শরতের_শিশির (অন্তিম পর্ব ) #মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)

0
608

#শরতের_শিশির (অন্তিম পর্ব )
#মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)

স্বাভাবিকভাবেই চলছে চাঁদনীর দৈনন্দিন রুটিন। নিজেকে স্থির রেখেছে কঠিন আদলে। তবে হামিদার বলা কথা নিয়ে অত্রকে জিজ্ঞেস করেছিল। কিন্তু ফলাফল তেমন কিছুই মেলেনি। তার কথার মধ্যে ছিল বিদ্রুপ আর কটাক্ষ মেশানো। উল্টো হামিদাকে নিয়েই কুটুক্তি ছড়ালো। মেয়েটার স্বভাব চরিত্র ভালো নয়। সে কথা বলতে না চাইলে উল্টো তাকে মেসেজ দিত। বারংবার কল করে জ্বালাতন করত। এসব তো আরও অনেক আগের কথা। মেয়েটার সাথে এখন সে কথা বলে না। অত্রের কথায় সন্তুষ্ট হয়নি সেদিন। হৃদকাননে সন্দেহের বীজ বপন হয়ে গেছে। সত্যি না জেনে যে ক্ষান্ত হবে না। কিন্তু কিভাবে জানবে অত্রের সত্যি।

সময় যেন নিজ গতিতে ছুটছে। হামিদার সাথে কথোপকথনের মাসখানেক পার হল। কিন্তু আজও কোনো সুরাহা করতে পারল না। নিজমনে অজস্র চক কষে কিন্তু দিনশেষে তা ব্যর্থতায় পরিণত হয়। সময়ের পালাবদলে দিন গড়ালো আরও কিছুদিন। যেখানে ছিল এখনো সেই একই জায়গায় স্থির হয়ে আছে সে। এর মাঝে এল অত্রের জন্মদিন। তাকে বিশেষভাবে নিমন্ত্রণ করল। একমন তার খুশি হলেও অন্যমন সন্দিহান এখনো। তবে ঠিক করল সে যাবে। সারারাত ভাবল অত্রকে উপহার হিসেবে কি দেয়া যায়। শেষে অনেক ভেবে অত্রের জন্মদিনের উপহার হিসেবে একটা শার্ট পছন্দ করল। যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। মুখে আলতো প্রসাধনীতে নিজেকে সজ্জিত করল। লং কুর্তির সাথে কালো হিজাবে আবৃত। বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তায় নামল। রিকশায় চড়ে কিছুদূর যেতেই একটা ফোনকল আসল। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখল নাম্বার অপরিচিত। প্রথমে ভাবল কে হতে পারে আবার। ভাবনা চিন্তা শেষে ফোনকল রিসিভ করল। কিন্তু ওপাশ থেকে নরম এক স্বর ভেসে এল। কন্ঠে ছিল ব্যকুলতা। শুধু ছোট্ট করে বলল,

‘প্লিজ বোন আসবেন না। আর যদিও আসেন পর্যাপ্ত নিজের সুরক্ষা নিয়ে আসুন। আপনার ভালোর জন্য বলছি। আমারও তো বোন আছে বাড়িতে। তাই কেন যেন মনে হল, আপনার মত ভালো মেয়ের বড় ক্ষতি না হোক। তাই নিষেধ করছি।’

আগুন্তকের কথা শুনে তার কপালে দরদর করে বিন্দু বিন্দু নোনাজল জমল। গলার স্বরের সাথে সাথে পুরো শরীরে মৃদু কাঁপুনি হচ্ছে। অন্তঃকরণে উষ্ণ মরুঝড়ের বাতাস বইছে তার। দু’টানায় পড়ল। এই আগুন্তকের কথা কি তার আদৌ শুনা উচিৎ। সে’কি ফিরে যাবে তবে। নাকি যাওয়া উচিৎ। রিকসার হুড টানানো। প্যাডেলে পা রেখে এখনও রিকশা টেনে যাচ্ছে রিকসাওয়ালা। আচম্বিত রিকসা থামাতে বলল। রিকশাওয়ালা তার কথা শুনে হতভম্ব। পিছনে তাকিয়ে বলল,
‘আপা যাইবেন না। কোন সমস্যা হইছে নাকি?’

‘বাসায় ফিরে যাব। এখন যাব না।’

রিকসাওয়ালা তার কথা মেনে আবার প্যাডেলে পা রাখল। আগের মতই চলতে শুরু করল তার বলা গন্তব্যের উদ্দেশ্য।

বাসায় এসেও অস্বস্তি হচ্ছিল। খুব জানতে ইচ্ছে করছে তার। কি এমন ভেবে রেখেছে অত্র তাকে নিয়ে স্বচক্ষে দেখা উচিৎ। কিন্তু কিভাবে! অনেক ভেবে চিন্তে নিজের পুরানো এক বোরকা নিল। সাজ বদলালো। বোরকার সাথে আপাদমস্তক ঢাকা এক হিজাব পরিধান করল। বোরকার সাজে দেখতে এক মধ্যবয়সী মহিলার মতই লাগছে। সহজে কেউ চিনতে পারবে আর। সে আবার নিচে নামল। এবার উদ্দেশ্য অত্রের বলা রেষ্টুরেন্টে যাওয়া।

এর মাঝে অত্রের বার কয়েক কল আসল। সে তার আগের সাজসজ্জার বর্ণনা দিল। সে কুর্তি পরেছে। আজ বোরকা পরেনি। অত্র শুনে খুশিতে গদগদ। চাঁদনীকে অসংখ্যবার ধন্যবাদ জানাল।
__
সময় যেন ফুরাল না। অত্র চাঁদনীর জন্য অপেক্ষারত। সেই একঘন্টা থেকে অপেক্ষার প্রহর শেষই হচ্ছে না। তার সাথের বন্ধুরা বিরক্ত হল। বার বার জিজ্ঞেস করল,
‘কিরে তোর ভদ্র প্রেমিকা কোথায়? এখনো আসল না কেন?’

অত্র নিজেও বিরক্তিতে মুখ কুঁচকাল। নিজের মুঠোফোনে সময় দেখল বার কয়েক। রাগের ছোটো ফোঁস ফোঁস করছে। শেষে না পেরে বলল,

‘মেয়েটা আসলেই বিরক্তিকর। এর সাথে প্রেম করতে মজাই পাইনা। মনে হয় নিজের বোনের সাথে কথা বলছি। এখন যৌবনের সময়। নিজের রূপ যৌবন নিয়ে কোথায় একটু নিজেদের মাতিয়ে রাখব, একটু কামসুখের কথা বলব। তা না, এই মেয়ে আছে রাতদিন পড়া নিয়ে। তাহলে কি লাভ প্রেম করে। আজ যদি একবার হাতের মুঠে পাই, তবে সব শোধ একসাথে নিব। আজ তার ওষ্ঠদ্বয়ে নিজের সব ঝাল মেটাবো।’

পাশে বসা অত্রের বন্ধু তাচ্ছিল্যের স্বরে হাসল। টিপ্পনী মেরে বলল,
‘আদৌ তুই পারবি। মেয়েটার সামনে তুই ভীতু হয়ে যাস। তোদের রিলেশনের এত মাসেও আজ পর্যন্ত একটা কি, নিতে পারিসনি। আর বলছিস ঝাল মিটাবি। বিশ্বাস করি না।’

অত্রের মুখের কোণে কুটিল হাসি। নিজের এক ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
‘দেখিস, আজ কি করি। যদি এই বাজিতে জিতি কি দিবি আমাকে। ট্যুর দিবি আর সব খরচ তোর। কি রাজি তো?’

টেবিলের এককোণে বসা চাঁদনী যেন বাকরুদ্ধ। কান্না’রা ধলা পাকিয়ে আছে। ভাবতেই ঘেন্না হচ্ছে তার। এই ছিল অত্রের মনে। ছিঃ! দ্রুতই জায়গা প্রস্থান করল। পিছনে একবারের জন্যও তাকালো না।

বাসায় এসে চাঁদনী ঐ আগুন্তককে কল দিল। কল রিসিভ হতেই তাকে চেপে ধরল। আমাকে সত্যি করে বলবেন, অত্র আদৌ কি আমাকে ভালোবাসে। দেখুন, সত্যিটা বলবেন কিন্তু। আগুন্তক একটা শর্ত দিলেন। সত্যি বলব তবে আপনি তা অত্রকে বলতে পারবেন না। কারণ অত্রের সব গোপন কথা আমি জানি শুধু। চাঁদনী রাজি হল। কিন্তু ওপাশের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল। এত বড় ধোকা তার সাথে। এখন তো নিজের উপরই ঘৃণা হচ্ছে। ছিঃ!

অত্রকে সেদিন কল দিল। নিজের দু’চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে অত্র। তোমার আমার মিল বোধহয় আর হবে না।’

অত্র নিস্তব্ধ নিথর। নিজেও বেশ কষ্ট পেল। মনের দুঃখে রাস্তার এককোণে বসল। সে চাঁদনীকে হারিয়ে ফেলবে। বক্ষস্থল ভীষণ কাঁপছে। দরদর করে ঘামছে তার কপাল। মূহুর্তে মুখশ্রী ফ্যাকাসে হয়ে গেল। এর মাঝে আচানক অপরিচিত এক কল আসল। সে না ভেবেই রিসিভ করল। ওপাশ থেকে অতি মোলায়েম নারী কন্ঠের আওয়াজ এল। সে অত কিছু না ভেবেই কথা বলতে লাগল। নিজের কষ্টগুলো শেয়ার করল। সে আসলে মেয়েদের সাথে টাইমপাস করে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে নিজের মামাতো বোনকে অনেক আগে থেকেই পছন্দ করে। তবে তার সহপাঠী এক মেয়েকে সে একটু হলেও ভালবাসত। কিন্তু আজ তাও শেষ হয়ে গেল। তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। তার জীবন থেকে সেই মেয়েটাও হারিয়ে গেল।

চাঁদনী তাচ্ছিল্যের এক হাসি হাসল। মিহিকে ধন্যবাদ দিয়ে সে এবার অত্রকে কল দিল। অত্র দ্রুতই কল রিসিভ করল।
‘মুনলাইট, তুমি আমার হয়েও হলে না। খুব কষ্ট হচ্ছে তোমার জন্য। এভাবে আমাকে কাঁদিয়ে চলে যাবে।’

চাঁদনী বেশ শব্দ করে হাসল। হাসির শব্দে অত্র বিস্মিত। মেয়েটা হাসছে। ভারী অদ্ভুত তো! সে জিজ্ঞেস করল, ‘কেন হাসছ? তোমার কষ্ট হচ্ছে না আমার জন্য। তুমি আমাকে ভালোবাসনি কখনও। তাই তো আনন্দে আপ্লূত।’

চাঁদনী মুখে শব্দ করল না। শুধু মিহির সাথে বলা কথার রেকর্ডটা অন করল। অত্র শুনে স্তব্ধ। সে’তো একটা ভিন্ন মেয়ের সাথে শেয়ার করেছিল। তার মানে সেটা! অত্রকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে এবার সেই বলে উঠল,
‘তোমার শুধু মেয়েদের শরীর প্রয়োজন, তাই না অত্র। মেয়েরা তোমার টাইমপাসের বস্তু।’

অত্র আমতা আমতা করল,
‘আসলে, আমি তোমাকেও ভালোবাসি। হ্যাঁ, মামাতো বোনকে বেশি ভালোবাসি। কিন্তু তার পরে কিন্তু তোমার স্থান। বিশ্বাস কর।’

চাঁদনীর হাসির মাত্রা আরও দ্বিগুণ হল। গলার স্বর গম্ভীর করে বলল,
‘মামাতো বোনকে ভালোবাস তাহলে অন্য মেয়েদের সাথে কেন টাইমপাস করা লাগবে। সবকিছু মামাতো বোনের সাথেই কর। নিজের রূপ যৌবন এক জায়গায় খরচ কর। তাহলেই তো হয়।’

অত্র যেন নির্বাক। কি বলবে কথা খুঁজে পেল না। এভাবে ধরা পড়বে ভাবেনি। কিন্তু চাঁদনী আজ থেকে মুক্তি পেল এক প্রতারক থেকে। চোখের কোণে জল নেই। মুখে তার তাচ্ছিল্যের হাসি। আর যাই হোক তার কান্নার যোগ্য নয় অত্র। তাই কান্না বিলাশ করবে। একদমই নয়। এতটাও নির্বোধ নই চাঁদনী। এরকম শরতের শিশিরের জন্য কাঁদা নিতান্তই বোকামি।

_____সমাপ্তি____

চাইলে অত্রকে ভালো দেখাতে পারতাম। কিন্তু বাস্তবতা বুঝানোর জন্যই আমার এই ছোটগল্প। আমাদের কল্পনার জগৎ অনেক সুন্দর। কিন্তু বিশ্বাস করুন কল্পনার জগতের মত কিন্তু আমাদের বাস্তবতা অত সুন্দর নয়। এই গল্পের ৮০ ভাগই সত্যি ঘটনার আলোকে। বর্তমানে ১৪ থেকে ১৮ এই বয়সের মেয়েরাই সবচেয়ে আবেগী হয়। তাই তাদের বুঝানোর জন্যই আমার এই সর্তকবার্তা। সাবধান থাকবেন। অত্রের মত ছেলেরা আপনার আশেপাশে অনেক আছে। শুধু চোখ-কান খোলা রাখবেন। তাহলেই এদের চিনতে পারবেন। নিজেকে হেফাজত রাখুন। ধন্যবাদ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here