গোলকধাঁধা ৬.

0
87

গোলকধাঁধা

৬.

মাছ যে এতো ফ্রেশ হবে ভাবতেই পারছি না। এই মাছ ভেজে গরম গরম ভাত দিয়ে খেতে সেই হবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, মাছ কাটা, ধোয়া, রান্না করা তারপর খাওয়া। আজকে একটা বউ থাকলে এতো চিন্তাভাবনা করতে হতো না। তিষা এদিকে ভিডিও কলে আমাকে মাছ কাটতে দেখে হাসতে হাসতে খুন। আমি কপট রাগ দেখিয়ে বললাম, ” যাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ। একদিন রাত দশটায় এক কেজি গুড়া মাছ এনে তোমাকে চমকে দিব। তখন আমিও তোমাকে দেখে এভাবে হাসবো। ”
” শুনেন, মিস্টার হবু বর। আমি এতো গাধী নই। একজন ছুটা কাজের বুয়া অবশ্যই রাখবো। এমন যাদু করে রাখবো যে, তাকে রাত একটায় ফোন দিলেও চলে আসবে। ”
আড়াই কেজি মাছ কিনেছি অতি আবেগে পড়ে। এতো পছন্দ হলো যে, ভবিষ্যতের ভাবনা না ভেবেই কিনে ফেললাম। এই আধা ঘণ্টায় মাত্র ছয়টা মাছ কেটেছি।
” এই শহরে কাজের বুয়ার যে ডিমান্ড আর যে নিয়মকানুন। সেই নিয়মকানুন স্বয়ং আমাদের বসেরও নেই। ”
” তুমি আমাকে এখনো পুরোপুরি চিনোই নাই। বিয়ের পরে যত চিনতে পারবা তত বেশি অবাক হবা। ”
” আমি তো অবাক হতে চাই হে প্রিয়া। আমি তো তোমার প্রেমে পাগল হতে চাই। ”
আমার বলার ধরনে তিষা আবারও হাসতে শুরু করলো।
আমি মাছ কাটায় মন দিলাম। দুপুরে খেতে হবে দুটোর মাঝে। তারপর নাকে তেল দিয়ে আরামে ঘুমাতে হবে।

( তুহিন এখন যে বাসায় আছে সেটা মূল শহর থেকে বেশ দূরে। চুপচাপ, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এলাকা। তার বাসাটা মেইন রোড থেকে একটু ভেতরে। দুই তিন মিনিট হাঁটলেই সাদা রঙের একটা তিন তলা ভবনে সবার চোখ আটকে যাবে। সেই তিনতলার দোতলার একদম কর্ণারে একটা বড় ঘর, বারান্দা, কিচেন আর বাথরুমসজ ছোট্ট এপার্টমেন্টে তুহিন থাকে। মাঝেমধ্যে সে বারান্দায় কফির মগ নিয়ে পায়চারি করে। আর ভাবে কীভাবে খোঁজ পাওয়া যায়? কিন্তু সে জানেই না, তার পাশের গলিতে একটা আধাপাকা বাড়িতে রোকাইয়ার বসবাস৷ দেয়াল ইট, সিমেন্টের কিন্তু চাল টিনের। বৃষ্টি রোকাইয়ার খুব একটা পছন্দ না হলেও টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার শব্দ তার ভালো লাগে। ওইসময় তার ঘুম ভালো হয়। সে যে একা থাকে তা না৷ পাশেই একতলা বাড়িতে বাড়িওয়ালার বসবাস। তিনি অবশ্য তেমন একটা ঘাটান না রোকাইয়াকে। মাস গেলে বাসা ভাড়া তার হাতে আসলেই হলো। তুহিন যেখানে প্রেমিকার সাথে প্রেম আর রান্নাবান্না নিয়ে ব্যস্ত। রোকাইয়া সেখানে রান্নাবান্না ফেলে চুপচাপ বসে আছে তার বিছানায় গুটিসুটি মেরে। কিছু একটা খারাপ হবে! এই ভাবনা তাকে সকাল থেকেই তাড়াচ্ছে। তার আর এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না। অন্য কোথাও যেতে হবে। নতুন কোনো পরিবেশে। যেখানে পুরাতন গলিতে আঁকা কাল্পনিক চিত্রটি থাকবে না। নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে খাওয়াতে অতীতের কিছু ঘুণে ধরা স্মৃতি ভুলে যাওয়া। তার এখানে মন বসছে না।)

রান্না শেষ করে গোসল সেরে নিলাম। দুপুরে খেয়ে দেয়ে বিশাল ঘুমে পুরো দুপুর বিকাল পাড় করে সন্ধ্যায় ঘুম ভাঙলো। তখন অভ্যাসবশত তেলে ভাজা খাবার দাবাড়ের কথা মনে পড়লো। রাস্তার মোড়েই একটা ভালো হোটেল আছে। ওখানে মনে হলো সবই পাওয়া যায়। সারাদিন গুমোট গরম থাকলেও এখন অনেকটা গরম কমেছে। হোটেলে গিয়ে আলুর চপ, বেগুনি, পিয়াজু আর দুধ চা অর্ডার করে সামনের একটা টেবিলেই চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। হালকা বাতাসে বসে খাবো আর রাস্তা ঘাটে মানুষ জনের চলাফেরা দেখবো। এটাও একধরনের খেলা। নয় দশ বছরের ছেলে প্রথমে চা দিয়ে গেল। চায়ে চুমুক দিচ্ছি আর রাস্তায় মানুষ জনের যাওয়া আসা দেখছি। দেখলাম একটা মেয়ে একটা সিঙ্গারা, একটা আলুর চপ আর দুটো বেগুনি কিনছে। মেয়েটার জামা কাপড় যেমন মলিন তেমন মলিন তার মুখের ভঙ্গি। দেখে মনে হচ্ছে, খাওয়া দাওয়া ঠিকঠাক মতো হচ্ছে না। বারবার ওড়না ঠিক করছে আর ঘোমটা দিয়ে যতটা সম্ভব মুখ ঢাকার চেষ্টা করছে। গ্রাম্য ভাষায় এই মুখকে বলে, চোপড়া ভাঙা। অপ্রীতিকর কিছু ঘটছে এমন তার ভাবভঙ্গি। আমি তার খাবারের প্যাকেট নেয়ার ভঙ্গি, টাকা দেয়া আর কথা বলার ভঙ্গি দেখছিলাম আর চায়ে চুমুক দিচ্ছিলাম। এরই মাঝে আমারও ভাজাপোড়া এসে গেছে। আমি সেটায় মন দিলাম। মেয়েটার চলে যাওয়া দেখলাম। কী নীরবে, রাস্তার এক কোণা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে! মেয়েটার জন্য হঠাৎ আমার মধ্যে মায়া জন্ম নিল। না জানি মেয়েটা কতটা কষ্টে আছে৷ পকেটে মোবাইলের রিং বাজার শব্দে ধ্যান চলে এলো ফোনকলে। ফোন রিসিভ করলাম।
” ভাই, আপনি ড্রাইভারদের সাথে কথা বলছিলেন?”
” না, কেন?”
” তাদের খোঁজ আবারও পাওয়া যাইতেছে না। আপনি বরং উনার বাবার পেছনে লোক লাগান৷ উনার বাবা মেয়ের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন। ”
” দেখো, আমার ওই লোকদের সাথে কথা বলা প্রয়োজন । ”
” আপনি এর আগেও একবার কথা বলেছিলেন। তাদের এইখানে কোনো ক্লু পান নাই। তাই এগো পিছে না দৌড়াঝাপ কইরা আপনে মাইয়াডারে খুঁজে বের করেন। ”
” বলতে কী চাচ্ছ?”
” মেয়েটা বেশিদিন এক জায়গায় থাকে না। খালি জায়গা পালটায়। আপনি যে ঢিলেমি করতেছেন। তাতে মাইয়া আরেক জায়গায় ফুড়ুৎ হয়ে যাবেনে। ”
” এই কথা আগে জানাবা না?”
” আপনি তো মিয়া আছেন আপনার বিয়েশাদি নিয়া। আপনারে কইলে কি কাজ হয়?”
” কথাবার্তা ভালোভাবে বলো। ”
” ভাই, আমি ঠিকভাবেই বলতেছি। আমি অনেক খাটছি আপনার জন্যি। শুধু টাকার জন্যি না। আপনার জন্যিও। কিন্তু আপনি যেন কেমন! বলেন একটা করেন আরেকটা। এর আগেও একবার মেয়ের ঠিকানা খুঁজে দিছিলাম৷ আপনি সেই জায়গায় দেরি করে গেলেন৷ মেয়েরে হারায় ফেললেন। ”

*****

রাতে বিছানায় শুয়ে হোটেলের সেই মলিন চেহারার মেয়েটার কথা ভাবছিলাম আর মোবাইলে আমার আর রোকাইয়ার ছবি দেখছিলাম। ওর ছবি জুম করে দেখার সময় একটা জিনিস খেয়াল করলাম। রোকাইয়ার চোখ আর আজকের সেই মেয়েটার চোখের মধ্যে মিল আছে। দুজনের ক্লান্ত হয়ে তাকানোর ধরনও এক। আরো কয়েক মিনিট ছবির দিকে তাকিয়ে থাকার পরে বুঝতে পারলাম। আজকের সন্ধ্যার মেয়েটাই রোকাইয়া! আগের থেকে অনেক শুকিয়ে গেছে, চোপড়া ভাঙা, চোখ গর্তে চলে গেছে। তাই প্রথম দেখায় চিনতে পারিনি। হায় আল্লাহ! আমার এতো কাছে ছিল! আমি চিনতে পারলাম না। এই মেয়েকে আমি এখন কোথায় পাই?
রাত একটার কাছাকাছি বাজে। এইসময় হোটেলও বন্ধ করে ফেলেছে। হোটেলের কর্মচারীদের জিজ্ঞেস করলেও হয়তোবা খোঁজ পাওয়া যেত। তিষা এদিকে রাগ হয়ে আছে। তিষা ডাকতে গিয়ে ভুলে রোকাইয়া ডেকে ফেলেছি। রাগ ভাঙানো প্রয়োজন কিন্তু মন চাচ্ছে না। কিছুই করতে মন চাচ্ছে না। অস্থিরতা বাড়ছে। কখন ভোর হবে? কখন?

চলবে…

~ Maria Kabir

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here