গোলকধাঁধা ৮.

0
177

গোলকধাঁধা

৮.

রোকাইয়ার হাত শক্ত করে ধরলাম। জানিনা কেন! আমি যে তিষার সাথে একটা সম্পর্কে আছি, সেটা মাথায় থাকা সত্ত্বেও আমি… live for the moment হয়ে গেল বিষয়টা৷ তিষার কানে গেলে বেশ ঝামেলার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। কী হবে সেটা ভেবে এখনকার সময় নষ্ট করার কারণ দেখি না।
” উনি কোনো একভাবে জানতে পেরেছিলেন, তোমার আর আমার সম্পর্কের কথা। আমাকে ব্ল্যাকমেইল করতে শুরু করলেন৷ খুব বিশ্রী রকমের ভাষা ব্যবহার করে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করতেন। তারপর একদিন বাসে করে ক্যাম্পাসে আসার পথে। আরেকটা ঘটনা ঘটে৷ বাসের এক যাত্রী আমার… তারপর তারপর আমার মাথা খারাপ হয়ে গেল। হ্যালুসিনেশন হলো। মনে হলো বাসের ড্রাইভার, হেল্পার সবাই অপু স্যার হয়ে গেছেন। স্যারের মূল উদ্দেশ্য ছিল, উনার চাহিদা পূরণ করা। কিন্তু আমাকে বাগে পাচ্ছিলেন না৷ কোনোভাবেই পারছিলেন। আমি সবসময় যেকোনো উপায়ে উনার সঙ্গ এড়িয়ে চলতাম। ওইদিন মনে হলো, উনি আমাকে সত্যিই গ্রাস করবেন৷ এই ভয়ে দৌঁড়াতে শুরু করলাম। ক্যাম্পাসে পৌঁছানোর পরেও ভয় যাচ্ছিল না। বারবার মনে হচ্ছিল, এই বুঝি উনি চলে আসবেন। তারপর সবার সামনে উনি…” এই পর্যায়ে এসে রোকাইয়া নিঃশব্দে কাঁদতে শুরু করলো। চোখ দিয়ে শ্রাবণের জলধারার মতো লবণাক্ত জলের স্রোত তার চিবুক বেয়ে নামতে শুরু করলো। আমি তার হাত দুখানা ছেড়ে ভেজা সিক্ত চিবুক মুছে দেয়ার জন্য হাত বাড়ালাম। রোকাইয়া আমার হাত ধরে ফেলল। তারপর নিজেকে সংবরণ করে বলল, ” আমি তোমার যত্ন পাওয়ার যোগ্য নই। তোমাকে আমি অনেক কষ্ট দিয়েছি। নিজের ভুলের মাশুল তুমি গুণেছ। এই হাত দুটো আমার মতো অভিশপ্ত মেয়ের জন্য না৷ আমি অভিশপ্ত তুহিন। আমি তোমাকে কী কী বলেছিলাম তার কিছুই মনে নেই। মনে করতে চেষ্টা করলে ভয়ংকর মাথাব্যথা শুরু হয়ে যায়। আমার শুধু মনে পড়ে, তুমি আমাকে শান্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলে। তখন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে। আমি তোমার মাঝে অপু স্যারকে দেখলাম। আমার শুধু মনে পড়ে, তোমার স্থানে অপু স্যার। তুহিন, আমি জানি না কী কী বলেছি তোমাকে। তবে বিশ্বাস করো, ওসব তোমাকে উদ্দেশ্য করে নয়। ওসব অপু স্যারকে উদ্দেশ্য করে। তুমি তো কখনো আমার হাতই ধরার সুযোগ পাওনি। আজকেই প্রথম তুমি আমাকে স্পর্শ করলে। আমি কীভাবে আমার পরিবারকে বুঝাবো? কীভাবে বুঝাবো, এখানে তোমার কোনো ভুল, দোষ নেই। সব ওই স্যার আর আমার দোষ। i’m sorry Tuhin. Extremely sorry, i know i did too much damages. I know I don’t deserve your forgiveness. But we had a great relation between us in past. And i also loved you. Maybe i do love you now. For the sake of love would you forgive me, please ? ”
রোকাইয়ার চোখ আবার ভিজে উঠেছে। চোখের নোনাপানি হয়তোবা কয়েক মুহুর্তের মধ্যে নেমে আসবে তার চিবুক বেয়ে। আমি কীভাবে ওকে ক্ষমা করবো যেখানে আমি নিজেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারিনি। আমার মনে হচ্ছিল গত পাঁচ বছর যাবত। ওর সাথে এমন কিছু ঘটেছে যার প্রভাব ওর ব্যক্তিত্বে, আচরণে, স্বভাবে ফুটে উঠেছিল। কিন্তু আমি ধরতে পারিনি৷
” আমার সরি বলা উচিৎ। আমার ক্ষমা চাওয়া উচিৎ। তোমার এখানে কোনো ভুল ছিল না। আমি শুধুই তোমাকে ভালোবেসেছি কিন্তু তোমার ভেতরের কষ্ট, ক্ষত গুলো আমি ধরতে পারিনি। ভালোবাসার অর্থ এটা না। ভালোবাসার অর্থ একে অপরের কষ্টগুলো, সমস্যা গুলো ভাগ করে নেয়া। আমি এমনই প্রেমিক ছিলাম যে, তোমার এতো বড় একটা অংশ থেকে দূরে সরে ছিলাম। আমি সেখানে পৌঁছাতেই পারিনি। এটা আমার ব্যর্থতা, রুকু। তুমি কি আমায় ক্ষমা করবে? আমি যদি তোমাকে পুরোপুরি বুঝতে পারতাম, তাহলে কি আমরা আজকে এখানে থাকতাম? আমরা হয়তোবা এই সময় আমাদের বাচ্চাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম৷ হয়তোবা আমরা কোথাও ঘুরতে যেতাম। আমরা একসাথে তো অন্ততপক্ষে বাঁচতে পারতাম। ” রোকাইয়া আমার কথাগুলো শুনছিল আর স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে। আমি কখনো ভাবিনি, একদিন এমন অবস্থায় আসতে হবে আমাদের। যেখানে চাইলেও কাছে আসা যায়না। চাইলেও গভীর আলিঙ্গনে তাকে ধরে রাখা যায়না৷ আমি চিবুক স্পর্শ করলাম। এমন সুন্দর, স্বস্তিদায়ক অনুভূতি আমি তৃষাকে স্পর্শ করেও পাইনি। রোকাইয়া আমার কমফোর্ট জোন। আমি ভেবেছিলাম রোকাইয়ার প্রতি সব অনুভূতি হয়তো আর আগের মতো নেই। কিন্তু তার সংস্পর্শে এসে সেই চিন্তা আর সত্যি হতে পারলো না৷ আমার মরুভূমির ন্যায় অনুভূতি গুলো কয়েক ফোটা বৃষ্টির শীতল, নির্জলা পানির স্পর্শে সতেজ হয়ে উঠলো। আমি তাকে আমার কাছে টানলাম। সে তখনও নীরবে অশ্রুবিসর্জন দিয়ে যাচ্ছে। আমার এই গাঢ় সান্নিধ্যে তার সব কষ্ট, বিষন্নতা, একাকীত্ব, দীর্ঘশ্বাস দূর হয়ে যাক।

*****
রোকাইয়ার বাসা থেকে প্রায় রাত দশটার পরে বের হলাম। রাতে না খেয়ে বের হতেই দিল না। আমার মনে একটা খটকা লেগেছে। খটকার বিষয়টা পরে বলি। আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ” বাসায় কেন বিষয়টা জানাও নাই?”
সে উত্তরে যা বলল তার সারমর্ম হচ্ছে – সে জানিয়েছিল তার মা বাবাকে। ওই ক্যাম্পাসের ঘটনার পরে। কিন্তু তার আগেই অপু স্যার নাকি আমাদের ছবি বাসায় দেখিয়ে, আমাদের প্রেমকথন নিজ দায়িত্বে বলে এসেছিলেন। অপু স্যারের নামে যখন ও অভিযোগ তুলে। তখন, সবাই ভেবেছিল যে, রিলেশনের কথা জানায় দেয়ার জন্যই এই অভিযোগ সে নাকি তুলেছে৷ বাসায় অনেক চাপ সৃষ্টি হতে থাকে আর তখন তার মাথাও ঠিক ছিল না। মানুষ ভেবেছিল, প্রতিশোধ নেয়ার জন্য আর নাহয় রেপড টেপড হইছিল। সেটা লুকানোর জন্য নাকি নাটক করতেছে। অপু স্যার যে ধুরন্ধর ব্যক্তি সেটা বোঝাই যাচ্ছে। তবে আমি যখন স্যারকে শিক্ষা দেয়ার কথা বলছিলাম তখন ওর মুখের ভঙ্গি অন্যকিছু বলছিল। আমাকে সে একপ্রকার বাধ্য করলো বিষয়টা নিয়ে মাথা না ঘামাইতে৷ তার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে ক্লাসমেট বা ক্যাম্পাসের চেনাজানা কারো সাথে শেয়ার করতে না করলো। মেয়ের সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট এর কথা শুনেও মা বাবা চুপ করে কীভাবে ছিলেন, বুঝতে পারছি না। এখানে কোনো কিছু মিসিং… যেটা রোকাইয়া বলে নাই। অনেক কিছুই লুকিয়েছে৷ ওর স্বভাব লুকিয়ে রাখা। ভাবতে ভাবতেই ঘুমানোর জন্য চোখ বুজলাম। তখন তিষার নাম্বার থেকে কল আসলো।

( রোকাইয়া )

কিচেনের সিংকে রাখা থালাবাসন মাজার সময় চকচকে ধারালো ছুড়িটা হাতে তুলে নিলাম। এই ছুড়ি দিয়ে খুব সহজে আর দ্রুততার সাথে যেকোনো সবজি, মাছ, মাংস কাটা যায়। যেমনটা অপু স্যারের হাতের তিনটা আঙুল কেটে ছিলাম। যদিও কাজটা করতে গিয়ে উন্মত্তের মতো আচরণ ফুটে উঠেছিল তখন৷ আমার নিজেকেই মানুষ মনে হচ্ছিল না। আঙুল গুলো খুব সুন্দর করে মেঝেতে পড়ে ছিল!

চলবে…

~ Maria Kabir

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here