#চুপিসারে (৪)
কলমে #রেহানা_পুতুল
সময় গড়ায়। নদীর বয়স যখন আট। তখন তার বাবা মোহনের দ্বিতীয় বিয়ে ঠিক হয় তার দাদীর ইচ্ছেই। কিন্তু বিয়ের মাত্র এক সপ্তাহ পূর্বেই নদীর বাবা মোহন দেওয়ানের অকাল প্রয়াণ ঘটে সড়ক দূর্ঘটনায়। কাকতালীয় সত্য হলো মোহন ছাড়া দ্বিতীয় কোন ব্যক্তি মারাতো যায়নি। এমনকি সামান্য আহতও হয়নি। জানা গেলো মোহন সময় স্বল্পতার জন্য লোকাল বাসের হাতল ধরে দরজায় কোনমতে ঝুলে দাঁড়িয়েছিলো গন্তব্যে যাওয়ার জন্য। তার খানিক পরেই সেই বাসের খুব পাশ ঘেঁষে আরেকটি লোকাল বাস তাকে চাপা দিয়ে যায়। সে ছিটকে রাস্তায় পড়ে যায়। স্থানীয় লোকজন তাকে হাসপাতালে নিলে ঘন্টা দুয়েক পরে সে মারা যায়। কেননা বুকের সব হাড় ভেঙে ভিতরে রক্ত জমাট বেঁধে গিয়েছিলো।
দুঃসংবাদটি পেয়ে নদীকে তার ছোট মামা ও দুই খালা নিয়ে আসে পিতাকে শেষ দেখার জন্য। কিন্তু রুবিনা আসেনি। তার আসাকে গ্রামীণ সমাজ ইতিবাচকভাবে দেখবে না কিছুতেই। তবে রুবিনার হৃদয়টা থেমে থেমে পুড়ছিলো হুটহাট। কারণেই না অকারণেই পুড়ছে, সে বুঝে উঠছে না।
জীবনটাকে তারকাছে ভীষণ আশ্চর্যজনক লাগছে৷ কখন যে কি ঘটবে,হিসেবের ছকটা যে কখন বদলে যাবে নিয়তির নিষ্ঠুরতায়। তা আগে কোন মহামানব ও বলতে পারবে না। নানান হায়হুতাশে,বিক্ষিপ্ত ভাবনায়,বহু জল্পনা কল্পনায় রুবিনার জীবন থেকে এক সপ্তাহ চলে গেলো। আগে প্রতি মাসে মাসে নদীর খরচ কিছুটা বহন করতো মোহন। সেটা এখন চিরতরেই বন্ধ হয়ে গেলো। রুবিনা একমাত্র মেয়ের জন্য আয়ের পথ বাড়ানোর চিন্তা করতে লাগলো।
মোহনের মৃত্যুর কিছুদিন অতিবাহিত হলে রুবিনা তার বড় ভাসুরকে ফোন দিলো। বলল,
ভাইজান, আপনার ভাই থাকতেই আমার সাথে তার সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, নদীকে নিয়ে যাবে তার কাছে। স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিবে। আপনাদের সেদিকের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের এদিকটার চেয়ে বেশি ভালো। আমি তো বাড়িতে হুজুর রেখে আরবিও প্রায় শেষ করে দিলাম নদীর। এদিকে আমার বড় ভাই আমার বিয়ে ঠিক করেছে এক বিপত্নীক লোকের সঙ্গে। উনার সেই ঘরে দুটো সন্তান। তাই ভাইয়া বলছিলো নদীকে আপনাদের বাড়িতে দিয়ে দেওয়ার জন্য। খরচ আমরাই বেশি বহন করবো।
রুবিনার ভাসুর রফিক দেওয়ান একটু থেমে ফোনের এপ্রান্ত হতে ধীর গলায় বললেন,
শোন রুবিনা,ব্যক্তিগতভাবে তোমার সাথে আমাদের কারোই কোন মনোমালিন্য হয়নি। বরং সুসম্পর্কই ছিলো তুমি দেওয়ান পরিবারের ছোটবউ হিসেবে। ভালো হোক মন্দ হোক যা কিছু হয়েছে তোমার,তা আম্মা ও মোহনের সাথে হয়েছে। আম্মা বরাবরই বদরাগী। একরোখা মানুষ। তবে মোহনের আকস্মিক বিদায় আম্মার গোটা পৃথিবীকে অন্ধকার করে দিয়েছে। কিন্তু আম্মা এটা কিছুতেই চায়না নদী এখন আমাদের বাড়ি থেকে পড়াশোনা করুক।
আমিও আম্মার সাথে তাল মিলিয়ে তোমাকে বলতে চাই,
নদী বর্তমান প্রেক্ষাপটে তোমার কাছে থাকলে যতটুকু ভালো থাকবে,আমাদের বাড়িতে থাকলে তারচেয়ে খারাপ থাকবে। এটা তুমি বিশ্বাস করতে পারো। কারণ তুমি জানো আমাদের বলতে গেলে জয়েন্ট পরিবার। শফিকের বউ কেমন তা আমার চেয়ে তুমিই ভালো জানো। সেতো উঠতে বসতে এটা বলবেই খোঁচা মেরে, কাবিনের সব টাকা তাকে দেওয়া হয়েছে। তার অতিরিক্তও দেওয়া হয়েছে। তাহলে নদী কেন এখানে থাকবে,খাবে?
তবে নদী বরাবরের মতই রমজান ঈদ,কোরবান ঈদ,গ্রীষ্মের ছুটি ও ফাইনাল পরিক্ষার পর শীতের সময় বেড়াতে আসবে বাড়িতে। তার ব্যত্যয় ঘটলে নদীর কচিমনে এসবকিছু বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
ধরো মোহন বেঁচে থাকলে নদীর উপর কোন টর্চার হওয়ার সুযোগ ছিল না। এখন কিন্তু সেই পথ চিরতরে রুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। নদীর পড়াশোনার যাতে কোন ব্যাঘাত না ঘটে, সেদিকে তুমি সজাগ থাকবে। এবং কখনো প্রয়োজন হলে আমাকে জানাবে। আমি হেল্প করবো নদীর জন্য। সে আমাদের পরিবারের কন্যা।
আচ্ছা ভাইজান বলে রুবিনা ফোন রেখে দিলো। দীর্ঘসময় যাবৎ ভাসুরের বলা কথাগুলোর রেশ ধরে গভীরভাবে ভাবতে লাগলো। এবং মা বোনদের সাথে শেয়ার করলো। তারাও শুনে তার ভাসুরের কথায় সহমত প্রকাশ করলো।
তারপর নদী মায়ের সাথে আগের মতো নানার বাড়িতেই রইলো। মেয়ের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে সেই ঠিক হওয়া বিয়ে ভেঙ্গে দিলো। শক্ত হাতে নদীকে লালন পালন করতে হলো। রুবিনার স্বল্প আয়ের টাকা,ও ব্যাংকে রাখা কাবিনের টাকার লভ্যাংশ দিয়ে কোনমতে মা মেয়ের যাবতীয় খরচ মেটে। কোনমতে এইজন্যই, ভাইদের মধ্যবিত্ত পরিবারে তার কিছুটা হলেও অর্থের যোগান দিতে হয়।
তবুও রুবিনার পথচলা ও তার মেয়ে নদীর বেড়ে উঠার পথ মসৃণ ছিলো না। ছিলো বেদনার। কাতরতার। সুতরাং মা মেয়ের দুঃখের অন্ত নেই।
বাড়িতে মামিদের অনাদর,লাঞ্চনা, উপেক্ষা ছিলো মা মেয়ের নিত্যসঙ্গী। শিশুকালে নদীর সমবয়েসী মামাতো ভাইবোনদের সাথে খেলনা, বিভিন্ন খাবারের ভাগ বাটোয়ারা, নলকূপে গোসল নিয়ে মারামারি লেগেই থাকতো। স্কুলেও প্রায় হতো অবহেলার শিকার। সবার বাবা যায় পেরেন্টস ডে তে এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। কতকিছু কিনে দেয় ক্লাসের অন্য বন্ধুদের বাবারা।
কিন্তু তার যে বাবাই বেঁচে নেই। থাকলে হয়তো যেতো। সবার স্কুল ড্রেসের চেয়ে তার স্কুল ড্রেস ছিলো কমমূল্যের। কয়মাস পেরোতেই গুটি গুটি উঠে যেতো। তা নিয়ে ক্লাসের কিছু ধনীর দুলালিরা উপহাস করতো নদীর দিকে চেয়ে। নদী সংকোচে, দ্বিধায় গুটিয়ে যেতো। মিইয়ে যেতো লজ্জাবতী পাতার ন্যায়।
সময়ের নিয়মে নদী তরতরিয়ে বেড়ে উঠে কচি লাউয়ের ডগার ন্যায়। পা দেয় লাগামহীন কৈশোরের দুরন্তপনায়। রুবিনার দুঃশ্চিন্তা ঘনীভূত হয় মেয়েকে নিয়ে। মাথায় ভর করে উপযুক্ত হলে মেয়ের বিয়ের বিষয়টি। হায়! তার নদী বুঝি বা তাকে ছেড়ে চলে যাবে পরের ঘরে। রুবিনার চোখ ভিজে উঠে।
মাঝে মাঝে মেয়েকে নিয়ে রুবিনা জোছনারাতে বের হয় আঙিনায়। বাড়ির সব ঘরগুলোর কপাট বন্ধ। সবাই ঘুমিয়ে থাকে বিভোর হয়ে। হয়তোবা কেউ কেউ সুখ স্বপ্নে নিমগ্ন। রুবিনার চোখজুড়ে ঘুম নেই। কত যে বিনিদ্ররজনী পার হলো এমনই চুপিসারে। কে রাখে তার খবর। নিরালা রাতে মা মেয়ে আকাশপানে চায়। চাঁদকে পাহারা দিচ্ছে ঝিকিমিকি শত তারার দল।
নদী মাকে বলে,
আম্মা, দেখো কি অভূতপূর্ব দৃশ্য! কেন যে মানুষ হলাম? এরচেয়ে তারা হতাম, মনের আনন্দে জ্বলতাম। চাঁদ হতাম, সারা পৃথিবীকে কোমল আলোয় ভরিয়ে দিতাম। মেঘ হতাম, বিশাল আকাশের বিশালতায় ভেসে ভেসে যেতাম কোন সূদুরে। পাখি হতাম, দু’ডানা মেলে উড়ে উড়ে চলে যেতাম অচিনপুরে। ফুল হতাম, সুবাস ছড়িয়ে দিতাম সবার মাঝে। ঠিক বলছি না আম্মা?
মেয়ের কথা শুনে রুবিনার বুক ভরা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। কলিজা ছেঁড়া হাহাকার তাকে তছনছ করে দিতে লাগলো। না পাওয়ার যন্ত্রণা আর হারানোর শূন্যতা হৃৎপিণ্ডটাকে এফোঁড়ওফোঁড় করে দিলো।
রুবিনা নিরব থেকে ভাবলো,
নদী পড়াশোনা করছে বলে কত কথা বলতে শিখেছে। কি চমৎকার উপমা দিয়ে কথা বলে। কি পরিপাটি গোছানো কথামালা আমার মেয়েটার। আমি নদীকে অনেক পড়াশোনা করাবো। স্বাবলম্বী হতে হবে তাকে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। ভালো স্কুলে দিয়ে দিবো এবার। আমার যত কষ্টই হোক। ওদের গ্রামের স্কুলে এবার নাইনে ভর্তি করিয়ে দিবো। কিছুই করার নেই। জীবনে কেষ্ট পেতে হলে কষ্ট করতেই হবে।
অদৃশ্য অচেনা কোন প্রাণীর আওয়াজে রুবিনা নড়ে উড়ে। কল্পনার জাল ছিঁড়ে মুক্ত হয়। নদীকে নিয়ে চলে যায় ঘরে। বিছানায় গা এলিয়ে দেয় মা মেয়ে আলস্যভঙ্গিতে।
জানুয়ারি মাসে স্কুল চেঞ্জ করে নদীকে ক্লাস নাইনে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি করিয়ে দেয় রুবিনা। নদীদের গ্রামেই এই স্কুল। কিন্তু তাদের বাড়িতে তাকে কেউ ভালো রাখবে না। তাই নদী নানার বাড়ি থেকেই আসা যাওয়া করে নিজের গ্রামের স্কুলে। কিছুপথ পায়ে হেঁটে, কিছুপথ রিকসায়,কিছুপথ বাসে করে এভাবে নানান ঝক্কিঝামেলা করে সে স্কুলে রোজ আসাযাওয়া করে। তার বড় ফুফু রাফিয়ার স্বশুর বাড়িও স্কুলের কাছে। মাঝে মাঝে তার দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা ফুফাতো ভাই রজত তাকে বাড়ি নিয়ে যায়। ভাত খাইয়ে দেয়। কিন্তু ফুফু কেমন যেনো উসখুস করে নদী গেলে। তা অনুধাবন করতে পেরে নদী আর যায়না রজত বললেও। বাহানা দেয় অন্যকিছুর। এভাবে দুবছর শেষ হয়ে যায়। নদীর এসএসসি পরিক্ষা সন্নিকটে চলে আসে। এতদূর থেকে এসে একাধিক স্যারের কাছে কোচিং করে নদী কূলিয়ে উঠছে না। কোনদিন আসতে লেট হয়ে যায়। কোনদিন গিয়ে কাহিল হয়ে যায়। কোনদিন আসতেও পারে না। পা ব্যথা করে তাই। রুবিনা দিশেহারা হয়ে পড়লো। এভাবেতো নদীর রেজাল্ট খুব খারাপ হবে। ভাগিনা রজতের সাথে আলাপ করলো বিষয়টা।
রজত বলল,
যাইহোক না কেন ছোট মামী। সেখানে তাকে মেনে নিতেই হবে। তবুও নদীকে তাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেন। সাত আট মিনিটের দূরত্ব মাত্র স্কুল আর নানাদের বাড়ি। পড়াশোনা করা ও কোচিং ধরতে সমস্যা হবে না আর।
তারপর মা রুবিনার একান্ত ইচ্ছায় নদী একদিন বিকেলে তার সবকিছু নিয়ে চলে যায় নিজের বাড়ি। তাকে দেখামাত্রই মাথায় হাত পড়ে তার চাচী নাহার বেগমের। তার চারদিন পরেই এক শান্ত ভোরে নদী এক অশান্ত কাণ্ড বাঁধিয়ে ফেলল।
চলবে…
#চুপিসারে
সকল পর্বের লিংক
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=122113601558106938&id=61553208165829&mibextid=2JQ9oc