উধয়রনী #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||পর্ব-১৯ (১ম ভাগ)||

0
307

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-১৯ (১ম ভাগ)||

৩৩।
অশ্রুসিক্ত দৃষ্টি আটকে আছে দূর পশ্চিমের আকাশে। ডুবন্ত সূর্যের রক্তিম আভা মেঘেদের ভাঁজে মিশ্র রঙ সৃষ্টি করেছে। সেই লালিমা রেখা হিয়ার কোণে লুকিয়ে রাখা সুপ্ত আকাঙ্ক্ষাদের জাগিয়ে দিতে চাইছে। কিন্তু সব আকাঙ্ক্ষা তো পূর্ণ হয় না। যেমনটা অসমাপ্ত আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ছটফট করছে আহি। পুষ্পের ফোনটা হাতের মুঠোয় আবদ্ধ তার। সেই সকাল থেকে অনেক বার মায়ের নম্বরে কল করেছিল আহি। বিকেলে কলটা রিসিভও হয়েছিল। ওপাশ থেকে অপরিচিত ভারী পুরুষালী কন্ঠ শুনে কল কেটে দেয় সে। অজানা ভয়ে আহির মনটা ভারী হয়ে আসছে এখন। বাবার মতো মাও কি তবে বিয়ে করে সংসারী হয়েছে?

সন্ধ্যা হয়ে আসছে। মুনিয়া খালা ফোন দিয়েছেন বার কয়েক। নিশ্চয় মিসেস লাবণি জেরা করছিলেন কল দেওয়ার জন্য। আহি ইচ্ছে করেই কল ধরছে না। সবকিছু তো আর তাদের নিয়মে চলবে না। ভালো লাগা, মন্দ লাগার অনুভূতি আহিরও তো আছে।
এদিকে আহিকে অনেকক্ষণ ছাদের এককোণে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাদ এবার তার কাছে এলো। আহি রাদের উপস্থিতি টের পেয়ে বলল,
“আমার সাথে ভাগ্যের কোনো দ্বন্ধ আছে নিশ্চয়। যা-ই আমি চাইবো, তা-ই আমার কাছ থেকে কেঁড়ে নেবে। অভিমান হয় আমার। একটা মানুষের গত কয়েক বছরের একটা ইচ্ছেও পূরণ হচ্ছে না। সে শুধু আঘাতের পর আঘাত পেয়েই যাচ্ছে। তাহলে তার কী বোঝা উচিত? সৃষ্টিকর্তা তার দিকে ফিরেই তাকাচ্ছেন না? একটা মানুষকে এতোটা নিঃস্ব করে দিলে, তার বাঁচার ইচ্ছা থাকে না, রাদ। আমারও বাঁচতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু নিজেকে শেষ করে দিলে তো আমারই ক্ষতি। এখানে সহ্য করছি, তখন ওখানেও সহ্য করতে হবে। তবে এতোটা অন্যায় আমার সাথে হওয়া উচিত না।”

ছাদের রেলিঙটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রেখেছে আহি। মনে হচ্ছে তার মনের ক্ষোভটা সেই ইটের তৈরী রেলিঙের উপরই সে বের করছে। রাদ আহির সেই হাতের উপর হাত রাখলো। আহি মুহূর্তেই শান্ত হয়ে গেলো। রেলিঙের উপর থেকে তার হাতটা আলগা হয়ে এলো। রাদ নিজের হাতটি আহির সেই আলগা হয়ে যাওয়া হাতের মুঠোয় আবদ্ধ করে নিতেই আহিও সেই হাতটি শক্ত করে ধরলো। রাদ আহির স্পর্শ পেয়ে তার দু’চোখ বন্ধ করে বলল,
“মনে হচ্ছে তোর সামনে অনেক সুখ। এজন্যই বোধহয় এই কষ্টগুলো একের পর এক তোকে সহ্য করতে হচ্ছে।”

আহি মলিন মুখে বললো,
“সুখ! এই শব্দটা এখন আমার জীবনের কৌতূকময় শব্দ। ভালোবাসার মানুষকে হারিয়েছি, বন্ধুদের হারিয়েছি, মাকে হারিয়েছি, এদের না পেলে আমি সুখী হবো না। আমি সবাইকে একসাথে চেয়েছি। কাউকে হারাতে চাই নি। কিন্তু আমার সুখের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে আমার বাবা, তার বর্তমান স্ত্রী, তাজওয়ার খান আর আমারই প্রিয় বান্ধবী। তাহলে আমি কেমন সুখ আশা করবো?”

রাদ এবার আহির দিকে তাকালো। হালকা হেসে বলল,
“ধর, তুই সব সমস্যার সমাধান করে ফেলেছিস। তোর শেষ স্বপ্নটা পদ্মের কারণেই আটকে আছে। তখন কি করবি?”

আহি মলিন হেসে বলল,
“মানুষ পুরোপুরি সুখী হয় না। আর আমি এই বাস্তবতা মেনে নিয়েছি।”

রাদ আহির গালে হাত ছুঁয়ে দিয়ে বলল,
“আফিফকে ভুলে যাওয়া যায় না?”

“যদি ভুলে যেতে পারতাম, আমার চেয়ে সুখী কেউ হতো না। বিচ্ছেদের দহনে আমিই কষ্ট পাচ্ছি, ওরা ঠিকই সংসার করছে। আমি ভুলে যেতে পারি না। আমার মনটা ওখানেই আটকে আছে। সেই চারুশিল্পের ইট-পাথরের মাঝে, সেই রং-তুলির ফাঁকে, আর সেই ডায়েরীর ভাঁজে।”

“বিয়ে তো করবিই। তখন?”

“দেবদাসের পারু কি বিয়ের পর তার দেবদাকে ভুলতে পেরেছিল? তার কপালে দেওয়া দেবদাসের সেই আঘাতের চিহ্ন সে মুছে যেতে দেয় নি। আমি তাহলে কিভাবে আমার হৃদয়ে আঁকা প্রিয় ছবিটা মুছে ফেলবো? হুমায়ুন আহমেদের লেখা হিমু চরিত্রটির সাথে রূপার কোনো মিল হতে দেখি নি। কিন্তু যখনই হিমু নামটি আসে, রূপা সেই নামের সাথেই যুক্ত হয়ে যায়। তাহলে আহির সাথে এআরের সম্পর্ক কিভাবে ছিন্ন হবে? পৃথিবীতে কতো শত প্রেমের গল্প! সবগুলোই কোনো না কোনোভাবে জীবনের সাথেই যুক্ত। হয়তো আমি তাদেরই একটা অংশ। আমার মনে হয় না নতুন কেউ আমার মনে সেভাবে জায়গা করে নিতে পারবে।”

রাদ শুকনো হাসলো। মনে মনে বলল,
“কাউকে ভালোবাসার চেয়ে কারো ভালোবাসা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। যে ভালোবাসে, সে তো সব উজাড় করেই ভালোবাসে। আর যে ভালোবাসা পায়, তার মতো সুখী কেউ হয় না। যদি আমার প্রিয় মানুষটা ঠিক এভাবেই আমাকে ভালোবাসতো!”

রাদ আহির দিকে তাকালো। আহির দৃষ্টি এখনো দূর আকাশের পানেই স্থির। রাদের ইচ্ছে করছে আহিকে শাসন করতে৷ তার উপর অভিমান করতে। চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে,
“দেখ, তোকে ভালোবাসে এমন অনেকেই আছে। আমি আছি। দেখ, আহি, আমাকে দেখ। আমাকে কি ভালোবাসা যায় না?”

কিন্তু রাদ এসব করবে না। আহিকে সে কিছুই বলবে না। আহি তো তাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে। শিখিয়েছে কিভাবে অনুভব করেও প্রিয় মানুষকে ভালোবাসা যায়। সেও আহিকে অনুভব করে যাবে। যতোদিন মনের তৃষ্ণা মিটবে না, ততোদিন সে এক তরফা ভালোবেসে যাবে।

(***)

বাসের বন্ধ জানালার দিকে তাকিয়ে আছে আহি। অস্বচ্ছ কাচটির মতোই ঝাপসা হয়ে আছে তার জীবন। যার কোনো গতি নেই। পুষ্প আর লাবীব পাশাপাশি সিটে বসেছে। আর রাদ আহির পাশে বসেছে। সে সিটে বসেই ঝিমুচ্ছে। বাড়ির সবাই তাকে থাকতে বলেছিল। কিন্তু আহিকে সে নিজে পৌঁছে না দিয়ে সন্তুষ্ট হবে না। তাই সে চলে এসেছে। এদিকে রাদের মাথাটা একটু পর পর হেলে পড়ছে সামনে। আহি পাশ ফিরে রাদকে ঢুলতে দেখে তার মাথাটা নিজের কাঁধের উপর রেখে বলল,
“এবার ঘুমা।”

আহি রাদের হাতটা ধরলো। রাদ আধো আধো চোখ মেলে আহির দিকে তাকালো। আর ঘুম ঘুম চোখ দু’টি প্রশান্তির আশ্রয় পেয়ে তার ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিলো।

(***)

নীরবতা ভেঙে পুষ্পের ফোনটা বেজে উঠলো। পুষ্প ফোনের দিকে তাকাতেই চমকে উঠলো। সিট থেকে উঠে আহির দিকে ফোন এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আহি, ওই নম্বরটা!”

আহি সাথে সাথেই পুষ্পের হাত থেকে একপ্রকার ছিনিয়ে নিলো ফোনটা। এদিক-ওদিক না তাকিয়ে কলটা ধরেই কানের কাছে আনলো। ওপাশ থেকে ভেসে এলো সেই মায়া মাখা কন্ঠের স্বর। আহি চুপ করে আছে। এদিকে রাদ আহির দিকে তাকিয়ে আছে। আহি হুট করে বসা থেকে উঠে যাওয়ায় রাদের ঘুমটা ভেঙে গিয়েছিলো। তাই সে স্থির হয়ে বসে বোঝার চেষ্টা করছে কি হচ্ছে।

এদিকে ওপাশ থেকে আবার ভেসে এলো সেই কন্ঠ,
“হ্যালো। কে বলছেন?”

আহি কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আমি। আমাকে চিনতে পেরেছো!”

ওপাশে কিছুক্ষণ নীরবতা চললো। এই নীরবতা আহির গলায় কাঁটার মতো বিঁধছে। সে একটু পর পর শুকনো ঢুক গিলছে। রাদ এতোক্ষণ পর বিষয়টা বুঝতে পারলো। সে আহির অস্থিরতা দেখে তার এক হাত আলতোভাবে ধরলো। রাদের স্পর্শ পেয়ে আহি কিছুটা স্বাভাবিক হলো। সে এবার নিজের পরিচয়টা দিতে যাবে তখনই ওপাশ থেকে সেই কন্ঠটি বলে উঠলো,
“আহি! আমার মা?”

মায়ের মুখে নিজের নাম শুনে আহির ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। সে কান্নাভেজা কন্ঠে বলল,
“আমাকে চিনতে পেরেছো?”

সালমা ফাওজিয়া কান্নাভেজা কন্ঠে বললেন,
“আমার মাকে আমি চিনবো না? তুমি কেমন আছো, মা?”

আহি এবার ফুঁপিয়ে উঠলো। সে শক্ত করে রাদের হাতটা চেপে ধরলো। রাদ আহিকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য আহির হাতের উলটো পিঠে আলতোভাবে তার বৃদ্ধ আঙ্গুলটি চালাতে লাগলো। এদিকে আহির গলায় কথা আটকে গেছে। পুষ্প তার ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে রাদকে দিলো। রাদ বোতলের ছিপি খুলে আহির দিকে বোতলটি এগিয়ে দিলো। আহি হালকা গলা ভিজিয়ে বলল,
“মা, তুমি আমার পাশে থাকলে হয়তো আমি আরেকটু বেশি ভালো থাকতাম।”

সালমা ফাওজিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“যদি সেই সৌভাগ্য হতো আমার!”

“কেমন আছো তুমি?”

“আমার মেয়ে আমার পাশে নেই। তাহলে আমি কিভাবে ভালো থাকবো? আমি তো শুধু বেঁচে আছি।”

“জানো, আমি ভেবেছি তুমি আমাকে ভুলে গেছো।”

সালমা ফাওজিয়া চোখের পানি মুছে বললেন,
“মা তার সন্তানদের ভুলতে পারে না। আর আমার তো তুমিই একমাত্র সম্বল। আর তো কেউ নেই আমার।”

আহি মৃদু হাসলো। বলল,
“কতো বছর পর কথা হচ্ছে আমাদের!”

“তোমার সাথে কথা বলতে চেয়েছিলাম আমি। কিন্তু তোমার বাবা সেই সুযোগ দেন নি।”

আহি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর বলল,
“জানো মা, আমি তোমার সাথে দেখা করতে আজ নানুর বাড়ি গিয়েছিলাম।”

“মামা বকেছে তোমাকে?”

“উঁহুম। ওসব বকা-ঝকা একটু আধটু খাওয়া যায়। বকার পরিবর্তে তোমার নম্বরটা তো পেয়েছি।”

সালমা ফাওজিয়া হাসলেন। ওপাশ থেকে পুরুষালী কন্ঠে কেউ একজন তাকে ডাকলো। আহি মলিন সুরে বলল,
“আচ্ছা, তুমি হয়তো ব্যস্ত।”

সালমা ফাওজিয়া ব্যস্ত কন্ঠে বললেন,
“না, আমি ব্যস্ত নই। ফোন কেটে না, আহি। শোনো, আমি তোমাকে দেখতে চাই।”

মায়ের এমন কথায় আহির ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। সে চোখ মুছে বলল,
“আমিও তোমার সাথে দেখা করতে চাই। আর এটা পুষ্পের নম্বর। আমার ফ্রেন্ড পুষ্প, মনে আছে?”

“হ্যাঁ, মনে আছে।”

“আসলে আমার নম্বরটা বাবার নামে রেজিস্ট্রার করা, তাই সেই নম্বর থেকে কল দেওয়ার সাহস হয় নি।”

“আমি জানি, আহি। চিন্তা করো না। তোমার বাবা কিছুই জানবেন না। আর আমি এখন ট্রেনিংয়ে এসেছি। আমার অফিস থেকে রাজশাহী এনেছে। চট্টগ্রাম এলেই আমি তোমার সাথে দেখা করবো।”

“আচ্ছা। মা, আমি তোমাকে সকালে কল দিয়েছিলাম। অন্য একজন ধরেছিল!”

“ওহ, হ্যাঁ। কামাল ধরেছিল। আমার কলিগ। ওর রুমেই আমার ফোনটা চার্জ হচ্ছিল। হুড়োহুড়িতে চার্জারটাই আনতে ভুলে গিয়েছিলাম।”

“আমি ভেবেছি কি জানো?”

“কি!”

“তুমিও বাবার মতো বিয়ে করে নিয়েছো!”

সালমা ফাওজিয়া হাসলেন। বললেন,
“তোমার বাবার সাথে সংসার করে শিক্ষা হয়ে গেছে আমার।”

কথাটি শুনে আহির মুখটা মলিন হয়ে গেলো। সালমা ফাওজিয়া বললেন,
“আমি তোমার জন্য নিজেকে দাঁড় করাচ্ছি, মা। সব তোমার জন্য করছি। এই আশা নিয়ে আছি, একদিন হয়তো তোমার বাবার চেয়ে ভালো অবস্থানে গিয়ে তার কাছ থেকে আমার মেয়েটাকে মুক্ত করে আনতে পারবো।”

আহি ঠোঁট চেপে কাঁদতে লাগলো। রাদ হাতের ইশারায় জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে? আহি না সূচক মাথা নেড়ে সালমা ফাওজিয়াকে বলল,
“ততোদিনে আমি খান সাহেবের রক্ষিতা হওয়া থেকে বাঁচি কি-না দেখো!”

আহির কথায় সালমা ফাওজিয়া চুপ হয়ে গেলেন। আর রাদের বুকটা ধক করে উঠলো।

(কালকে রাতে দিবো দ্বিতীয় অংশ।)

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here