উধয়রনী #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||পর্ব-১৮||

0
665

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-১৮||

৩১।
লাগেজ থেকে পুরোনো জামা-কাপড় বের করছে পদ্ম। ঘরের বাইরে গেট ধরে এক মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। তার ছেলের জন্য এক সেট জামা খুঁজতে এসেছেন। তাই আফিফের পুরোনো শার্টগুলোই বের করছিলো পদ্ম। আফিফ সবে মাত্র ঘরে ঢুকেছে। আর তখনই পদ্ম লাগেজ থেকে একটা বই বের করলো। বইয়ের প্রচ্ছদটি দেখে পদ্ম ভ্রূ কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। এপাশ-ওপাশ উলটে পদ্ম বলল,
“নাম ছাড়া বই?”

আফিফ তখন শার্টের হাতা ভাঁজ করছিলো। পদ্মের কন্ঠে তার বইটির দিকে চোখ পড়লো। মুহূর্তেই চমকে উঠলো সে। পদ্ম বইটি আফিফের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “আপনার বই?”

আফিফ ঘাবড়ে গেলেও পদ্মের সামনে তা প্রকাশ করলো না। সে বইটি পদ্মের হাত থেকে নিয়ে বলল,
“এটা এই লাগেজে ছিল?”

“হ্যাঁ।”

“আমি অনেক খুঁজেছিলাম। ভেবেছি বাসা চেঞ্জ করার সময় হারিয়ে ফেলেছি।”

“বইয়ের উপর যে নাম নেই! কার লেখা?”

“নাম ছাড়া বই। লেখকের কোনো পরিচয় নেই। এসব বাদ দাও। লাগেজে কি খুঁজছিলে?”

“আপনার পুরোনো জামা বের করছি। বাইরে একটা মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন না, উনার ছেলের জন্য বের করছিলাম।”

আফিফ প্রতিত্তোরে হাসি ফেরত দিয়ে বইটি হাতে নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো।

গুমোট বাতাবরণ বিরাজ করছে আজ। বারান্দায় দাঁড়ালেই হালকা হাওয়া গায়ে লাগে। দু’তলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় থাকে আফিফরা। পুরোনো বাড়ি। উপরে ছাদ থাকায় সূর্যের তাপে ঘর গরম হয়ে যায়। গ্রীষ্মকালে একটু বেশিই কষ্ট হয় তাদের। এই বাসার মালিক দু’মাস পর পর ভাড়া নেন। দুই মাসে দশ হাজার টাকা। নিচতলা থাকার অনুপযোগী। বর্ষাকালে এই রাস্তায় বেশ পানি উঠে। তবে সামনের রাস্তাগুলো উঁচু হওয়ায় বাড়িটা নিচের দিকে চলে গেছে। বাড়ির মালিক ঢাকায় থাকেন। খুব শীঘ্রই তিনি এই জায়গাটা ডেভেলাপারকে দিয়ে দেবেন। যতোদিন দেবেন না, ততোদিন আফিফের জন্যই ভালো। শহর উন্নত হচ্ছে, বাসা ভাড়া বাড়ছে। বাড়ছে না শুধু আফিফের বেতন। যেখানে দু’মাস হচ্ছে তার চাকরি নেই। এই শহরে চাকরি পাওয়া খুব কঠিন। তবুও সে ধৈর্য নিয়ে চাকরি খুঁজছে।

আফিফ খোলা বারান্দার রেলিঙ ঘেষে দাঁড়ালো। হাতে থাকা বইটির প্রচ্ছদে আলতো করে আঙ্গুল ছোঁয়ালো। অস্ফুটস্বরে বলল, “ক্ষণকালের খেয়াল।”

বইয়ের পাতা উল্টাতে গিয়েই থেমে গেলে আফিফ। চোখ বন্ধ করে বলল,
“আমি আমার পদ্মফুলকে ভীষণ ভালোবাসি।”

আফিফ রুমে ঢুকে দেখলো পদ্ম জামাগুলো নিয়ে মহিলাটিকে দিতে চলে গেছে। আফিফ লাগেজটির ভেতরে বইটি রেখে দিয়ে লাগেজটি আবার আলমারীর উপরে তুলে রাখলো। পদ্ম রুমে ঢুকতেই আফিফ তার কোমড় ধরে তাকে নিজের কাছে টেনে এনে বলল,
“তুমি এতো লক্ষী কেন বলো তো?”

পদ্ম লাজুক হেসে বলল, “হঠাৎ এতো ভালোবাসা!”

আফিফ পদ্মের সামনে আসা চুলগুলো কানের পেছনে গুজে দিতে দিতে বলল,
“হঠাৎ মনে পড়ে গেলো, আমার তো পদ্মফুল একটাই আছে।”

পদ্ম আফিফের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
“একটা কথা বলি আপনাকে?”

আফিফ পদ্মের কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,
“হুম, হুম। বলো।”

পদ্ম বলল,
“আহি বললো চাইলে আমরা অন্যভাবেও বাচ্চা নিতে পারবো।”

আহির নাম শুনে আফিফ পদ্মকে ছেড়ে দিলো। তবে পদ্ম বিষয়টা স্বাভাবিকভাবেই নিলো। সেকেন্ড খানিক পর আফিফ নিজেই পদ্মের হাত ধরে তাকে বিছানার উপর বসালো। নিজেও পা গুটিয়ে পদ্মের মুখোমুখি বসলো। পদ্ম আফিফের হাতের উপর হাত রেখে বলল,
“মাকে গিয়ে বলুন না, বাচ্চা নেওয়ার অনেক পদ্ধতি আছে।”

“আচ্ছা, বলবো।”

“শুনুন না।”

“বলো, শুনছি।”

“ওসব পদ্ধতিতে অনেক টাকা লাগে।”

“হুম। লাগবে স্বাভাবিক।”

“তখন আমি নিশ্চিত মা হতে পারবো। এখন তো ডাক্তার দেখাতে গিয়েই অনেক টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। ওষুধের খরচে সঞ্চয়টাও শেষ হয়ে গেছে। যদি সেই পদ্ধতিতে বাচ্চা নেই, তাহলে আমরা সত্যিই বাবা-মা হতে পারবো। অনিশ্চয়তা নেই।”

“হবো একদিন। তুমি তো আছোই।”

পদ্ম ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আপনি আমার কথাটা মনোযোগ দিয়ে শুনছেন না। আমি বোঝাতে চাইছি, পদ্ধতিটার জন্য অনেক টাকা লাগবে। আপনার চাকরি দরকার। টাকা ছাড়া কি কিছু হয়?”

আফিফ পদ্মের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর বলল,
“জানতেই তো আমি বেকার, তবুও তো বিয়ে করেছিলে। আজও আমি বেকার, একটু তো ধৈর্য রাখো। আমি চাকরি খুঁজছি।”

পদ্ম আফিফের গালে হাত রেখে কান্না ভেজা কন্ঠে বলল,
“আমার কি কোনো শখ-আহ্লাদ আছে? আপনিই আমার সব শখ-আহ্লাদ। আপনাকে হারিয়ে ফেললে আমি নিঃস্ব হয়ে যাবো। আফিফ, ভয় পাচ্ছি আমি। আপনার বুকে অন্য কেউ মাথা রাখুক আমি সহ্য করতে পারবো না। ভালোবাসার মানুষকে অন্য কারো সাথে সহ্য করা যায় না, আফিফ।”

পদ্মের কথায় আফিফ অন্যমনস্ক হয়ে গেলো। পদ্ম আফিফের হাত ঝাঁকুনি দিতেই সে পদ্মকে বলল,
“পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে, যারা ভালোবাসার মানুষকে পায় না। তারা কিন্তু বেঁচে আছে। ভালোই আছে। এমন অনেকেই আছে যারা ভালোবাসতে না পারলেও কাউকে ভীষণ ভাবে চায়, কিন্তু বাস্তবতা তো কল্পনার ঊর্ধ্বে। আর তারাও কিন্তু নতুন মানুষকে নিয়ে খুব সুখেই থাকে। আর তুমি? তুমি তো আমার পদ্মফুল। পদ্মফুলের অধিকার কেউ নিতে পারবে না।”

৩২।

বাসে উঠেই এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলো আহি। পুষ্প আহির উৎকন্ঠিত চাহনি দেখে তার হাতটি শক্ত করে ধরলো। আহি পুষ্পের দিকে তাকাতেই পুষ্প বলল,
“ভয় পাচ্ছিস কেন?”

আহি বিচলিত কন্ঠে বলল,
“বাবা যদি কাউকে আমার পিছু পাঠায়?”

“কতোবার বাইরে ঘুরতে গিয়েছিলি৷ কখনো পাঠিয়েছিল?”

“তখন আর আজ এক নয়, পুষ্প। তখন আমি সত্যিই ঘুরতে গিয়েছিলাম। আর আজ আমি মায়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি।”

“আংকেল এতোকিছু ভাবছেনই না। আর আমি তো তোর সাথেই আছি। আচ্ছা, তোর বাবা আরেকটা বিয়ে করেছিলেন না? ওই আন্টিটা কেমন রে!”

আহি পুষ্পের কথায় কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। লিনাশার বোনই যে আহির বাবার বর্তমান স্ত্রী এই কথা পুষ্প, পদ্ম কেউই জানে না৷ রাদ আর লাবীব মিসেস লাবণিকে চেনে। কারণ আহি ইউকেতে থাকাকালীন ছুটি পেলেই লাবণি আর রিজওয়ান কবির আহিকে দেখতে যেতো। তবে তারা এটা জানে না, যে সে লিনাশার বোন। কারণ তারা লিনাশার বড় বোনকে কখনো দেখে নি। এদিকে পুষ্প আর পদ্ম অনেকবার লাবণিকে দেখেছিল। যেহেতু তারা ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ছিল। লিনাশার বাসায় অনেক বার যাওয়া হয়েছিলো তাদের। সেই সূত্রেই পরিচিতি। তবে পুষ্প আর পদ্ম এতোটুকু জানে রিজওয়ান কবির দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন।

পুষ্প আহির মুখের সামনে হাত নাড়িয়ে বলল,
“কোথায় হারিয়ে গেলি?”

আহি মলিন মুখে বলল,
“ভালো না উনি। অনেক জঘন্য। বাবা আগে আমার সাথে কখনোই খারাপ ব্যবহার করে নি। কিন্তু উনাকে বিয়ে করার পর থেকে বাবা পালটে গেছে।”

“বাদ দে। মন খারাপ করিস না। ভবিষ্যতে ভালো কিছু হবে। দেখ, পদ্মের কি অবস্থা! তার শাশুড়ি তার মাথা খেয়ে ফেলছে। তবে একদিকে পদ্মের ভাগ্য ভালোই, তার বরটা ভালো। নয়তো কেউ এমন পরিস্থিতিতে স্ত্রীকে এতোটা ভালোবাসে, বল?”

আহি মুচকি হাসলো। মনে মনে বলল,
“জানি সে ভালো। তাই তো আমার ভালোবাসার জায়গাটা একমাত্র সে-ই দখল করে নিয়েছে। সে সবার চেয়ে আলাদা। তাই হয়তো আমার মন-মস্তিষ্কে সে এখনো গেঁথে আছে। হোক, সে অন্য কারো মানুষ। বাসুক না হয় অন্য কাউকে ভালো। সুখে থাকুক তারা। আমি তাকে তবুও ভালোবাসবো। কল্পনায় সে আমার সেই ফেলে আসা, এআর। আমার ডাইরির প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে প্রাণহীন তার প্রতিটি মুহূর্ত। আমি তাকে যেভাবে অনুভব করেছি আর কেউ সেভাবে অনুভব করতে পারবে না। পদ্ম শুধু তাকে স্পর্শ করতে পেরেছে। কিন্তু আমি তাকে ধারণ করে ফেলেছি। তার প্রিয় রং, প্রিয় ফুল, প্রিয় অভ্যাস, সবই আমার, একান্তই আমার।”

(***)

বাস চলছে গ্রামের উদ্দেশ্যে। দুই ঘন্টার রাস্তা৷ আহি জানালার পাশে বসেছে। এখন জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ সপ্তাহ চলছে। তবুও গরমের উত্তাপ যেন একটুও কমে নি। বাস চলছে বিধায় আরামবোধ করছে আহি। ইচ্ছে করছে হাত বের করে দিয়ে গলায় ঝুলানো উড়নাটি আঙ্গুলের ডগায় ঝুলিয়ে আজকের দিনটি উপভোগ করতে। কারণ আজ সে তার মায়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে। কিন্তু আহি এমনটা করতে পারবে না। লোকে দেখলে পাগল বলবে। মানুষের মনে অনেক উদ্ভট ইচ্ছা জন্মে। এসব ইচ্ছেগুলো দমিয়ে রাখতে হয়। সব ইচ্ছে পূরণ করতে গেলে আবার সভ্য সমাজে উন্মাদ আখ্যায়িত হবে সে।

বাস শহর ছেড়ে গ্রামের রাস্তায় উঠে গেছে। রাস্তার ধারগুলো এতো মায়াবী দেখতে! সারি সারি গাছ, ওপাড়ে সবুজ মাঠ। আহির ইচ্ছে করছে ছবি আঁকতে। কিন্তু হাতে তো রং-তুলি, ক্যানভাস কিছুই নেই। ছবি আঁকতে পারলে নিশ্চয় ছবিটি নাম দিতো আহি। সে চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলল,
“স্বপ্নীল পথ। যেই পথ নিয়ে যায় আপন মানুষের কাছে। সে আহির আপন মানুষ।”

দেড় ঘন্টা পর বাস তাদের চন্দ্রঘোনা নামিয়ে দিলো৷ সেখান থেকে ফেরি পার হয়ে যেতে হয় অন্য পাড়ে। আর সেখানে অনেকগুলো গ্রাম। আহির মায়ের বাড়ি আর রাদের বাবার বাড়ি পাশাপাশি। পাহাড়ি এলাকাও আছে সেইদিকটাই। আহি অনেক বছর পর এসেছে। তাই জায়গাটার নাম জানে না সে। রাদের পিছু পিছু যাচ্ছে তারা। রাদ একটা সিএনজি ঠিক করলো। সিএনজিতে উঠেই তারা ফেরি পার হলো। রাইখালি বাজার পার করতেই তারা রাদের বাড়ির সামনে চলে এলো। পুষ্প সিএনজি থেকে নেমে চোখে সানগ্লাস পরে বলল,
“রাদ, এদিক থেকে তো বান্দরবানও যাওয়া যায়!”

রাদ ভাড়া মিটিয়ে বলল,
“হ্যাঁ। যাওয়া যাবে। তোমরা তো বেশি সময় নিয়ে আসো নি। আর বান্দরবান একদিনে ঘুরে দেখা যায় না। অন্তত হাতে তিন দিন সময় নিয়ে আসতে হবে। আর এই ঋতুতে ভীষণ অসহ্যকর লাগে ট্যুর দিতে।”

লাবীব বলল,
“বর্ষা শুরু হলে যাওয়া যাবে।”

“বর্ষায় বান্দরবান যাই নি আমি। ওই সময় সীতাকুণ্ডের ঝর্ণাগুলোতে যাওয়া যায়। এদিকে না হয় আবার শরতের শেষে আসবো।”

এদিকে আহি মনোযোগ দিয়ে এপাশ-ওপাশ তাকাচ্ছে। সে অনেক বছর পর নানার বাড়ি এসেছে। জায়গাগুলো তার কাছে অচেনা। একটা দোকানের নামফলকে লেখা রাইখালি, কাপ্তাই রাঙ্গামাটি। এতেই বুঝে নিয়েছে সে তার নানার বাড়ির আশেপাশেই আছে। পুষ্প সামনে উঁচু সিঁড়িটির দিকে তাকিয়ে বলল,
“রাদ, তুমি কি উপজাতি?”

পুষ্পের প্রশ্নে আহি শব্দ করে হাসলো। আহিকে হাসতে দেখে রাদ তার দিকে তাকালো। কতো বছর পর এই মেয়েটা শব্দ করে হাসছে! কি প্রাণোচ্ছল সেই হাসি! রাদ আর পুষ্পের উপর রাগ করলো না। হালকা হেসে বলল,
“দাদা রাউজান থেকে এসে এখানে বাড়ি করেছেন। তাই এটা আমাদের বর্তমান দাদার বাড়ি।”

“রাউজানে কি হয়েছিল?”

“ওটা দাদার বাবার বাড়ি ছিল। দাদা অনেক আগেই আলাদা হয়ে গেছেন। এখন আমার বাবা-চাচা এখানেই আসে।”

পুষ্প সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে বলল,
“তাহলে শ’খানেক সিঁড়ি পার করে তোমাদের উপরে উঠতে হয়।”

রাদ চোখ ছোট করে বলল,
“মাত্র ত্রিশ ধাপ!”

সিঁড়ি পার করতেই দৃশ্যমান হলো কিছু বাড়ি। রাদের বাড়ি ডানদিকে। আর আহির নানার বাড়ির বামদিকের পেছনের অংশ জুড়ে। রাদ বাড়ির লোহার গেটে জোরে জোরে ধাক্কা দিতেই ভেতর থেকে মাঝবয়সী এক নারী বেরিয়ে এলেন। তিনি রাদকে দেখে রীতিমতো অশ্রু ফেলতে লাগলেন৷ ভেতর থেকে চেঁচিয়ে কয়েকজনের নাম ধরে ডাকলেন। ছোট ছোট তিনটে বাচ্চা, দু’জন কিশোরী, দুই জন যুবতী আর একজন বয়ষ্ক পুরুষ বেরিয়ে এলেন। একজন বৃদ্ধাও বাড়ির ভেতর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। আহির কাছে সবকিছুই কেমন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। এমন ঊষ্ণ অভ্যর্থনা সে জীবনে প্রথম দেখেছে। রাদ বয়ষ্ক লোকটির পা ধরে সালাম করলো। তারপর আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার বড় চাচা।”

আহিও রাদের দেখাদেখি তার পা ছুঁয়ে দিলো। রাদ চাচার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। পুষ্প আর লাবীবও চাচাকে পা ধরে সালাম করতে যাবে তখনই তিনি আটকালেন। রাদের বড় চাচী তাদের ভেতরে নিয়ে গেলো। কিশোরী দু’জন রাদের ছোট চাচার মেয়ে। বড় দুই যুবতীর একজন রাদের চাচাতো ভাইয়ের স্ত্রী, আরেকজন রাদের বড় চাচার মেয়ে। সে তার দুই ছেলেকে নিয়ে নাইওরে এসেছে। অন্য বাচ্চা মেয়েটি রাদের চাচাতো ভাইয়ের একমাত্র মেয়ে। মেয়েটির নাম নোহিন। বয়স পাঁচ বছর। আহির মেয়েটিকে ভীষণ পছন্দ হয়েছে। সে একটু পর পর মেয়েটির গাল টেনে দিচ্ছে। মেয়েটিও প্রতিত্তোরে আহির দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে আছে। গাল টানাটানি তার একদমই পছন্দ না। কিন্তু সে লজ্জায় কিছু বলতে পারছে না। কারণ নতুন মানুষদের সাথে সে অভিমান করতে পারে না। এদিকে নোহিন রাদকেও চিনতে পারে নি। রাদ যখন ইউকেতে যাচ্ছিল, তখন নোহিন মাত্র কয়েক মাসের ছিল।

এদিকে রাদের দাদি রাদকে চিনতে পারছেন না৷ বয়স বেশি হয়েছে তার। স্মরণ শক্তি কমে গেছে। কিন্তু আহিকে দেখে তিনি জড়িয়ে ধরলেন। হাত ধরে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। আহির নাম-পরিচয় জিজ্ঞেস করলেন। বেশ গল্প জুড়িয়ে দিলেন। হঠাৎ আহিকেই কেন তার এতো পছন্দ হয়েছে, তা কেউই বুঝতে পারলো না।

(***)

অনেকক্ষণ হয়ে গেলো রাদের কোনো খোঁজ নেই। লাবীব আর পুষ্প সামনের উঠানে দাঁড়িয়ে আছে। পুষ্প বিভিন্ন ভঙ্গিতে দাঁড়াচ্ছে, লাবীব তাকে ছবি উঠিয়ে দিচ্ছে। আহি বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গলা উঁচিয়ে বলল,
“রাদকে দেখেছিস?”

পুষ্প বলল,
“না। ওকে তো চাচার সাথে বাইরে যেতে দেখলাম।”

আহি মলিন মুখে ঘরে ঢুকলো। তার মন মাকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে আছে। সে কিছু একটা ভেবে রাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো। তাকে মেইন গেটের কাছে আসতে দেখে পুষ্প বলল,
“এই আহি, কোথায় যাচ্ছিস?”

“তোরা এখানে থাক। আমি একটু হেঁটে আসি।”

লাবীব বলল,
“রাদ তোকে একা বাইরে না যেতে বলেছে। আমরা সহ আসছি।”

লাবীব আর পুষ্পও আহির পেছন পেছন গেলো। আহি বলল,
“পেছনের বাড়িটা আমার নানার বাড়ি, যতোটুকু আমার মনে আছে।”

“এভাবে না জেনে যাওয়ার কি দরকার? রাদ আসুক।”

“আমি অনেকক্ষণ ধৈর্য ধরেছি। আর পারবো না। আর রাদ এভাবে আমাকে বসিয়ে রেখে কেন চলে গেলো? ওর উচিত ছিল আগে মায়ের সাথে আমাকে দেখা করিয়ে দেওয়া।”

(***)

আহি পেছনের বাড়িটির সামনে এসে দাঁড়ালো। দেয়ালে খোদাইকৃত নামফলক, আফজাল নিবাস। আহির নানার নাম।
আহির তিন মামা। বড় মামা দেশের বাইরে থাকেন। মেজ মামা গ্রামে থাকেন। ছোট মামাও এখানেই থাকতেন। আহির বাবা-মার যখন তালাক হয়েছিল, তখন তিনি ঢাকায় চলে যান। আর সালমা ফাওজিয়া আফজাল সাহেবের একমাত্র মেয়ে।

এদিকে আহি নানার নামফলকে হাত রেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। গেটের হাতলটি দিয়ে লোহার গেটে দু’বার ধাক্কা দিলো। একটু পর ভেতর থেকে লোহার গরাদটি টানার শব্দ হলো। আর মুহূর্তেই সে শরীরের সব শক্তি হারিয়ে ফেললো যেন। হয়তো মায়ের সাথে দেখা হবে সেই উত্তেজনায়। গেট খুলতেই একটি মেয়ে দৃশ্যমান হলো। সে জিজ্ঞেস করলো, “কাকে চান?”

আহি কাঁপা কন্ঠে বললো,
“সালমা ফওজিয়া থাকেন না এখানে?”

মেয়েটি ভ্রূ কুঁচকে বলল, “ফুপ্পি!”

আহি মেয়েটির হাত ধরে বলল,
“উনি তোমার ফুফু?”

মেয়েটি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। আহি বলল,
“আমি আহি।”

“আহি আপু?”

“হ্যাঁ।”

মেয়েটি দৌঁড়ে ভেতরে চলে গেলো। আহিও গেট খোলা পেয়ে ভেতরে পা বাড়ালো। কিছুক্ষণের মধ্যেই আহির মেজ মামী ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। তিনি আহিকে দেখে সামনে এগুতে যাবেন তখনই আহির মেজ মামা রাগান্বিত মুখে বাড়ির বাইরে এসে বললেন,
“এই মেয়েকে ঘরে ঢুকতে দিলি কেন?”

মামী তার হাত ধরে আটকালেন। কিন্তু তিনি চুপ হলেন না। বাজখাঁই সুরে বললেন,
“লম্পট বাবার সাথে থেকে তার মেয়ে লম্পট হয় নি এর নিশ্চয়তা কি?”

মামার মুখে এমন কথা শুনে আহির মুখে অন্ধকার নেমে এলো। পুষ্প আহির হাত ধরে বলল,
“আহি, চল এখান থেকে।”

আহি পুষ্পের হাত সরিয়ে দিয়ে মামার সামনে এসে দাঁড়ালো। আর শান্ত কন্ঠে বলল,
“কেমন আছো মেজমামা? কতো বছর পর দেখলাম!”

আহির প্রশ্নের কোনো উত্তর এলো না। আহি এবার মামীর দিকে তাকালো। ভদ্রমহিলা স্বামীর হাত ধরে রেখেছেন। মনে হচ্ছে এই হাত ছাড়া পেলেই ভদ্রলোক আহিকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবেন। আহি মাথা নিচু করে বলল,
“আমি জানি তোমরা আমার বাবাকে ঘৃণা করো। কিন্তু এখানে আমার কি অপরাধ, বলো? আমার কি ইচ্ছে করে না আমার মায়ের সাথে থাকতে? মাকে দেখতে? মা ছাড়া বড় হচ্ছি আমি। আমি তোমাদের বিরক্ত করবো না। শুধু মায়ের সাথে দেখা কর‍তে এসেছি। মাকে এক নজর দেখেই চলে যাবো। একটু অনুমতি দাও।”

ভদ্রলোক রাগী স্বরে বললেন,
“তোর বাবা আমাদের পথে বসিয়ে দিয়েছে। আমার বোনের জীবনটা ধ্বংস করে দিয়েছে। রিজওয়ান কবিরের ছায়াও আর আমার বোনের জীবনে পড়বে না। দূর হ এখান থেকে। আমাদের জীবনে কখনো ফিরে আসবি না। তোর কোনো মা নেই।”

আহি অশ্রুসিক্ত নয়নে হাতজোড় করে বলল,
“অনেক আশা নিয়ে এসেছি, মামা। প্লিজ, মাকে একটু দেখতে দাও। দূর থেকেই দেখবো না হয়। একটু তো দেখে যাই। প্লিজ মামা।”

আহির কাকুতি মিনতি দেখে পুষ্পের চোখ ভিজে গেলো। লাবীব এখনো গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। সে আহির মামার চেঁচামেচি শুনে ভেতরে ঢুকার সাহস পেলো না। এদিকে আহির মেজ মামা তার কান্নাভেজা চাহনি উপেক্ষা করে স্ত্রীর হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ঘরে ঢুকে গেলেন। ভেতর থেকেই চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন,
“এই মেয়েকে এখনি বের হয়ে যেতে বলো। ও যদি না যায়, আমি নিজেই ওকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করবো।”

আহি মলিন মুখে বাড়ির দরজার দিকে তাকিয়ে রইলো। আহির মেজ মামী করুণ দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকিয়ে ঘরে ঢুকে গেলেন। পুষ্প আহির হাত ধরে বলল,
“রাদ আসুক। ও নিশ্চিত মামাকে মানিয়ে নেবে।”

আহি কোনো উত্তর দিলো না। সে এলোমেলো ভাবে হেঁটে গেটের কাছে আসতেই তার সেই কিশোরী মামাতো বোনটি দৌঁড়ে এলো। তার হাবভাব দেখে বোঝা গেলো, সে আবার গেট লাগাতে এসেছে। আহি বেরিয়ে যেতেই মেয়েটি গেটের বাইরে হাত বের করে দিয়ে বলল,
“আহি আপু, মা বলেছে তোমাকে দিতে।”

আহি দেখলো মেয়েটির হাতে একটা চিরকুট। আহি চিরকুটটি নিয়ে কিছু বলার আগেই মেয়েটি গেট বন্ধ করে দিলো। আহি চিরকুটটি খুলে দেখলো একটা ফোন নম্বর। পুষ্প বলল,
“হয়তো আন্টির নম্বর দিয়েছে।”

লাবীব কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে পুষ্প ইশারায় তাকে চুপ করিয়ে দিলো। এদিকে আহি নম্বরটি দেখেই অস্থির হয়ে গেলো। সে লাবীবকে বলল,
“তোর ফোনটা একটু দে। আমি এই নম্বরে কল দিয়ে দেখি।”

লাবীব বলল,
“আমার ফোন তো রাদের বাড়িতে চার্জে দিয়েছি। তোর ফোন কোথায়?”

“সিমটা বাবার নামে রেজিস্ট্রার করা। বাবা যদি কল রেকর্ড বের করে ফেলে? বাবা চাইলেই যে-কোনো কিছু করতে পারে।”

পুষ্প তার ফোন এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আমরটা থেকে ট্রাই কর।”

আহি কাঁপা হাতে নম্বরটি ফোনে তুললো। তারপর ফোনটা কানের কাছে নিয়ে সামনে হাঁটতে লাগলো। কল যাচ্ছে, কিন্তু ওপাশ থেকে কেউ ধরছে না। আহির অস্থিরতা বাড়তে লাগলো। সে আরো অস্থিরভাবে সামনে হাঁটছে। পুষ্প আহির পিছু নিয়েছে। এ মেয়ে যে-কোনো সময় হোঁচট খেয়ে পড়ে যাবে। যা ভেবেছে তা-ই হলো। আহি সামনে যেতেই উঁচুনিচু ইটের রাস্তায় উঠলো। আর সেখানেই হোঁচট খেলো। পুষ্প ভয়ার্ত চোখে সেদিকেই তাকিয়ে রইলো। আহি শক্ত করে ফোনটা হাতে ধরে রেখেছে। যেন তার প্রাণটা এই ফোনেই আটকে আছে। আহির হুঁশ ফিরতেই সে দেখলো রাদ তাকে ধরে রেখেছে। আহি রাদের দিকে তাকাতেই সে বলল,
“পাগল না-কি তুই? এভাবে হাঁটছিস কেন?”

আহি হেসে বলল,
“মায়ের নম্বর পেয়েছি। মা হয়তো এখানে নেই। থাকলে আমার কন্ঠ শুনে নিশ্চিত বের হতো।”

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here