#মেঘের_শহর
#পর্ব_১৫
Saji Afroz
.
দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে দরজা খুললো জিকো। মোখলেস কে দেখে ওড়না ঠিক করতে করতে বলল-
আপনি এই সময়ে?
-ঘুমোচ্ছিলে বুঝি?
-হ্যাঁ। ক্লান্ত লাগছিল। আসুন না ভেতরে।
.
জিকোর সাথে ভেতরে এসে বসলো মোখলেস। পানি খেতে চাইলো সে। জিকো রান্নাঘর থেকে এক গ্লাস পানি এনে তার দিকে এগিয়ে দিলো। পানি খাওয়া শেষ করে পাশের টেবিল টার উপরে গ্লাস রাখতে রাখতে মোখলেস বলল-
এমন মেসেজ দিলে কেনো?
.
জিকো মুখটা ফ্যাকাসে করে বলল-
এই কাজ আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
-কেনো?
.
ক্লাস করানোর সময় যা যা হয়েছিল সবটা মোখলেস কে খুলে বললো জিকো। সে ভেবেছিল সব শুনে মোখলেস তার প্রতি সহানুভূতি দেখাবে। কিন্তু সে উল্টো হাসতে হাসতে বিছানায় শুয়ে পড়ল। জিকো বিরক্তিভরা কণ্ঠে বলল-
আপনি হাসছেন?
.
মোখলেস হাসি থামিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো। কিন্তু হাসি যেন কিছুতেই থামতে চাইছে না! অনেক কষ্টে সে স্বাভাবিক হয়ে বলল-
আসলে বাচ্চারা তো ফাঁকিবাজ হয় তাই তোমার সাথে এমন করেছে। তবে আমারো ভুল আছে। উচিত ছিল তোমার সাথে যাওয়া। ওদের বুঝালে নিশ্চয় তোমাকে এত প্যারা দিত না। কাল আমি ভালোভাবে বলে দিব, যেন তোমাকে জ্বালাতন না করে।
.
জিকো এক প্রকার চিৎকার করেই বলল-
না না! আমি আর যেতে চাই না ওখানে।
-নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাও না?
.
মুখটা মলীন করে জিকো বলল-
চাই।
-তবে এখন এছাড়া উপায় নেই আর। তুমি ছেলে হলে সমস্যা ছিল না। এখন তোমাকে আমি যেই সেই কাজ করতে বলতে পারি না!
.
জিকো নীরব থাকলে তাকে ভরসা দিয়ে মোখলেস বলল-
কাল থেকে এমন আর হবে না।
.
জিকো হেসে সম্মতি জানালো।
মোখলেস চলে যেতে চাইলে কিছু একটা ভেবে থেমে গেল। পেছনে ফিরে বলল-
জিকো আমার ফোন রিসিভ করে না। ওর অন্য কোনো নাম্বার কি তোমার কাছে আছে?
.
মুখের উপরে মিথ্যে যেন বলতে পারছে না জিকো। এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল-
না নেই।
-তোমার সাথে কথা হয়?
-হ্যাঁ।
-কখন আসবে সে?
-কয়েকদিন পরে।
-ও আচ্ছা। আসি তবে এখন।
.
মোখলেস চলে যেতেই জিকো যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। জানে না আর কত মিথ্যে তাকে বলতে হবে।
আগে অনায়াসে মিথ্যে বলতে একটুও খারাপ লাগতো না তার। কিন্তু ইদানীং তার মাঝে বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সে কি নিজেকে বদলাতে চাচ্ছে? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলো জিকো।
.
.
.
মেঘের মুখে হুরায়রার কথা শুনে কি বলবে বুঝে উঠতে পারছেন না অন্তরা আহম্মেদ।
মেঘ মা কে সবটা খুলে বলে আকাশের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
অন্তরা আহম্মেদ কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললেন-
আমি ভেবেছিলাম সাইয়ারা কে তুই পছন্দ করিস৷ তাই আমিও ওকে পছন্দ করতে শুরু করেছিলাম।
-কিন্তু এটা সত্য নয় মা। আমি হুরায়রা নামক মেয়েটার প্রতি দূর্বল হয়ে পড়ছি। ওকেই চাই আমার। ও রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে জেনে তোমার হয়তো খারাপ লাগছে। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমার একটুও লাগছে না। কারণ আমি ভালোবাসি ওকে। ওর…
.
মেঘ কে থামিয়ে অন্তরা আহম্মেদ বললেন-
নিজের মা কে এই চিনলি তুই! তোর ভালো লাগার কোনো গুরুত্ব কি আমার কাছে নেই? হুরায়রা কে নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই।
.
মায়ের কাছে এমন একটা কথা শুনবে ভাবতেই পারেনি মেঘ। খুশিতে তার চোখটা ছলছল করে উঠেছে। সে মা কে জড়িয়ে ধরে বলল-
তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মা।
-হয়েছে হয়েছে। এবার আমাকে ছাড়। মেয়েটার যে বিয়ে ঠিক হয়ে যাচ্ছে সেই খেয়াল আছে?
.
মা কে ছেড়ে চিন্তিত স্বরে মেঘ বলল-
এখন কি করব?
-সোজা ও বাড়ি নিয়ে যাবি আমাকে।
-চলো তবে।
.
অট্টহাসি দিয়ে তিনি বললেন-
এখন নয়। কাল যাব। নিজের হাতে অনেক নাস্তা বানাব আমি। আমার হাতের নাস্তা খেয়েই যেন পাত্রীর মা বাবা ফিদা হয়ে যায়।
.
মেঘ আবারো তাকে জড়িয়ে ধরে বলল-
আচ্ছা।
-দেখি ছাড় এখন। মিন্নী কে খুশির সংবাদ টা দিই।
.
অন্তরা আহম্মেদ তাড়াহুড়ো করে নিচে নেমে গেলেন। মেঘ নীরবে তার পথের দিকে তাকিয়ে আপনমনে বলল –
যত সহজে মা রাজি হয়েছে তত সহজে হুরায়রা ও তার পরিবার কি রাজি হবে?
.
.
.
ট্রলি ব্যাগটাকে রাস্তার সাথে ঘেষে অদ্ভুত এক শব্দ তুলে এগিয়ে চলছে হুরায়রা। একটু আগেই শেষ ট্রেনটি তাকে নামিয়ে দিয়ে গেল স্টেশনে। রাত একদম কম হয়নি। আশেপাশে কোনো রিকশাও নেই। অবশ্য এখান থেকে মিনিট পনেরো হাঁটলেই পা রাখা যাবে এক বিষণ্ণ শহরে। হুরায়রার মাঝ রাতে হাঁটতে ভালো লাগে৷ মনে কোনো প্রকার ভয় বা সংশয় ছাড়াই হুরায়রা পায়ে হেঁটে এগিয়ে যায় হাতে থাকা ছোট্ট চিরকুটে লেখা নির্দেশনা অনুযায়ী। কিন্তু বিষণ্ণ শহরের বিষণ্ণতা হুরায়রাকে গ্রাস করে নেয় সেখানে প্রবেশের আগেই। হুট করেই শুরু হয় তুমুল বৃষ্টি। হুরায়রার হাতে থাকা চিরকুটে কয়েকটি ভারী বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে ছিড়ে যায়। কি একটা ভুল করে পুরো ঠিকানাটা একসাথে দেখে রাখেনি সে। অবশ্য ইচ্ছাকৃত ভুল। একসাথে পুরো ঠিকানা দেখে পথ চলতে তেমন মজা পাওয়া যায় না৷
হুরায়রা সামনের দিকে পা ফেলে হাঁটতে থাকে। তুমুল বর্ষণ শুরু হয়ে যায় ইতিমধ্যে। ট্রলি ব্যাগের ভিতরে ছাতা থাকলেও হুরায়রার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই মাথার উপরে ছাতা ধরে বৃষ্টির হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর। বরং নিজেকে সে শপে দিয়েছে অবাধ্য বরষার তুমুল বর্ষণে। বেশ অনেকক্ষণ আশপাশ খালি সোজা রাস্তা ধরে হাঁটার পরে খানিক দূরেই কিছু বিল্ডিংয়ের কাঠামো চোখে পড়ে হুরায়রার। বুঝতে পারে বিষণ্ণ শহরের আঙ্গীনায় চলে এসেছে সে।
গুটি গুটি পা ফেলে প্রবেশ করে অদ্ভুত এ শহরে। অনেকটা শুনশান পরিবেশ৷ কোথাও কেউ নেই৷ যেদিকে চোখ যায় বৃষ্টিস্নাত হলুদ নিয়ন লাইটের আলো। একেবারেই গা ছমছমে পরিবেশ।
হুরায়রা নিজের পা ফেলে এগিয়ে যাওয়ার শব্দও স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে।
সে ঠিক করে রাতে এভাবেই পুরো শহরটা একটু ঘুরে দেখবে। যেহেতু তার হাতে ঠিকানা নেই এবং জিজ্ঞেস করার মতো আশেপাশে নেই কোনো লোকজনও, তাই এই সিদ্ধান্ত নেয় হুরায়রা।
খানিকটা হাঁটার পরেই হুট করে বন্ধ হয়ে থাকা এক দোকানের শাটারের পাশে একটা লোক দেখে একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে হুরায়রা। লোকটিকে নিয়ে ভাবতে না ভাবতেই বেশ কয়েকটা তরতাজা স্বাস্থবান কুকুর এসে দাঁড়ায় হুরায়রার সামনে। ভীষণ জোরে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে। হুরায়রার দিকে আক্রমনাত্মক ভাবে এগিয়ে আসতে থাকে। কি করতে হবে বুঝতে না পেরে নিরবে দাঁড়িয়ে রয় হুরায়রা। কুকুরদের প্রতি তার একটা এলার্জী আছে। কুকুরগুলো হালকা দৌঁড়ে এসে ঝাপিয়ে পড়বে হুরায়রার উপর, ঠিক এমন সময়ে আচমকাই সবাক’টা কুকুর থেমে যায়৷ শান্ত হয়ে নিজ থেকেই চলে যায় হেঁটে হেঁটে। ততক্ষনে লোকটি মেয়েটির কাছাকাছি চলে এসেছে। হুরায়রা ভারী একটা কন্ঠের গম্ভীর আওয়াজ শুনতে পায়,
“দুঃখের শহরে হুট করেই এমন একজন পরীর আগমন?
এত রাতে এরকম ভিজে অবস্থায় একা একা হাঁটা ভালো না। ”
কথাটি শুনে একটু চমকালেও পরমুহূর্তে নিজেকে স্বাভাবিক করে
হুরায়রা জিজ্ঞেস করলো, “কে আপনি?”
– আমি এই শহরেরই এক নাগরিক। আমার নাম শহর আহমেদ।।
– বাহ। ভালো নাম। আপনি বৃষ্টিতে ভিজছেন কেনো এত রাতে?
– আমি আপনার মতো এত সুন্দর নই।
আমার জন্য রাত দিন সবকিছুই সমান।
এইযে দেখলেন একটু আগে কিছু কুকুর আপনাকে ঘিরে ধরলো, এরা ভেবেছিলো আপনি আমাদের শহরের জন্য একজন ক্ষতিকর লোক৷ এদের থেকেও নিকৃষ্ট কিছু মানুষরূপী জানোয়ার আছে, যারা ওদের মতো সরে যাবেনা। তাদের হাত থেকে বাঁচার জন্য নিজেকে সাবধানে রাখবেন।
– বুঝলাম।
– আপনার সাথে যেচে কথা বলতে এসেছি। কারণ কিছু প্রশ্ন আছে আমার।
– কি প্রশ্ন?
– হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি?
– বেশ।
.
দুজনে পাশাপাশি হাঁটা শুরু করলো। শহর হালকা কেশে বলল-
শাহীন নামের কাউকে চিনেন?
– শাহীন! না এই নামের কারো সাথে পরিচিত নই।
– হুম। পরিচিত থাকার কথাও না, আপনি তো আমাদের শহরে একেবারেই নতুন।
– কিভাবে বুঝলেন! শহরের সব মেয়েকে চিনেন নাকি?
– নাহ, আমাদের শহরের লোকদের ঘ্রাণটা খুব পরিচিত।। এখানে বাতাসে বিষণ্ণতা ভেসে বেড়ায়। বাইরে থেকে আসা কারো গন্ধ থেকেই বলা যায়, কে নতুন বা কে এখানের বাসিন্দা।
– কিন্তু আপনি আমাকে নিশ্চয়ই গন্ধ শুঁকে শনাক্ত করেন নি। বৃষ্টির পানিতে সব ধুয়ে গেছে।
– আমি শরীরের গন্ধের কথা বলিনি। এখানের মানুষের কথা বলার সিস্টেম, চিন্তা ভাবনার,মনের,আচরণ ব্যবহারের অন্যরকম একটা পরিচিত গন্ধ থাকে, যেটা আপনার মাঝে নেই।
– বাহ, আপনি তো দারুণ খেয়াল রাখেন সবদিকে।
– শাহিনের ব্যপার নিয়ে কথা বলার আছে অনেক। শাহীন নামের একটা ছেলে খুন হয়েছে বুঝলেন! কিছু রহস্যভেদ করতে হবে।
– আমাকে বলছেন কেনো?
– আসলেই তো! আপনাকে কেনো বলছি। বাদ দিন আমার অযথা কথা আর শুনতে হবেনা। নিন আপনার পুনমের বাসার সামনে এসে গেছি। ঐ যে একটা লোহার গেট দেখছেন, ওখানে গিয়ে দুইবার জোরে লাথি দিবেন। পুনম তাহলেই দরজা খুলবে।
– অনেক ধন্যবাদ শহর সাহেব।
– শুকরিয়া।
.
হুরায়রা কয়েকপা এগিয়ে যায় পুনমের বাসার দিকে। আর তখনি তার মনে পড়ে, শহর নামের লোকটার কাছে তো বলেই নি যে সে পুনমের বাসায় আসবে। তাহলে ও জানলো কিভাবে! হুরায়রা পিছনে ফিরে তাকায় শহরের কাছে কথাটি জিজ্ঞেস করার জন্য। কিন্তু অবাক হতে হয় হুরায়রাকে, পিছনে তাকানোর পরে সেখানে কাউকেই দেখতে পায় না সে।
.
চলবে
.
বি:দ্র: আজকের পর্ব হাসিবুল ইসলাম ফাহাদ এর “বিষণ্ণ শহর” গল্পটির সাথে লিংক আপ করা হয়েছে।