গোলকধাঁধা ৭.

0
162

গোলকধাঁধা

৭.

আমি এমন একটা অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছি যেখান থেকে অতীত ও ভবিষ্যৎ সমদূরবর্তী। রোকাইয়া আমার পাশেই আছে যেমনটা তিষা আছে। তিষা একটু বেশিই মনে হয়। রোকাইয়ার ঠিকানা আমি এখন জানি। হোটেলের কর্মচারীরা ওকে বেশ ভালোভাবেই চিনেন৷ অতিরিক্ত চুপচাপ আর শান্ত স্বভাবের জন্য তাকে মনে রাখা সহজ। আরেকটা কারণ আছে, পাশেই একটা প্রাইভেট হাই স্কুলের এসিস্ট্যান্ট টিচার। টিচার হিসেবে নাকি বেশ সুনাম আছে তার৷ চুপচাপ দেখা গেলেও, পড়ানোর সময় নাকি স্বভাবই পরিবর্তন হয়ে যায়। আমার খোঁজ করার বিষয়ে তারা কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। হয়তোবা তাদের কাছে সন্তোষজনক উত্তর আছে৷ আমি যখন তার বাসার সামনে উপস্থিত হলাম। তখন মনে হলো ফিরে যাই। তার মুখোমুখি হওয়ার সাহস সঞ্চয় করতে পারছিলাম না৷ মনে হচ্ছিল তাকে দেখার পরে আমার জাগতিক জ্ঞান লোপ পাবে৷ আমি এতদিন যে সুস্থ স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা চালিয়েছি। সেটা ভেঙে যাবে বালির তৈরি কাঠামোর মতোন। আমি তার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দোটানায় পড়ে গেলাম। কী ভেবে টোকা দিতে যাবো সদর দরজায় তখন পেছন থেকে একজন বললেন, ” আপনি কে? এখানে কেন?”
আমি পেছন ফিরে দেখলাম বয়স্ক একজন লোক লাঠি ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন৷ খানিকটা বিরক্ত আবার অবাকও হয়েছেন। মনে হয় এই বাড়ির মধ্যে তেমন কেউ আসা যাওয়া করে না। রোকাইয়া এই বাসা কেন ভাড়া নিল? ওর তো ভয়ডর বেশি ছিল!
” রোকাইয়া এই বাসায় থাকে না?”
” থাকে। আপনি কে? ”
” আমি তার ইউনিভার্সিটি ফ্রেন্ড। ”
” ওহ, ও স্কুলে গেছে। আসবে বিকালে। ওইসময় আসবেন। ”

অফিস থেকে ছুটি নিয়েছিলাম। ছুটিটা কি বৃথা যাবে কিনা বুঝতে পারছি না। আছরের আজান দেয়ার সাথে সাথে শুরু করলাম দাঁড়িয়ে থাকা। একবার হোটেলের সামনে, একবার গলির মোড়ে, একবার মুদির দোকানের সামনে। এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকাটা সন্দেহজনক হবে বিধায় এই বুদ্ধি। কিন্তু মাগরিবের আজান দেয়ার পরেও রোকাইয়ার টিকিটাও চোখে পড়লো না। বাধ্য হয়ে তার বাসার গেলাম। দরজা সকালে তালা ঝোলানো ছিল। এখন সেই তালা ঝোলানো নেই। দরজার সামনে লেডিস স্যান্ডেল রাখা। দরজায় কয়েকবার টোকা দেয়ার পরে ভেতর থেকে নারী কণ্ঠ ভেসে আসল।
” কে? ”
আমি কী বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। কী বলা উচিৎ? পরিচয় দিলে যদি আর কথা না বলে? বা দরজাই না খোলে? তখন? এতদূর আসার মানে কী হলো?
কোনো প্রতি উত্তর না পেয়ে আবারও প্রশ্ন করলো, ” কে এসেছেন? চাচা? ” আমি কথা না বলে আমার টোকা দিলাম। তখন দরজা খুলে গেল। আমার সামনে ভেজা চুলের মলিন পোশাকে আবৃত এক নারীকে দেখতে পেলাম। যার সাথে আমার রোকাইয়ার চোখ, তাকানোর ভঙ্গিতে মিল রয়ে গেছে।
আমাকে দেখে চেনার উপায় আছে কি? আমি নিজেও তাকে চিনি নাই। আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো, ” আপনি কে? এখানে কেন?” আমাকে চিনতে পারেনি। আগের তুলনায় আমার স্বাস্থ্য বেড়েছে। আগের থেকে গায়ের রঙও উজ্জ্বল হয়েছে।
” রুকু ”
কাজ হয়েছে৷ আমার দিকে ভূত দেখার মতো করে তাকিয়ে আছে। মনে হলো সে ভুল শুনেছে এমন মুখভঙ্গি। এই নামে আমি হঠাৎ হঠাৎ ডাকতাম তাকে। যদিও তার বিশেষ পছন্দ ছিল না।
” আমাকে ভেতরে ঢুকতে তো দাও। সেই দুপুরের পরে থেকে বসার সুযোগ পাইনি। ”
রোকাইয়া মাথা নিচু করে ফেললো তারপর দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়িয়ে পড়লো।

****
সদর দরজা দিয়ে ঢুকতেই ওর বসার ঘর। সীমিত আসবাবপত্র দিয়ে সুন্দর করে সাজানো। আমাকে সোফায় বসিয়ে রেখে রান্নাঘরে গেছে। হয়তোবা চা বা কোল্ড ড্রিংকস বা কফি আনতে গিয়েছে। আমাদের মধ্যে এখন আগের মতো সহজ ভাবটা নেই। কেমন আটকে যাচ্ছে সবকিছু। আমি চাইলেও জিজ্ঞেস করতে পারছি না, “কেমন আছ?”
ট্রে-তে করে র’চা, বিস্কুট আর এক গ্লাস পানি নিয়ে ও ফিরে আসলো। আমার সামনের টি টেবিলে রেখে জিজ্ঞেস করলো, ” বাসায় দুধ নেই। তাই দুধ চা বানাতে পারিনি। র’চা হবে?”
আমি দ্রুত বললাম, ” হবে না কেন? হবে অবশ্যই হবে। ”
” তোমার তো র’চা পছন্দ না। তাই জিজ্ঞেস করলাম। ”
আমি চায়ের কাপ নিতে যাবো তখন ও বাঁধা দিয়ে বলল, ” আগে পানিটা খেয়ে নাও। তারপর চা। ”
” ওহ হ্যাঁ ”
” তুমি এতো নার্ভাস কেন হচ্ছ? এটা চাকরির ভাইবা না। ” রোকাইয়া হাসলো। বহুদিন পরে এই হাসি আমি দেখলাম। আমার হাত থেকে পানির গ্লাস পড়ে গেল। আমার সামনে থাকা মানুষটাকে কতদিন পরে দেখছি সেই হিসাব কষতে গিয়েই বোধহয় এমন হলো।

****
ভাঙা গ্লাস উঠাতে গিয়ে হাত কেটে গেল। রোকাইয়া তড়িঘড়ি করে স্যাভলন ক্রিম লাগিয়ে দিল। তারপর সুন্দর আর স্পষ্ট গলায় প্রশ্ন করল, ” কেন এসেছ?”
” তোমার সাথে আমার অনেক কিছু জানবার আছে। ”
” তারপর চলে যাবে। আর এ মুখো হবে না। ” রোকাইয়া থমথমে গলায় বলল। এতদিন পরেও মানুষটার আমার জন্য একটুও আবেগ কাজ করছে না? মায়া হচ্ছে না? আমি তো তাকে দেখেই আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছি। বারবার ইচ্ছা করছে, তার গাঢ় সান্নিধ্য লাভের।
” তুমি আমাকে ছেড়ে আসলে কেন?” সরাসরি প্রশ্ন করার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু রোকাইয়া আমাকে বাধ্য করলো।
” কারণ এছাড়া ভালো কোনো অপশন আমার কাছে ছিল না। ”
” আমাকে ছুড়ে ফেলে দেয়াটাই ভালো অপশন ছিল তোমার কাছে?”
” ছুড়ে ফেলে দেইনি। তোমার উল্টো ঝামেলা থেকে মুক্তি দিয়েছি। ”
” কোন ধরনের ঝামেলা, রুকু? ঠিক কোন ধরনের ঝামেলার জন্য তুমি আমাকে ছেড়ে এসেছ? আমার কাছে তোমার চলে যাওয়াটা সবচেয়ে বেশি কষ্টের ছিল। আমি ইউনিভার্সিটির প্রশাসন, মানুষের বা ক্লাসমেটের ঝামেলা গুলোকে আমি কেয়ার করি না। I didn’t care about those things. I only cared about us. I love you Ruku. I fuc*king love you. And you know i missed you. Do you know, how hurt i was when you left me alone? Do you know how i survived? ”
” তুহিন আমার কিছু নিজস্ব কারণ ছিল। আমি বাধ্য হয়েছিলাম সরে আসতে। তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি। ”
” কষ্ট দিতে চাইলে ছেড়ে আসছ কেন? কারণটা কি বলা যেত না?”
” না, তুহিন যেত না। ” আমার ভেতরের রাগ বাড়ছে। মনে হচ্ছে আমি চাইলেও রাগ আটকাতে পারবো না।
” আমি কি তোমার কাছে খেলনা ছিলাম? ”
” না ” রোকাইয়া আমার দিকে তাকাচ্ছে না। মেঝের দিকে তাকিয়ে উত্তর গুলো দিচ্ছে।
আমি তার কাছে বসলাম। দুই হাত তার ঘাড়ের ওপর রেখে জিজ্ঞেস করলাম, ” তাহলে কারণটা বলো। আজকে কারণ না বললে আমি এখান থেকে যাবো না। ” রোকাইয়া এবার মেঝে থেকে চোখ সরিয়ে আমার দিকে স্থির করে বলল, ” বলার হলেই আগেই বলতাম। এতদূর আসার প্রয়োজন হতো না।আমার জন্য তোমাকে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। তোমার উচিৎ আমার সাথে যোগাযোগ না রাখা। তুমি উল্টো কাজকর্ম করে বসে আছ। ”
” আমি অলরেডি তোমাকে বলেছি। আমি ওইসব নিয়ে মাথা ঘামাই না। আমি আমার জীবনে একটা জিনিস নিয়েই এখন মাথা ঘামাচ্ছি। আর সেটা হচ্ছে, তুমি কেন গেলে? আমি কী করেছিলাম? আমি কোন ভুলটা করেছি? কীসের শাস্তি আমাকে দিলে?”
” তোমার ভুল ছিল না। আমার ভুলের জন্য আর আমার কারণেই তোমাকে শাস্তি পেতে হয়েছে। আমি কারণটা বলতে পারবো না। তুমি আমাকে ঘৃণা করতে শুরু করবে।”
” তুমি, তোমার সম্পর্কিত সবকিছুকে আমি ভালোবাসি। তুমি মানেই আমার ভালোলাগা। এতদিন হয়ে গেছে আমি এখনো তোমার কাছেই আটকে আছি। আমার এখনো তোমার শরীরের গন্ধে ঘোর সৃষ্টি হয়। এখনো তোমার শরীরের সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করে। তারপরও কি তোমার অজুহাত শেষ হবে না?”
রোকাইয়া দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বলল, ” আমি যা বলবো তুমি নিতে পারবে না৷ তোমার মাথায় ঢুকবে না। তুমি এসবের সাথে পরিচিত না। ”
” রুকু, যাস্ট বলেই দেখো না। একবার? আমি প্রতিনিয়ত একটা কলঙ্ক বয়ে বেড়াচ্ছি। আমি নিজেকে দোষারোপ করে আসছি এই পাঁচটা বছর। তোমার কাছে কি এগুলো মজার মনে হচ্ছে?”
” না, তুহিন actually i was..was… ”
রেকাইয়া থেমে যাওয়াতে আমি বললাম, ” হ্যাঁ তুমি কি?”
” i was sexually harassed by Opu sir. He did twice or maybe thrice this shit. After those incidents i was traumatised. And then i met you at my university and fell in love with you. I never ever thought i could love someone. Or someone like you could love me. You are really special to me. You know i missed you, i missed your voice, your smiles, yours fake letters. I missed you but… ”

” but what Ruku? What is it? ”
রোকাইয়া আমার দিকে অনুভূতি শূন্য চোখে তাকাল।

চলবে…

~ Maria Kabir

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here