিকাকে দেখতে ক্লিনিকে আসে।
মৃত্তিকার জ্ঞান ফিরেছে, তবে চুপচাপ বসে আছে সে। ইমতিয়াজের এমন কান্ড সে এখনো মেনে নিতে পারছে না।
তানজিম আহনাফকে বলে,
“সকালে আমি খবরটা পেয়েছি। শাফিন মা°রা গেছে আর রিজভিও। শরীফ আংকেল বলছে উনিই মে°রেছেন, তবে সহযোগী সন্দেহে ইমতিয়াজ ভাইয়াকে গ্রে°ফ°তার করেছে।”
আহনাফ চুপ করে যায়। মৃত্তিকার দিকে তাকিয়ে দেখে অনুভূতিহীন একটা মানবী নিরবে তাকিয়ে আছে সাদা টাইলসের মেঝেতে।
______________________________________
একদিন, দুইদিন করে সপ্তাহ পার হয়। আজ সাদাবের আকিকা। কুমিল্লায় আহনাফের বাসায় বেশ রমরমা আয়োজন। একমাত্র ছেলের আকিকা উপলক্ষ্যে হাঁটের বড়বড় দুই খাসি কিনে এনেছে আহনাফ।
সামিহা তো সারাদিন সাদাবকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে আছে। সাদাবকে খাওয়ানো ছাড়া সারাহ্-র আর কোনো কাজ নেই, বাকি সব সামিহাই দেখে।
রান্নার দিকটা দেখে আহনাফ রুমে আসে। সারাহ্ শাড়ি পড়ছে। আঁচল বেশি রাখায় তা ফ্লোর স্পর্শ করছে।
আহনাফ কাছে এসে আঁচলটা তুলে হাতে দিয়ে বলল,
“আঁচল তো মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে।”
“আঁচল ধরার মানুষ থাকলে মাঝে মাঝে লুটোপুটি খাওয়া ভালো।”
“কে ধরবে? আমি? অসম্ভব, আমি কোনো নারীর আঁচল ধরতে রাজি নই।”
সারাহ্ হেসে দেয়। গলায় নেকলেস পড়তে শুরু করলে আহনাফ বলে,
“মনে হচ্ছে বিয়ে করবে। অবশ্য আমি রাজি, বাসর করার ফিলিংসও এখনো আছে। প্রথম বাসর তো করা হয়নি, এখন করতেই পারি।”
সারাহ্ ফিরে দাঁড়িয়ে বলে,
“এই আপনার লজ্জা নেই, সভ্য হবেন না কোনোদিন?”
আহনাফ হেসে ওর কাছে এসে বলল,
“এভাবে কথা বলো না, আমার রাগ হয়।”
আহনাফ নিচু হতে নিলে সারাহ্ ওকে বাধা দিয়ে জড়িয়ে ধরে। আহনাফও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
“সাদাবকে পেয়ে সাইদার পাপাকে ভুললে চলবে না। আমার কিন্তু সাইদাও চাই।”
সারাহ্ ফিসফিসিয়ে উঠে,
“তবে আরো রাগ করুন, বারেবারে রাগ করতে থাকুন।”
হঠাৎ করেই বাইরে শোরগোল শুরু হয়। দুজনে চমকে দুদিকে সরে যায়। আহনাফ দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এসে দেখে, তানজিমকে আসতে দেখেই নার্গিস পারভিন রেগে গেছেন।
“মা, আমি ওকে ইনভাইট করেছি। তানজিম এসো।”
আহনাফের কথায় নার্গিস পারভিন শান্ত হয়ে যায়। চুপ করে চলে যায় নিজের কাজে। সামিহা সাদাবকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর চোখ দিয়ে টুপটুপ করে জল পড়ছে।
আহনাফ একবার সামিহার দিকে তাকিয়ে আবারো তাকায় তানজিমের দিকে। তানজিম যে জ°ঘ°ন্যরকম অপমানিত হয়েছে তা বোঝাই যাচ্ছে।
“তানজিম, সাদাবকে আজও দেখবে না?”
আহনাফের কথায় তানজিম নির্জীব হয়ে তাকিয়ে বলল,
“থাক ভাইয়া, আজ না। এই খু°নি র°ক্ত ওকে স্পর্শ না করলেই বোধহয় ভালো হবে।”
তানজিম বের হয়ে যায়। সামিহার ইচ্ছে করছিলো ওকে আটকাতে, কিন্তু সে আটকায় না। সে দ্রুত পায়ে সারাহ্-র কোলে সাদাবকে দিয়ে ভিতরে চলে যায়।
______________________________________
মৃত্তিকা নিজের রুমে বসে আছে। এই কয়েকদিন তার খাওয়া দাওয়ার ঠিক নেই, আর না নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি কোনো খেয়াল আছে।
রাইদ এক মাকে হারিয়ে আরেকটা মা পেয়েছিল আর সেও এখন তার থেকে দূরে থাকে। কোনোরকমে ওকে খাইয়ে দিয়ে মৃত্তিকা আবারো দূরে বসে থাকে।
দেলোয়ারা ওর এমন অবস্থা খেয়াল করছে। খাবার নিয়ে মাঝেমধ্যেই জোর করে খাইয়ে দেয়। এছাড়া কোনো উপায় নেই, ওকে শত বললেও ও নিজের থেকে খাবে না।
সময় মৃত্তিকার এভাবেই কাটে, বেশ অনেকদিন পার হয়। সাড়ে পাঁচমাসের অন্তঃসত্ত্বা এখন মৃত্তিকা। ওর মধ্যে সময়ের প্রতিচ্ছবি ভালোই ফুটেছে।
কোর্ট থেকে আজ রায় দেয়ার কথা। সবাই সেটা নিয়েই ব্যস্ত, শুধু ব্যস্ততা নেই মৃত্তিকার মধ্যে। তার ইমতিয়াজ যে তাকে ভালোবাসে না। সে টিভি দেখেনি, খোঁজও পায়নি যে ইমতিয়াজ ছাড়া পেয়েছে।
শরীফের জন্য আবারো শুনানি হবে আর ইমতিয়াজ খা°লাশ পেয়ে গেছে। বিষয়টা এমন হয়েছিল যে নাহিদের টিম সেখানে গিয়ে দুজনকে একসাথে পেলেও শরীফকেই মূলত শাফিনকে মা°রতে দেখেছে। তাছাড়া যেহেতু এর আগে নাহিদের সাথে ইমতিয়াজের যোগাযোগ ছিল, তাই পিবিআইয়ের অনেকেই তার পক্ষে কথা বলেছে। সাক্ষী মজবুত হওয়ায় আর যুক্তিযুক্ত প্রমাণ না পাওয়ায় সে ছাড়া পেয়ে যায়।
আজ আবার এটাও জানিয়েছে আগামীকাল মমতাজ বেগমের ফাঁ°সি হবে। শারমিলির খু°ন ও বাকি তিন খু°নের সাথে সরাসরি যুক্ত থাকায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সুরভির জন্য সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত, সাত বছরের কারাদণ্ড হয়েছে।
সব আনুষ্ঠানিকতা সেরে সন্ধ্যায় ইমতিয়াজ বাসায় পৌঁছায়। দেলোয়ারা দরজা খুলে ওকে দেখে মলিন মুখে হাসে। ইমতিয়াজ উনাকে সালাম দিয়ে বাসায় প্রবেশ করে।
“মৃত্তিকা কোথায়?”
ইমতিয়াজের প্রশ্নে দেলোয়ারা চিন্তিত হয়ে জবাব দেয়,
“সে রুমে, তুমি যাও।”
ইমতিয়াজ ধীর পায়ে রুমে এসে দরজা খুলে। হালকা শব্দ হয়। বিছানায় হেলান দিয়ে মৃত্তিকা বসে আছে। ওকে দেখে হা করে তাকিয়ে আছে। ইমতিয়াজও ওকে দেখে। চোখের নিচে কালি পড়েছে, গালমুখ ফুলে আছে। সাহসী, শান্ত মেয়েটার মন যে বড় ভীতু আর অশান্ত হয়ে উঠেছে।
ইমতিয়াজ দরজা লাগিয়ে ওর সামনে এসে বসে। মৃত্তিকা বলে,
“চলে যাওয়ার জন্য বারবার কেন আসেন?”
“চলে যেতে আমি আসিনি, মৃত্তিকা।”
মৃত্তিকা এগিয়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে। হঠাৎ এমন ধা°ক্কায় ইমতিয়াজ বিছানায় শুয়ে পড়ে। মৃত্তিকা ছাড়ে না, দুহাতে জোর করে ধরে রেখেছে। ইমতিয়াজ ওকে খুব আলতো করে ধরে রাখে৷ থেমে থেমে ফুঁপিয়ে উঠছে মৃত্তিকা।
বামহাতটা মেলে দিয়ে ইমতিয়াজ ওর মাথাটা হাতের উপর রেখে বলল,
“শান্ত হও, আমিই এসেছি।”
মৃত্তিকা ওর গালে হাত দেয়। একটা ঢোক গিলে বলল,
“বাবা কবে আসবে?”
ইমতিয়াজ ওর গালের সাথে নিজের গাল ঘ°ষে বলল,
“আসবে, খুব তাড়াতাড়ি আসবে।”
“মি°থ্যা বলছেন, তাই না? বাবাকে ওরা ছাড়বে না।”
ইমতিয়াজ চেয়ে থাকে। ওর দৃষ্টিতেই মৃত্তিকা বুঝে যায় তার বাবা আসবে না। ইমতিয়াজ চোখ সরিয়ে উঠে যেতে নিলে মৃত্তিকা ওকে কাছে টে°নে আনে।
“চলে যেতে আসেননি তো চলে কেন যাচ্ছেন?”
______________________________________
পরদিন সকালে, মমতাজ বেগমের ফাঁ°সি আজ কার্যকর হয়েছে। উনার লা°শ গ্রহণ করতে এসেছে মৃত্তিকা, ইমতিয়াজ, তানজিম। লুৎফর রহমান আসেননি, উনি আসবেন না।
মমতাজ বেগমের সাথে শেষবার দেখায় শুধু বলেছিলেন,
“শারমিলির প্রতি আমার ভালোবাসা দেখে হিং°সা করেছো, অথচ তোমাকে কত ভালোবেসেছিলাম তা কখনো বুঝোনি। হিং°সা তোমাকে অন্ধ করে দিয়েছে মমতা। তুমি আমাকে বুঝতেই চাওনি।”
লা°শ বের করে আনা হলো। তানজিম সরে যায়, মায়ের লা°শ দেখার ক্ষমতা তার নেই। মৃত্তিকা কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে সে চিৎকার করে কান্না করে দেয়। বড্ড বেশি ভালোবাসতো সে তার বড়মণিকে। বড়মণির এই নি°কৃষ্ট কর্ম আজও তার বিশ্বাসের বাইরে।
ইমতিয়াজ ওকে জড়িয়ে ধরে, তার কান্না থামে না। ইমতিয়াজের বুকে মাথা রেখে ক্রমাগত কাঁদছে মৃত্তিকা।
তানজিম একটু দূরে থম মে°রে দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে তারই মায়ের মৃ°তদেহ। চোখের পানি আজ একফোঁটাও গড়িয়ে পড়ছে না। থেমে থেমে সে ঢোক গিলছে, তার শরীর কেঁপে উঠছে।
______________________________________
চারমাস পর,
“তানজিম যেন এই বাসায় আর না আসে। তোমার আশেপাশেও ওকে আমি দেখতে চাই না।”
সামিহা চুপ করে আছে। আজ ভার্সিটি থেকে ফেরার সময় তানজিম ওকে পৌঁছে দিয়ে গেছে। আর তখনই ওদেরকে একসাথে দেখে নার্গিস পারভিন।
“আম্মু, সবাই একরকম হয় না। তানজিমের মামা আর মা খারাপ ছিল বলে, সেও খারাপ হবে- এটা কেমন যুক্তি?”
নার্গিস পারভিন কিছু না বলে চলে যায়। সামিহা মায়ের দিকে চলে যাওয়া দেখে। তানজিমের জন্য ওর যে অনুভূতিটা আছে তা সে না তানজিমকে বলতে পারছে আর না নিজের মাকে। বলছে না বলে কি কেউ বুঝতেও পারছে না?
সামিহা রুমে এসে সারাহ্-কে কল দেয়। সাদাবকে নিয়ের সমস্তদিন সারাহ্-র ব্যস্ততা। এখনো এই কাজই করছে। সারাদিনে সাদাবের নোংরা করা কাপড় ধুয়ে বারান্দায় ছড়িয়ে দিতে ব্যস্ত সে।
সামিহার নাম্বার দেখে রিসিভ করে,
“হ্যাঁ সামিহা, বল।”
সামিহার কন্ঠ কাঁপছে। ভা°ঙা ভা°ঙা গলায় বলে,
“আপু, তানজিমকে আমি ছাড়তে পারবো না।”
সারাহ্ নিজের কাজকর্ম থামিয়ে দেয়। কপাল কুঁচকে বলে,
“হঠাৎ এই কথা?”
“আম্মু ওকে পছন্দ করে না।”
সারাহ্ চুপ করে থাকে। আহনাফ মাত্রই কলেজ থেকে ফিরেছে। ফ্রেশ হয়ে ছেলের সঙ্গে খেলায় ব্যস্ত সে। সারাহ্ সেদিকে তাকিয়ে “রাখছি” বলে কল কে°টে দেয়।
সারাহ্ মলিন মুখ করে রুমে আসে। ফোন পাশে রেখে চুপচাপ বসে থাকে।
“ঐশী? কি হয়েছে?”
সারাহ্ ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
“আম্মু আবারো তানজিমের বিষয়টা নিয়ে সামিহার সাথে বাড়াবাড়ি করেছে।”
আহনাফ শোয়া থেকে উঠে সোজা হয়ে বসে বলল,
“সামিহা আর তানজিমের সম্পর্ক গভীর হয়েছে, ঐশী। চাইলেই ওদের আলাদা করতে পারবে না।”
“আমি চাইছিও না, কিন্তু আম্মু বারবার কেন শাফিনের কথা বলে তানজিমকে অপমান করছে?”
“শাফিনের সাথে উনার স্মৃতি খারাপ। এরকমটা হওয়া স্বাভাবিক। তবে উনি বুঝদার মানুষ, আমি বুঝিয়ে বলবো সবটা।”
সারাহ্ আলতো করে মাথা নাড়ে। কিছুক্ষণ আহনাফের দিকে তাকিয়ে থেকে ওকে তাড়া দিয়ে বলল,
“খেয়ে নিবেন চলুন।”
______________________________________
আগামীকাল মৃত্তিকার ডেলিভারির তারিখ দিয়েছে আর আজ শরীফের চূড়ান্ত রায় হবে। সকলের চোখে এখন শরীফ খু°নি, শরীফও নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে চায়নি।
আজ বাবার সাথে দেখা করতে এসেছে মৃত্তিকা। বাবার কাছে গিয়ে নিরবে দাঁড়ায় মৃত্তিকা। কিছুক্ষণ পরই শরীফকে আদালতে নিয়ে যাওয়া হবে।
লোহার বে°ড়াজালে আঙ্গুল দিয়ে বাবার হাতে স্পর্শ করে মৃত্তিকা।
“বাবা, তোমার মেয়েটাকে ক্ষমা করে দিও। কোনোদিন তোমাকে বুঝিনি আমি।”
সবাই ধরে নিয়েছে শরীফের ফাঁ°সি হবে। সে তো খু°ন কম করেনি, অনেকগুলো মানুষকে সে মে°রেছে। কেন মে°রেছে তা তো বহু কথা, কিন্তু মে°রেছে সেটাই আসল।
শরীফ মেয়ের আঙ্গুলে চুমো দেয়। বলে,
“নাতি-নাতনিকে কোলে নেয়ার সৌভাগ্য এই অভাগার হয়নি রে মা। তোমার জীবনের সুখ শান্তি আমি কে°ড়ে নিয়েছি, ক্ষমা তো তুমি আমাকে করবে।”
“বাবা..”
মৃত্তিকা আর কিছু বলতে পারে না। অনবরত কাঁদতে থাকে। ইমতিয়াজ একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল, সে এগিয়ে আসে।
শরীফ মৃত্তিকাকে নিয়ে যেতে ইশারা করে। ইমতিয়াজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, কি করবে সে? উপায় কি আছে এছাড়া?
হঠাৎ মৃত্তিকা ব্য°থায় চিৎকার করে উঠে। হয়তো সময় হয়ে গেছে। ওকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে।
“ইমতিয়াজ আমাকে ছেড়ে দিয়ে যাবেন না, থাকেন আমার সাথে।”
“কোথাও যাচ্ছি না আমি, আছি তোমার পাশে।”
যাচ্ছি না বলেও লেবাররুমে ওকে রেখেই বাইরে আসতে হয় ইমতিয়াজের। ওর চিৎকার সহ্য করার ক্ষমতা ইমতিয়াজের নেই।
পৃথিবীতে নতুন একটা মুখ আসলো। কাঁদতে কাঁদতে প্রচুর আগ্রহ নিয়ে দেখতে লাগলো পৃথিবীর আলো। কন্যা সন্তান এসেছে, দুজনের এতোদিনের অপেক্ষার সমাপ্তি হয়েছে।
ইমতিয়াজ নিজেই মেয়ের কানে আযান দেয়। মেয়ের কপালে চুমো খায়। মেয়েকে কোলে নিয়ে মৃত্তিকার প্রথম কথা,
“বাবার সাথে ওর দেখা করাতে পারবেন? বাবা ওকে দেখবে।”
মৃত্তিকা সঙ্গে সঙ্গেই কান্না করে দেয়। ইমতিয়াজ ঘড়িতে দেখে সময় দেখে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এখন এমন সদ্য জন্ম নেয়া নবজাতককে নিয়ে বের হওয়াও মুসকিল।
তবুও ইমতিয়াজ ঝুঁ°কি নেয়। মৃত্তিকাকে রেখে যেতে চাইলেও সে রাজি হয় না। ইমতিয়াজের সাথে যাওয়ার জন্য জে°দ ধরে। ওর জে°দের কাছে ইমতিয়াজ বরাবরের মতো এবারেও পরাজিত হয়।
ফোনযোগে জানতে পারে শরীফের ফাঁ°সির রায় হয়নি, যাবজ্জীবন কা°রা°দণ্ড হয়েছে। বিশেষ বিবেচনায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
জেলে এসে শরীফের সাথে দেখা করার সুযোগ হয়। তবে শরীফ নাতনিকে কোলে নিতে পারেনা। দূর থেকে চেয়ে দেখে। এইতো ওই মিউকো, রিপার আদরের মৃত্তিকা।
বিদায়ের সময় শরীফের বলা কথাটায় মৃত্তিকার কান্নার রেশ আবারো আসে,
“আমি তোমার মামের কাছে যেতে চাইছিলাম মিউকো, ক্ষমা চাইতাম তার কাছে। তোমার মাম কি এখনো রেগে আছে আমার উপর? তুমি বলে দিও যেন এই অধমের উপর রেগে না থাকে।”
শরীফের কন্ঠ শুনে মনে হচ্ছে ছোট্ট মৃত্তিকার সাথে কথা বলছে সে। দুর্বল মৃত্তিকা ইমতিয়াজের শরীরের উপর ঢলে পড়ে৷ ঘনঘন নিশ্বাস নিচ্ছে সে।
______________________________________
বিরামহীন সময়ে বিরাম পড়বে না, এটা তো সর্বদাই সত্য। এবারেও তাই হলো, তিনবছর পেরিয়ে গেল।
অবশেষে আহনাফের এতোদিনের চেষ্টায় সামিহা-তানজিমের বিয়েতে রাজি হয়েছে নার্গিস পারভিন। একটা অসম্ভবকে সে সম্ভব করেছে।
পুরো বাড়িতে রমরমা পরিবেশ৷ আত্নীয়স্বজন, প্রতিবেশীতে একদম হইহই করছে। এরমধ্যে সাদাবকে সামলে রাখা বেশ কষ্টের হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আজও তাকে সামিহাই শান্ত করে নিজের পাশে বসিয়ে রেখেছে। পার্লার থেকে সাজগোজ করে এসে সে এখন অপেক্ষা করছে তার তানজিমের জন্য।
সারাহ্ তো সাইদাকে নিয়ে ভারি ব্যস্ত, মেয়েটা কিছুতেই ঘুমাচ্ছে না। বয়স কত হলো মেয়ের? মাত্রই সাতমাসে পড়েছে।
বর্তমানে দেশে থাকায়, জাহাঙ্গীর সাহেবের দাওয়াত রক্ষা করতে ওদের বাসায় এসেছে আফরোজা-জুহাইব, সাথে ওদের ছেলে জাবের আবরারও এসেছে।
বাবার মতো টার্কিশ চেহারা হয়েছে আবরারের। সাদাবের সাথে বনিবনাও ভালো। দুজনে বেশ আনন্দে খেলতে শুরু করে।
বরপক্ষের লোক হিসেবে লোকজন খুবই কম। তানজিমের বাবা লুৎফর রহমান, ওর চাচা আর ইমতিয়াজ, মৃত্তিকা এসেছে।
ইমতিয়াজ, মৃত্তিকার দুই মেয়ে আর রাইদও এসেছে। বড়মেয়ে সৈয়দ মেহরিবা মেহজাবিন আর ছোট মেয়ে সৈয়দ বারাকাহ্ মেহজাবিন, বারাকাহ্ এবারে একমাসে পড়লো।
সাদাব, আবরারের প্রায় সমবয়সী হওয়ায় মেহরিবা ও রাইদ ওদের সাথে মিশে যায়।
কোনোরকম ঝা°মেলা ছাড়াই নিরিবিলিতে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়ে যায়। সামিহা ঘোমটার আড়াল থেকে তানজিমকে ঠিকই দেখে।
তানজিমের কানের কাছে গিয়ে বলল,
“বিয়ের দিন বরকে এমন বেকুব বেকুব লাগে কেন রে?”
তানজিমও ফিসফিস করে বলে,
“বেকুবের বর চালাক হলেও দেখতে বেকুবই লাগে।”
সামিহা মুখ ভেংচায়। সাদাব এসে আবারো ওর কোল দখল করে ফেলে। সাদাবের সাথে মেহরিবা আসে। সামিহা দুজনকে দুইহাতে জড়িয়ে ধরে আবরার আর রাইদকেও ডাকে।
“বাচ্চারা তোমাকে এতো পছন্দ করে কেন?”
মৃত্তিকা হাসিমুখে কথাটা বলল।
সামিহাও হাসে। বলে,
“ওরা বোধহয় আমাকে ওদের বয়সীই ভাবে।”
তানজিম পাশ থেকে বলে,
“ওদের ভাবনা সঠিক।”
______________________________________
চারদিন পর, মৃত্তিকা-ইমতিয়াজ পরিবারসহ ইতালি যাবে। মৃত্তিকার বিক্রি করে দেয়া রিপা বেগমের সেই বাড়িটি ইমতিয়াজ পুনরায় কিনে নিয়েছে। সেখানে কিছুদিন থাকার জন্যই ইতালি যাবে ওরা।
আজ সামিহার সাথে মৃত্তিকা এসেছে একটা বৃদ্ধাশ্রমে, মেহরিবাও এসেছে ওদের সাথে। এখানে আজ খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করেছে মৃত্তিকা।
মেহরিবা এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যাকে দেখছে তাকেই নানু, দাদু ডাকছে। সামিহা ওকে খুঁজতে খুঁজতে এসে দেখে শতবর্ষী এক বৃদ্ধার কাছে মেহরিবা দাঁড়িয়ে আছে।
“মেহরিবা আসো, মিউকো আপু ডাকছে তোমাকে।”
সামিহার ডাকে মেহরিবা শান্তভাবে বলে,
“থাকি কিছুক্ষণ।”
বৃদ্ধা মহিলাটি চমকে উঠে হাতড়ে হাতড়ে মেহরিবাকে টে°নে ধরে বলল,
“তুমি মেহরিবা, সেই মেহরিবা না তুমি? রাহার মা তুমি?”
মেহরিবা ভয় পেয়ে কান্না করে দেয়। সামিহা এসে ওকে সরিয়ে নিতে চায়। বৃদ্ধা জোর করে ধরে রাখে ওকে। ব্য°থা পাবে ভেবে সামিহা টা°না°টা°নি করে না।
মৃত্তিকা এসে এ অবস্থা দেখে বৃদ্ধাকে বলল,
“দাদুমণি, ও আমার মেয়ে, মেহরিবা। আপনি কার কথা বলছেন?”
বৃদ্ধা হাত আলগা করে বলে,
“সেই মেহরিবা, আমার সন্তানকে বাঁচিয়েছিল যে, আমাকে যে বাঁচিয়েছিল। রাহার মা মেহরিবা।”
বৃদ্ধা কাঁদতে শুরু করে। বৃদ্ধাশ্রমের একজন স্বেচ্ছাসেবী বলে,
“উনি সারাদিন এই দুইটা নামই জপতে থাকেন। মেহরিবা আর রাহা। নিজেকে সবসময় পা°পী জোসনা বলে।”
মৃত্তিকা কপাল কুঁচকে ফেলে। বলে,
“আপনি কে? জোসনা?”
বৃদ্ধা কাঁপা হাতে মৃত্তিকাকে ধরে বলে,
“আমি জোসনা, পা°পী জোসনা।”
মৃত্তিকা বুঝতে পেরেছে কে এই জোসনা। মমতাজ, শাফিনের মা। যাকে মমতাজ বেগম জীবিত অবস্থায় এতো খুঁজেছে, অথচ খুঁজে পায়নি। ভেবেছি মা°রা গেছে, অথচ আল্লাহ্ তার ম°রণ এতো তাড়াতাড়ি রাখেনি।
______________________________________
তাহসিনার কবর জিয়ারত করে আহনাফ। একটু দূরে সারাহ্ও দাঁড়িয়ে আছে। আজ ওরা আবারো কুমিল্লা ফিরে যাবে।
আহনাফ সারাহ্-র আড়ালে চোখের পানি মুছলেও সারাহ্ তা খেয়াল করে, যদিও সে কিছুই বলে না।
বাইরে রাখা গাড়িতে উঠে বসে ওরা। আহনাফ নিজেই গাড়ি কিনেছে, ওর শখ পূরণ করেছে। গাড়ি স্টার্ট করে আহনাফ বলে,
“তুমি কিন্তু এখনো তোমার শেয়ার দাওনি, ঐশী।”
“কিসের?”
“কিসের আবার? যেটাতে চ°ড়ে বেড়াচ্ছো।”
সারাহ্ কপাল কুঁচকে রাগ দেখিয়ে বলে,
“ওহ, কিছুই দেইনি? এই যে সমস্ত দিন আপনার সাদাব-সাইদা মিলে আমাকে ভ°র্তা করছে, তার বেলা?”
সাদাব পিছন থেকে বলে,
“ইয়েস পাপা, তার বেলা?”
আহনাফ সামনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ওরে, ব্যাটা দেখি মায়ের পক্ষে চলে যায়।”
সারাহ্ ভাব নিয়ে বলে,
“মা কে দেখতে হবে তো।”
আহনাফ গাড়ি থামিয়ে দেয়। হঠাৎ করে থামায় সারাহ্ সামনে ঝুঁ°কে পড়ে। আহনাফ সিটবেল্ট খুলে ওর কাছে এসে চেহারার দিকে তাকিয়ে বলল,
“দেখি একটু।”
সারাহ্ ওকে হালকা ধা°ক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়।
“ছেলে এখানে, কি করেন?”
“কি করি, তোমাকে দেখতেছি। দেখতেই তো বললে।”
“দূর, বে°হায়া লোক।”
সাদাব পিছন থেকে সারাহ্-র হাত টে°নে বলল,
“আম্মু, সাইদাকে আমার কাছে বসিয়ে দাও না প্লিজ প্লিজ।”
“না, সাইদা ঘুমাচ্ছে। তুমি উঠিয়ে ফেলবে।”
“প্লিজ।”
“নো।”
আহনাফ আবারো গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলে,
“হ্যাঁ, সাইদাকে সাদাবের কাছেই রেখে দাও। তারপর তো ওদের আবার একটা ভাইবোন আসবে।”
সারাহ্ মুচকি হাসে। লজ্জায় আজও সে লাল হয়ে আসে। তারপর বলে,
“ভাইবোন আসছে ওদের। এবার তো আপনার অ°স্থিরতা কমান।”
আহনাফ চোখ বড়বড় করে বলল,
“কি বললে তুমি?”
সারাহ্ লাজুক হেসে মাথা নাড়ায়। আহনাফ গাড়ি রাস্তার পাশে থামিয়ে বের হয়ে সারাহ্ দিকে এসে দরজা খুলে বলে,
“সত্যি বলছো?”
সারাহ্ মাথানেড়ে বলল,
“হুম।”
আহনাফ দুহাত দুদিকে দিয়ে চিৎকার করে বলল,
“আল্লাহ্, আল্লাহ্, এতো খুশি আমি কোথায় রাখবো?”
“আহনাফ, আস্তে। কি করছেন? লোকজন তাকিয়ে আছে।”
“থাকুক, তাকিয়ে থাকুক।”
সারাহ্ দুগালে হাত দিয়ে কপালে চুম্বন করে আহনাফ। সাদাব বলে,
“পাপা, আমাকেও চুমু দাও।”
আহনাফ ওকেও চুম্বন করে। সারাহ্ হাসতে হাসতে বলে,
“পাপার মতোই হবে। বেহায়া একটা।”
______________________________________
রাতে বাসায় আসার পথে গো°র°স্থানে এসেছে ইমতিয়াজ। এটা আজ নতুন নয়, প্রায় প্রতিদিনই আসা হয়।
তাহমিনার কবরটা পরিষ্কার করে সে। কিছুক্ষণ নিরবে সময় কা°টায়। কতটা বছর চলে গেছে, ছয়বছরের বেশি সময়।
অনেকক্ষণ পর ইমতিয়াজ গো°র°স্থান থেকে বের হয়, বাসায় ফিরে আসে সে। বেল বাজালে মেহরিবা দৌড়ে এসে খুলে দেয়। দরজা খুলেই সে ইমতিয়াজের কোল দখল করে আজকের দিনের গল্প বলতে শুরু করে।
মৃত্তিকা এসে বলে,
“উনি ওই জোসনাই, বড়মণির মা। জমিদার বাড়িতে আমি ছবি দেখেছিলাম, চেনা চেনা লেগেছে।”
ইমতিয়াজ মেহরিবার গালে চুমো দিয়ে ওকে কোল থেকে নামিয়ে বলে,
“এখন কি সিদ্ধান্ত নিয়েছো?”
মৃত্তিকা মাথানিচু করে বলল,
“উনি যেখানে আছে, ওখানেই থাকবে। শুধু আমি খরচ দিবো।”
“বাসায় নিয়ে আসলে কি হবে?”
“চাচ্ছি না আমি।”
মৃত্তিকার বারাকাহ্-র কাছে চলে যায়। সে চাচ্ছে না জোসনাকে বাসায় আনতে। কারণ তো স্পষ্ট, সে জোসনাকে ভালোবাসে না বা ভালোবাসতে চাচ্ছে না।
ইমতিয়াজ গিয়ে মেহরিবাকে দেখে মিউকোর সাথে খেলছে। তারপর ফ্রেশ হয়ে এসে মৃত্তিকার পাশে বসে বলল,
“ঠিক আছে তোমার ইচ্ছাই সই।”
মৃত্তিকা ওর দিকে ফিরে। কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল,
“ইতালি থেকে এসে আমি আপনার গ্রামে যাবো। নিয়ে যাবেন?”
“ওখানে কেন আবার?”
“বাবা-মায়ের কবর দেখে আসবো।”
ইমতিয়াজ মলিন হেসে বলল,
“আচ্ছা, নিয়ে গেলাম। তারপর কি চাই?”
“কিছু না।”
মৃত্তিকা মাথানিচু করে। ইমতিয়াজের এই দৃষ্টি ওর চেনা। ইমতিয়াজ কাছে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমাকে কিন্তু আবারো অস্ট্রেলিয়া যেতে হবে।”
“কবে?”
“এ বছরের শেষে।”
“বহু দেরি।”
মৃত্তিকা ওর মুখটা নিজের কাছে এনে বলল,
“বুড়ো হয়ে গেছেন, আজ আপনি আটত্রিশে পড়েছেন।”
ইমতিয়াজ হাসে। বলে,
“মনে রেখেছো? আমার তো মনে ছিল না।”
“আর মনে রাখবো না বুড়ো।”
“বুড়ি।”
চট করে কথাটা বলে মৃত্তিকার নাক টে°নে দেয় ইমতিয়াজ।
এটা তো সবে শুরু, যাত্রা এখনো বহুদূর বাকি। ওদেরকে চলতে হবে একসাথে, পায়ে পা মিলাতে হবে। হয়তো আরো কঠিন সময় আসবে, তবে পাশে থাকলে কঠিনকে সহজ করাও সম্ভব হবে।
সমাপ্ত
(আমার লেখা প্রথম থ্রিলার-রোমান্টিক উপন্যাস এটি। তাই ভুলত্রুটি হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। যারা শেষ পর্যন্ত পাশে ছিলেন, তাদের অসংখ্য ধন্যবাদ ও ভালোবাসা।)