শরতের_শিশির (৫) #মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)

0
210

#শরতের_শিশির (৫)
#মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)

‘মেয়েদের বিশ্রামাগার’ বড় বড় অক্ষরে লিখা বোর্ডের নিচে বসে আছে চাঁদনী। আর দুই/এক দিন ক্লাস শেষে কলেজ বন্ধ হয়ে যাবে। দেয়ালের পাশ ঘেঁষে একটা টেবিল পড়ে আছে। আচমকাই চোখ পড়ল ৩য় বর্ষের ফলাফলের লাল রঙা রেজিস্টার খাতার উপর। প্রথমে হতবাক। ধূলিমাখা টেবিলে অবহেলায় পড়ে আছে দেখে। পরক্ষণেই কিছু একটা মনে পড়ল। তড়িৎ ছুটল সেখানে। অত্রের ক্লাস রোল এতদিন জানা ছিল না। একদিন বুদ্ধি খাটিয়ে জেনে নিয়েছে। লাল রঙা রেজিস্টার খাতা উল্টালো। খুব বেশি বেগ পেতে হল না। খুঁজে পেয়ে ১৬১তম রোল নাম্বারে চোখ বুলালো। অত্রের পরীক্ষার ফলাফল দেখে তার জ্ঞানশূন্য হওয়ার উপক্রম। নিজমনে বলে উঠল,

‘ইয়াক’ এই ছেলে পড়াশোনায় এত বাজে কেনো? আট বিষয়ে তার ফলাফল যথাক্রমে ১৫, ২৭, ২৫, ১৭, ৫, ২১, ৩৪, ১১। ইয়া আল্লাহ’ একটা বিষয়ও পাশ আসেনি। এই ছেলে পড়াশোনায় এত অমনোযোগী। উফফ! হঠাৎই মস্তিষ্কের নিউরনে এক তীক্ষ্ণবুদ্ধির উদয় হল। কিঞ্চিৎ কুঠিল হাসল। এবার জমবে মজা।

অত্র থেকে নেওয়া সময়ের সময় শেষ হতে চলেছে। আজ রাতেই শেষ সিদ্ধান্ত জানাতে হবে। নয়ত এই ছেলে আবার কোন তামাশা করে বসে কে জানে?

আজ অত্র কলেজ এসেছে। বার বার চাঁদনীর দিকে দৃষ্টি বুলাচ্ছে। সে ক্লাসে এসে চুপচাপ একপাশে বসে আছে। অত্র তার কাছে এসে দাঁড়াল। মুখের কোণে মিষ্টি হাসি। নিজের এক ভ্রু উঁচিয়ে ধরল।
‘মনে আছে তো মুনলাইট। আজকে কিন্তু শেষদিন।’
চাঁদনী নিজের দৃষ্টি নত করল। ছোট্ট করে জবাব দিল, ‘হুমম।’
‘ক্লাস শেষে আমার সাথে দেখা করবে কিন্তু।’

চাঁদনী নিরুত্তর। নিজের নত মস্তক উপরে তুলল শুধু। দৃষ্টিতে কি আছে অত্রের জানা নেই। তবে মন তার প্রফুল্ল। চাঁদনীর আপাদমস্তক আরও একবার পরখ করল। শেষ হাসি’টা সেই হাসবে। নিজের অটুট আত্মবিশ্বাস নিয়েই প্রস্থান করল।
_
বাসায় ফিরতেই অত্রের একগাদা ফোনকল আসা শুরু হল। চাঁদনী নিজের মস্তিষ্ককে কাজে লাগাল। নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে লম্বা করে শ্বাস নিয়ে কল রিসিভ করল।
‘হুমম, বল।’
অত্র কিঞ্চিৎ অবাক হল।
‘উত্তর তোমার দেয়ার কথা মুনলাইট। আমার নই।’
চাঁদনী নিজের হাসি চেপে রাখল। গলার স্বর গম্ভীর করল,
‘হুমম, জানি। তবে আমার একটা শর্ত আছে।’
অত্র আবারও অবাক হল।
‘কিসের শর্ত?’
‘যদি তুমি ঠিকভাবে পড়াশোনা কর। তবেই হ্যাঁ বলব।’
রুদ্ধশ্বাস অত্র যেনো হুঁশজ্ঞানহীন। উত্তরটা ঠিক কি হওয়া উচিৎ ক্ষানিক ভাবল।
‘পড়াশোনার সাথে রিলেশনের কি সম্পর্ক।’
চাঁদনীর চোয়াল শক্ত হল। গলার স্বর আরও দৃঢ় করল,
‘তোমার টেস্ট পরীক্ষার ফলাফল কেমন ছিল অত্র? আমি বলব নাকি তুমি বলবে।’
অত্র যেনো অথৈজলে ভাসমান জলকণা। মিনমিনে বলল,
‘তুমি আমার রেজাল্ট দেখেছো। আমার পড়তে ভালো লাগে না। একদমই ইচ্ছে করে না। কিন্তু, তুমি পাশে থাকলে সত্যি বলছি পড়ব। প্লিজ আমাকে ছেড়ে যেও না। তুমি যা বলবে তাই করব। তবু তুমি আমার থাকো। থাকবে তো আমার পাশে মুনলাইট।’

চাঁদনী যারপরনাই অবাক। বাপরে! এত সহজে রাজি হবে তার ধারণার বাইরে ছিল। অধরকোণে তার মুচকি হাসি। কিন্তু নিজের হাসি চেপে জবাব দিল,
‘রাতে উত্তর দিব। এখন ঘুমাব, রাখছি।’
অত্রের জবাবের অপেক্ষা করল না। নিজেই কল কেটে দিল। চুপচাপ শুয়ে পড়ল বিছানায়।

সন্ধ্যা গড়ালো ধরণীতলে। আঁধার নামতেই চাঁদনীর মুঠোফোন কর্কশ ধ্বনি তুলল। বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকালো। এত তাড়া কেনো এই ছেলের। কল কেটে মেসেজ পাঠাল। একটু ধৈর্য্য ধর। উত্তর দিচ্ছি। তার ক্ষানিক বাদেই বিশাল লম্বা এক মেসেজ দিল। হ্যাঁ আর না এর সংমিশ্রণে। অত্র মেসেজ দেখে হতবিহ্বল।

‘হ্যাঁ, না, হ্যাঁ, না, হ্যাঁ, না’

এরকম হ্যাঁ, না লিখে কে মেসেজ দেয়। আসল উত্তর তাহলে কি দিয়েছে। সে পুনরায় কল দিল চাঁদনীকে। কিন্তু কল রিসিভ হল না। চাঁদনী পুনরায় মেসেজ দিল।
‘নিজের বুদ্ধিকে কাজে লাগাও অত্র’।

অত্র দীর্ঘ সময় ভাবল। মেসেজটা বার’কয়েক পড়ল। কিন্তু কূল-কিনারা না পেয়ে চাঁদনীর ধাতস্থ হল। চাঁদনী ছোট্ট করে মেসেজ দিল। আরেকবার মেসেজটা পড়। উত্তর পেয়ে যাবে। অত্র সূক্ষ্ম নজর বুলালো। কিছু সময় পর তার মুখের কোণে হাসি ফুটল। মেয়েটা আসলেই বেশ বুদ্ধিমতি। কতটা সূক্ষ্মভাবে হ্যাঁ এর জায়গায় দু’টো কমা ব্যবহার করেছে। এতক্ষণ পর তার বোধগম্য হল। উচ্ছ্বসিত হয়ে কল দিল। চাঁদনী কল পেয়ে লাজুক হাসল। বেশ ক্ষানিকটা সময় নিয়ে কল রিসিভ করল। কিন্তু কথা বলল না। নিশ্চুপ হয়ে আছে। অত্র গলা খাঁকারি দিল।
‘কি ব্যাপার! কথা বল না মুনলাইট।’
লজ্জায় আড়ষ্ট চাঁদনী। মুখে তার ছোট্ট শব্দ উচ্চারিত হল, ‘হুমম।’
অত্র যেন কথার ঝুলি নিয়ে বসেছে,
‘অস্থিরতায় আমি হাসফাস করেছি। কত বিনিদ্র রজনী কেটেছে আমার! তোমার কথা ভেবে আমার দু’চোখের নিচে কালসিটে দাগ পড়ে গেছে। কত নিষ্টুর তুমি! কেন এত কষ্ট দিলে মুনলাইট।’

চাঁদনী নিজের হাসি সংবরণ করল। অত্রকে কড়া গলায় বলল,
‘কিন্তু, এখন থেকে যা বলব তা শুনতে হবে। তুমি কিন্তু ওয়াদা করেছে আমার সাথে।’
অত্রের মুখে দুষ্ট হাসি।
‘বলেই দেখুন না ম্যাডাম, আপনার জন্য আমার জান কোরবান দিতেও রাজি আছি।’
‘থাক, জান দিতে হবে না। শুধু পড়াশোনা করলেই হবে।’

অত্র হতাশার সুর তুলল।
‘সত্যিই, পড়তে হবে। কিন্তু কি পড়ব? আমার মন তো আজকাল তোমার কাছেই থাকে। প্রেম প্রেম পায় শুধু। পড়াশোনা কি আমাকে দিয়ে হবে!’
চাঁদনীর মুখে লাজুক হাসি। কিন্তু নিজের লাজুকলতা সংবরণ করে গলায় স্বর দৃঢ় করল। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে দু’জনের প্রেমালাপ চলল বেশরাত পর্যন্ত।

পরেরদিন অত্রের জন্য তার বানানো সাজেশন নিয়ে গেল। অত্র শুধু হা’ হয়ে দেখছিল। এই মেয়ে প্রেম কম পড়াশোনা নিয়ে কথা বলে সারাক্ষণ। এর থেকে তো তার বাবা-মা’ অনেক ভালো। টিচাররাও এত কঠিন কঠিন আদেশ দেয় না। যত আদেশ এই মেয়ে দেয়। মাত্র দু’দিনে হাঁফিয়ে গেছে সে। কোথায় হাতে হাত রেখে প্রেম নিবেদন করবে। প্রেমের বুলি আওড়াবে তা নয়। প্রেমিকার আদেশে পড়ার টেবিলে বসতে হচ্ছে। সারাদিনে মাত্র দশমিনিট কথা বলা যাবে। আরও কত নানা শর্ত দিয়ে রেখেছে। তার তো ছেড়ে দেয় মা’ কেঁদে বাঁচি অবস্থা। এ কেমন প্রেমিকা তার!

ক্লাস করে কোনোভাবে বাসায় ফিরল। মনটা আকুপাকু করছে অন্যকিছু পেতে। ভেবেছিল কি, আর হল’টা কি! নিজের হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে যখন দেয়াল ঘেঁষে বসল। তার বন্ধুরা তার মজা উড়াল। এত কিছুর মাঝে তার মনটা শীতল করল খেলার মাঠে গিয়ে। পরীক্ষা মাথার উপর চেপে বসে আছে তার হুঁশ নেই। সে নির্বিঘ্নে মাঠে খেলছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলে বাসায় আসল। পড়ার টেবিলে বসতেই কল দিল চাঁদনীকে। বার’কয়েক কল দিলেও রিসিভ হল না। মনঃক্ষুণ্ন হল তার। কিছুসময় চুপ থাকল। ফের আবার কল দিল। এবার কল রিসিভ হল। অত্র ফিসফিস করে বলল,
‘কি ব্যাপার কল রিসিভ করছো না কেন জান?’

চাঁদনী হতবাক হল অত্রের ফিসফিস করা কথা শুনে। তার বোন পাশের রুমেই আছে। তাই খুব জোরে সেও কথা বলতে পারবে না। অত্রের মতই ফিসফিস করল,
‘পড়ছিলাম, এখন কি কথা বলার সময়। তুমি পড়ছো না।’
‘হুমম, মাত্র বসলাম।’
চাঁদনীর মুখশ্রী মূহুর্তে শক্ত হল।
‘এত দেরিতে পড়তে বসেছো? সন্ধ্যা হয়েছে একঘন্টা পেরিয়েছে কিন্তু।’

অত্র ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে ফেলছে। আগের ন্যায় ফিসফিস করল,
‘সর‍্যিই, ভুলে গেছিলাম। কাল থেকে সময়মত পড়ব।’
চাঁদনী কঠিন গলায় হুমকি দিল।
‘এখন কল কেটে পড়। আমিও পড়ছি। ঠিক আছে।’
অত্র যেনো সুযোগ পেল। নতুন এক আবদার নিয়ে বসল,
‘তাহলে একটা কি, দাও। আমি কল কেটে দিব।’

চাঁদনীর রাগে আকাশ ছুঁল। নিয়ন্ত্রণহীন রাগে থরথর করে কাঁপছিল। তিরিক্ষি গলায় বলল,
‘বেয়া, কোথাকার। কল কাটো।’
অত্র যেনো হুঁশে এল। কিঞ্চিৎ হাসি রেখে বলল,
‘আরে আমি তো মজা করছিলাম।’
চাঁদনী যেনো বাঁধন হারা। নিজের রাগ বেড়েই চলল। অত্রকে ধমক দিল,
‘আমাকে আর কল দিবে না।’

অত্রকে কিছু বলতে না দিয়ে নিজেই কল কাটল। পুরো দু’দিন আর কল রিসিভ করল না। শেষে অনেকবার ক্ষমা চাইল অত্র। সে আর দ্বিতীয়বার এমন কথা বলবে না। দু’জনের মাঝে সবকিছু আগের মতই ঠিক হল। পরীক্ষা শুরু হল। সরাসরি দু’জনের দেখা হলেও খুব কমই কথা হয়। চাঁদনী নিজেই বলেছে সবার সামনে কথা না বলতে। সময়ের পরতে পরতে তাদের প্রেমময় দিনগুলো মাসে গড়ালো। পরীক্ষা শেষ হল অনেক দিন হল। কলেজ বন্ধ থাকায় তাদের মাঝে দেখা সাক্ষাত হল না বেশকিছু দিন। একদিন আচমকাই অত্র একটা প্রস্তাব রাখল। তারা দেখা করবে। চাঁদনী প্রথমে রাজি হল না। শেষে হ্যাঁ বলল। দেখা করবে আশেপাশে কোনো এক পার্কে। বিকেল চারটায় দেখার কথা বলা হল। কিন্তু অত্রের মুঠোফোনে ব্যালেন্স না থাকায় সে তার বন্ধুর মুঠোফোন থেকে কল দিল। সময় অনুযায়ী দু’জনের দেখা হল। অত্র চাঁদনীকে দেখে অবাক হল। ভেবেছিল একটু খোলামেলা আসবে। কিন্তু মেয়েটা দেখা করতে এসে বোরকা পরে এসেছে। এটা কেমন দেখাসাক্ষাৎ। কত কমনভাবে এসেছে। কোন সাজসজ্জা, নতুন কোন পোশাক কিছুই নেই। তার মন’টা খারাপ হয়ে গেল। তাও কোনোভাবে দেখা করে বাসায় ফিরল।

চলবে,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here