উধয়রনী #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||পর্ব-৫৯||

0
103

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫৯||

১২৩।
পুষ্প আর লিনাশা পদ্মের পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে। পদ্মের দৃষ্টি নত। আহি দাঁড়িয়ে পদ্মের দিকে তাকিয়ে আছে। পুষ্প রাগী স্বরে পদ্মকে জিজ্ঞেস করলো,
“আহি যাকে ভালোবাসতো, সেই মানুষটা আফিফ ভাইয়া ছিলেন?”

লিনাশা বলল,
“ওকে আর কি জিজ্ঞেস করছিস। সবটাই তো পরিষ্কার। ও সব জেনেশুনে আহির ভালোবাসা কেঁড়ে নিয়েছে।”

“কীভাবে করলি এমনটা, পদ্ম? বুক কাঁপে নি তোর? ক্লাস থ্রি থেকে আমরা ফ্রেন্ড। কলেজ পর্যন্ত একসাথে ছিলাম।”

“শুধু বন্ধুত্ব না হারানোর জন্য আহি সেই কলেজে ভর্তি হয়েছে, যেই কলেজে পড়া তুই এফোর্ড করিস।”

“ছি! ছি! আমার রেজাল্ট ভালো এসেছিল। আমাকে বাবা ঢাকায় ভর্তি করাতে চেয়েছিল। লিনাশা আর আহির রেজাল্ট অনুসারে ওরাও ওখানে আসতো। শুধু তোর জন্য আমরা সেই কলেজে পড়েছি।”

“আমার মনে হচ্ছে, আমরা সেদিন বাবা-মার কথা মেনে নিলে, আহিকে কখনোই তার ভালোবাসার মানুষকে হারাতে হতো না। বন্ধুত্বকে বেছে নিয়ে এতো বড় ভুল করেছে মেয়েটা?”

পদ্ম নিরবে কাঁদছে। আহি তাদের কথার মাঝখানে এসে বলল,
“আমি পদ্মকে ক্ষমা করে দেবো।”

লিনাশা আর পুষ্প চোখ-মুখ কুঁচকে বলল,
“কখনো না। এর কোনো ক্ষমা নেই।”

আহি বলল, “করবো। কিন্তু এক শর্তে।”

পদ্ম কাঁপা কন্ঠে বললো, “কি শর্ত!”

“আমি আফিফকে ঠিক সেভাবেই পেতে চাই, যেভাবে আমার প্রেমের গল্পটা আমি সাজাতে চেয়েছিলাম।”

পদ্ম নিশ্চুপ। আহি আবার বলল,
“তুই আফিফকে সেখানেই ছেড়ে আয়।”

পদ্ম ভ্রূ কুঁচকে বললো, “মানে?”

“আহি পাগলের মতো ভালোবাসে তার এআরকে। আগেও ভালোবাসতো। এখনো ভালোবাসে। আমৃত্যু ভালোবাসবে। তুই হাসি-মুখে আফিফের কাছে সম্বন্ধ নিয়ে যাবি। তাও আমার বিয়ের।”

লিনাশা আহির বাহু ধরে বলল,
“এই মেয়েকে তুই আফিফের ব্রেইন-ওয়াশ করতে পাঠাচ্ছিস?”

“আফিফ যদি সত্যিই আমাকে ভালোবাসে, তাহলে কারো কথার জালে সে আটকাবে না। এবার আমার মায়ায় ওকে ছুটে আসতেই হবে।”

পদ্ম বলল,
“তুই আমাকে ক্ষমা করছিস, না-কি শাস্তি দিচ্ছিস, আহি।”

“সরি, আমাকে ক্ষমা করে দে, এই একটা বাক্যে কি আমি আমার দশ বছর ফিরে পাবো? চার বছরের এক তরফা ভালোবেসে যাওয়া, এরপর চার বছরের ট্রমা, তারপর এক বছর সামনা-সামনি তার সংসার দেখে যাওয়া, আর এরপর পাঁচ বছর এই ভেবে জীবন কাটানো যে সে আমাকে ঘৃণা করে। মোট দশ বছরের বিচ্ছেদ। চৌদ্দ বছরের একাকীত্ব। এতোগুলো সময় শুধু সরি, আমাকে ক্ষমা করে দে, এই এক বাক্যে শেষ হয়ে যাবে? তোকে সব দেখতে হবে। তুই আমার পাওয়া সব কষ্টকে সুখ হতে দেখবি। এটাই তোর ক্ষমা।”

আহি চলে গেলো। পদ্ম বউ সেজে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে আছে এখনো। লিনাশা পদ্মকে বলল,
“আই হেইট ইউ। পলি আপু গ্রুপ এখানেই শেষ। তুই আমার বেস্টিকে কষ্ট দিয়েছিস। আমিও দিয়েছিলাম একটা সময়। কিন্তু আমার সিচুয়েশন এমন ছিলো না। আমার বাবা মারা গিয়েছিল। আমার কোনো ভাই নেই। আমি ছোট ছিলাম। মা অসুস্থ ছিল। মা বার-বার বলছিল, আহির সাথে বন্ধুত্ব রাখায় আমি আমার বাবাকে হারিয়েছি। ফ্রাস্ট্রেশনে ছিলাম আমি। তাই সব যোগাযোগ শেষ করে দিয়েছি। কীভাবে রাখতাম যোগাযোগ? আহির নতুন মা আমারই বড় আপু। কীভাবে বাবার খুনীর পরিবারের সাথে সম্পর্ক রাখতাম? কিন্তু এমন একদিনও যায় নি, যেদিন আমি আহিকে মিস করিনি। সবসময় চাইতাম, আহি যাতে মুভ অন করতে পারে। কারণ আমি জানি, ওর জীবনে আসা সব ট্রাজেডির চেয়ে ভয়ংকর ট্রাজেডি ছিল আফিফকে হারানো। যেই আঘাতটা তুই ওকে ইচ্ছেকৃত ভাবে দিয়েছিস। আর আমি তোর ভালোর জন্য আহিকে বলতাম, তোর সংসার যাতে না ভাঙে। তুই জেনে গেলে কষ্ট পাবি। বোকা আমি! একবার যদি সত্যটা জানতাম, তোকে খুন করে আহি আর আফিফের পথের কাঁটা সরিয়ে দিতাম। আই হেইট ইউ, পদ্ম।”

পুষ্প বলল,
“আমি তো আর ভাবতেই চাই না, তুই আমার বন্ধু ছিলি। না জানি কখন, কার বরের প্রেমে পড়ে তাকে জীবন থেকেই কেঁড়ে নিস।”

পদ্ম কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
“ভুল করেছি আমি। কিন্তু যা করেছি, আফিফকে পাওয়ার জন্য করেছি।”

“এখনো নিজেকে ডিফেন্ড করবি? তোর কাছে আশাও কেন করছি? অশিক্ষিত, মূর্খ তুই।”

পদ্ম বলল,
“যা বলার বল। আমি আফিফকে ভালোবাসি। এখনো ভালোবাসি। আমি কখনো চাইবো না, আহি আফিফের হোক। আর আমি আফিফকে রাজী করাবো না।”

“তোর রাজী করানো, না করানোতে কোনো যায় আসে না আহির।”

লিনাশা বলল,
“আহি যেটা চায়, সেটা তোর রাজী হওয়া না হওয়াতে নির্ভর করবে না। সেটা হয়েই যাবে। দুঃখের কথা কি জানিস? তুই আফিফকেই নয়, তিনটে ভালো বন্ধুও হারিয়েছিস। তোর মতো দুর্ভাগা যাতে কেউ না হয়! না আফিফ আছে, না বন্ধু আছে, না নৈতিকতা আছে, না সম্মান আছে, না একটা সন্তান আছে। তুই আলটিমেট লুজার। তাজওয়ার খানের মতো। তাজওয়ার তো অন্তত তোর চেয়ে একটু ভালো। সে যায় করেছে, আহির ক্ষতি করে নি। তুই তো আফিফকে বিক্রি করে দিয়েছিস। তার সম্মান, তার বোনের সম্মান সবটাই তাজওয়ারের হাতে তুলে দিলি। নিজেরটাও ছাড় দিলি না। জেনেশুনে আফিফকে খানস গ্রুপের কাজটা করতে দিলি। এখনো আফিফ লোন শোধ করছে। আসলে তোর মতো ইডিয়ট ভালোবাসারই যোগ্য না।”

১২৪।

আহি পদ্মের স্বামী বোরহান আলী হাতে একটা কার্ড এগিয়ে দিলো। পদ্ম স্বামীর পাশেই দাঁড়ানো। সে ভ্রূ কুঁচকে আহির দিকে তাকিয়ে আছে। পদ্মের স্বামী, বোরহান আলীর বয়স চল্লিশের একটু এপার-ওপার। কাঠ ব্যবসায়ী। যেখানে খুব একটা সুবিধা করতে পারছেন না তিনি। দুই সন্তানের পিতা। একটার বয়স সাত। অন্যটার বয়স এক। আহি বোরহান আলীকে বলল,
“আপনার ব্যবসা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। আপনি যদি এই কাজটা নেন, বেশ খুশি হবো।”

বোরহান আলী খুশিতে গদগদ। তিনি আহির এগিয়ে দেওয়া কার্ডটি নিয়ে বললেন,
“কাজটা কি!”

আহি মুচকি হেসে বলল,
“কক্সবাজারে আমার একটা বাংলো বাড়ি আছে। ওখানের জন্য একজন বিশ্বস্ত গার্ড লাগবে। নাইট গার্ড। আপনার থাকার ব্যবস্থা আমিই করে দেবো। বাকিটা আপনি চালাবেন।”

পদ্মের মুখ লাল হয়ে গেলো। বোরহান আলী বললেন,
“বেতন কতো!”

“মাসে ত্রিশ হাজার টাকা। ওভার টাইম করতে চাইলে বাড়িয়ে দেওয়া হবে।”

বোরহান আলী যেন আকাশ থেকে পড়লেন। তিনি সানন্দে রাজি হলেন। পদ্ম বলল,
“অপমান করছিস?”

বোরহান আলী ভ্রূ কুঁচকে পদ্মের দিকে তাকালেন। আহি বলল,
“আহি কাউকে অপমান করে না। সাহায্য করে। শোন কোনো কাজই ছোট না। মোজাম্মেল চাচা আমার খুব কাছের মানুষ ছিলেন। তিনি এখনো শক্ত থাকলে এই কাজ আমি উনাকেই দিতাম। তোর স্বামী আমার ভাইয়ের মতো। তার শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুসারে এই কাজটা অনেক সহজ, আর এর বেতনও অনেক বেশি। সরাসরি কোম্পানিতে কাজ দিলে, খাটতেও হতো, এমপ্লয়িদের কথাও শুনতে হতো।”

বোরহান আলী বললেন,
“আমার এই কাজ খুব পছন্দ হয়েছে। আমি করবো কাজটা।”

আহি পদ্মের দিকে তাকিয়ে হাসলো। লিনাশা চাপা স্বরে আহিকে বলল,
“কেন দিয়েছিস উনাকে কাজ? মরুক না ও।”

“অভাব তো পদ্মের জন্য কিছুই না। পদ্মের অভাব তখন হবে যখন ভালোবাসার অভাবে তার হৃদয়ে খরা হবে। আমি যেভাবে দহন যন্ত্রণায় ছটফট করেছি, পদ্মকেও একই ভাবে ছটফট করতে হবে। তখনই আমি শান্তি পাবো। এবার সব ওর সামনে হবে। এবার ও আমার সংসার দেখবে।”

(***)

দুই দিন চট্টগ্রাম ঘুরে কক্সবাজার ফিরলো পুষ্প, আহি আর লিনাশা। নায়ীব লিনাশাকে দেখেই বলল,
“কেমন বউ তুমি, স্বামী-সন্তান ফেলে চলে গেছো।”

লিনাশা বলল,
“কেন? তোমার ছেলে তো তোমার সাথেই বেশি থাকে।”

লাবীব বলল,
“পিয়ালী তো ছোট। পুষ্প, তুমি তো আমার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিলে!”

পুষ্প বলল,
“এখন বুঝেছো, অফিস আর বাচ্চা একসাথে দেখা আমার জন্য কতোটা কষ্টকর? বাসায় এসে তো শুধু হাত-পা ছড়িয়ে টিভি দেখো। এসে তো রান্নাঘরে একটা প্লেট এগিয়ে দাও না।”

আহি বলল,
“হয়েছে হয়েছে। এতো অভিযোগ! আমি যদি সংসারী হয়, আমার বরকে শুধু রান্না করে খাওয়াবো।”

লিনাশা আর পুষ্প ভ্রূ কুঁচকে আহির দিকে তাকালো। আহি মুখ চেপে হাসলো। নায়ীব আর লাবীব বলল,
“শেখো কিছু আহির থেকে।”

লিনাশা বলল,
“খুব ফ্যান্টাসি লাগছে এখন! সংসার শুরু কর, তারপর বুঝবি।”

আহি নায়ীব আর লাবীবকে বলল,
“ফ্যান্টাসি তো আমার লাগবেই। রানীরা কি করে? রাজার আশেপাশে ঘুরঘুর করে। ঘরে হেঁটে সময় নষ্ট করে। কারণ তাদের কোনো কিছুর অভাব নেই। আল্লাহ আমাকেও কিছুর অভাব দেন নি। অভাব ছিল ভালোবাসার। জীবন যুদ্ধে নেমে পড়লে, একটা মেয়ে রানী হয়ে থাকতে পারে না। তাকে রানীর মতো রাখতে জানতে হয়। তারপরই একজন পুরুষ বিনা মুকুটে রাজা হতে পারে। আর রাজাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ মানায় না। ভাইয়ারা, অভিযোগ না করে, রানী করে রাখুন, দেখবেন রাজার হালে থাকবেন। একদিন না হয় সংসারটা একাই করলেন। অন্তত এটা তো বুঝলেন, আমার বান্ধবীদের ছাড়া আপনারা কতোটা ছন্নছাড়া।”

নায়ীব লিনাশার হাত ধরে বলল,
“লিনাশা তো আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ।”

লাবীব পুষ্পকে কাছে টেনে এনে বলল,
“সরি, বউ। বেশি বলে ফেলেছি। রাগ করো না। তুমি তো জানোই, তোমাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি।”

আহি দুই বান্ধবীর লাজুক হাসি দেখে মুচকি হাসলো। মনে মনে বলল,
“আমার তৃষাতুর কান তোমার মুখ থেকে ভালোবাসি শব্দটা শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে, আফিফ। কখন বলবে আমাকে ভালোবাসো?”

(***)

সালমা ফাওজিয়া মেয়ের হাত ধরে তাকে টেনে নিজের রুমে নিয়ে এলেন। ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন,
“হুট করে আমাদের এখানে ফেলে চট্টগ্রাম কেন গিয়েছিলে?”

“জরুরি কাজ ছিল।”

“তোমার সব জরুরি কাজ আমি মেনে নিয়েছি। তোমার সব আবদার আমি মেনে নিয়েছি। মা হয়ে কি আমার এতোটুকু অধিকার নেই? আমার একটা আবদার রাখা যাবে না?”

আহি মায়ের হাত ধরে বলল,
“কি বলছো তুমি? তুমি যা বলবে, আমি তা-ই শুনবো।”

“উজ্জ্বল ছেলেটা ভালো। তোমাকে অনেক সাহায্য করেছে। তাজওয়ার আর লাবণির বিরুদ্ধে কেইসটা ও নিয়েছিলো। তুমি রাজি হয়ে যাও, মা।”

“মা, আমি উজ্জ্বলকে বিয়ে করতে পারবো না।”

“তাহলে তোমার কি করতে ইচ্ছে করছে? বিয়ে না করে সারাজীবন এভাবেই থাকবে? ত্রিশ বছর চলছে তোমার। কয়েকমাস পর একত্রিশ হবে। এই বয়সে এসে তোমার জন্য আমি কোথায় যোগ্য পাত্র পাবো? একটাও তোমার মন মতো হয় না। আমি সারাজীবন বেঁচে থাকবো না। তোমার বাবা নেই। আমি ছাড়া তোমার কেউ নেই। তোমার মামাদের ভরসায় তোমাকে রেখে আমি শান্তিতে মরতে পারবো না। তুমি মা হলে, আমার চিন্তাটা বুঝতে।”

আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি বিয়ে করবো।”

সালমা ফাওজিয়া আনন্দিত কণ্ঠে বললেন,
“আমি তাহলে আমিনা আপার সাথে কথা বলি। বিয়ের কথা পাকাপাকি করে ফেলি?”

“না। আমি বিয়ে করবো বলেছি। উজ্জ্বলকে করবো বলি নি। তবে আমি উজ্জ্বলের সাথে কথা বলবো।”

“তুমি কি কাউকে পছন্দ করো?”

“হ্যাঁ।”

সালমা ফাওজিয়া মেয়ের থুতনি ধরে বললেন,
“আমাকে আগে বলবে না? কি করে ছেলেটা? দেখতে কেমন? পরিবার ভালো তো!”

“কি করে? দেখতে কেমন? পরিবার কেমন? এর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তোমার মেয়ের তাকে খুব পছন্দ। আমার পছন্দ কখনো খারাপ হয় না।”

“আলহামদুলিল্লাহ। বিয়েটা তাড়াতাড়ি হয়ে যাক। ছেলের মা-বাবা কেউ থাকলে নম্বরটা দাও। কথা বলি আমি। আর দেরী করো না। তোমার নানু বেঁচে থাকতেই বিয়েটা হয়ে যাক।”

আহি মুচকি হাসলো। মনে মনে ভাবলো,
“এতো সহজে বিয়ে হবে না। এতো বছরের কষ্টের শোধ তো আমি নেবোই, মিস্টার আফিফ রাফাত।”

(***)

এ আর টি গ্যালারির সামনে বাগানের বেঞ্চে উজ্জ্বল আর আহি পাশাপাশি বসে আছে। আহি উজ্জ্বলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“বিয়ে করছেন না কেন?”

উজ্জ্বল হালকা হেসে বলল,
“বয়স হলেই যে বিয়ে করতে হবে এমনটাও নয়। আমি মনমতো জীবনসঙ্গী পাচ্ছি না।”

“আপনার কেন মনে হলো, আমি আপনার মনের মতো মানুষ?”

“তোমাকে যতোটুকু জেনেছি, তাতেই মনে হলো।”

“আমি একজনকে ভালোবাসি।”

উজ্জ্বল আহির দিকে তাকালো। সেকেন্ড খানিক নিরব থেকে বলল,
“আগের সেই মানুষটা? না-কি নতুন কেউ?”

“যাকে ভালোবাসেছিলাম, তাকে ভালোবাসতেই আমার মন ভরে নি। মনে হচ্ছে আরো কিছু বাকি রয়ে গেছে। তাহলে দ্বিতীয় কাউকে কীভাবে সেখানে জায়গা দেই?”

“শুনেছি সে বিবাহিত।”

“এখন ডিভোর্স হয়ে গেছে।”

উজ্জ্বল হাসলো। বলল, “তাহলে তো ভালোই হলো।”

আহি উজ্জ্বলের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি তাকে যতোটা ভালোবাসি, অন্য কাউকে সেভাবে কখনোই ভালোবাসতে পারবো না। ভালোবাসার থাকলে আমার জন্য তার পরের স্থানটা রাদেরই হতো। যেখানে আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুটাই আমার ভালোবাসা পায় নি, আমি অন্য কাউকে কীভাবে সেই স্থান দেবো? অন্যায় হবে, আপনার সাথে, বা অন্য কোনো পুরুষের সাথে। আর আমাকে সেই মানুষটার চেয়ে বেশি কেউ ভালোবাসতে পারবে না। যদি বেসে থাকে, তাহলে সেও আমার প্রিয় বন্ধু রাদই ছিল। এবার বলুন, যাকে আমি ভালোবাসি, তাকে না পেলে আমি দ্বিতীয় কোনো মানুষের জীবনে যাওয়াটা তো অন্যায় হবে, তাই না? এটা রাদের সাথে অন্যায় হবে। রাদ খুশি হবে, আমি যদি আফিফের সাথে ভালো থাকি৷ কারণ আমি জানি, সে আফিফ ছাড়া আর কাউকে আমার সাথে সহ্য করতে পারবে না।”

উজ্জ্বল বলল, “আফিফ খুব ভাগ্যবান পুরুষ।”

আহি হাসলো। হঠাৎ তার চোখ আটকালো নন্দনকানন স্কুলের গেটের সামনে। আফিফ ওয়াসিফকে নিতে এসেছে স্কুল থেকে। আহি আফিফকে দেখিয়ে দিয়ে উজ্জ্বলকে বলল,
“মানুষটা মনে করে ও আমার অযোগ্য। ভালোবাসি বলতে ভয় পায়। আমার খুব কষ্ট হয়৷ আমি কতো বার বলেছি, আমি তাকে ভালোবাসি। কতো বার বুঝিয়েছি। সে একবার কি আমাকে ভালোবাসি বলতে পারে না? আমার কি শুনতে ইচ্ছে করে না?”

“জিজ্ঞেস করে দেখো।”

“বলবে না। ওর মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। ঠিক করতে হবে মাথাটা।”

“কীভাবে করবে?”

“জানি না। ছেলেরা ভালোবাসি কখন বলে?”

উজ্জ্বল কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“এমন মুহূর্তে যখন তাকে পাওয়ার কোনো সম্ভাবনায় নেই। ভালোবাসি বলে মনের চাপ কমিয়ে ফেলে। বা কোনো ইমোশনাল সিচুয়েশনে।”

আহি হালকা হেসে বলল,
“মানুষটা খুব চাপা স্বভাবের। ও এতো সহজে মুখ খুলবে না।”

“তাহলে?”

“একটা সাহায্য করলে, আমি আপনার একটা উপকার করতে পারি।”

“কেমন?”

আহি উজ্জ্বলকে তার পরিকল্পনাটা বললো। উজ্জ্বল সব শুনে হাসলো। সামনে তাকিয়ে দেখলো আফিফ এদিকেই তাকিয়ে আছে। উজ্জ্বল বলল,
“মিস্টার আফিফ তো এদিকেই তাকিয়ে আছেন।”

আহি আফিফের দিকে না তাকিয়ে বলল,
“তাহলে প্ল্যান এক্সিকিউট করি।”

“আমার কি উপকার করবে?”

“আপনার আর আমার বিয়েটা একসাথেই না হয় হবে।”

“কীভাবে?”

“আমার জুনিয়র, চয়নিকা। বেশ মিষ্টি মেয়ে। ওর বাসা থেকে ছেলে দেখছে। আমার ওর সাথে পরিচয় আঁকা-আঁকি থেকেই। ভালোই ছবি আঁকে। সংসারীও মনে হয়।”

“তোমার কি মনে হয়, ভালো হবে?”

“হ্যাঁ, আমার তো ভালোই মনে হয়।”

“তোমার পছন্দের উপর আস্থা আছে আমার।”

আহি হাসলো। উজ্জ্বলের দিকে হাত এগিয়ে দিলো। উজ্জ্বল আহির সাথে হাত মেলাতেই আহি বলল,
“আমি চয়নিকার মায়ের সাথে কথা বলবো। আপনার বায়োডাটাটাও পাঠিয়ে দেবেন।”

১২৫।

পরদিন চয়নিকার মায়ের সাথে কথা বললো আহি। উজ্জ্বলের বায়োডাটাও পাঠানো হলো। দুই পক্ষই এক সপ্তাহ সময় নিলো। আহি এই এক সপ্তাহ উজ্জ্বলের সাথে ভালোই সময় কাটালো। প্রতিদিন ওয়াসিফের স্কুল ছুটির আগ মুহূর্তে এ আর টি গ্যালারির বাগানে বসে আহি আর উজ্জ্বল গল্প জুড়িয়ে দেয়। আর প্রায়ই আফিফ তাদের দেখে ক্ষণিকের জন্য দাঁড়িয়ে যায়। আহির বেশ ভালোই লাগছে এসব। মনে মনে ভাবছে,
“দহন যন্ত্রণায় পুড়িয়েছো আমাকে৷ এবার বুঝো, তোমাকে আর পদ্মকে একসাথে দেখে আমার কতোটা কষ্ট হতো!”

এক সপ্তাহ পর চট্টগ্রামে গেলো উজ্জ্বল। পারিবারিক ভাবে চয়নিকার সাথে দেখা হলো তার। আহি আর পুষ্পও সাথে ছিলো। পনেরো মিনিটের আলাপে চয়নিকা আর উজ্জ্বল বেশ খুশি। কথাবার্তা শেষে বেরিয়ে আসার সময় উজ্জ্বল আহিকে বলল,
“চয়নিকাকে আমার ভালোই লেগেছে।”

আহি হেসে বলল,
“তাহলে বিয়ের কথাবার্তা আগানো যাবে।”

“ওদের রেসপন্সটাও তো জরুরি।”

দু’দিন পর উজ্জ্বলের পরিবার আনুষ্ঠানিকভাবে চয়নিকার পরিবারের সাথে দেখা করতে চাইলো। চয়নিকার পরিবারও রাজি হলো। তাদেরও উজ্জ্বলকে বেশ পছন্দ হয়েছে। এরপর কথাবার্তা পাকাপোক্ত হতেই আহি আবার কক্সবাজার ফিরলো।

আজ বোরহান আলী পদ্মকে নিয়ে কক্সবাজার এসেছেন। আজ থেকেই তিনি নাইট গার্ডের দায়িত্ব নিচ্ছেন। আহি তার বাংলো বাড়ির পাশেই একটা সেমি পাকা বাড়িতে তাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিলো। তিন রুমের বড় বাড়ি। পাশে আরো কয়েকটা সেমি পাকা বাড়ি আছে। আহি তার বাংলো বাড়ির দারোয়ানদের আর ব্যক্তিগত ড্রাইভারের রেস্ট হাউজ হিসেবে এই সেমি পাকা বাড়িগুলো বানিয়েছিলো। যদিও এখানে থাকার সম্পূর্ণ খরচ আহি নিজেই দেয়। চিকিৎসা খরচও আহি চালায়। কিন্তু পদ্মের ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্নতা রাখলো আহি। ভেতরের আসবাবপত্রও আহি নিজেই পছন্দ করে কিনে দিয়েছে। বোরহান আলীর বাচ্চাদের পড়াশুনার খরচ চালানোর দায়িত্বও নিয়েছে। সাথে একটা মোটর সাইকেল দিয়েছে বোরহান আলীকে। আপতত মোটর সাইকেল চালানোর জন্য একটা প্রশিক্ষকের ব্যবস্থা করেছে আহি। পদ্ম আহিকে এতোকিছু করতে দেখে বলল,
“কেন করছিস এসব আমার জন্য?”

“অন্তত কেউ নিমকহারামি যাতে করতে না আসে।”

“তুই ভাবছিস এসব করে তুই আমার কাছ থেকে আফিফকে কেঁড়ে নিবি?”

আহি হেসে বলল,
“প্রথমত তুই আমার কাছ থেকে আফিফকে কেঁড়ে নিয়েছিলি। আর এখন আফিফ তোর নেই। তাহলে কেঁড়ে নেওয়ার প্রশ্নই আসে না।”

“আমি উনাকে তালাক দিয়ে আফিফকে আবার বিয়ে করবো।”

আহি হাসলো। একটু জোরেই হাসলো। আহির হাসির শব্দ শুনে পদ্ম অবাক হলো। আহি পদ্মের হাত ধরে বলল,
“বোন, তোর তো আমার চেয়েও বাজে অবস্থা। নায়ীব ভাইয়ার শরণাপন্ন হতে হবে তোকে। বান্ধবীর বর কিন্তু, সাবধান। আমি তাই ছাড় পেয়েছিস, ওদিকে নজর দিলে লিনু তোর চোখ গেলে দেবে।”

“আহি, আফিফ আমার স্বামী ছিল।”

“তোর সেই স্বামী আমার ভালোবাসার মানুষ ছিল।”

“প্রেমিকার চেয়ে স্ত্রীর মর্যাদা অনেক বেশি।”

“এজন্যই তো তখন আমার হাতে কিছু ছিল না। কিন্তু এখন সময়টাও আমার, আফিফও আমার। আর তুই স্ত্রীর কথা বলছিস? মাথা টাথা কি খারাপ হয়ে গেছে না-কি? আফিফ আর তোর ডিভোর্স হয়ে গেছে। কোথাকার স্ত্রী তুই? যা, বোরহান আলীর সেবা কর। মানুষটা ওতোটাও খারাপ না। নয়তো পরে শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থা হবে।”

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here